ফেনী সদর উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও ফেনী পৌরসভা নিয়ে ফেনী-২ সদর আসন। এ আসনে যিনি নির্বাচিত হন তিনিই হন পুরো জেলার কাণ্ডারী।
বিগত প্রায় এক দশক আগেও এ জনপদটি পরিচিত ছিল বাংলাদেশের ‘লেবানন’ হিসেবে। খুন, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ছিল এখানকার প্রাত্যহিক ঘটনা। এখন সে দৃশ্যপট পাল্টেছে। এখন আর আগের মতো ঘুম থেকে উঠলেই বোমার শব্দ শুনতে হয় না শহরের রামপুর আর মাস্টার পাড়ার বাসিন্দাদের।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, এ পরিবেশ তৈরির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) নিজাম উদ্দিন হাজারী।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় এমপি নির্বাচিত হন। ওই সময় জেলার তিনটি আসনই বিএনপির হাতছাড়া হয়। আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে জনপদের উন্নয়ন ও সন্ত্রাস দূরীকরণে সাফল্যের কারণে এ আসনে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী আওয়ামী লীগ।
অপরদিকে, নিজেদের পুরনো অবস্থান ফিরে পেতে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে চাইলেও তাদের মাঠে দেখাই মিলছে না। তবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দৌড়ে নিজাম হাজারীর নাম যেভাবে প্রথমে আসছে ঠিক সেভাবে বিএনপিতে আসছে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন ভিপির নাম।
সাধারণ ভোটাররা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে আগে যেখানে লড়াই হতো দুই জয়নালে (ভিপি জয়নাল-জয়নাল হাজারী) এখন সেখানে লড়াই হবে নিজাম-জয়নালে।
খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ভিপি জয়নাল ১৯৯৬ সালে জাসদ থেকে ফেনী জেলা বিএনপিতে যোগ দেন। এর আগে ১৯৮৮ সালে জাসদ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন।
২০০১ সালের নির্বাচনে সদর আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়নাল হাজারীকে পরাজিত করে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন তিনি। জয়ের ধারা অব্যাহত রাখেন ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনেও।
এ সময় আওয়ামী লীগ প্রার্থী, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন তিনি।
ভিপি জয়নাল মনে করছেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এবারও তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হবেন। অপরদিকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি রফিকুল আলম মজনুকে এলাকায় মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে দেখা যাচ্ছে। তিনি এ আসনে নির্বাচন করতে আগ্রহী বলে জানান।
এদিকে নিজাম হাজারীও নৌকার জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। শনিবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে শহরের ট্রাংক রোড়ের জনসভায় তিনি ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকেই মনোনয়ন দেন তার জন্যই তিনি কাজ করবেন।
শুধু ফেনী-২ আসন নয় জেলার তিনটি আসনই নেত্রীতে উপহার দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন তিনি। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে নিজাম হাজারীর ভরসার জায়গা হলো আলাউদ্দীন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের সমর্থন। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সুসম্পর্ক রয়েছে।
অপরদিকে, বিভিন্ন গ্রুপ-উপ গ্রুপে বিভক্ত মামলা হামলায় জর্জরিত বিএনপি। মামলা ও গ্রুপিংয়ের কারণে দলটির নেতা-কর্মীরা নির্বাচনী প্রস্তুতি তো দূরের কথা মাঠেই দাঁড়াতে পারছেন না। তবে সবাই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে দলের প্রধান খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।
আগামী নির্বাচনে দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার নেতৃত্বে নির্বাচন করার কথাও জানিয়েছেন নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলছেন, মামলা হামলা আর কোন্দলে জর্জরিত বিএনপি মাঠে দাঁড়াতে পারবে না। জেলাজুড়ে যে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে, তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নিজাম হাজারীকেই প্রার্থী হিসেবে চাইছেন দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী। যেকোনো সময়ের চেয়ে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো অনেক শক্তিশালী বলে মনে করেন তারা।
আর সে কারণেই শনিবার (২২ সেপ্টেম্বর) জনসভায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ফেনী এখন বিএনপি নয় আওয়ামী লীগের ঘাঁটি।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য উপদেষ্টা ও সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর নামও উঠে আসছে বারবার। এ আসনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পান তিনি।
কিন্তু ভোটে বিএনপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। এবারও দলীয় মনোনয়ন লাভের জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানান একাদিক নেতা।
কারণ হিসেবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলার একাধিক নেতা জানান, তিনি সময় পেলেই ছুটে আসেন সদর উপজেলার নিজ বাড়ি শর্শদি ইউনিয়নের ফতেহপুরে। অংশ নেন বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও।
এদিকে তার প্রতি সমর্থন রয়েছে সাবেক এমপি জয়নাল হাজারীর- এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। যদিও মনোনয়ন পেতে চাইছেন তিনি নিজেও। জানতে চাইলে ইকবাল সোবহান চৌধুরীর একটি ঘনিষ্ট সূত্র জানান, প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দিলে তিনি ফেনী সদর আসনে আবারও প্রার্থী হবেন।
অপরদিকে এ আসন নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণভাবে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকলেও প্রকাশ্যে তা দেখা যাচ্ছে না।
এক সময়কার ত্রাস জয়নাল হাজারীও এ আসনে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। আওয়ামী লীগের সাবেক জেলা সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন হাজারী ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচনে তৎকালীন জাতীয় পার্টির প্রার্থী ভিপি জয়নালকে পরাজিত করেন। ১৯৯১ সালে বিএনপির জেলা সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন ফেরদৌসকে এবং ১৯৯৬ সালে বিএনপির ফেরদৌস আহাম্মদ কোরাইশীকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন।
এদিকে জয়নাল হাজারী এক ফেসবুক লাইভে জানান, তিনি নিজ থেকে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন না। তবে শেখ হাসিনা যদি তাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য অনুমতি দেন, তাহলে তিনি সাদরে তা গ্রহণ করবেন।
আলোচনায় আছে অ্যাডভোকেট কাজি ওয়ালী উদ্দিনের (কাজী ফয়সল) নামও। আলোচিত মুখ কাজী ফয়সল তৃণমূলের ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে এসে ক্রমশ কেন্দ্রীয় যুবলীগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, বর্তমানে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ-কমিটিতে রয়েছেন তিনি।
বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি রেহানা আক্তার রানু ও ফেনী জেলা যুবদলের সভাপতি গাজী মানিক ফেনী-২ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশায় দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আর জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জাতীয় যুব সংহতির কেন্দ্রীয় ভাইস-চেয়ারম্যান এম এম ইকবাল আলমগীর, ফেনী জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব খোন্দকার নজরুল ইসলাম ও দলীয় মনোনয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
সব হিসেব-নিকেশ আর সমীকরণে এখন পর্যন্ত এ আসনে নির্বাচনী প্রস্তুতিতে এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগ। মাঠে উপস্থিতি নেই বিএনপির, আড়ালে কাজ করছে জামায়াত। কোনো কোনো জায়গায় বেশ সক্রিয় রয়েছে জাতীয় পার্টি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৮
এসএইচডি/এমএ