ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভোটের-কথা

জোট থাকলে নৌকার প্রার্থী বাদশা, বিএনপিতে এগিয়ে মিনু

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৮
জোট থাকলে নৌকার প্রার্থী বাদশা, বিএনপিতে এগিয়ে মিনু রাজশাহী-২ আসন

রাজশাহী: রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) এলাকা নিয়ে রাজশাহী-২ আসন। রাজশাহী সদর আসন হিসেবে পরিচিত এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।  আওয়ামী লীগের টিকিটে পরপর দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। 

শরিক দলের হলেও এরই মধ্যে এলাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছেন তিনি। তাই জোটগত নির্বাচন হলে মনোনয়ন-দৌড়ে তাকেই এগিয়ে রাখছেন সবাই।

অন্যদিকে সদ্য সমাপ্ত সিটি নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী বিএনপির মহানগর সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে নিয়ে বেকায়দায় রয়েছেন মনোনয়ন-দৌড়ে এগিয়ে থাকা দলটির হেভিওয়েট নেতা মিজানুর রহমান মিনু।  

পরপর তিনবারের মেয়র ও দু’বার রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য মিনু। বলা হচ্ছিল, বিএনপি নির্বাচনে গেলে তিনি এই আসনের নিশ্চিত প্রার্থী। তবে সিটি নির্বাচনে পরাজয়ের পর এখান থেকে প্রার্থী হতে চাইছেন বুলবুল।  

এছাড়া বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রাত্যাশী রয়েছেন আরও কয়েকজন। এর উপরে রয়েছে ২০ দলীয় জোটের চাপ। ফলে সদর আসনটি নিয়ে এখন গাত্রদাহ শুরু হয়েছে বিএনপি শিবিরে।  

গত সিটি নির্বাচনের পর মূলত সদর আসনের ভোটের চিত্রই পাল্টে গেছে। বিপুল ভোটে মেয়র পদে জয়ী হওয়ার পর এই আসনে নৌকার পালে যেন নতুন করে হাওয়া লেগেছে। পাল্টে গেছে ভোটের হিসাব-নিকাশও। আসনটি এবারও ধরে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিকরা।  

এক্ষেত্রে দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তিই বড় ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে দেখছেন প্রার্থীরা। সিটি নির্বাচনে ভরাডুবির পর অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে পড়েছে বিএনপির ধানের শীষ। এক সময়ের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর ছয়টি আসনেই দলটির সাংগঠনিক অবস্থা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি নড়বড়ে। এরপরও হারানো আসনগুলো পুনরুদ্ধার করতে চায় দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি।

মনোনয়ন নামক সোনার হরিণ ধরতে কেউ-ই কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীদের পরিবর্তে তাই মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজ দলেরই সম্ভাব্য প্রার্থী ও এমপিদের বিরুদ্ধে সমালোচনায় মুখর।  

২০০৮ সালে জোটগতভাবে নির্বাচন হওয়ার পর ওয়ার্কার্স পার্টির মাধ্যমে আসনটি পুনরুদ্ধার করে আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচনে এখানে পরাজিত হন নৌকার প্রার্থী।  

মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রবাসী মন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর এএইচএম কামারুজ্জামান সেই নির্বাচনে জাসদের অখ্যাত প্রার্থী মঈনুদ্দিন আহমেদ মানিকের কাছে হেরে যান। স্বাধীন বাংলাদেশে এ আসনে জাসদের প্রার্থী এমপি হন। কিন্তু এরপর আর কখনও জাসদের উত্থান ঘটেনি এখানে।
  
প্রথম সংসদে জাসদের পর দ্বিতীয় সংসদে এই আসনে এমপি হন বিএনপির এমরান আলী সরকার। জাতীয় পার্টির (জাপা) আমলে তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদে এমপি হন জাপার মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ বাবলু। পঞ্চম ও সপ্তম সংসদে বিএনপির অ্যাডভোকেট কবির হোসেন এমপি হন। দেশের সব রাজনৈতিক দল ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন বয়কট করায় আসনটিতে তখন নির্বাচন হয়নি।  

আর অষ্টম সংসদে এই এলাকার জনপ্রতিনিধি হন মিনু। তবে নবম সংসদ থেকে সদর আসনটি হাতছাড়া হয়ে যায় বিএনপির। মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে তখন এমপি হন ফজলে হোসেন বাদশা। ১০ম সংসদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় তিনি বিনা ভোটে আবারো এমপি হন। এবারের নির্বাচনেও ১৪ দলীয় মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে লড়বেন ফজলে হোসেন বাদশা।  

তার মনোনয়নের বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত বলেই জানিয়েছেন দলীয় নেতারা। তাদের ভাষ্য, গত ১০ বছরে বাদশা এলাকার অনেক উন্নয়ন করেছেন। মহানগরের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে তার উন্নয়নের ছোঁয়া। এখনও পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ নেই তার বিরুদ্ধে। তার উদ্যোগে চার দলীয় জোট সরকারের আমলে বন্ধ থাকা রাজশাহী রেশম কারখানার চাকা সম্প্রতি আবার খুলেছে।  

চালু হয়েছে শাহ মখদুম (রহ.) বিমানবন্দর। এগিয়ে চলেছে রাজশাহীতে আইটি ভিলেজের কাজ। এরপরও জোটগত নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়েই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হবে বাদশাকে।  

তবে সদরের মতো গুরুত্বপূর্ণ এই আসনটি শরিক দলকে ছেড়ে দিতে চান না এখানকার অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সমর্থক। ফলে এ নিয়ে ঠাণ্ডা লড়াইও চলছে জোটে।

সদর আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার সবচেয়ে বড় দাবিদার দলটির মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার। কিন্তু হাইকমান্ড থেকে এই আসনটি জোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টিকে ছেড়ে দেওয়ার সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে।  

এরপরও মহাজোটের প্রার্থী বাদশার পক্ষে একাট্টা হয়ে মাঠে নামার বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে এখনও সংশয় কাটেনি। দলটির একটি পক্ষ নানা কারণে তার প্রতি নাখোশ। তাদের অভিযোগ, ফজলে হোসেন বাদশা আওয়ামী লীগের লোকজনকে মূল্যায়ন করেননি। তাই এবারের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন চান তারা।  

এক্ষেত্রে ডাবলু সরকার দীর্ঘদিন থেকে মহানগরীর বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে রেখেছেন। বাংলানিউজকে ডাবলু সরকার বলেন, আওয়ামী লীগের ভোট এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এ ভোট কাজে লাগাতে সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থি হতে চাইবো। বর্তমান এমপি রাজশাহীর উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনো নেতা সদর আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে।  

মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান বাবু ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আহসানুল হক পিন্টুও।

এদিকে টানা দুইবার এমপি থাকায় আওয়ামী লীগেও বেশ ভালো প্রভাব রয়েছে ফজলে হোসেন বাদশা। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজশাহীতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। পিছিয়ে আছে শিল্পক্ষেত্রে। এখানকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান দরকার। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য রাজশাহীতে পোশাক কারখানাসহ শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।  

‘এসব বিষয় রাজশাহীবাসীর কাছে উত্থাপন করা হয়েছে। সবাই এ উদ্যোগকে সাধুবাদও জানিয়েছেন। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সাধারণ ভোটাররা আমাকে নির্বাচিত করবেন। ’

এদিকে সদর আসনে বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন মিজানুর রহমান মিনু। তবে এবার তার রাজনৈতিক গুরু কবির হোসেনকে নিয়ে কিছুটা টেনশনে রয়েছেন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মিনু।  

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কবির হোসেন ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার এমপি ছিলেন। এর মধ্যে রাজশাহী-২ আসনে দুইবার ও রাজশাহী-৬ আসন থেকে একবার নির্বাচিত হন তিনি।  

কবির হোসেন ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রথমে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং পরে ভূমি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। অন্যদিকে মিনুর সঙ্গে মহানগর বিএনপি সভাপতি বুলবুলের বিরোধ রয়েছে।  

সিটি নির্বাচনে পরাজয়ের পর তিনিও এবার সদর আসনের এমপি পদে নির্বাচন করতে চান। তবে মিনু বিরোধীদের একটি অংশ সদর আসনের প্রার্থী হিসেবে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি রুহুল কবির রিজভীর পক্ষে কাজ করছেন বলে শোনা যাচ্ছে।  

ফলে দলের আরেক হেভিওয়েট নেতা রিজভীকে নিয়েও খানিকটা টেনশনে রয়েছেন মিনু। তবে নেতাকর্মীরা এও বলছেন, রাজশাহী অঞ্চলে বিএনপির রাজনীতিতে মিনুই দীর্ঘ সময় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মূলত ৮০ ও ৯০-এর দশকে মিনু দক্ষ সংগঠক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন। মিনুর নেতৃত্বেই এ অঞ্চলে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।  

মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন বলেন, মিনুই পুরো উত্তরাঞ্চলে বিএনপির প্রাণ। তিনি ত্যাগী ও কর্মীবান্ধব নেতা। রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী। সমর্থকদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতাও বেশি। মিনুর ডাকে যেকোনো সময় হাজার হাজার নেতাকর্মী রাস্তায় নেমে আসেন। আর এ কারণে হাইকমান্ডে মিনুর গুরুত্ব একটুও কমেনি।  

এ প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান মিনু বলেন, বিএনপি সব সময় আন্দোলন ও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। এটি দেশের সর্ববৃহৎ দল। আর দলটি উদার গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনমুখী। সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচন চাই। বিএনপি আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিলে রাজশাহী বিভাগের ১৮ থেকে ১৯টি আসনে বিজয়ী হবে।  

এ সময় রাজশাহীতে বিএনপিতে কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলেও দাবি করেন তিনি।  

রাজশাহী সদর আসন-২ এর মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ১৮ হাজার ১৩৮। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৫ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৬২ হাজার ৫৩ জন। এ আসনের সঙ্গে আগে পবা উপজেলা যুক্ত ছিল।  

তবে ২০০৮ সালে পবা উপজেলাকে বাদ দিয়ে সীমানা পুননির্ধারণ করা হয়। এ সময় শুধু সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ড এলাকা নিয়ে সদর আসনটি গঠিত হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৮
এসএস/এমএ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।