বলা হয় রাজশাহীতে রাজনীতির মারপ্যাঁচে সবচেয়ে জটিল আসন এটি। একাদশ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এ আসনে প্রধান দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে গৃহদাহ চলছে।
এক সময়ের বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর এ আসনটিতে গত দুইবারই সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারা।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। তবে ২০১৪ সালের ১০ম সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসন গাঁড়েন জাতীয় সংসদে। তবে এবার আসনটিতে দলটি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বর্তমান সংসদ সদস্যসহ মোট দশজন।
এর মধ্যে রয়েছেন-এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক, জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সহ-সভাপতি আবদুল মজিদ সরদার, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. মনসুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আহসান-উল-হক মাসুদ, যুব মহিলা লীগের সভাপতি অধ্যাপিকা নারগিস সুরাইয়া সুলতানা শেলী, জেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি ওবাইদুর রহমান, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবু সায়েম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য রাকসুর সাবেক ভিপি নূরুল ইসলাম ঠাণ্ডু, ব্যবসায়ী আসিফ ইবনে আলম তিতাস এবং বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারা।
এদিকে, নির্বাচনী ইতিহাস বলছে রাজশাহী-৫ আসনটি বিএনপির ঘাঁটি বলা হলেও স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শাহ মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ। এরপর ৫ম জাতীয় সংসদের ফলাফলে বিএনপি সরকার গঠন করলেও এ আসন থেকে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ পর্যন্ত সব মিলে চারবার এখান থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা।
এরপরও এখানে বিএনপির অবস্থান বেশ শক্ত। ১৯৭৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জেলা বিএনপির বর্তমান সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার মণ্ডল। ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে পরবর্তী ৭ম সংসদ নির্বাচনে এ আসনে প্রার্থী মনোনয়নে চমক আনে বিএনপি। দলের মনোনয়ন পান সাড়ে ৩১ বছর বয়সের তরুণ যুবদল নেতা এবং পরবর্তীতে জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট নাদিম মোস্তফা। ৮ম সংসদেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে তার বিশেষ সর্ম্পক থাকায় টানা ১০ বছর সংসদ সদস্য থেকে এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন তিনি।
তার কার্যক্রমের ফলেই আসনটি বিএনপির শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এ আসনে ১৯৮৬ সালের ৩য় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রয়াত মুহাম্মদ আয়েন উদ্দীন। এছাড়া জাতীয় পার্টির অধ্যাপক আবুল হোসেন ৪র্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তবে রাজনৈতিক নানা সমীকরণের ফলে বর্তমানে এখানে নির্বাচনে জেতার মতো অস্তিত্ব নেই জাতীয় পার্টির। কিন্তু এলাকায় প্রচার আছে সারাদেশের মধ্যে যে কয়েকটি আসন দাবি করেছে পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার মধ্যে রাজশাহী-৫ অন্যতম। তাই এ আসনটিতে মহাজোটের প্রার্থী দেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। অধ্যাপক আবুল হোসেনকে এরই মধ্যে সবুজ সংকেত দিয়েছেন তিনি। এর প্রেক্ষিতে এলাকায় প্রচারণায়ও নেমে পড়েছে আবুল হোসেন।
এছাড়া আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারার মনোনয়ন ঠেকাতে এখানে একাট্টা হয়েছেন দলের ১০ নেতা। গত আগস্টে দুর্গাপুরে জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের উপস্থিতিতে এ পাঁচ নেতা আব্দুল ওয়াদুদ দারাকে মনোনয়ন না দিতে কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তাদের মতে, সংসদ সদস্য দারা এলাকায় কোনো কাজ করেননি। সাধারণ মানুষ তার ওপর ক্ষুব্ধ। তিনি দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছেন। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের তিনি অবমূল্যায়ন করেছেন।
বর্তমান সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ‘জামায়াত-বিএনপির’ লোকজনকে টাকার বিনিময়ে স্কুল-কলেজে চাকরি দেওয়ার অভিযোগও করেছেন তারা।
এ ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে আসনটিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের দাবিদার হিসেবে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক, দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুল মজিদ সরদার, সাংগঠনিক সম্পাদক আহসান-উল-হক মাসুদ, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. মনসুর রহমান, জেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি ওবায়দুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবু সায়েম ও ব্যবসায়ী আসিফ ইবনে আলম তিতাসসহ অন্যরা।
বর্তমান সংসদ সদস্য ছাড়া এসব নেতার মধ্যে যে কাউকে দলীয় মনোনয়ন দিলে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন তারা। নৌকার দাবিদার হিসেবে তারা পুঠিয়া-দুর্গাপুরের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে সাঁটিয়েছেন নিজেদের ব্যানার-ফেস্টুন। তবে এই ১০ নেতার মধ্যে ওবায়দুর রহমান ও আহসান-উল-হক মাসুদ মাঠে শক্ত অবস্থান নিয়ে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু তাদের মধ্যে এখনো সংসদ সদস্য দারার অবস্থানই মাঠপর্যায়ে শক্তিশালী বলে দাবি করেছেন দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অনেকেই।
তারা বলছেন, সংসদ সদস্য সময় পেলেই ছুটে যাচ্ছেন এলাকায়। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।
তবে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুল মজিদ দাবি করে বলেন, সংসদ সদস্য দারার সঙ্গে কোনো নেতাকর্মী নেই। পুঠিয়া ও দুর্গাপুরের মানুষ এখন পরিবর্তন চায়। সেই পরিবর্তনের জন্য আমরা মাঠে আছি। মাঠে থেকে নেতাকর্মীদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। এখন দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার হয়েই কাজ করতে হবে।
আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান জানিয়ে মজিদ বলেন, দুইবার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও একবার উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছি বিপুল ভোটের ব্যবধানে। এবার পুঠিয়া-দুর্গাপুরের মানুষের মধ্যে আরো বৃহদাকারে সেবা করার মানসিকতা নিয়ে মাঠে নেমেছি। আশা করছি দল আমাকে এবার মনোনয়ন দেবে।
তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক বলেন, দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার হয়েই আমরা কাজ করব। তবে দারার কারণে পুঠিয়া-দুর্গাপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আজ দ্বিধাবিভক্ত। এটির অবসান হওয়ার দরকার। এ অবস্থায় দল যদি আমাকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়, তাহলে অবশ্যই জয়ী হব বলে বিশ্বাস রাখি।
অধ্যাপক ডা. মনসুর রহমান বলেন, আমি গতবারেও প্রার্থী ছিলাম। দীর্ঘদিন ধরেই পুঠিয়া-দুর্গাপুরের মানুষের সঙ্গে আছি। কাজেই আগামী নির্বাচনে দল আমাকে মূল্যায়ন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের আরেক নেতা আহসান-উল-হক মাসুদ বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করে আসছি। এখন পুঠিয়া-দুর্গাপুরের মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষও আমার পাশে আছে।
সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদ দারা বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এখানে অনেক নেতা আছে। সবাই যে যার মতো করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে যাদের দলে অবস্থান নেই, তারাই গিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করছে। আমি কোনো বিভেদ সৃষ্টি করিনি। এখানে মূল কথা হচ্ছে অনেকেই মনোনয়নপ্রত্যাশী হবেন। কিন্তু দলীয় সভানেত্রী যাকে মনোনয়ন দেবেন তার জন্য কাজ করতে হবে। কারণ ব্যক্তি কোনো ফ্যাক্টর নয় এখানে নৌকাকে বিজয়ী করতে হবে এটাই মূল কথা।
অপরদিকে রাজশাহী-৫ আসনটিতে নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি চলছে বিএনপিতেও।
স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, পুঠিয়া-দুর্গাপুরের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন নাদিম মোস্তফা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে তিনি এলাকাছাড়া। প্রায় ১২ বছর ধরে তিনি এলাকায় যান না। যোগাযোগ নেই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে। নাদিম মোস্তফার নিষ্ক্রিয়তার ফলে এলাকায় সক্রিয় হয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে ভালো অবস্থান তৈরি করেছেন তরুণ ব্যবসায়ী পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ইসফা খায়রুল হক। বর্তমান সরকারের সময়ে দুই উপজেলার বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা বেশিরভাগ মামলার আসামিদের দেখভাল করছেন তিনি। ফলে এরই মধ্যে নেতাকর্মীদের মধ্যে ভালো অবস্থান তৈরি করে ফেলেছেন।
এ আসনে নাদিম মোস্তফা, নজরুল ইসলাম মণ্ডল, ইসফা খায়রুল হক ছাড়াও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন আরো কয়েকজন নেতা। এরা হচ্ছেন- দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদল নেতা আবু বকর সিদ্দিক, দুর্গাপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম সাকলায়েন ও জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের কেন্দ্রীয় সদস্য সিরাজুল করিম সনু। তবে সাধারণ মানুষের কাছে এখনও জনপ্রিয় আসনটির সাবেক সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফার। আওয়ামী লীগের হাত থেকে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে তার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন নাদিম অনুসারিরা।
আবার দলের অনেকেই বলছেন, নাদিম মোস্তফা এলাকার জনপ্রিয় নেতা হলেও গত ১২ বছর ধরে এলাকায় আসেন না তিনি। নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মোবাইল রাজনীতির বেড়াজাল থেকে বের হতে এবার নেতাকর্মীরা এলাকার প্রার্থী হিসেবে ইসফা খায়রুল হক শিমুলকে বেছে নিয়েছেন।
রাজশাহী-৫ আসনের ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ১ হাজার ৬১৪ জন। এর মধ্যে দুর্গাপুরে ১ লাখ ৫১ হাজার ৪১৮ ও পুঠিয়ায় ভোটার ১ লাখ ৫০ হাজার ১৯৬জন।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৮
এসএস/ওএইচ/আরএ