সারা বিশ্বেই যে সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করছে তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে খাদ্য। বাংলাদেশে খাদ্যসংকট অবশ্য বৈশ্বিক সংকট থেকে একটু ভিন্নতর হয়।
এর মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য খাদ্যসংকট ও কৃষি বিপণন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তরুণরাউৎপাদন হ্রাস; ইউক্রেন রাশিয়ার আক্রমণে রণভূমিতে পরিণত হওয়ায় দেশটিতে খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে যাওয়া এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য কমে যাওয়া; বিশ্বব্যাপী পরিবহন ও শিপিং ভাড়ার ঊর্ধ্বমুখিতা। মার্কিন ডলারের মূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্যপণ্য আমদানিকারক দেশগুলোর, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে খাদ্যপণ্য আমদানি খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে দেশের একজন তরুণ হিসেবে কিছু করণীয় রয়েছে বলে মনে করছি। জলবায়ু পরিবর্তন আজকের পৃথিবীর অন্যতম বড় সংকট।
এটি শুধু পরিবেশ নয়, আমাদের অর্থনীতি, সমাজ এবং বিশেষ করে কৃষিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশ, যা মূলত একটি কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ, ২০২০ সালের তথ্য মতে, এই দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ জীবিকার জন্য মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংকটের অন্যতম শিকার বাংলাদেশ।
একজন কৃষি অর্থনীতির শিক্ষার্থী এবং কৃষিবিষয়ক সংগঠনে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি উপলব্ধি করেছি যে জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষি বিপণনের সমস্যা সমাধানে সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও কৃষির চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বাংলাদেশের কৃষি প্রধানত প্রকৃতিনির্ভর। এখানে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, তাপমাত্রার অস্বাভাবিক ওঠানামা, নদীভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো জলবায়ুজনিত সমস্যাগুলো সরাসরি কৃষি উৎপাদনকে প্রভাবিত করছে।
আমাদের দেশের কৃষি বিপণন ব্যবস্থা যুগোপযোগী নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের ক্ষতি হলে বাজারে পণ্যের সরবরাহ কমে যায়, যার প্রভাব পড়ে কৃষি অর্থনীতিতে। প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কৃষিপণ্যই নষ্ট হয়ে যায়।
এ ছাড়া পরিবহন, সংরক্ষণ এবং পণ্য প্রক্রিয়াকরণে পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় কৃষিপণ্যের বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। ফলসরূপ, খাদ্যের চাহিদা পূরণে একটি বড় অংশ আমদানি করতে হয়।
আমার সংগঠনে কাজ করার সময় আমরা কৃষকদের এই সমস্যাগুলো নিয়ে সচেতন করেছি। আমরা দেখেছি, কৃষকদের সরাসরি ভোক্তাদের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারলে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, ই-কমার্স প্ল্যাটফরম, স্থানীয় বাজার এবং কৃষকদের জন্য মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করে বিপণনব্যবস্থা সহজ করা যেতে পারে।
কৃষিতে বিপণন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের তরুণদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে আমাদের সম্মিলিতভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে :
১. ক্লাইমেট-স্মার্ট কৃষি পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। কৃষকদের এমন ফসলের জাত সরবরাহ করতে হবে, যা তাপমাত্রার পরিবর্তন, খরা ও লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। পাশাপাশি আধুনিক সেচ ব্যবস্থা এবং ফসল সংরক্ষণের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
২. ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি বিপণনকে আরো উন্নত করা সম্ভব। আমরা তরুণরা ই-কমার্স প্ল্যাটফরম তৈরি করে সরাসরি কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পারি। এর মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীর প্রভাব কমানো যাবে এবং কৃষক তাদের ন্যায্য মূল্য পাবেন।
৩. জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব সম্পর্কে কৃষকদের সচেতন করা প্রয়োজন। স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালা, তথ্যচিত্র এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে।
৪. সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে কৃষি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে; যেমন—প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য প্রণোদনা দেওয়া এবং তাঁদের প্রযুক্তি ব্যবহারে উত্সাহিত করা।
তরুণ প্রজন্মের উদ্ভাবনী চিন্তা-ভাবনা এই সমস্যার সমাধানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তরুণদের মধ্যে নতুন আইডিয়া এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ইচ্ছা অনেক বেশি। আমাদের উচিত স্থানীয় সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর জন্য বাস্তবসম্মত সমাধান তৈরি করা। আমরা যদি কৃষি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্রিয় হই, তাহলে এই খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিপণনব্যবস্থার সংকটের কারণে আমাদের কৃষি খাত আজ হুমকির মুখে। কৃষিতে বিপণন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উদ্ভাবন, সচেতনতা ও গবেষণার সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে এবং টেকসই কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে। সঠিক দিকনির্দেশনা ও উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত ও নিরাপদ বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারব।
লেখক: চতুর্থ বর্ষ, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হেড অব কন্ট্রোল বোর্ড, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব স্টুডেন্টস ইন অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড রিলেটেড সায়েন্সেস (ইয়াস), বাংলাদেশ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি
বাংলাদেশ সময়: ১০০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৫