‘প্রতিশোধ’—নামটি দেখে অবশ্য গল্পের ধরন অনুমান করা যেতে পারে কিন্তু আন্দাজ করাটা কঠিন। থ্রিলার ঘরানার গল্পের জন্য বেশ জনপ্রিয় এবং বহুলব্যবহৃত নাম।
সাকিব রায়হান প্রথমেই উল্লেখ করে নিয়েছেন, এটি একটি ‘ক্ল্যাসিক থ্রিলার’। ক্ল্যাসিক থ্রিলার সিরিজের ক্ষেত্রে জেমস বন্ড কিংবা মাসুদ রানার কথাই বলা যেতে পারে। জেমস বন্ড কিংবা মাসুদ রানার উপস্থাপনের ক্ষেত্রে একটি বিষয় স্পস্ট—তারা দুঃসাহসিক এক যোদ্ধা। শত্রুপক্ষের জন্য ত্রাস এবং মিত্রদের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতেও রাজি। এই দুইপক্ষের সঙ্গে আচরণগত পার্থক্য গল্পের ভেতরে থাকা চরিত্রদের মধ্যেই নায়ক সম্পর্কে এক ধরনের হেয়ালি তৈরি করে। তবে পাঠক যেহেতু বাহির থেকে সব দেখেন, তাই তিনি মুগ্ধ হন। ক্ল্যাসিক ঘরানার বৈশিষ্ট্যগুলোকে খুব দক্ষতার সঙ্গে সামলে সাকিব রায়হান তার গল্প এগিয়ে নিয়েছেন। তবে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায়, প্রথম থ্রিলার লেখার ক্ষেত্রে লেখকরা সচরাচর যে বিষয়গুলো খেয়াল করেন না তা ‘প্রতিশোধ’ বইটিতেও পাওয়া গেছে। থ্রিলার সাহিত্যে প্রথম বই বিবেচনায় বিষয়টি মেনে নেয়ার মতো। তবে বিষয়গুলো চিহ্নিত করে দেয়াও জরুরি। কিন্তু সব মিলিয়ে ‘প্রতিশোধ’ বইটিতে লেখক যে অ্যাকশনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা আছে। ভালোভাবেই আছে।
গল্পটা আহামরি কিছু নয়। দাউদ বিভিন্ন অফিসে চাকরির জন্য তদবির চালাচ্ছে। এর আগে আট বছর নিউ ইয়র্কে কাটিয়েছে সে। এমন পরিবেশে দাউদ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। যেহেতু জানি থ্রিলার তাই মূল নায়ক কি দাউদ কি-না সে সম্পর্কে সাসপেন্স লেখক রেখে দেন। একসময় দাউদ আবিষ্কার করে তাকে একদল লোক অনুসরণ করছে। কেন করছে আর তাকেই বা কেন খুঁজছে সে উত্তর পাওয়ার সমান্তরালে লেখক আস্তে আস্তে দাউদের অতীত ইতিহাসেরও কিছু ধারণা দিতে থাকেন। একসময় আমরা জানতে পারি দাউদের পরিচয়। দেশে ফিরে আসার তীব্র তাড়না এবং এখানে স্বাভাবিক জীবনে থিতু হওয়ার পরিকল্পনার মাঝে বাঁধ সাধে প্রতিশোধের প্রেক্ষাপট। সেখানে ঢাকার দুই প্রতাপশালী গ্যাং জড়িত। দাউদ বিনা কারণে সহিংসতার পথে যেতে নারাজ। কিন্তু এই প্রতিশোধে তাকেও শামিল হতেই হয় এবং তার লক্ষ্য হয়ে ওঠে কুখ্যাত সন্ত্রাসী মনোজ। ক্ল্যাসিকেল থ্রিলারের ধরন অনুযায়ী বিষয়টি সহজেই অনুমেয়, নায়ক তার লক্ষ্যভেদ করবেন। কিন্তু তার অ্যাকশন কেমন হবে তা নির্ধারণ করে দেয় গল্পের পাঠ অভিজ্ঞতা।
যেমনটা বলেছি, থ্রিলারের পাঠ অভিজ্ঞতা যত সুখকর হবে, গল্পের স্বার্থকতা তত বাড়বে। সেজন্য যে অতিরঞ্জিত অ্যাকশনের প্রয়োজন নেই তা অনেকেই বোঝেন না। এদিক দিয়ে সাকিব রায়হান ব্যতিক্রমী রুট ধরেছেন। প্রথম থ্রিলার গল্পে তিনি অতিরঞ্জিত অ্যাকশনের আশ্রয় নেন নি। বরং মনোযোগ দিয়েছেন ‘সাসপেন্স’ গড়ার দিকে। রহস্য গল্পে যেমন হেয়ালীর পরিবেশ একদম শেষ পর্যন্ত থাকে, থ্রিলারে থাকতে হয় ‘সাসপেন্স’। পরবর্তী অ্যাকশন কি হতে পারে সে সম্পর্কে পাঠককে আগ্রহী রাখা। এজন্য থ্রিলারের পটভূমি সাজাতে হয় দক্ষভাবে। সাকিব রায়হান এক্ষেত্রে ভালো দক্ষতা দেখিয়েছেন। দাউদের পরিচিতি থেকে শুরু করে তার অনুসারিদের কার্যকলাপ, কোথাও তিনি বাড়তি বর্ণনা রাখেন নি। গল্পের খাতিরে যতটুকু না বললেই নয়, বলেছেন। এমনকি দাউদের অতীত ইতিহাসের পুরোটা তিনি সামনে আনেন নি। গল্পের স্বার্থে নানা জায়গায় বিষয়গুলো টেনে এনেছেন। ঢাকার পথগুলোর উল্লেখ করেছেন কিন্তু একদম নিঁখুত বর্ণনার দিকে যান নি। তাহলে বিরক্ত লাগতো। কিন্তু গল্প অনেক জায়গায় একটু বেশিই দ্রুত টেনে ফেলেছেন। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। অ্যাকশনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ থ্রিলার লেখক (সেটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনেক লেখকের ক্ষেত্রেও সত্য) উত্তেজনার সংযত রাশ টানতে ভুলে যান। থ্রিলার লেখায় তিনি যে যথেষ্ট ডুবে ছিলেন এবং অতিরঞ্জিত কোনো অ্যাকশন টানতে চান নি সেটা স্পস্ট। এমনকি অ্যাকশনের মাধ্যম হিসেবে লেখক দাউদের মিলিটারিতে সার্ভাইভ্যাল টেনিং এর প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। এ বিষয়টি প্রশংসার দাবি রাখে। সচরাচর অনেক থ্রিলার লেখক অ্যাকশন মুভির অনেক সিনের মতো বর্ণনা আনেন। তেমনটা সাকিব রায়হান করেন নি। এই বিষয়টা থ্রিলারের ক্ষেত্রে তার মৌলিকত্ব সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে, তাই প্রশংসা না করে পারা যায় না।
গল্পের অ্যাকশনের জায়গাটিও লেখক বেছে নিয়েছেন পাহাড়ে। আর কোনো অ্যাকশনের ব্যাখ্যায় লেখক যাননি যা একটি ভালো দিক। কারণ ক্ল্যাসিক থ্রিলারে অ্যাকশনের ব্যখ্যা দিতে গেলে গল্পের নানা প্লটহোল বের হয়। অতিবর্ণনার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে পুরো গল্পেই তিনি সচেতন ছিলেন বোঝা যায়। তবে প্রথমেই যেমনটা বলেছি, প্রথম থ্রিলার গল্প লেখার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো সচরাচর লেখকদের চোখ এড়িয়ে যায় সেগুলো থেকে সাকিব রায়হানও মুক্ত হতে পারেন নি। মূলত বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে পরিচিত কিছু শব্দকেই ব্যবহার করা এবং বর্ণনায় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার একটু কমিয়ে আনতে পারলে তার থ্রিলারটি আরও মেদহীন মনে হতো। গল্প বলার ঢঙ তার এমনিতেই মেদহীন হয়েছে। কিন্তু বর্ণনার ক্ষেত্রে শব্দ সম্পর্কে সচেতন হওয়াটা জরুরি। একটা শব্দও অ্যাকশনের গতিবিধিকে বৈচিত্র্যময় করতে পারে। থ্রিলার লেখকরা যত লিখবেন, ততই শব্দসচেতনতা ও পরিবেশ নির্মাণের কারিগরি দিক সম্পর্কে সচেতন হবেন। যেহেতু এটি ডেয়ার ডেভিডের প্রথম বই তাই প্রত্যাশা করাই যায় সামনে আরও গল্প আসবে। প্রথম বইয়ে সামান্য কিছু বিষয় বাদে পুরো গল্পটিই মেদহীন, অ্যাকশনে ভরপুর। গল্পটিতে অতিরঞ্জিত অ্যাকশন না থাকায় বিদেশি গল্পের অনুকরণ বা মেকি বলেও মনে হয় না। এ জায়গায় সাকিব রায়হানের মৌলিকত্ব প্রশংসনীয়। তিনি খুব স্বল্প কিছু বাস্তবিক উপকরণ মিলিয়ে একটি সুন্দর পরিবেশ গড়ে নিয়েছেন। আমার মনে হয়েছে, তিনি চাইলে গল্পটির বর্ণনাকে আরেকটু দীর্ঘায়িত করতে পারতেন। শুরুতে তিনি গল্পকে অনেক দ্রুত টেনে নিয়েছেন। কিন্তু একদম শেষে তিনি যেন সত্যিই বর্ণনার ঢঙে নিয়ন্ত্রণ আনতে পেরেছেন। দেশে ক্লাসিক থ্রিলার লেখকের সংখ্যা বেশ কম। অনেকেই লিখছেন কিন্তু সফলভাবে পারছেন না। সেখানে সাকিব রায়হানের ‘প্রতিশোধ’ পড়ার পর মনে হয়েছে সামনে আরও পরিশীলিত আকারে গল্প আনবেন তিনি। এইযে আগ্রহটি জিইয়ে রাখা, এটিই কি প্রথম গল্প হিসেবে তার স্বার্থকতা নয়?
প্রতিশোধ (ক্লাসিক্যাল থ্রিলার)
সাকিব রায়হান
প্রকাশক: অন্যধারা
দাম: ৩৫০ টাকা
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০২৩
এমজেএফ