ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কবি আবু বকর সিদ্দিকের অনবদ্য যত সৃষ্টি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২৩
কবি আবু বকর সিদ্দিকের অনবদ্য যত সৃষ্টি

খুলনা: বাংলা সাহিত্যের প্রতিভাবান কবি আবু বকর সিদ্দিক বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) ভোর পৌনে ৬টার দিকে খুলনার সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকটা নীরবে নিভৃতে চলে গেলেন তিনি।

হযরত খানজাহান আলীর (র) পুণ্যভূমি বাগেরহাটের গোটাপাড়া গ্রামে ১৯৩৪ সালে জন্ম নেওয়া কবি ঘুমিয়ে পড়েছেন রূপসী রূপসার তীরে খুলনায়। তার মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তার লেখনী বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বাংলা সাহিত্যের আকাশ থেকে ঝরে গেল আরও একটি আলোকিত নক্ষত্র।

সাহিত্যভুবনে আবুবকর সিদ্দিক স্বল্পালোচিত, অথচ বহুমুখী প্রতিভাগুণে সমৃদ্ধ এক বিশেষ সাহিত্যব্যক্তিত্ব ছিলেন। পর্যটনপ্রিয় কবি আবু বকর সিদ্দিকের কবিতা ও গল্প-উপন্যাসের ভাষা স্বতন্ত্র ও স্বকীয়তা ছিল। যে কারণে কবি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমার কবিতা কখনো আমার গদ্যকে শাসন করেনি।

কবির অনবদ্য যত সৃষ্টি

আবু বকর সিদ্দিকের সাহিত্যসৃষ্টি ও শিল্পদৃষ্টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাহিত্যামোদী পিতার কর্মসূত্রে তার বাল্যকাল কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে আর জন্মভূমি দক্ষিণ বাংলার বাগেরহাটে অতিবাহিত হয়েছে কৈশোর, তারুণ্য ও কর্মজীবনের অনেকটা সময়। দু-দশকের অধিককাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুবাদে গোটা উত্তরবঙ্গ অবলোকন শেষে তিনি রাজধানী ঢাকার জনজীবন ও পরে এক যুগ ধরে খুলনায় অবস্থান করেন। তৃণমূল মানুষের গভীরতম তলদেশ থেকে বিত্তবান বিলাসীজীবনের খুঁটিনাটি তার নখদর্পণে ছিল। ব্যক্তিজীবনেও তাকে বহু ঝড়ঝাপটা পোহাতে হয়েছে। দীর্ঘ এ ব্যক্তিক, আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পরিক্রমা এবং শিল্প-দর্শনের নির্যাস তার সাহিত্যভুবনে প্রতিফলিত হয়।

সাহিত্য বিশ্লেষক মোহাম্মদ জয়নুদ্দীনের তথ্য মতে, আধুনিক বাংলা কবিতার মননশীল কবি আবু বকর সিদ্দিকের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা আঠারোটি: ধবল দুধের স্বরগ্রাম (১৯৬৯), বিনিদ্র কালের ভেলা (১৯৭৬), হে লোকসভ্যতা (১৯৮৪), মানুষ তোমার বিক্ষত দিন (১৯৮৬), হেমন্তের সোনালতা (১৯৮৮), নিজস্ব এই মাতৃভাষায় (১৩৯৭), কালো কালো মেহনতী পাখি (২০০০), কংকালে অলংকার দিয়ো (২০০১), শ্যামল যাযাবর (২০০০), মানব হাড়ের হিম ও বিদ্যুৎ (২০০২), মনীষাকে ডেকে ডেকে (২০০২), আমার যত রক্তফোঁটা (২০০২), শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০০২), কবিতা কোব্রামালা (২০০৫), বৃষ্টির কথা বলি বীজের কথা বলি (২০০৬), এইসব ভ্রƒণশস্য (২০০৭), বাভী (২০০৮), নদীহারা মানুষের কথা (২০০৮) ইত্যাদি এবং ছড়াগ্রন্থ: হট্টমালা (২০০১)। এসব কাব্যরচনার পাশাপাশি তিনি ক্রমাগত নির্মাণ করেন অবিনাশী গণসংগীত, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা ও জীবনীগ্রন্থ। তার প্রথম গ্রন্থ ধবল দুধের স্বরগ্রাম। তার একটি মাত্র ছড়াগ্রন্থ হট্টমালা (২০০১)।

আবু বকর সিদ্দিকের প্রকাশিত ছোটগল্পগ্রন্থসমূহ: ভূমিহীন দেশ (১৯৮৫), চরবিনাশকাল (১৯৮৭), মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৮৭), কুয়ো থেকে বেরিয়ে (১৯৯৪) এবং ছায়াপ্রধান অঘ্রান (২০০০)।

নির্মম কালপুরুষের মতো তিনি বাংলাদেশের শোষিত মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনসত্যকে ভূমিহীন দেশের (১৯৮৫) ‘ভূমিহীন দেশ’ গল্পে চিত্রিত করেন।

লেখকের শৈল্পিক প্রতিবাদের ধারাবাহিক প্রকাশ মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৮৭) গল্পগ্রন্থ, যা মুক্তিযুদ্ধের শিল্পদলিল হিসেবে স্বীকৃত। এ ছাড়াও ‘বেলুনওয়ালা’, ‘খালখসা লাল কংকাল’, ‘ভূতপ্যাদানী’, ‘খাদ্য মন্ত্রণালয় কতো দূরে’, ‘চন্দনের ঘূণ’, ‘লাশের নাম নেই’, ‘খতম’, ‘এই সেই জয় বাংলা’, ‘ফজরালি হেঁটে যায়’, ‘রক্তগর্জন’ ও ‘খোঁড়া সমাজ’ গল্পের কোথাও কৃত্রিমতার ফাঁক নেই।

চরবিনাশকাল (১৯৮৭) গল্পগ্রন্থের সাতটি গল্পে রূপক-প্রতীকী ভাষায় মানবজীবনের কিছু অস্তিত্বের প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে। কুয়ো থেকে বেরিয়ে (১৯৯৪) গল্পগ্রন্থে তার এ-পরিচিতি অধিক সমুজ্জ্বল।

ছায়াপ্রধান অঘ্রান (২০০০) গল্পসংকলনেও রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, গ্রামীণজীবন, ধর্মীয় অন্ধত্ব, শোষণ-নির্যাতন গাল্পিকের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা এবং নিজস্ব রচনাশৈলীতে নির্মিত হয়েছে। কান্নাদাসী (২০০৬), হংসভাসীর তীরে (২০০৮), কালাকুম্ভীর (২০০৮), মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প: মুক্তিলাল অভ্যুদয় (২০০৮), মধুবন্তী (২০০৯) এবং বরীনভূমি-বাদাবন (২০১৭) গ্রন্থের প্রতিটি গল্পই ভিন্নমাত্রিক ও জীবনঘনিষ্ঠ।

তার প্রকাশিত উপন্যাস চারটি: দক্ষিণবঙ্গের জনজীবন নিয়ে রচিত জলরাক্ষস (১৯৮৫, দ্বি. প্র. ২০০১), উত্তরবঙ্গের খরাপীড়নের ভয়াবহ শিল্পনির্মাণ খরাদাহ (১৯৮৭, দ্বি. প্র. ২০০০), স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের পটভূমিতে রচিত বারুদপোড়া প্রহর (১৯৯৬) এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের আলেখ্য একাত্তরের হৃদয়ভস্ম (১৯৯৭)।

তার প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ কালের কলস্বর (২০০১) ও সাহিত্যের সংগপ্রসংগ (২০০১)। জীবনীগ্রন্থ রমেশচন্দ্র সেন (১৯৯২)। স্মৃতিকথা সাতদিনের সুলতান (২০০২), প্রীতিময় স্মৃতিময় (২০১০) এবং স্মরণের মুখশ্রী (২০১১)।

খানিকটা হালকা মেজাজের হলেও ‘বইপ্রেমের কিশোরবেলা’ ও ‘বই তুমি জনতার হাতে এসো’ প্রবন্ধ দুটি আবু বকর সিদ্দিকের মন-মানসিকতা-সাধনা-কামনার নির্ভেজাল প্রকাশক।

কবির যত প্রাপ্তি

বাংলা কবিতাকে সম্পূর্ণরূপে নিজ ঢঙে, রঙে, ভাবে, শিল্পে প্রকাশ করেছেন তিনি। সাহিত্যে অবদানের জন্য কবি আবু বকর সিদ্দিক ভূষিত হয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে (১৯৮৮), বাংলাদেশ কথাশিল্পী সংসদ পুরস্কার, বঙ্গভাষা সংস্কৃতি প্রচার সমিতি পুরস্কার (কলকাতা), খুলনা সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, বাগেরহাট ফাউন্ডেশন পুরস্কার, ঋষিজ পদকসহ দেশি-বিদেশি বহু পুরস্কার ও সম্মাননায়।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২৩
এমআরএম/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।