ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মুক্তিযুদ্ধ ও পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের একাল-সেকাল

স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা/ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫
মুক্তিযুদ্ধ ও পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের একাল-সেকাল

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে কলকাতার সম্পর্কের দিকে নজর রাখলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার নজির হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতায় আসা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর কলকাতার সেই রিফিউজি কলোনিগুলি ঘুরে সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতির খোঁজখবর করল বাংলানিউজ।



প্রধানত পাক বাহিনীর আক্রমণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের কারণে ছিন্নমূল পূর্ববঙ্গের মানুষেরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে সব থেকে বেশি মানুষ পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন।

পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অংশে আশ্রয় নিয়েছিল এই শরণার্থী পরিবারগুলি। ১৯৭১ সালের আগেও পঞ্চাশের দশক থেকেই কলকাতা পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল মানুষদের বড় অংশের বসবাসের জায়গা হয়ে উঠেছিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৫১ সালের ভারতের জনগণনার তথ্যে। দেখা যাচ্ছে ঐ সময় কলকাতার জনসংখ্যার ২৭% মানুষ রিফিউজি।

তবে একসঙ্গে  সব থেকে বেশি শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে আসার ঘটনা ঘটে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকের কয়েক মাস প্রায় এক কোটি মানুষ পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এবং ১৫ লক্ষ মানুষ আর ফিরে যাননি।



সরকারের তরফ থেকে প্রাথমিকভাবে এই শরণার্থীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়।   পরবর্তী সময়ে বহু বেসরকারি মালিকানাধীন জমিতেও রিফিউজি কলোনি গড়ে ওঠে। এই বেসরকারি কলোনির জমি ‘জবর দখল’ করে এই কলোনিগুলি গড়ে তোলেন এই সব ছিন্নমূল মানুষরা।

সেই সময়ে এই সব জমির মালিকদের সঙ্গে তাদের সরাসরি বিরোধিতা হয়। এই বিরোধিতা অনেক সময়ই সহিংস রূপ নিয়েছিল বলে জানা যায়।
 
এই সময় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আবেদন জানান।

১৯৭১ সালে যে এক কোটির মতো শরণার্থী এসেছিলেন বলে জানা যায়, তাদের একটা বড় অংশই বসবাস শুরু করেন কলকাতা এবং তার আশেপাশের এলাকায়। জানতে পারা যায় এই সময়েই আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলাম লুঙ্গিপরা অবস্থায় ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতে হাজির হন।

শরণার্থীরা ভারতে আসার পরেই ১৯৭১ সালের ১৭ মে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গে আসেন। এবং পরিষ্কারভাবে রাজ্য সরকারকে জানান, শরণার্থী বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত রকম সাহায্য করবে।

বনগাঁ সীমান্ত পেরিয়ে বহু মানুষ শিয়ালদা স্টেশনে হাজির হয়েছিলেন বলে জানা যায়। তাদের সম্বল যা ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা দিয়ে জীবন ধারণ করা কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না। পূর্ব রেলের দক্ষিণ শাখার স্টেশনগুলিতে একের পর এক ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে রিফিউজি কলোনি। এর মধ্যে কসবা, ঢাকুরিয়া, যাদবপুর, বাঘাযতীন, গড়িয়া, নরেন্দ্রপুর, টালিগঞ্জ, আজাদগড়, বিজয়গড় ছিল অন্যতম।

অন্যদিকে কলকাতার পূর্ব অংশে বেলেঘাটা, দমদম ক্যান্টনমেন্ট, মধ্যমগ্রাম এবং কেষ্টপুর খালের পাশের অঞ্চলেও গড়ে উঠেছিল রিফিউজি কলোনি। তবে সব থেকে বেশি সংখ্যক রিফিউজি কলোনি ছিল কলকাতার যাদবপুর-বাঘাযতীন-বিজয়গড়-টালিগঞ্জ অঞ্চলকে ঘিরে।

কেমন ছিল এই শরণার্থী শিবিরগুলি? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হওয়া এবং তার পর থেকে দীর্ঘকাল খালি পড়ে থাকা সেনা ছাউনিগুলিকে অনেক ক্ষেত্রেই শরণার্থী শিবির হিসেবে  ব্যবহার করা হয়েছিল। বাসস্থানের জায়গা গুলি ছিল মাটির উপরে লম্বা টানেলের মত। টিন দিয়ে তৈরি। সেখানেই একত্রে বহু মানুষ বসবাস করতেন।



কলকাতার যাদবপুর এবং টালিগঞ্জের মধ্যবর্তী অংশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের একটি খালি সেনা ব্যারাক ছিল বলে জানা যায়। সেখানে বসবাস শুরু করেন উদ্বাস্তু মানুষরা। এছাড়াও সামরিক ছাউনির বাইরে তাঁবুতেও থাকতেন বহু পরিবার। একটি তাঁবুতে চারটি পরিবার থাকার কথাও জানতে পারা যায়। এমনই মানবেতর জীবন ছিল পূর্ববঙ্গ থেকে শরণার্থী হ’য়ে আসা এসব ছিন্নমূল বিপন্ন মানুষের।

পরে এই ছাউনি সংলগ্ন বেসরকারি খালি জমিতেও তারা বসবাস শুরু করেন। যাদবপুর থেকে টালিগঞ্জের দিকের জমিগুলির মালিক ছিল লায়ালকা পরিবার। তাদের নামেই এই অঞ্চলের একাংশের বর্তমান নাম ‘লায়ালকার মাঠ’।

জমির মালিকদের সঙ্গে উদ্বাস্তু মানুষদের লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত আজও এসব কলোনিতে গেলে শোনা যায়। জমির মালিকরা অনেক সময় তাদের ভাড়া কড়া গুণ্ডাবাহিনী পাঠাতেন কলোনিগুলির দখল নিজেদের কব্জায় রাখতে। ফলে তাদের সঙ্গে সংঘাত ছিল অনিবার্য। এসব গুণ্ডাবাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী লড়াই চলতো কলোনিবাসীর।

তবে এই ইতিহাস শুধু যে সংঘাতের এমনও নয়। শরণার্থীদের জন্য কলকাতার আদি বাসিন্দাদের সাহায্যের হাতও ছিল প্রসারিত। অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক কর্মী থেকে সাধারণ মানুষ এই শরণার্থীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

তবে এই কলোনি বা ক্যাম্পগুলিতে জীবন মোটেও সহজ ছিল না। বেকারত্ব ছিল সব থেকে বড় সমস্যা। এইসব ক্যাম্পে মৃত্যুর হারও ছিল বেশি। তৎকালীন সরকারের তরফে ১৬ রুপি করে মৃতদেহ সৎকার করতে দেওয়া হতো বলে জানিয়েছেন এই ধরনের শিবিরে বাস করা মানুষেরা। কারণ বাস্তবিক ক্ষেত্রে এই মানুষদের সৎকার করার মত আর্থিক ক্ষমতা একেবারেই ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে মৃতদেহ জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হত বলেও জানা গেছে।

সরকারি ক্যাম্পের বাইরে ‘জবর দখল’ করে গড়ে ওঠা কলোনিগুলির অবস্থাও ছিল প্রায় একই। জীবন বা খুব ছোট বয়সে এসব কলোনিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এমন মানুষেরা জানিয়েছেন, তাদের জীবন তখন ছিল এক নির্মম লড়াইয়ের নাম—একটি বাস্তুচ্যুত, ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর শূন্য থেকে শুরু করবার লড়াই।

কেমন ছিল সেই লড়াই? এক প্রবীণ জানালেন, খাবার জোটেনি এমন দিন কম ছিল না। অনেকদিনই কাঁচা আলু আর কাঁচা লাউ খেয়ে পেট ভরাতে হয়েছে।

জানা যায় দক্ষিণ কলকাতার বাঘাযতীন মোড় থেকে সোজা তাকালে রেল লাইন দেখা যেত ১৯৭০ সাল নাগাদ। এই অঞ্চলগুলিতে প্রচুর শেয়াল এবং সাপের উপদ্রব ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে ছিল শুধু রেলপথ। যাদবপুর, বাঘাযতীন, নাকতলা, টালিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার কলোনিগুলিতে পানীয় জল, চিকিৎসার অভাব ছিল প্রচণ্ড। কলকাতা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে অন্য কয়েকটি জেলাতেও গড়ে ওঠা কলোনিগুলির চিত্র ছিল একই রকমের।


[বাঘাযতীন মোড়ের বর্তমান অবস্থা]

কিন্তু এখন সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে এই অঞ্চলগুলির চেহারা, চরিত্র। কলোনির মাটির টালি, টিনের ছাউনি কিংবা খড়ের চালের দেখা মেলে না আর কলোনিগুলিতে। কলোনির সমস্ত বাসিন্দাদের সরকারের তরফে জমির মালিকানা হস্তান্তর বা পাট্টা প্রদান করা হয়েছে। বদল হয়েছে এই কলোনিগুলির আর্থ-সামাজিক অবস্থা। অর্থনৈতিক অবস্থার বদল ঘটাতে সরকারের তরফে বিভিন্ন বৃত্তিমুলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল কলোনি গড়ে ওঠার প্রথম থেকেই।

যাদবপুর, বাঘাযতীন, টালিগঞ্জ এখন পুরোমাত্রার শহর। বিরাট চওড়া রাস্তার দুইধারে অট্টালিকার সারি। দ্রুতগতির যানবাহন, বাজারঘাট সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল,বাজার, রেস্তোরাঁ, প্রেক্ষাগৃহসহ আধুনিক জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই বিদ্যমান এখানে।


[লেক গ্রাউন্ডের বর্তমান অবস্থা]

প্রায় প্রতিটি কলোনিতে তৈরি হয়েছে এক বা একাধিক বিদ্যালয় এবং কলেজ। তৈরি হয়েছে কমিউনিটি হল থেকে শুরু করে খেলার মাঠ, পাঠাগারসহ আধুনিক নাগরিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই।

শহরের অন্য অংশের সঙ্গে আজ আর কোনও পার্থক্য নেই কলোনিগুলির। অনেক জায়গাতেই কলোনির জমিতে তৈরি হয়েছে আবাসন। আর এই আবাসনগুলিতে কলকাতা শহরের ‘কসমোপলিটান’ চরিত্র বজায় রেখে বসবাস করছেন বিভিন্ন রাজ্যর মানুষ। তৈরি হয়েছে শপিংমল থেকে মালটিপ্লেক্স।

এই কলোনিতে জন্ম নেওয়া নতুন প্রজন্ম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে বাকি কলকাতার সঙ্গে। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের আবেগ আছে, আছে উৎসাহ। আর প্রবীণরা স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান কেবল—চিরদিনের জন্য পেছনে ফেলে আসা জন্মভিটে, প্রিয় নদীতীর, শেকড় স্মৃতির ভেতর থেকে আজও প্রাণে উঁকি দ্যায়। ঢের সময় পেরিয়ে এইভাবেই আজ কলকাতার বাকি অংশের সাথে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে গেছে একসময়ের ছিন্নমূল পরিবারগুলি।



বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।