ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভোটার | চিনুয়া আচেবে | অনুবাদ: বিদ্যুত খোশনবীশ

অনুবাদ গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০১৫
ভোটার | চিনুয়া আচেবে | অনুবাদ: বিদ্যুত খোশনবীশ

রুফাস ওকিকি ওরফে রুফ দারুণ জনপ্রিয় এক যুবক। গ্রামের লোকেরা তার জনপ্রিয়তার কারণ বিস্তারিত বলে না।

তবে বোঝা যায়, এই জনপ্রিয়তা আসলে তার প্রতি গ্রামবাসীদের কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। কারণ আজকালকার দিনের আর পাঁচটা যুবকের মত যেন-তেন একটা চাকরির লোভে গ্রাম ছেড়ে সে শহরে যায়নি। তাছাড়া রুফ গ্রাম্য বেয়াদব নয়—আদব-কায়দা জানে। হারকোর্ট বন্দরে এক সাইকেল মিস্ত্রির দোকানে সে দুই বছর কাজ করেছে। সেখানে থেকে গেলে তার ভবিষ্যত আরও উজ্জ্বল হতে পারত। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে পেছনে ফেলে রুফ তার গ্রামের প্রিয় মানুষগুলোর কাছে ফিরে এসেছে, তাদের দুর্দিনে পাশে দাঁড়াতে চেয়েছে। অবশ্য মোফিয়া গ্রামে রুফের মত যুবকের নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা খুব একটা নেই। কারণ মোফিয়ার নেতৃত্ব ইতোমধ্যেই পিপলস এলায়েন্স পার্টি ও এর যোগ্য সন্তান মান্যবর মার্কাস ইবি’র হাতে চলে গেছে। মার্কাস ইবি গ্রামের সর্দার এবং বিদায়ী জাতীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রী। বিদায়ী সরকারের ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা এখন অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গেছে। পাশাপাশি মান্যবর মন্ত্রী মার্কাস ইবিও যে তার আসনে পুনর্নির্বাচিত হবেন সে বিষয়েও কারও কোনও সন্দেহ নেই। তার প্রতিপক্ষের অবস্থা অনেকটা গোবরে পোকার মত—নিজের চেয়ে কয়েকগুণ বড় গোবরের ঢিঁবি ঠেলতে ঠেলতে যার নাভিশ্বাস উঠে গেছে। কিছুদিন আগেও যে দলের কোনও নাম-গন্ধ ছিল না তার অবস্থা এমন হাস্যকর হওয়াটাই স্বাভাবিক।

রুফ মান্যবর মন্ত্রীর নির্বাচনের দায়িত্ব নিয়েছে। প্রচার-প্রচারণায় সে একজন এক্সপার্ট—হোক সেটা গ্রাম্য নির্বাচন কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচন কিংবা জাতীয় নির্বাচন। রুফের একটা বড় গুণ, সে খুব অনায়াসেই পাবলিকের মেজাজ-মর্জি ধরতে পারে। এবার দায়িত্ব নিয়েই মান্যবর মন্ত্রীকে সে জানিয়ে দিয়েছে, গত ইলেকশনের পর থেকেই মোফিয়াবাসীদের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।

রাজনীতি যে কতটা দ্রুত সম্পদ, খেতাব আর ডক্টরেট ডিগ্রি এনে দিতে পারে গত পাঁচ বছর ধরে মোফিয়ার জনগণ তা দেখার সুযোগ পেয়েছে। যদিও ডক্টরেট ডিগ্রিটা এখনও তারা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। তাদের ধারণা, গ্রামে এতদিনে বুঝি একজন ডাক্তার পাওয়া গেল। যাইহোক, এইসব খেতাব আর সুযোগ-সুবিধা এমন এক লোকের কপালে জুটেছে যাকে তারা পাঁচ বছর আগে বিনামূল্যে ভোট দিয়েছিল। তবে এবার তাদের চিন্তাভাবনা একটু ভিন্ন। খুব সম্ভবত তাদের ভোটগুলো এবার আর বিনামূল্যে কারও বাক্সে পড়বে না।

কিছুদিন আগেও মার্কাস ইবি মিশন স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি যে খুব সফল ছিলেন তা নয়। গ্রামে হঠাৎ একদিন রাজনীতি ঢুকল আর তিনিও বুদ্ধিমানের মত রাজনীতিতে ঢুকলেন। কেউ কেউ অবশ্য বলে, তার এক নারী সহকর্মী গর্ভবতী হয়ে যাওয়ায় দুদিন বাদে এমনিতেই তার চাকরিটা যেত। আজ তিনি গ্রামের সর্দার। লম্বা লম্বা দুটো গাড়ি, বিশাল একটা বাড়ির মালিক। এত বড় বাড়ি এ অঞ্চলের মানুষ এর আগে কখনও দেখেনি। তবে সত্যি বলতে, এসবের কোনও কিছুই মার্কাস ইবির মগজ ধোলাই করতে পারেনি। তিনি এখনও জনগণের জন্য নিবেদিত। যখনই সময় পান তখনই রাজধানীর বিলাসিতা ছেড়ে গ্রামে ছুঁটে আসেন—যেখানে সাপ্লাইয়ের পানি নেই, ইলেকট্রিসিটিও নেই। অবশ্য কিছুদিন আগে তিনি তার গ্রামের বিশাল বাড়িতে একটা জেনারেটার বসিয়েছেন। মার্কাস ইবি জানেন, তার এই সৌভাগ্যের উৎস কোথায়। তিনি সেইসব পাখিদের মত নন যারা হুট করে উড়ে আসে, গেরস্তের দানাপানি খায়, আবার হুট করে উড়াল দিয়ে চলে যায়। তাই গ্রামের সম্মানে তিনি নতুন বাড়িটার নাম রেখেছেন, ‘মোফিয়া ম্যানসন’। স্বয়ং আর্চবিশপ বাড়িটার উদ্বোধন করে গেছেন। উদ্বোধনের দিন পাঁচটা বড় বড় ষাঁড় আর অসংখ্য খাসি জবাই করে তিনি গ্রামের মানুষকে আপ্যায়িত করেছিলেন।

আদর-আপ্যায়নে খুশি হয়ে সেদিন মার্কাস ইবির প্রশংসায় সবাই ছিল পঞ্চমুখ। এক বৃদ্ধ মন্তব্য করেছিল, ‘আমাদের সন্তান ইবি সত্যিই একজন ভালো মানুষ। তিনি হাম্বলদিস্তা নন যে পেটে কিছু ঢোকা মাত্রই সব পিষে ফেলবেন। ’ কিন্তু খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে না হতেই তারাই আবার নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, ‘আগেরবার আমরা ব্যালটের ক্ষমতা বুঝতে পারি নাই। কিন্তু এইবার আর ভুল করব না। ’ তবে মান্যবর সর্দার মার্কাস ইবিও অপ্রস্তুত ছিলেন না। পাঁচ মাসের সরকারি বেতন অগ্রিম তুলে কয়েক শ’ পাউন্ড ভাঙ্গিয়ে তিনি চকচকে শিলিং জোগাড় করেছিলেন। ছোট ছোট পাটের ব্যাগে শিলিংগুলো ভরে চ্যালাপ্যালাদের নামিয়ে দিয়েছিলেন ভোটের মাঠে। এই কাজে রুফের ওপরই তার ভরসা ছিল সবচেয়ে বেশি।

এক রাতে রুফ ওবিফি জিনুয়া’র বাড়িতে গণ্যমান্য কয়েকজন মুরুব্বির সাথে বৈঠকে বসল। ওবিফি জিনুয়া গ্রামের একজন সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। রুফ বলল, ‘এই গ্রাম থেকে আমরা একজন মন্ত্রী পেয়েছি। সে আমাদেরই সন্তান। একটি গ্রামের জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে। আপনারা কি কখনও ভেবে দেখেছেন, এত বড় সম্মানের জন্য আমাদের গ্রামকে কেন বেছে নেওয়া হয়েছে। আচ্ছা আমিই বলছি, কারণ পিএপি নেতারা আমাদের এই গ্রামকে খুব পছন্দ করেন। মান্যবর মার্কাসকে আমরা ভোট দেই আর না দেই, পিএপি আবারও ক্ষমতায় আসবে। ভুলে যাবেন না, তারা কথা দিয়েছে, এবার আমাদের গ্রামে সাপ্লাইয়ের পানির ব্যবস্থা হবে। ’

রুফ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ বাদে জিনুয়ার ঘরে পাঁচজন বয়স্ক লোক ছিল। একটা ফাটা, কালিপড়া চিমনির হারিকেন ঘরে হলুদ আলো ছড়াচ্ছিল। প্রবীণ লোকগুলো বসে ছিল নিচু টুলে আর তাদের ঠিক সামনে মেঝেতে রাখা ছিল দুটো করে শিলিং। বন্ধ দরজার ওপারে উজ্জ্বল চাঁদটা তাকিয়ে ছিল জিনুয়ার বাড়ির দিকে।

জিনুয়া বললেন, ‘তুমি যা যা বললে, আমরা সেগুলোকে সত্য মানি। আমরা সবাই মার্কাসকেই ভোট দেব। মার্কাসকে বলো, সে আমাদের ভোট পেয়ে গেছে আর সাথে আমাদের বিবিদেরটাও। তবে যে কথা না বললেই নয়, দুই শিলিং খুবই লজ্জাজনক। ’ এই বলে জিনুয়া মেঝেতে রাখা শিলিং-এর কাছে হারিকেনটা এগিয়ে আনলেন। তিনি হয়ত আরেকটু নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন যে ওখানে আসলে দুই শিলিং-ই রাখা আছে। নিশ্চিত হয়ে তিনি আবারও বললেন, ‘হ্যাঁ, দুই শিলিং আসলেই লজ্জাজনক। মার্কাস যদি হতদরিদ্র হতো তাহলে আমরা তাকে গতবারের মত বিনামূল্যেই ভোট দিতাম। কিন্তু সে এখন অনেক বড় হয়েছে, তার চালচলনও বড় মানুষদের মত। আমরা আগে কখনও তার কাছে টাকা-পয়সা চাইনি, ভবিষ্যতেও চাইব না। কিন্তু আজকের দিনটা আমাদের। গাছে উঠে খালি হাতে নেমে আসা বোকামি নয় কি?’

রুফ জিনুয়ার সাথে একমত হলো। কারণ সেও গাছে উঠলে খালি হাতে নামে না। গতকাল সে মার্কাসের দামি একটা আলখাল্লা চেয়ে নিয়েছে। আর গত রোববার মার্কাসের ফ্রিজ থেকে সে যখন পঞ্চমবারের মত বিয়ারের বোতল নিতে যাচ্ছিল তখন মার্কাসের স্ত্রী চেঁচিয়ে উঠেছিল। তবে মার্কাস সবার সামনেই বউকে ধমক মেরেছিলেন। মার্কাস ইবি যে মহিলাকে বিয়ে করেছেন সে একসময় মিশন স্কুলে তার সহকর্মী ছিল। মূলত এই মহিলার কারণেই চাকরিটা তিনি হারাতে বসেছিলেন। সম্প্রতি রুফ একটা ভেজাল জমির মামলায় জিতে এসেছে। এর পেছনেও মার্কাসের হাত ছিল। এই কারণেই মুরুব্বিদের কথার অর্থ বুঝতে রুফকে বেগ পেতে হয়নি।

‘অল রাইট’—এটুকু ইংরেজিতে বলে রুফ ইবো ভাষায় বলল, ‘ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা উচিত না। ’ টুল থেকে উঠে গায়ের আলখাল্লাটা টেনে-টুনে ঠিক করে চটের ব্যাগে হাত ঢোকাল রুফ। তারপর যাজকের মত ঝুঁকে পড়ে প্রত্যেকের সামনে একটা করে শিলিং রাখল। তারপরও লোকগুলো হতাশায় মাথা ঝাকাল। রুফ আবারও উঠে আরও এক শিলিং করে মেঝেতে রাখল।

কিন্তু এরপরও লোকগুলো সাড়া-শব্দ করল না। এবার রুফ বলল, ‘এর চেয়ে বেশি হবে না। ’ অবশ্য বৃদ্ধ লোকগুলোও জানত মান-সম্মান বাঁচিয়ে কতদূর এগুতে হবে। তাই রুফ যখন বলল, ‘যান, ইচ্ছা হলে আমাদের শত্রুকেই ভোট দিন’—তখন তারা সুর নরম করে রুফকে শান্ত করল এবং মেঝে থেকে যার যার শিলিংগুলো তুলে নিল।

শত্রু বলতে রুফ প্রগ্রেসিভ অর্গানাইজেশন পার্টিকেই (পিওপি) বুঝিয়েছে। পিওপি উপকূলবর্তী আদিবাসীদের সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল। তাদের দাবি, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই তারা এই দল গঠন করেছে। ঘোষণাপত্রে দলের প্রতিষ্ঠাতারা দাবি করেছেন, ‘রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নিগ্রহের কবল থেকে নিজেদের রক্ষার জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ। ’ অবশ্য পিএপি’র মত দলের সাথে মাঠের লড়াইয়ে এই দলের যে কোনও খাওয়া নেই তা ছিল দিবালোকের মতই স্পষ্ট। গাড়ি আর মাইক দিয়ে গুটি কয়েক গ্রাম্য টাউট-বাটপারকে মাঠে নামিয়ে দিলেই তো আর ইলেকশনে জেতা যায় না। মাইক বাজিয়ে টাউট-বাটপারদের এরকম চেঁচামেচি আদর্শ বোকামির পর্যায়েই পড়ে। তবে ভোটে জিততে পিওপি কত টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছে সে বিষয়ে কারও সঠিক ধারণা ছিল না। যদিও অনেকেই বলে, ওদের বাজেট একেবারে খারাপ না। ভোট শেষে অন্তত টাউট কর্মীগুলো যে বড়লোকের খাতায় নাম লেখাবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

গত রাত পর্যন্ত সবকিছু পরিকল্পনা মাফিকই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই পিওপি’র কর্মীবাহিনীর নেতা রুফের সাথে দেখা করতে এলে সবকিছু বদলে যেতে শুরু করে। আগন্তুক রুফের পূর্বপরিচিত—বন্ধুর মত। তবে তাদের সাক্ষাৎপর্বটা ছিল নিরুত্তাপ, অনেকটা ব্যবসায়ীদের মত। কেউ কোনও বাড়তি কথা বলেনি। এক পাউন্ডের পাঁচটা নোট রুফের সামনে মেঝেতে রেখে আগন্তুক বলল, ‘তোমার ভোটটা আমরা চাই। ’ কোনও কথা না বলে চেয়ার থেকে উঠে রুফ দরজা বন্ধ করে দিল, তারপর আবারও চেয়ারে এসে বসল। প্রস্তাবটা ভেবে দেখার জন্য এটুকু সময়ই তার জন্য যথেষ্ট ছিল। কথা বলার সময় রুফের চোখ মেঝেতে থাকা চকচকে নোটগুলো থেকে একবারের জন্যও সরেনি। তার চোখে বারবার ভেসে উঠছিল নিজের একটি কোকো বাগান আর সেই বাগানে চাষীদের কাজ করার দৃশ্য। বোঝা যাচ্ছিল সে সম্মোহিত হয়ে গেছে।

ফিসফিস করে রুফ বলল, ‘তুমি তো জানো আমি মার্কাসের জন্য কাজ করছি। ব্যাপারটা খুব বাজে হবে যদি আমি...’
আগন্তুক বলল, ‘বাক্সে যখন ভোটটা ফেলবে তখন তো আর মার্কাস থাকবে না। আমাদের আরও অনেক কাজ আছে। ঝটপট বলে ফেল, এগুলো তুমি রাখবে না নিয়ে যাব?’
রুফ নিশ্চয়তা চেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এ ঘটনা কি আরও কেউ জানবে?’
আগন্তুকের জবাব ছিল, ‘আমরা ভোটের জন্য এসেছি, খোশগল্প করতে আসি নাই। ’
‘অল রাইট’—রুফ ইংরেজিতে বলল।

রুফের জবাব পেয়ে আগন্তুক তার সঙ্গীকে কনুই দিয়ে ঠেলা দিল। ইঙ্গিত পেয়ে দ্বিতীয় লোকটি লাল কাপড়ে মোড়ানো একটা মাটির পাত্র রুফের সামনে ধরল। ওটার মধ্যে একটা ইয়ি আছে—জিনিসটা ভীতিকরই বটে। সদ্যজাত মৃত সন্তানের আত্মাকে মোফিয়াবাসীরা ইয়ি বলে। তারা বিশ্বাস করে, আত্মা ধরে রাখলে সেটা আবার তার মায়ের গর্ভে ফেরত আসবে। এ আত্মা পবিত্র। লোকটি লাল কাপড়টা সরিয়ে দিল।

আগন্তুক বলল, ‘এটা বান্তার কাছ থেকে এনেছি। তুমি ভালো করেই জানো এর মানে কী। কসম খেয়ে বলো, তুমি মাদুকাকে ভোট দেবে। আর না দিলে এই ইয়ি তোমার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেবে। ’

ইয়িটা দেখামাত্র রুফের বুক ধরফর করে উঠল। কারণ মরা মানুষের আত্মা নিয়ে বান্তার কাজকর্ম সম্পর্কে তার পূর্বধারণা ছিল। তবে রুফ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে জানত। সে ভাবল, গোপনে মাদুকাকে একটা ভোট দিয়ে দিলে মার্কাসের তাতে কী-ই বা আসবে-যাবে? কিচ্ছু না।

‘আমি মাদুকাকেই ভোট দেব, না দিলে এই ইয়ি তার সাক্ষী থাকবে। ’
‘দ্যাস অল’—ভুল উচ্চারণে কথাটা বলেই আগন্তুক তার সঙ্গীকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল আর মাটির পাত্রটাকে আবারও লাল কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল।
লোক দুজন যখন তাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন রুফ দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘মার্কাসের বিরুদ্ধে মাদুকা জয়ী হতে পারবে না। ’
ওরা বলল, ‘এবারের ইলেকশনে কিছু ভোট পেলেই তার চলবে। পরেরবার সে আরও বেশি ভোট পাবে। কারণ মানুষ ততদিনে জেনে যাবে মাদুকা পাউন্ড দেয়, শিলিং না। ’

নির্বাচনের দিন ভোর বেলা। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এমনই একটা মহৎ দিনে জনতা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ পায়। বাড়িঘরের দেয়ালে, গাছের বাকলে আর টেলিগ্রাফের খুটিতে বিবর্ণ-ছিন্নভিন্ন পোস্টার শোভা পাচ্ছে। যে কয়টা এখনও অক্ষত আছে গুটি কয়েক পড়ালেখা জানা মানুষের জন্য সেগুলো এখনও প্রার্থীদের বার্তা বহন করে চলছে—পিপলস এলায়েন্স পার্টিকে ভোট দিন! প্রগ্রেসিভ অর্গানাইজেশন পার্টিকে ভোট দিন! পিএপি-কে ভোট দিন! পিওপি-কে ভোট দিন! আর যে পোস্টারগুলো ছেঁড়া ছিল, তা থেকেও মানুষ যতটুকু পারছিল পড়ার চেষ্টা করছিল।

নির্বাচনের দিনেও মান্যবর সর্দার মার্কাস ইবি তার স্বভাবসুলভ ঢঙে সব কাজ করছিলেন। একদিনের জন্য তিনি জনপ্রিয় একটা ব্যান্ড দলকে ভাড়া করেছেন। ভোট কেন্দ্র থেকে যতটা দূরে থাকলে আইন লঙ্ঘিত হবে না, ব্যান্ড দলটি ঠিক ততটাই দূরে থেকে গান-বাজনা চালিয়ে যাচ্ছে। ভোট দেওয়ার আগে গ্রামের অনেকেই ব্যান্ড সঙ্গীতের তালে তালে নেচে-গেয়ে হাতের ব্যালট পেপার উঁচু করে মার্কাসের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছিল। মান্যবর মার্কাস ইবি লম্বা সবুজ গাড়িতে তার ‘সংরক্ষিত’ আসনে বসে হাসিমুখে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছিলেন। একজন মুরুব্বি গোছের লোক তার দিকে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করে বললেন, কংগ্র্যাচুলেশন!’ আর তার দেখাদেখি বাকিরাও একই কাজ শুরু করে দিল। শত শত লোক একে একে তার সাথে হাত মিলাল আর ইংরেজিতে ‘কংগ্র্যাস’ বলে অগ্রিম অভিনন্দন জানাল। আর ওদিকে রুফ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা ভোটারদের বুদ্ধি-পরামর্শ আর মিষ্টি বিতরণ করতে করতে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছিল।

‘ভুলে যাবেন না...’—গ্রামের একদল অশিক্ষিত মহিলাদের উদ্দেশ্যে রুফ একথা বলা মাত্রই তারাও সমস্বরে বলে উঠল, ‘আমাদের মার্কা মোটর গাড়ি...। মার্কাস যে গাড়িটাতে বসে আছেন ওটাই আমাদের মার্কা। ’
রুফ বলল, ‘মা-জননীরা! শুকরিয়া, শুকরিয়া। ঠিক এই গাড়িটাই। যে বাক্সে এই গাড়ির ছবি দেখবেন সেটাই আপনাদের। মানুষের মাথাওয়ালা বাক্সটার দিকে ভুলেও তাকাবেন না। ওই বাক্সটা মাথাখারাপ লোকদের জন্য। ’
মহিলারা রুফের কথা শুনে হাসতে হাসতে ভোট কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে গেল। রুফ ব্যস্তভঙ্গিতে চট করে একবার মন্ত্রী মহোদয়ের দিকে তাকাল। মান্যবর মন্ত্রী মুচকি হেসে তাকে সাধুবাদ জানালেন।
রুফ আবারও চিৎকার করে বলল, ‘গাড়ি মার্কায় ভোট দিন। ’ রুফের গলার সবকটা রগ তখন স্পষ্টতই চোখে পড়ছিল।
রুফ বলল, ‘গাড়ি মার্কায় ভোট দিন। একদিন আপনারাও এই গাড়িতে চড়তে পারবেন। ’
রুফের কথা শেষ হতে না হতেই এক মহিলা বলে উঠল, ‘আর যদি তোমরা চড়তে না পার তাহলে তোমাদের ছেলে-পুলেরা চড়বে। ’
আর ওদিকে ব্যান্ড দল নতুন একটা গান ধরেছে, ‘যদি চড়তে পার গাড়িতে তবে হাঁটছো কেন মাটিতে...’

মান্যবর সর্দার মার্কাস ইবি দৃশ্যত শান্ত মেজাজেই বসে আছেন। জয়ের ব্যাপারে তার পূর্ণ আত্মবিশ্বাস আছে। তবে তিনি একজন ঝানু রাজনীতিবিদ। পত্রপত্রিকাগুলো তার ‘নিরঙ্কুশ’ বিজয়ের আভাস দিলেও একটি ভোটও যাতে হাতছাড়া না হয় সেদিকে তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। একারণেই ভোটারদের প্রথম দলটা ভোট দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসার পর তিনি তার কর্মীদের একে একে নিজের ভোটটা দিয়ে আসার হুকুম দিলেন।

মার্কাস বললেন, ‘রুফ, তুমিই আগে যাও। ’

রুফের চঞ্চলতা দপ করে থেমে গেল, বুক ধরফর করে উঠল। সে অবশ্য কাউকে বুঝতে দিল না। সকাল থেকেই ভেতরের কাপুনিটা সে আড়াল করে রেখেছে। এমন চালাকি এর আগে কখনও তাকে করতে হয়নি। মন্ত্রীর হুকুম পেয়ে রুফ তার স্বভাবসুলভ চঞ্চলতা দেখিয়ে ভোট কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে গেল। কেন্দ্রে ঢোকার আগে একজন পুলিশ তার দেহ তল্লাশি করল। ভেতরে যাওয়ার পর পোলিং অফিসার সামনে থাকা ব্যালটা বাক্স দুটি রুফকে দেখিয়ে দিলেন। রুফের চঞ্চলতা আবারও থেমে গেল। বেলট বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না ভোটটা কাকে দেবে—গাড়ি মার্কায়, না মাথা মার্কায়। পকেট থেকে ব্যালট পেপার বের করে রুফ বেশ কিছুক্ষণ ওটার দিকে তাকিয়ে রইল। মার্কাসের সাথে সে কিভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করবে—হোক না তা গোপনে! সে সিদ্ধান্ত নিল, পাউন্ডগুলো ফেরত দিয়ে দেবে... পাঁচ পাউন্ড! কম তো নয়। এতগুলো টাকা এখন কি আর ফেরত দেওয়া সম্ভব? তাছাড়া ইয়ি ছুঁয়ে সে কসম খেয়েছে। রুফের চোখে আবারও ভেসে উঠল চকচকে লাল পাউন্ড আর নিজের কোকো বাগানে চাষীদের কাজ করার দৃশ্য।

রুফ শুনতে পেল, পুলিশের লোকটা ফিঁসফিঁস করে পোলিং অফিসারকে বলছে, ‘ও বেটা ওখানে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কী করছে?’

বিদ্যুতের ঝলকের মত রুফের মগজে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ব্যালট পেপারটা সমান দুই ভাগে ভাঁজ করে সে ছিড়ে ফেলল। তারপর চট করে দুটো বাক্সে দু’ টুকরো ব্যালট পেপার ফেলে দিল। বাক্সে ব্যালট পেপার ফেলার আগে সে নিশ্চিত হয়ে নিল সঠিক অংশটা মাদুকার বাক্সে পড়ছে কিনা। তারপর রুফ শব্দ করে বলল, ‘আমি মাদুকাকে ভোট দিলাম। ’

পোলিং অফিসার নিয়মমাফিক রুফের হাতে অমোচনীয় কালি লাগিয়ে দিলেন যাতে দ্বিতীয়বার সে আর ভোট দিতে আসতে না পারে। হাতে কালি লাগিয়ে রুফ ঠিক সেভাবেই ভোট কেন্দ্র থেকে বের হয়ে গেল যেভাবে সে ঢুকেছিল—স্বভাবসুলভ চঞ্চল পায়ে।
___________________________________

চিনুয়া আচেবে: আফ্রিকান সাহিত্যের কিংবদন্তী, প্রয়াত ঔপন্যাসিক চিনুয়া আচেবের জন্ম ১৯৩০ সালে পূর্ব নাইজেরিয়ায়। তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় স্থানীয় একটি পাবলিক স্কুলে এবং তিনি দেশটির ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েটদের একজন। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর আচেবে নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন-এ রেডিও প্রোডিওসার হিসেবে যোগ দেন এবং পরে বহিঃসম্প্রচার বিভাগের পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। এ সময়েই তাঁর লেখক জীবনের শুরু।

আচেবের প্রথম উপন্যাস The Things Fall Apart ১৯৫৮ সালে, No Longer at Ease ১৯৬০ সালে, Arrow of God ১৯৬৪ সালে, A Man of the people ১৯৬৬ সালে এবং Anthills of Savannah প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। চিনুয়া আচেবে ছিলেন সাহিত্য ম্যাগাজিন Okike’র সম্পাদক এবং The Heinemann Series on African Literature এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্জন করেন পঁচিশটি সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি। আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের জনক বলে খ্যাত চিনুয়া আচেবে তার The Things Fall Apart উপন্যাস ও সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০০৭ সালে ভূষিত হন Booker International Prize-এ। চিনুয়া আচেবের মুত্যুবরণ করেন ২০১৩ সালের ২১ মার্চ।



বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০১৫
টিকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।