ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বিষবৃক্ষ উপন্যাসের ক্যানভাস এবং বঙ্কিমের সমাজভাবনা | ফজলুল হক সৈকত

বিশেষ রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১৫
বিষবৃক্ষ উপন্যাসের ক্যানভাস এবং বঙ্কিমের সমাজভাবনা | ফজলুল হক সৈকত

ভারতবর্ষে সাহিত্যশিল্পচর্চায় সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় যাঁরা বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জন্ম: ২৬ জুন ১৮৩৮; মৃত্যু: ৮ এপ্রিল ১৮৯৪) অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। বাঙালির ঘরে বঙ্কিমের আবির্ভাব কেবল বাংলার জন্য নয়, পুরো ভারতের জন্যই একটা শুভসূচনা বলে চিহ্নিত হয়ে আছে।

তাঁর জাতীয়তাবোধ আজও আমাদেরকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পথ-নির্দেশ দিয়ে চলেছে। জাতির মেরুদণ্ড সোজা রাখতে তাঁর মত প্রাণপুরুষের প্রয়োজন আজ বড় বেশি টের পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমই প্রথম ‘সোশিয়ালিস্ট’, ‘কম্যুনিস্ট’, ‘কম্যুনিজম’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল’ প্রভৃতি শব্দ বাংলা রচনায় প্রয়োগ করেন; এবং এই শব্দগুলোর তাৎপর্যও যথাসম্ভব নিজের মত করে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর ‘সাম্য’ সমাজতান্ত্রিক মতবাদ-বিষয়ক বাংলাভাষায় প্রকাশিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। এখানে তিনি সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণগত, দেশগত ও জাতিগত বৈষম্যের অনিষ্টকারিতা ও অন্যায্যতা সম্বন্ধে আলোকপাত করেছেন। দেখেছেন সমাজের শ্রেণিগত বৈষম্যের ভয়াবহ রূপ। পাঠককে জানাচ্ছেন তিনি সে কথা: ‘সর্বাপেক্ষা অর্থগত (টাকা-পয়সানির্ভর) বৈষম্য গুরুতর। তাহার ফলে কোথাও দুই একজন লোক টাকার খরচ খুঁজিয়া পায়েন না—কিন্তু লক্ষ লোক অন্নাভাবে উৎকট রোগগ্রস্ত হইতেছে। সমাজের উন্নতিবোধ বা অবনতির যে সকল কারণ আছে, অপ্রাকৃতিক বৈষম্যের আধিক্যই তাহার প্রধান। ভারতবর্ষের যে এতদিন হইতে এত দুর্দশা, সামাজিক বৈষম্যের আধিক্যই তাহার বিশিষ্ট কারণ। ’—এই বোধ ও চিন্তার সূত্র ধরেই বঙ্কিমের সাহিত্যে প্রবেশ করেছে সামাজিক কাঠামোর চালচিত্র ও সত্যাসত্য। কাজেই তিনি ঐতিহাসিক ধারার উপাখ্যান লেখার পাশাপাশি বিষবৃক্ষ (১৮৭৩) প্রভৃতি সামাজিক ধারার উপন্যাসও লিখে ফেলেছেন খুব সহজে।

বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক কালজয়ী প্রতিভার নাম। বাংলা উপন্যাস সৃজনে তিনি যে অক্ষয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তা যুগে যুগে নানানভাবে আলোচিত-সমালোচিত, নিন্দিত ও নন্দিত। উপন্যাস রচনা করে বঙ্কিম সৃষ্টি করেছেন একটি যুগ, যাকে বলা যায় ‘বঙ্কিম যুগ’। তাঁর উপন্যাসগুলোর রচনাশৈলী বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় একটি বিশেষ স্টাইল, যাকে বলে ‘বঙ্কিম স্টাইল’। অর্থাৎ বাংলাসাহিত্যে বঙ্কিম একটি বিশেষ প্রবাহের নাম। একটি ধারাসৃষ্টিকারি শিল্পীর প্রতিকৃতি। তাঁর কিছু উপন্যাস ও গল্প ভারতের বিভিন্ন ভাষায় এবং ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ হওয়ায় তিনি সর্বভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্যমহলে পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেছেন। উনিশশতকে বাঙালি শিক্ষিত সমাজকে সচেতন করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর যথাসাধ্য প্রচেষ্টা অবশ্য-অনুসরণীয়। তিনি ইউরোপীয় ভাবধারায় ভারতীয় মেজাজে সমাজের গতি-প্রকৃতির অবস্থা বিবরণের সতর্ক শিল্পী। তবে, ইতিহাসের বস্তুবাদী জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তিনি ভাববাদেই বেশি নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। আর সে কারণেই অবিরাম শ্রেণি-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যে ইতিহাসের পাতায় সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব ও বিকাশ সে কথার সহজ অনুধাবনের প্রতিফলন তাঁর সাহিত্যে তেমন একটা মেলে না। তারপরও সামাজিক স্তরবিন্যাস ও সংকট উপস্থাপনে তিনি সাবধানী লেখক।

বঙ্কিম তাঁর সমকালের সমাজপ্রগতির ছবি আঁকতে গিয়ে ভাবের চেয়ে রূপকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। আর উপস্থাপনভঙ্গিতে ছিল কবিত্ব। বিশেষ করে নারীর রূপের মোহ জাগানিয়া শক্তির প্রকাশে তাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই। নারীর রূপের মহিমার পাশাপাশি এঁকেছেন পুরুষের সৌর্ন্দতৃষ্ণা। নরনারীর প্রেম, নারীর রূপের মোহে আচ্ছন্ন পুরুষের করুণ পরিণতি, বিধবা-প্রসঙ্গ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব-বিবাদ এবং সমকালীন সামাজিকতার বিচারে তাঁর বিষবৃক্ষ কালোত্তীর্ণ উপন্যাস। শিল্পের বিচারে উপন্যাসটি খুবই উঁচু মাপের হলেও সামাজিক বিষয়াদি পরিবেশনে রক্ষণশীলতার দায় এড়াতে পারেনি। সূর্যমুখীর স্বামীভক্তিকে এত বেশি রঙ চড়িয়ে আঁকা হয়েছে যে, তা সাধারণ পাঠকের চোখে অবিশ্বাস্য বলে ঠেকে। আবার সূর্যমুখীর মুখ দিয়ে বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে মত প্রকাশের মধ্য দিয়ে লেখক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর হিন্দুয়ানির প্রতিক্রিয়াশীলতাকেই তুলে ধরেছেন বলে অনেকের ধারণা। বিদ্যাসাগরের সমাজ-সংস্কারের মূল ধারায় বঙ্কিম প্রবেশ করতে পারেননি কেবল সনাতন ধর্মের কায়েমি স্বার্থের কাছে মনে মনে হার মেনেছিলেন বলে। তবে তিনি আধুনিক বাঙালির চিন্তা ও কল্পনা, উদ্যম ও উন্নত আশার পূর্ণ বিকাশভূমি। উনিশশতকে ভারতে জ্ঞান ও বাণিজ্যের উৎকর্ষের সময় ব্যক্তিগত প্রতিভা ও শক্তিকে অবলম্বন করে সামনে এগোবার যে পথ তৈরি হচ্ছিল, তার বারতাবাহক এই সমাজশিল্পী বঙ্কিমচন্দ্র। ভারতবাসীকে আধুনিকতার বারান্দায় হাজির করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মনের শক্তি, চিন্তার স্পর্ধা, জাতীয়তাবোধ আর ধর্মাচারের প্রতি নিমগ্নতায় সেদিনের অগ্রগমণের ইতিহাস সৃষ্টিতে সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্রের যে অবদান, তা আজও উজ্জ্বল আলোর প্রভায় সুচিহ্নিত। তাঁর প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে সক্রেটিসের জীবনদর্শন, নেপোলিয়নের বীরত্ব ও ফরাসি-বিপ্লব।

বিষবৃক্ষ গ্রন্থে বাল্য-বিধবা নারীর প্রেম এবং বিয়েকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেবার একটা সাহিত্যিক প্রচেষ্টা আছে। নারীর হৃদয়ের স্বাভাবিক আবেগ-ভালোবাসা, পুরুষের প্রতি আকর্ষণ প্রভৃতির পাশাপাশি নারীর প্রতি পুরুষের আকষর্ণ-বিকর্ষণের কাহিনীও চিত্রিত হয়েছে। সাংসারিক সুখ-দুঃখ এবং পাওয়া-না-পাওয়ার শান্তি ও যাতনার কথামালাও প্রকাশ পেয়েছে সমকালীন প্রয়োজনের পাটাতনে। সমকালের সতর্ক শিল্পী বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও মননশীলতা প্রসারিত রেখেছিলেন মানুষ ও সমাজের ভেতরবাড়িতে। বিষবৃক্ষও তাঁর ওই অভিনিবেশে আত্মপ্রতিফলনের গল্পমাত্র। নগেন্দ্র-সূর্যমুখী-কুন্দনন্দিনী—এই তিনজনকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে মূল কাহিনী। ক্যানভাসে প্রবেশ করেছে হীরা-দেবেন্দ্র-হরিদাসী বৈষ্ণবী (ছদ্মবেশী দেবেন্দ্র দত্ত)-কমলমণি-তারাচরণ প্রভৃতি কিছু দরকারি চরিত্রও। বঙ্কিমের সৃষ্ট সূর্যমুখী গরীয়সী। সে ‘সম্বন্ধে স্ত্রী, সৌহার্দ্যে ভ্রাতা, যত্নে ভগিনী, আপ্যায়িত করিতে কুটুম্বিনী, স্নেহে মাতা, ভক্তিতে কন্যা, প্রমোদে বন্ধু, পরামর্শে শিক্ষক, পরিচর্যায় দাসী। ’ স্বামীগতপ্রাণা এই রমণী নগেন্দ্রর বোন কমলমণিকে একবার চিঠিতে লিখেছিল: ‘পৃথিবীতে যদি আমার কোনও সুখ থাকে, তবে সে স্বামী; পৃথিবীতে যদি আমার কোনও চিন্তা থাকে, তবে সে স্বামী; পৃথিবীতে যদি আমার কোনও কিছু সম্পত্তি থাকে, তবে সে স্বামী; সে স্বামী কুন্দনন্দিনী আমার হৃদয় হইতে কাড়িয়া লইতেছে। পৃথিবীতে যদি আমার কোনও অভিলাষ থাকে, তবে সে স্বামীর স্নেহ। সেই স্নেহে কুন্দনন্দিনী আমাকে বঞ্চিত করিতেছে। ’ বঙ্কিমের কুন্দনন্দিনী দুঃখিনী। তার হৃদয়ের কাতরতা পাঠকের মনে করুণা জাগায়। নগেন্দ্রনাথের ভালোবাসার তীক্ষ্ণ আলোকে চোখ মেলতে সাহস হতো না তার। কুন্দ যেন নগেন্দ্রের প্রতি আকর্ষণে বিলীন। বালিকা বয়সে বিধবা হওয়া মেয়েটি এই পুরুষটিকে ভালোবেসেছে—তাকে বিয়ে করার বাসনা থেকে নয়, শুধু ভালোবাসবার জন্য। তাই তো নগেন্দ্র যখন জানতে চাইল সে তার ঘরণী হতে চায় কি-না, তখন কুন্দ নিরাবেগকণ্ঠে বলেছে—‘না’। কিন্তু কুন্দর মনের অন্তরালের কথা জানেন তার অন্তর্যামি আর তার স্রষ্টা বঙ্কিম। লেখক বলছেন: ‘বিধবার বিয়ে শাস্ত্রে আছে। তাহার জন্য নয়। তবে কুন্দ ডুবিয়া মরিল না কেন? স্বচ্ছ বারি—শীতল জল—নীচে নক্ষত্র নাচিতেছে—কুন্দ ডুবিয়া মরিল না কেন?’—তাই তো কেন?! নগেন্দ্রের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকাতেই যেন তার সকল সুখ। সূর্যমুখীকে সে কখনও হিংসা করেনি; নগেন্দ্রর কাছ থেকে তাকে দূরে সরাতেও চায়নি। কুন্দের এই নীরব চাহনিই নগেন্দ্রকে সংসার-সম্পত্তি-সম্ভ্রম থেকে এক গভীর শূন্যে নিয়ে গেছে। নগেন্দ্র-সূর্যমুখীর গৃহকে শ্মশানে পরিণত করেছে। লক্ষ্মী সূর্যমুখী ছাড়া নগেন্দ্রের ঘরে আর আনন্দ কিসে! কিন্তু এই সাংসারিক অশান্তির জন্য কি কেবল কুন্দ দায়ী। কেন, নগেন্দ্র কি তাকে আশা-ভরসা, সান্ত্বনা-মন্ত্রণা দিয়া সুখ নষ্ট করার পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করেনি? স্বামী তারাচরণের মৃত্যর পর বিধবা কুন্দকে বাড়িতে স্থান দিয়েও তো নগেন্দ্র-সূর্যমুখী একটা পথ খুলে দিয়েছে। অনাধ কুন্দের প্রতি বরাবরই এই দম্পতির একটা বিশেষ স্নেহ ছিল। তবে নগেন্দ্র কুন্দের রূপে ভোলেনি; তার জন্য সূর্যমুখীকেও দূরে ঠেলে দেয়নি। সূর্যমুখী তো যে কোনওভাবে সংসারের-স্বামীর সুখ চেয়েছে। একবার সে নগেন্দ্রকে চিঠিতে লিখেছিল যে, যদি কুন্দকে বিয়ে করতে তার কোনও ইচ্ছে থাকে, তাহলে সে সবকিছুর আয়োজন করবে। কিন্তু তখন কি জানত যে, এই রসিকতাটাই ৪/৫ বছরের মধ্যে তার জীবনে সত্য হয়ে দেখা দেবে? তাহলে শান্তির সংসারের সুবাতাসে সঙ্কট ঢোকানোর দায়টা কার?

উপন্যাসের ক্যানভাসে মনোযোগী চোখ রাখলে দেখা যায়, সংসারের এই যে শান্তিহরণ—এর জন্য বঙ্কিম বিধাতার সাজিয়ে রাখা নিয়তিকেই দায়ী করতে চান। ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপীয়রের নাটকে যেমন আমরা নায়কের নিয়তিতাড়িত দুর্ভাগ্যকে অবলোকন করি, তেমনি নগেন্দ্রের জীবনেও নিয়তির অমোঘ বিধান সরাসরি কার্যকর হয়েছে। এখানে ব্যক্তির আচরণের ভুল-ত্রুটি কোনও কার্যকারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। তবে কাহিনীকার সতর্কভাবে নগেন্দ্রের চরিত্রে নায়োকোচিত আবেগ ও দুর্বলতা যোগ করেছেন। কিন্তু নায়কের আবেগ ও দুর্বলতাকে ঢেকে দিয়েছে বিধাতার অবোধ্য শাসন; যেখানে মানুষের কোনও হাত নেই। নগেন্দ্র সংসারের চোখে, সমাজের চোখে পতিত পুরুষ নয়। মানে-জ্ঞানে সে অনুকরণীয়। বঙ্কিম জানাচ্ছেন নগেন্দ্র সম্বন্ধে: ‘নগেন্দ্রনাথ মহাধনবান ব্যক্তি, জমিদার। তাঁহার বাসস্থান গোবিন্দপুর। যে জেলায় সেই গ্রাম, তাহার নাম গোপন রাখিয়া, হরিপুর বলিয়া তাহার বর্ণন করিব। নগেন্দ্র বাবু যুবা পুরুষ, বয়ঃক্রম ত্রিংশৎ বর্ষমাত্র। ’ অবশ্য এই অভিজাত যুবক একসময় কুন্দের প্রতি নিমগ্ন হয়ে সে মদে আসক্ত হয়ে পড়ে। কুন্দর জন্য সে ঘর পর্যন্ত ছাড়তে উদ্যত হয়। বঙ্কিম বাবু অবশ্য নিয়তির টান প্রয়োগ করে অবশেষে কুন্দকে নগেন্দ্রের সামনে হাজির করেছেন। কার্যকারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন, সূর্যকে বেহালদশা থেকে বাঁচাবার জন্য বিধাতা স্বয়ং তাকে সহযোগিতা করছেন। সংসারে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সূর্যের আত্মত্যাগ প্রভৃতিকে লেখক নিয়তিবাদের ঘেরাটোপে আটকে দিয়েছেন সাহিত্যিক কৌশল প্রয়োগ করে। নগেন্দ্রের দায় বা দোষকে এখানে সামান্য বিষয় করে তোলা হয়েছে। পুরুষের প্রতি বর্তমান লেখকের কোনও বিশেষ পক্ষপাত ছিল কি-না, সে বিষয়েও খানিকটা প্রশ্নের অবতারণার সুযোগ থেকে যায় বটে!

কাহিনীর প্রায় শেষপ্রান্তে আমরা নগেন্দ্রকে বিরহকাতর হতে দেখি। সূর্যমুখীর জন্য সে জন্মভূমি ত্যাগ করে বৈরাগী হতেও প্রস্তুত। গৃহধর্ম প্রভৃতিতে তার অনীহা জন্মে। সূর্যের স্মৃতিতে কাতর হয়ে ওঠে নগেন্দ্র। ঘরের দেয়ালে ও বাতাসে সে দেখতে পায় সূর্যমুখীর ছায়া ও মমতা। সূর্য একদা ঘরের দেয়ালে লিখেছিল:
১৯১০ সম্বৎসরে
ইষ্টদেবতা
স্বামীর স্থাপনা জন্য
এই মন্দির
তাঁহার দাসী সূর্যমুখী
কর্তৃক
প্রতিষ্ঠিত হইল।

এই গৃহমন্দিরের শান্তিহরণের জন্য নিজেকে দায়ী মনে করেছে নগেন্দ্র। তার জন্য সে যারপরনাই কষ্টও ভোগ করেছে মানসিক ও সামাজিকভাবে। অতঃপর বিধাতা কী যেন ভেবে অথবা কাহিনীতে সাংসারিক শান্তিপ্রতিষ্ঠার জন্য বোধহয় লেখক বঙ্কিম এক যাতনার রাতে নগেন্দ্রের শিয়রের পাশে সূর্যমুখীকে হাজির করলেন। এবং সকল প্রায়শ্চিত্তের ভার অর্পণ করলেন অনাথিনী কুন্দের ওপর। এই তো সমাজের বিচার! কুন্দকে বিষপানে আত্মহত্মার পথে পাঠিয়েই যেন লেখকের শান্তি! সমাজের কল্যাণ! ভুলের মাশুল! আর পাঠকের জন্য রাখা হলো কুন্দের আবেগভরা কণ্ঠের আকুতি। মরতে বসে কুন্দ প্রাণপ্রিয় স্বামী নগেন্দ্রকে বলছে: ‘তোমাকে দেখিয়া মরিবার ইচ্ছা ছিল, সে সাধ পূর্ণ হইল, কিন্তু তোমাকে দেখিলে মরিতে আর ইচ্ছা হয় না। ’ বঙ্কিম কি তাহলে বিধবার প্রেম ও বিয়ের সামাজিক পরিণতি হিসেবে এই শাস্তির কথা জানাতে চেয়েছেন? না কি তিনি বিধবার মানবিক আর্তি ও হৃদয়ের আবেগকে প্রকাশ করতে গিয়ে সামাজিক কোনও চাপের মধ্যে পড়েছিলেন? শেষ পর্যন্তকি তিনি তাহলে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সাহিত্যিক-পরাজয়ের শিকার হলেন?

কুন্দের প্রথম স্বামী তারাচরণ ছিল স্কুলের মাস্টার। সূর্যমুখীর উৎসাহে নগেন্দ্রনাথ এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করে। তারাচরণ সূর্যমুখীর শৈশবে সেবাদানকারী দাসী শ্রীমতির পুত্র; তার সমবয়সী এবং বাল্যকালে খেলার সাথীও বটে। তারাচরণ মুক্তচিন্তার অধিকারী, লালনকারী এবং স্ত্রী-স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চারকণ্ঠ। সবসময় সে সমাজের মুক্তির কথা প্রচার করত। বলত, ‘তোমরা ইট-পাটখেলের পূজা ছাড়ো, খুড়ি জ্যেঠাইমার বিবাহ দাও, মেয়েদের লেখাপড়া শিখাও, তাহাদের পিজরায় পুরিয়া রাখ কেন? মেয়েদের বাহির কর। ’ এই তারাচরণের সাথে সূর্যমুখী-নগেন্দ্র কুন্দর বিয়ে দিয়েছিল। তিনবছর সংসার করার পর জ্বরে তারাচরণের মৃত্যু হলে নগেন্দ্রের বাড়িতে কুন্দ স্থান পায়। লেখক বলছেন যে, কুন্দকে বাড়িতে জায়গা করে দেওয়ার মধ্যদিয়ে মূল কাহিনীর সূত্রপাত; এবং মূলত তখনই বিষবৃক্ষের বীজ বপন হলো।

প্রেম-ভালোবাসা ফলত কলঙ্ক—এই হলো সমাজের নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সমাচারের ভেতরের কথা। বঙ্কিম সেই কথাটি ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে পরিবেশন করেছেন হরিদাসী বৈষ্ণবীর কথায়:
কাঁটা বনে তুলতে গেলাম কলঙ্কের ফুল,
গো সখি কাল কলঙ্কেরি ফুল।
মাথায় পর্লেম মালা গেঁথে, কানে পর্লেম দুল।
সখি কলঙ্কেরি ফুল। ...
মরি মরব কাঁটা ফুটে,
ফুলের মধু খাব লুটে,
খুঁজে বেড়াই কোথায় ফুটে,
নবীন মুকুল।

৫০টি পরিচ্ছেদে বিভাজিত এই উপন্যাসটির ২৯তম পরিচ্ছেদের উপশিরোনাম ‘বিষবৃক্ষ কী?’ লেখক এখানে জানাচ্ছেন, ‘যে বিষবৃক্ষের বীজ বপন হইতে ফলোৎপত্তি এবং ফলভোগ পর্য্যন্তব্যাখ্যানে আমরা প্রবৃত্ত হইয়াছি, তাহা সকলেরই গৃহপ্রাঙ্গণে রোপিত আছে। রিপুর প্রাবল্য ইহার বীজ; ঘটনাধীনে তাহা সকল ক্ষেত্রে উপ্ত হইয়া থাকে। কেহই এমন মনুষ্য নাই যে, তাঁহার চিত্ত রাগদ্বেষকাম-ক্রোধাদির অস্পৃশ্য। জ্ঞানী ব্যক্তিরাও ঘটনাধীনে সেইসকল রিপুকর্তৃক বিচলিত হইয়া থাকেন। কিন্তু মনুষ্যে মনুষ্যে প্রভেদ এই যে, কেহ আপন উচ্ছলিত মনোবৃত্তি সকল সংযত করিতে পারেন এবং সংযত করিয়া থাকেন, সেই ব্যক্তি মহাত্মা; কেহ বা আপন চিত্ত সংযত করে না, তাহারই জন্য বিষবৃক্ষের বীজ উপ্ত হয়। চিত্ত সংযমের অভাবই ইহার অঙ্কুর, তাহাতেই এ বৃক্ষের বৃদ্ধি। এই বৃক্ষ মহাতেজস্বী; একবার ইহার পুষ্টি হইলে, আর নাশ নাই। এবং ইহার শোভা অতিশয় নয়নপ্রীতিকর; দূর হইতে ইহার বিবিধবর্ণ পল্লব ও সমুৎফুল্ল মুকুলদাম দেখিতে অতি রমণীয়। কিন্তু ইহার ফল বিষময়; যে খায়, সেই মরে। ’

এবং লেখক উপন্যাসটি শেষ করছেন যে অনুচ্ছেদে, তাতে দুটি বাক্য, ‘আমরা বিষবৃক্ষ সমাপ্ত করিলাম। ভরসা করি, ইহাতে গৃহে গৃহে অমৃত ফলিবে। ’

মানুষের রিপু বা প্রবৃত্তির সংযম সাধনার প্রতি লেখকের বিশেষ ঝোঁকটি আমাদের নজরে আসে। সংসারের শান্তিপ্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সকলকে কামনা-বাসনার যথেচ্ছাচার পরিহার করার পরামর্শই প্রদান করেছেন বটে। বিধবার অধিকার ও জীবনের স্বাদগ্রহণের বাসনা এবং সর্বোপরি নারীর মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পাপাচারের শাস্তিরও বিপক্ষে ছিলেন না। কুন্দর মৃত্যুকে বাদ দিলে পুরো কাহিনীতে নারীমুক্তির অনেক বারতার গন্ধ লেগে আছে—আমরা দেখতে পাই। প্রকৃতঅর্থে পর্যবেক্ষণশীল এক গভীর জীবনদর্শন এই উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে।

সংসারে বিষবৃক্ষ রোপণ করতে গিয়ে কথানির্মাতা বঙ্কিমচন্দ্র তাহলে পাঠকের সামনে কী বিষয়বস্তু পরিবেশন করলেন? তিনি কি শেষঅবধি ট্র্যাজেডিই নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন? নাকি প্রেমের ও প্রাপ্তির কথা বলতে গিয়ে পথ পাল্টে কষ্টের কাহিনী বানিয়ে ফেলেছেন। মাইকেল যেমন তাঁর মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্য (প্রকাশকাল: ১৮৬১) লিখতে আরম্ভ করে বলেছিলেন, ‘গাইব মা বীররসে ভাসি মহাগীত’; কিন্তু শেষত তিনি কাহিনীর পরিসমাপ্তি টানলেন করুণ রস দিয়ে! এটাই কি উনিশ শতকের সাহিত্যের ও শিল্পের মূল সুর? লেখক ও শিল্পীরা যে-কথা বলতে চেয়েছেন, তা আর শেষপর্যন্ত বলতে পারেননি! ভারতীয় ভীরুতা ও আবেগে কি সব পরিকল্পনা, প্রতিবাদ ও প্রতিশ্রুতি বিলীন হয়ে গেছে? আর বঙ্কিমও বোধকরি ওই অসহায়তার শিকার। অধিকার আর মুক্তিভাবনার কথা বলতে গিয়ে শেষপর্যন্ত সমাজের চাপে সে অভিলাষ থেকে মন সরিয়ে নিতে হয়েছে বোধকরি। এখানেই লেখকের ট্র্যাজেডি। বর্তমান কাহিনীটি মূলত বিশেষ কোনও পর্যবেক্ষণের ধারাবাহিক বর্ণনামাত্র! প্রবৃত্তির লোভ পরিহার করে যে শান্তিময় জীবন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব—সে কথাই বঙ্কিম ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলতে চান।



বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১৫
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।