ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নিউইয়র্কে ঐতিহ্যের হালখাতা | ফকির ইলিয়াস

বৈশাখের আয়োজন / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫
নিউইয়র্কে ঐতিহ্যের হালখাতা | ফকির ইলিয়াস ছবি. লেখক

এপ্রিল মাসের শুরুতেই উত্তর আমেরিকা মেতে ওঠে বাংলা নববর্ষ উৎসব উদযাপনে। এখানে ‘শুভ হালখাতা মহরত’ নেই যদিও, তারপরও বাঙালি মালিকানাধীন বিপনি-বিতানগুলোতে মিষ্টি মুখের রেওয়াজ চালু হয়েছে বেশ আগে থেকেই।

নতুন একটা পর্ব যোগ করেছে আনন্দ-মাত্রা। আর তা হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজনে ‘পিঠা উৎসব’।

যুক্তরাষ্ট্রে এবার একটি দীর্ঘ শীতকাল কাটল। শীতকে বিদায় জানিয়ে বসন্তের রঙে রাঙাতে নানা আয়োজনে নিউইয়র্কে প্রথম পিঠা ও বসন্ত উৎসব পালিত হয়েছে মার্চের শেষ সপ্তাহে। কুইন্সের এস্টোরিয়ায় সাউন্ড ভিউ অডিটোরিয়ামে আয়োজন করা হয় আইপিটিভি-আরসিএন ক্যাবল পিঠা মেলা ও লোকজ উৎসব।

সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় রোববার অনেক বেশি ক্রেতা-দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে এ মেলায়। সকাল থেকেই নিউইয়র্ক, নিউজার্সিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মেলা প্রাঙ্গণে ছুটে আসেন প্রবাসীরা। বাংলাদেশী-আমেরিকান নতুন পুরাতন প্রজন্মের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও কমিউনিটি এক্টিভিটসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রবাসীদের আনাগোনাও ছিল চোখে পড়ার মত।

অন্যান্য বছরের মত এবারও নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হলো ‘বাংলার পিঠা উৎসব’। প্রবাসে বাঙালি ঐতিহ্যকে ধরে রাখার অঙ্গিকার নিয়ে উডসাইডের কুইন্স প্যালেসে অনুষ্ঠিত উক্ত পিঠা উৎসবে নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশীদের উপচে পড়া ভিড় জমে যায়। দিনব্যাপী এ উৎসবে ছিল রকমারি বাহারি পিঠার পাশাপাশি দেশিয় পোশাক আর মনোহরীর নানা দোকান।

এবছর আরও একটি বড় আয়োজন করছে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশি বিজনেস এসোসিয়েশন-জেবিবিএ। ১২ এপ্রিল ২০১৫ রোববার উডসাইডের কুইন্স প্যালেসে বর্ণাঢ্য আয়োজনে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। দিনব্যাপী এ উৎসবে থাকবে পিঠা মেলা, নাচ, গান, আবৃত্তিসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক আয়োজন। পিঠা ছাড়াও উৎসবে থাকবে বিভিন্ন রকমের খাবার-দাবার, পান্তা-ইলিশ, পোশাক ও অলঙ্কারের স্টল।

নিউইয়র্কে, বাংলা নববর্ষ উদযাপনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পারফর্মিং আর্টস (বিপা)। গেল বছর বৈশাখ বরণে বিপা প্রবাসে নতুনত্ব এনেছিল তাদের আয়োজনে।



উত্তর আমেরিকার অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পারফর্মিং আর্টস বিপা’র আয়োজনে গত বছরের বৈশাখি উৎসবের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হিসেবে চিত্রাঙ্কন কর্মশালায় শিশুকিশোরদের মুখোশ বানাবার প্রতিযোগিতা ছিল বেশ নান্দনিক। মনোরম আবহাওয়ায় উম্মুক্ত আকাশের নিচে সেদিনের কর্মশালাটি বাংলাদেশের চারুকলা অনুষদ আয়োজিত বৈশাখি উৎসবের মতই মনে হয়েছিল প্রবাসীদের কাছে।

নিউইয়র্কের পিএস ১১২’র চত্বর ঘেরা লোহার প্রাচীর ঢেকে দেওয়া হয়েছিল বাংলা স্লোগান লেখা বর্ণাঢ্য সব ব্যানারে। এর সামনেই পরিচালক জিল রেইনিয়ার বিভিন্ন বিভাগের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব উপকরণ সরবরাহ করেন। বিকেল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত এই কর্মশালায় প্রতিযোগীদের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ছিল কে.জি থেকে দ্বিতীয় গ্রেডের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাঘের মুখ, তৃতীয় থেকে পঞ্চম গ্রেডের জন্য পেঁচার মুখ, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম গ্রেডের জন্য সিংহের মুখ ও নবম থেকে দ্বাদশ গ্রেডের জন্য ছিল ময়ূরের অবয়ব। পথচারি আমেরিকানরা যখন সেদৃশ্য দেখছিল—তা মনে করিয়ে দিচ্ছিল বাংলাদেশের লোকজ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে।

নিউইয়র্কে আরেকটি সংগঠন পয়লা বৈশাখ পালনে সাহসী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে—‘উদীচী, যুক্তরাষ্ট্র। ’ দুবছর আগে উদীচীর এই আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।



অত্যন্ত প্রাণবন্ত সেই অনুষ্ঠানে উদীচীর সংগীত বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা ‘আলো আমার আলো ওগো, আয় তবে সহচরী, আকাশভরা সূর্যতারা অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে, আমার গহীন গাঙের নাইয়া প্রভৃতি গান গেয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন সংগীত শিক্ষক শফি চৌধুরী হারুন। জীবন বিশ্বাসের পরিচালনায় উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী পরিবেশন করেছিল ‘আবার এসেছে বৈশাখ, ধান নদী ভরা দেশ, ভাসাইয়া দে রে নোঙর তুইলা দে’—প্রভৃতি গানের বহর।

বিপা ও উদীচী এবছরও মহা সমারোহে বাংলা নববর্ষ পালন করছে। নিউইয়র্কে এখন বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন, বাংলাদেশ কনস্যুলেট, বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউইয়র্ক, জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকা, চট্টগ্রাম সমিতি সহ প্রায় প্রতিটি সংগঠনই একক অথবা যৌথভাবে বাংলা নববর্ষ পালন করে।

যে বিষয়টি হালে চোখে পড়ার মত, তা হলো—বাঙালির এই প্রাণের উৎসবে এখন ছোবল দিতে চাইছে কিছু কর্পোরেট মিডিয়া কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ‘বানিজ্যই নিয়ন্ত্রণ করবে সংস্কৃতি’—এমন একটি থিম-তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে কেউ কেউ। এদের কারও কারও বিরুদ্ধে বাণিজ্য মেলার নামে ‘আদম আমদানি’র অভিযোগও উঠছে। ফলে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কাছে বাংলাদেশ, বাঙালি জাতির কৃষ্টি-সভ্যতা-ঐতিহ্যের আবেদন কিছুটা হলেও ম্লান হচ্ছে। যা খুবই দুঃখজনক।

বলা হচ্ছে, শুধুমাত্র নিউইয়র্ক নগরীতেই প্রায় সোয়া লক্ষ বাংলাদেশির বসবাস। তাই আয়োজন, পার্বণ, উৎসব লেগে থাকে প্রায় প্রতি উইকএন্ডেই। ঘরে ঘরে পিঠা উৎসব হয় পারিবারিক আয়োজনে। অভিবাসী জীবনে এই যে শিকড়ের হালখাতার মহরত, তা শাণিত করছে উত্তর প্রজন্মকে।

বাঙালির জীবনে পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতে ব্যাপক তা অনুধাবন করার জন্যই প্রবাসেও চলে নানা আয়োজন। প্রায় পাঁচশতাধিক বছর যাবত দিনটি নববর্ষ হিসেবে উদযাপিত হওয়ার হাওয়া এখন আটলান্টিকের পাড়েও। ধর্ম ও রাজনৈতিক সীমানা নির্বিশেষে বাংলা নববর্ষ, বাঙালির একমাত্র সর্বজনীন উৎসব। তাই যুগ যুগ ধরে ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বাঙালির সকল কার্যাদি সম্পন্ন হলেও বাংলা নববর্ষের প্রতি সকল বাঙালিই গভীরতর এক প্রাণের টান অনুভব করেন। পরবাসী প্রজন্মও করছে সেই কৃষ্টির সন্ধান। নিউইয়র্কের বাঙালি গ্রোসারিগুলো বাংলা ক্যালেন্ডার চালু করতে শুরু করেছে। যা এক অভিনব আউডিয়া তো বটেই।

যুক্তরাষ্ট্র বহুজাতিক, বহুভাষিক মানুষের দেশ। এখানে চীনা নববর্ষ, জুইশ নববর্ষ, হিজরি নববর্ষ বেশ জোরেশোরেই পালিত হয়। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সিনেটর, কংগ্রেসম্যানরা শুভেচ্ছা বাণী দিতে শুরু করেছেন ইতোমধ্যে। এটা অত্যন্ত আশার কথা। বাংলা নববর্ষ যে সম্প্রীতি মানুষে মানুষে ছড়িয়ে যায়—তা বিশ্বমানবতার একটি উজ্জ্বল সিঁড়ি। অভিবাসী প্রজন্ম সেই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তার পিতা, পিতামহ, মাতামহীর ফেলে আসা বাংলাদেশকে দেখতে চাইছে। এটা তো বিদেশে বাঙালির কম অর্জন নয়।



বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।