ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

হাউ টু মেক হন্টেড হাউস | মেহেদী উল্লাহ

বৈশাখের আয়োজন / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫
হাউ টু মেক হন্টেড হাউস | মেহেদী উল্লাহ

সুরে সুরে পত্রিকা পড়েন আব্বা। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর গত একবছরের অভ্যাস এইটা।

সকাল থেকে রাত নয়টা নাগাদ চলে। মাঝে শুধু খাওয়া, নামাজ আর ঘুমের বিরতি। বাদবাকি যে কাজগুলোতে বিরতির উদ্ভব ঘটতে পারে, তা তিনি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই সারেন, এই যেমন গোসল একটা। একটু আগে আমি ড্রয়িংরুম হয়ে বারান্দায় যাওয়ার পথে তার সুর করা একটা হেডলাইন শুনলাম; ‘হাসপাতাল এখন ভূতের বাড়ি!’ তার সুরেলা তেলওয়াত, যেন বাথরুমে গোসলের সময় কারও গুনগুনাগুন। যাইহোক, ফ্যামেলির কারোরই এমন পড়ায় কখনও কান নেই। আমার কানে ভূত শব্দটা ঢুকল কারণ বেশ কিছু দিন হলো ‘ভূতের বাড়ি’ মাথায়।

এখানকার ভূতের বাড়ি কন্সেপ্টটা বিরাট ফালতু। এই যেমন, খবরের কাগজে লেখা হয়েছে হাসপাতালটা নিয়ে। অনুমান যদি ভুল না হয় তবে হাসপাতালটা এখন পরিত্যক্ত আর তাই শুনশান পরিত্যক্ত ব্যাপারটাকেই বোঝানো হয়েছে ভূতের বাড়ি হিসেবে। আসলে ভূতের বাড়ি এত মামুলি নয়। তিনবছর ধরে জিনিসটা নিয়ে চিন্তায় আছি। আমার খুব শখ ঢাকা শহরের ধানমণ্ডির ভূতের গলিতে একটা ভূতের বাড়ি বানাব। বিষয়টা নিয়ে আমি পাঞ্চাল দেশের রাজা দ্রুপদের পুত্রকামনার মতই সিরিয়াস; আর এরা? দ্রৌপদীর জন্মকামনায় দ্রুপদ যতটা না পারতে টাইপ আর সিরিয়াস না—সেই রকম। ভূতই কেউ বুঝল না, আর ভূতের বাড়ি!

এরা ভূতের বাড়ির এইরকম কল্পনা করতে পছন্দ করে। একছিল এক পুরাতন বাড়ি। বাড়ির দেয়ালে ও ছাদে অসংখ্য ছিদ্র। চামচিকারা ওড়াউড়ি করছে। পোকামাকড়ের  ঘরবসতি। বাড়ির দেয়াল কাত যাচ্ছে ক্রমে। মনে হয় একটু ধাক্কা দিলেই পড়বে। বাড়ির চারধারে জঙ্গল। এক কোণে আছে দুটি কদম গাছ আরেক কোণে একটি তেঁতুল গাছ। এটাই এদের কল্পিত বেস্ট ভূতুড়ে বাড়ির চিত্র।

এসব না! লোকজন জানে এইগুলা। ভূত-প্রেতে যেরকম বিশ্বাসই লোকের থাকুক না কেন, লোকে কিন্তু ভয় পেতে পছন্দ করে। আনন্দের শতবাতি জ্বালিয়ে রেখেও বসতঘরে স্বামী-স্ত্রী খানিক ভয়ার্ত অন্ধকার চায়। এইটা দম্পতির মত কম-বেশি সবারই ধর্ম। মানুষ হুদাই ভয় পেতে ভালোবাসে। অযথা আতংকে থেকে মশাকেও অন্ধকারে ভূত ঠাওরায়।

এইরকম একটা ভূতময় পরিস্থিতে যথাযথ একটা ভূতের বাড়ি লোকের চিত্তের জন্য স্বাস্থ্যকর হবে। তাই আমার স্বপ্ন টিকিট কাটিয়ে লোকজনকে ভূতের ভয় খাওয়ানো।

এমনি এমনি পুরনো খালি বাড়ির জানালায় উঁকি দিয়ে ভূত দেখার আশায় কিন্তু ভূত না দেখেই যে ভয় আর আতংকে কৌতূহলের তাড়না অসম্পূর্ণ রেখেই লোকে টাসকি খেয়ে দৌড় দেয়; তাদের এই অদ্ভুত জিনিসটাই ভূতের বাড়ি করার পেছনে আমার একমাত্র সম্বল ও ভরসা। এই ভিন্ন আমার কপালেও আর অন্য কর্ম খালি নাই। দেশে কর্মের বড় অভাব উপস্থিত।

আমাদের এই শহরে লোকে যে বাড়িগুলোকে ভূতের বাড়ি বলে জানে এবং যাতে কখনও যায় না আর তার গড়ে ওঠার ইতিহাসও মোটামোটি কাছাকাছি। সে বাড়িগুলোর সম্পর্কে লোকের বয়ান এই—আশপাশের বাসিন্দাদের তৃতীয় প্রজন্ম ছোটবেলা থেকে এই বাড়িটাকে একদম খালি দেখে আসছে। অন্দর কেমন কেউ জানে না, বাইরে থেকে কল্পনা করে হয়ত এমন হবে, খসে পড়া চুন-সুরকিতে ভর্তি পুরোটা বিল্ডিং। মাকড়শার জালে ভরা। রাত-বিরাতে ভূতদের সভা হয় ইত্যাদি। বাইরে থেকে দেখে কাচগুলো সেই শুরু থেকেই একইভাবে ভাঙ্গা। জীবনে কাউকে এই বাড়ির দোতলা বা তিনতলায় উঠতে দেখেনি তারা। জনমানুষের ছায়াও নেই বাড়িটিতে। বছরের পর বছর ধরে এই বাড়িতে কেউ রাত কাটায় না। সর্বশেষ মানুষ শূন্য হয়ে পড়ার আগে এইবাড়িতে কেউ একজন হয়তো আত্মহত্যা করেছিল, ফলে তার অতৃপ্ত আত্মা বাড়ির লোকেদের ভয় দেখায়, রাতের বেলা ভেংচি কাটে। বাচ্চাগুলো অকারণে কেঁদে ওঠে, কথা ফোটেনি এমন বাচ্চাও আঙুল তুলে কাউকে দেখায়। শেষে হুজুর ডেকে পুরো বাড়ি বন্ধ করেও যখন ফল মিলে না ততক্ষণে বাড়িটার শূন্যদশা কল্পনা করতে করতে গৃহিণী মূর্ছা গেছেন।

বিদেশি ভূতের বাড়িগুলোর পত্তনের কাহিনীও প্রায় একই। ফ্লোরিডায় ওয়েস্ট পাম্পবিচ থেকে একশ’ মাইল দূরে লেক মিয়াকায় একটা ভূতুড়ে বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছিল। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে, ‘স্পুকি হাউস’। বাড়িটিতে একবার আগুন লেগে চার শিশুসহ অনেকেই আগুনে পুড়ে মারা যায়। এরপর থেকে আশেপাশের স্থানীয় অনেকেই শিশুদের প্রেতাত্মা দেখে বাড়িটিতে। গভীর রাতে শিশুরা কাঁদে, বাড়ির চারপাশে ঘুরে। এমন শিশুদের দেখার জন্য শয়ে শয়ে লোক আসে এখানে প্রতিদিন। দেখে কী?

ভূতের বাড়ির কথা ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম সেদিন। রাতে স্বপ্নের ভেতর লিংকনের তাড়া খেলাম। জীবনে এই প্রথম রঙিন স্বপ্নের ভেতর হোয়াইট হাউস দেখছিলাম। এই হাউসের প্রথম প্রেসিডেন্ট জন এডামস। তার স্ত্রী এবাগেইল। ভদ্রমহিলা ভূত হয়ে রয়ে গেছেন হোয়াইট হাউসে। হোয়াইট হাউসে বিভিন্ন সময়ে থাকতে আসা লিংকন থেকে শুরু করে আমি পর্যন্ত অনেকেই ভৌতিক ঘটনার মুখে পড়েছিলাম। এরপর আমরা অনেকেই স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ভূতকে হোয়াইট হাউসে দেখলাম। লিংকনের বন্ধু এবং জীবনীকার অয়ার্ড হিল ল্যামন আমাদের জানান, ভয় নাই, ১৮৬৫ সালের এপ্রিলে মানে যে মাসে তিনি মারা যান সেই মাসে লিংকন এক রাতে স্বপ্নে দেখেন তিনি ঘুমোচ্ছেন। হঠাৎ চারদিকে কান্নার শব্দ। প্রেসিডেন্ট স্বপ্নের মধ্যে দেখলেন তিনি ঘুম থেকে উঠেছেন। কোথা থেকে কান্নার শব্দ আসছে খুঁজতে লাগলেন। শেষে দেখলেন লোকজন কাঁদছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?

তারা জানাল, আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন লিংকন। ভয়ে লিংকনের ঘুম ভেঙে যায়। আর তার ঘুম ভাঙতেই তিনি আমার দিকে তেড়ে আসলেন। কেন বুঝলাম না। এরপর দেখলাম, প্রেসিডেন্ট চার্চিল, থিয়োডর রুজভেল্টসহ আরও অনেকেই হোয়াইট হাউসে হো হো করে হাসছেন। আমাকে তারা জানালেন, লিংকনের ভূত আমাকে তাড়াচ্ছে। আর তারাও বেঁচে থাকছে লিংকনের ভূত দেখেছেন। চার্চিল আমাকে আতংকিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বললেন, ‘গর্দভ,  তোমার মত আমিও একরাতে এত ভয় পেয়েছিলাম যে রাতভর নির্ঘুম ছিলাম। ’

সত্যিই রাতের স্বপ্নটা বিরাট বাজে। আগামাথা নাই আর বাঁকাতেড়া। শুধু এইটুকু বুঝলাম, ভূতের স্বপ্নটার একমাত্র লিংক হতে পারে লিংকন।

নিজে একটা ভূতের বাড়ি বানানোর আগে এই বিষয়ে আমার পর্যাপ্ত পড়াশোনা দরকার। আমি পৃথিবীর বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ভূতের বাড়িগুলোর খোঁজ নিতে শুরু করি। টটনেসের বেরি পমেরয় ক্যাসেল।   ১৪০০ শতকের এই দুর্গ যার কুখ্যাতি আছে দুটি মহিলা ভূতের জন্য। এই দুই মহিলা গা হিম করে দেয়। হোয়াইট লেডি এবং ব্লু লেডি। জানতে পারি, হোয়াইট লেডি বা মার্গারেট পমেরয় তার হিংসুটে বোন দ্বারা কারারুদ্ধ অবস্থায় খাদ্যের অভাবে মারা গেছিলেন। এখনও অনেক মানুষ রাতে তার অতৃপ্ত আত্মাকে কারাগারে, দুর্গের দেয়ালের উপর কিংবা টাওয়ারে হেঁটে বেড়াতে দেখে। আর ব্লু লেডি হঠাৎ হঠাৎ উপস্থিত হয়ে তার রূপ দিয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করে সুখী মানুষদের বিপদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই ক্যাসেলে অনেক আহত ও নিহত হওয়ার ঘটনা আছে। এখানকার মানুষের কাছে এই ক্যাসেল একটা অভিশপ্ত ক্যাসেল।

পোল্যান্ডের অস্উইটজ ব্রিকেনাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪০-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মান নাৎসি বাহিনী কতৃক পরিচালিত এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হাজার হাজার মানুষকে নিপীড়ন করে, নির্বিচারে মারা হয়েছিল। পরবর্তীকালে জার্মান বাহিনী এই ক্যাম্প ছেড়ে গেলেও এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটিতে ঘটতে থাকে এমন অদেখা ঘটনা যা ব্যাখ্যাতীত। এই ক্যাম্পে যারা ঢুকেছে সকলেই বলেছে তারা বিভিন্ন অদ্ভুত অস্বস্তিকারক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। এই সব থেকেই অস্উইটজ ব্রিকেনাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প একটি বিখ্যাত ভূতুড়ে বাড়ি। ইংল্যান্ডের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে ভূতুড়ে হোটেলের একটি স্কুনার হোটেল যা আজও অতিথিদের জন্য খোলা আছে। কিন্তু এই হোটেলের সবচেয়ে বিপদজনক কক্ষ ১৭ এবং ১৮ নম্বর। বিভিন্ন অস্বাভাবিক ঘটনা ও ভূতের উপদ্রপের জন্য কুখ্যাতি আছে কক্ষ দুটির।

আমি যে ধরনের ভূতের বাড়ি বানাতে চাই, এই বাড়িগুলো থেকে আমার প্রাপ্তি স্বল্প। শুরুতেই এই যুক্তিতে এগুলোর আদর্শ আমার জন্য নাকচ হয়ে যাচ্ছে যে, এই বাড়িগুলো কেউ একজন তৈরি করেনি, এরা কোনও না কোনও ভয়াবহ পরিণামের ফল। এগুলোতে ঘুরঘুর করছে অতৃপ্ত আত্মা। অবশ্য একদিক থেকে মিল আছে—এগুলোর মত আমার বাড়িটায়ও মানুষ ভূতই দেখবে। টিকিট কেটে ভূত দেখবে। ভূতুড়ে পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হবে। এই বাড়িগুলো থেকে আমার প্রাপ্তি এই যে, আমার ভূতের বাড়িতেও ভূত ঘুরঘুর করবে, হেঁটে বেড়াবে প্রকাশ্যে, সুখী আর আপদহীন মানুষদের বিপদের সঙ্গে পরিচিত করাবে, এই বাড়িতে যারা ঢুকবে সকলেই বাইরের আরও দশজনকে এখানে ডেকে আনবে এই বরে যে, তারা বিভিন্ন অদ্ভুত অস্বস্তিকারক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে এবং তাদের গা ভয়ে হিম হয়ে গেছে। এখানের অদেখা ঘটনাও ব্যাখ্যাতীত।

পরবর্তীধাপে আমি ডা. আইনুন্নাহার রিতা ও প্রকৌশলী নুরুন্নাহার মিতার সঙ্গে সাক্ষাত করতে আগ্রহী। আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছ থেকে তাদের ঠিকানা ও ফোন নম্বর নিলাম। এরা সেই দুইবোন যারা মিরপুরের কথিত ভূতের বাড়ির বাসিন্দা, অনেক দিন হলো ‘ভূতের বাড়ি’র অভিশপ্ত জীবন ত্যাগ করে নতুন জীবন শুরু করেছেন। আমি তাদের কাছ থেকে ভূতের বাড়ির অভিজ্ঞতা শুনতে গেলাম। সব শুনে তারা হাসলেন কিছুক্ষণ। তারপর জানালেন, তারা এখন সিজোফ্রেনিয়া মুক্ত। আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমাকে এ নতুন কোন রোগে ধরেছে যে আমি ভূতের বাড়ি বানাতে চাই। আমার এখনই ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার, তারাও সময় থাকতে পাত্তা দেননি তাদের রোগটিকে, এমনকি বুঝতেও পারেন নি। তারা আমাকে এও বললেন, ‘আমরা তো নিজেরাই একটি বাড়ির ভূতুড়ে পরিবেশের জন্য দায়ী, অর্থাৎ আমরা দিনে দিনে বাড়িটিকে ভূতুড়ে করে তুলেছিলাম। কিন্তু আপনি তো শুরুতেই ভূতুড়ে পরিবেশ দিয়ে মানুষকে ভুতগ্রস্ত করে তুলতে চাইছেন। ’ তাই তারা জানালেন, তাদের কোনও অভিজ্ঞতা আমার কাজে আসবে না। আমি তাদের মিনতি করলাম, যদি আমি তাদের অভিজ্ঞতার উল্টো প্রয়োগ করি, তাহলে? তারা আমাকে জানালেন, তারা এখন পবিত্র কোরান শরীফের ইংরেজি অনুবাদে খুব ব্যস্ত, সুতরাং তাদের হাতে সময় নেই আমার সঙ্গে বকবক করার। আরও বললেন, ‘রোগের অভিজ্ঞতার উল্টোটি হয় না কখনও, রোগ সোজা মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় যে কাউকে। ডাক্তারই কেবল রোগকে উল্টো যাত্রা করিয়ে মানুষকে জীবনের দিকে আনতে পারেন। ’ তাই তারা আমাকে আবারও ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। রিতা-মিতা আমাকে আরও বললেন, ‘ইসলাম ধর্মের প্রচারে বাকি জীবন কাজ করে যেতে চাই। আমাদের মা রওশনারা বেগমেরও ইচ্ছা ছিল আমরা পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিমে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দেব। এ জন্য আমরা সমমনাদের নিয়ে একটি গ্রুপ গড়ে তুলতে চাই। ’ তারা আমাকে প্রস্তাব দিলেন, আমি যেন তাদের গ্রুপে অবশ্যই থাকি। এতে আমার কল্যাণ হবে।

দুইবোনের বক্তব্য আমাকে হতাশ করলেও আমি হতাশা নিয়ে ফিরিনি। আমি ভূতের বাড়ি বানানোর যে সংকল্প করেছি তাতে আবিচল। আমি বেশ কিছুদিন ভেবে বাড়িটা কেমন হবে তার একটা রূপ কল্পনায় দেখতে পেলাম।

ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন শীতল ঘর লাগবে আমার। যে ঘরের দরজা আলতো করে লাগানো থাকবে আর কারও হালকা হাতের পরশ পেলেই খুলে যাবে। সে ঘরে ঘুরে বেড়াবে ধেড়ে ইঁদুর। ঢুকলেই তীব্র উৎকট দুর্গন্ধ নাকে লাগবে। বাড়িটার আঙিনার কাঁটাযুক্ত আগাছা সবাইকে ঘরে প্রবেশে স্বাগত জানাবে। বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও ঘরটি অধিকাংশ সময়ে থাকবে বিদ্যুৎহীন। দেয়াল হাতড়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখা যাবে, পুরো ঘরে শুকনো পাতা, ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ। ইঁদুরের সঙ্গে থাকবে আরশোলা। দেয়ালে ঝুলবে মাকড়সার বড় জাল। এভাবে আরও বিবিধ উপায়ে ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরির পর আমার ভূত লাগবে। ভূত যোগাড়ের বিষয়টিও আমি ভেবে রেখেছি।

আমার নানি যিনি খুব সহজেই নিজের মুখটিকে পেঁচার মুখের মত করে ফেলতে পারেন। আমি তাকে বলেছি, সারাদিন কিন্তু পেঁচামুখী হয়েই থাকতে হবে এখানে, তিনি রাজি হয়েছেন। আর আমি আত্মবিশ্বাসী নানিকে অদ্ভুত পোশাকে সাজিয়ে পেঁচামুখী করে রাখলে লোকে সত্যিই পেত্নী দেখবে। আমার এক বন্ধু আছে যার মাথায় আজন্ম চুল গজায়নি, সে মুখটাকে মাছের মত করে তুলতে পারে, সে মাছ হয়ে এখানে থাকতে রাজি হয়েছে। আর তার উচ্চতার চেয়ে চারগুণ বেশি শরীরের ওজনটা তাকে নিশ্চয়ই কাতলামাছ হিসেবেই দর্শকের কাছে পরিচিত করে তুলবে। এই মাছটির ভয়ানক হা আর চোখের কারসাজিতে মানুষ ভয়ে হিম হয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস।

গ্রামে আমার এক বন্ধু আছে, যে কখনও ঢাকা শহর দেখেনি। তার দুটি হাত নেই, শরীরের নিম্নাঙ্গ ঘন-কালো রোমে আবৃত। এত বড় রোম যে সে নগ্ন হওয়ার পরও সেখানকার চামড়া চোখে পড়ে না। তাকে গ্রামের মানুষ এখনও ‘ভুতো’ বলে ডাকে। আমি ভুতোকে কথা দিয়েছি, তাকে শহর দেখাব। এইবার সে শহরে এসে ভূত হয়ে থাকবে সারাজীবন। আমি এমন একজনকে চিনি যার প্রায় দুটো মাথা। একটা সত্যি মাথা, অন্যটি ঘাড়ের দিক থেকে গজিয়ে ওঠা মাথার সমান টিউমার, এর অগ্রভাগে ইয়াবড় কালো তিল দেখে অন্ধকারে চুল বলেই অনুমান হবে। ফলে দুইমাথাওলা পরিচিতকেও লোকে ভূত হিসেবেই ভাবতে পারবে। আমার গ্রামের ‘ফুটবল’কে আমার মনে পড়ছে খুব। লোকটার দেহ বলতে কিছুই নেই, একটা গোলাকার পিণ্ড, শুধু মুখ-মাথা আছে, সে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে, ফলে এই ফুটবলকে ভূতের ভূমিকায় ভালো মানাবে। এইভাবে এমন আরও অনেক ভূত আমি পেয়ে যাব।

ভূতের বাড়িতে যখন আর কিছু দেখানোর থাকবে না, অর্থাৎ সবকিছু দেখতে দেখতে শেষের পথে ঠিক তখনই এক ভূত সুরে সুরে কিছু পড়তে থাকবে, যে সুরে খেলা করবে অতীত, শুধু অতীত। মোহ থাকবে সে সুরে আর মায়া অনেক। সে ভূতটি নিঃসন্দেহে আমার আব্বা থাকবেন। তার সুরে এতই মোহ থাকবে যে, শেষপ্রান্তে কেউ পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো কাঠের মেঝে দেবে যাওয়ার ভান করবে। হঠাৎ বাবা সুরের মায়াজাল বুনবেন। লোকেরা আরও ভীত হয়ে পেছনদিকে ঘুরবে, এতে প্রেতাত্মাগুলো তার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকবে, যাদের লোকেরা খানিক আগে দেখে গেছিল। আবার ঠাণ্ডা বাতাস লোকেদের চুল আলতো করে বুলিয়ে দিল বুঝি, তাদের কাছে এমন মনে হলেও আসলে একটা পেত্নী তাদের চুল স্পর্শ করতে থাকবে। তারা হাতের পরশকে বাতাস ভাববে ভয়ে দিশেহারা হয়ে। তখন লোকেরা নিজের সামাল দিতে পারবে না। ভয়ে শরীর অবশ হয়ে যাবে। একদৌড়ে তারা বেড়িয়ে যাবে ভূতের বাড়ি ছেড়ে। একসময় ভয় কেটে গেলে লোকেরা মনে করার চেষ্টা করবে শেষে চুলটাই বা কে ঠাণ্ডা হাওয়ায় বুলিয়ে দিল? তাহলে কেউ ছিল নিশ্চয়? কোনও অশরীরী? মনে করার চেষ্টা করবে। তারপর একটা ঝলসে যাওয়া মুখ তাদের চোখে পড়বে। ঠিকই। এই ধাঁধা সৃষ্টিকারী অশরীরী, কিন্তু ঠিকই শরীরী—আমার প্রেমিকা। কয়েক বছর আগে যাকে তার পুরনো প্রেমিক দণ্ড হিসেবে অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছিল। এই অপরাধে যে, সে কেন লোকটিকে বাস্তবিক ঘৃণা করেও উপরে-উপরে ভালোবেসে যাওয়ার অভিনয় করছে না।

একদম শেষে লোকেদের মনে পড়বে ভূতের বাড়ির মাঝামাঝিতে পিয়ানো বেজে উঠতে শুনেছিল তারা। কিন্তু কে বাজিয়েছে দেখতে পায়নি। এই পেত্নীটি আমার মা, যাকে সংসারে এমনিতেই আমরা কখনও দেখতে পাইনি! লোকে কী দেখতে পাবে! লোকেদের আরও মনে পড়বে পিয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা কুকুর উঁচু স্বরে ডেকেছিল। কুকুরভূতটি আমার বোন, যে জন্মসূত্রে কুকুরের ডাকপাপ্ত। আর রোজ মাঝরাতে কুকুরের মত ডেকে সে আমাদের ঘুমোতে দিত না। পড়শীরা ভাবত, বাইরে সত্যিই কুকুর ডাকছে।

এরপর লোকেরা শহরময় এই কথা ছড়াতে থাকবে, ভূতের গলি হন্টেড হাউসে টিকিট কেটে ভূতের ভয় খেয়ে এলাম।



বাংলাদেশ সময়: ১৮৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।