ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সূর্য না ওঠা জনপদের গল্প | সাব্বির জাদিদ

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১৫
সূর্য না ওঠা জনপদের গল্প | সাব্বির জাদিদ

গণ্ডগ্রাম বলেই আলোনগরে তাড়াতাড়ি রাত নামে। আটটা নয়টার ভেতরে খেয়েদেয়ে সবাই বিছানায় যায় আর সুনশান কবরের নীরবতা নেমে আসে জনপদে।

যাদের জীবনে রাত নামে তাড়াতাড়ি তাদের ভোরও আসে তাড়াতাড়ি। এটাই তো নিয়ম। অন্তত আলোনগরের জীবনযাত্রা দেখলে তা-ই মনে হয়। খুব ভোরে সূর্য ওঠার আগেই এরা জেগে ওঠে। চোখ ডলতে ডলতে নেমে পড়ে প্রতিদিনকার কাজে। মুরব্বিরা ওজু করে মাথার টুপি ঠিক করতে করতে মসজিদে যায়। ফিরে এসে গোয়াল থেকে গরু বার করে। চাড়িতে দানাপানি দেয়। মহিলারা রান্নার প্রস্তুতি নিতে চুলোর বাসি ছাই মালসায় তোলে। সেগুলো ছড়িয়ে দেয় ওলগাছের গোড়ায়। নতুন দম্পতির ফরজ গোসল করি করি করে আলসেমিতে আর করা হয়ে ওঠে না। সূর্য উঠে যায় গোসলের আগেই। উঠতি যুবক ছেলেরা গালের ভেতর ব্রাশ গুঁজে কোচিং সেন্টরের রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। যদি দু’একটা সুন্দরী মেয়ের দেখা মেলে!

কিন্তু একবার এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে গেল। মুরব্বিরা ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখে, ঘোর অন্ধকার। এমন কখনওই হয় না। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব লম্বা মোনাজাত ধরে। রব্বিরহামহুমা কামা রব্বাইয়ানিস সগিরা। সুরে সুরে মোনাজাত। এই মোনাজাতের ফাঁকেই চরাচর ফর্সা হতে শুরু করে। মসজিদের ভেতরে কাপড়ের রঙ দেখেই বলে দেয়া যায়—কে ছলেহ আর কে আব্দুল কুদ্দুস। এইবার মসজিদের বাইরে এসেও ঘোর অন্ধকার দেখে মুসল্লিরা ভাবে, নির্ঘাত নামাজ আধঘণ্টা আগে পড়া হয়ে গেছে ভুলক্রমে। কিন্তু এই ভুলের জন্য কেউ কোনও কথা বলে না। বাড়ি গিয়ে বউয়ের পাশে আরও আধঘণ্টা শুয়ে থাকার সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায় না। কিন্তু বাড়ি গিয়ে তারা হতাশ হয়। কারণ তাদের বউরা ইতোমধ্যে বিছানা ছেড়েছে এবং কোমরে আঁচল গুঁজে উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে। বউদের এই কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্ম দেখে তারা বিরক্ত হয়। তাদের ভেতর যারা রাগী এবং বউকে ভয় পায় না—তারা তাদের বউদের ধমক মারে। বউরা জানায়, তারা ঠিক সময়েই বিছানা ছেড়ে কাজে লেগেছে। তাদের আন্দাজ ঘড়ির কাঁটার চেয়েও নিখুঁত। স্বামীরা তখন ধন্দে পড়ে যায়। তাদের চোখেমুখে বিস্ময়ের মানচিত্র দেখা দেয়। বউরা তাদের স্বামীদের আশ্বস্ত করতে বলে, ‘আকাশে হয়ত ম্যাগ করেছে তাই এমুন অন্দকার। ম্যাগ কাটে গেলি সপ ঠিক হয়ে যাবিনি। ’ কিন্তু স্বামীরা আশ্বস্ত হতে পারে না। তারা তাদের অভিজ্ঞ পুরনো চোখ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করে—‘ম্যাগের কুনু আলামতই নি আকাশে। তালি ঘটনা কী হতি পারে!’—তারা চিন্তিত হয়। এভাবে আরও খানিকটা সময় পার হয়। সূর্য ওঠে না। ইতোমধ্যে বেনামাজিরাও চোখ ডলতে ডলতে উঠে পড়ে। বাচ্চারা দুধ খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে। গোয়ালে গরু হাম্বা হাম্বা ডাক পাড়ে। মুরগির খোপে মোরগ-মুরগি পাখা ঝাপটায় আর কককক কককক করে। যাদের স্কুল আছে তারা বেশ আনন্দিত হয়। এমন ঘটনা প্রতি মাসে একবার কেন ঘটে না ভেবে আফসোস করে। দু’চারজন শিক্ষিত—যাদের বিজ্ঞানের ওপর আস্থা আছে—তারা মন্তব্য করে, ‘কোনও কারণে হয়ত পৃথিবীর ঘূর্ণন বন্ধ হয়ে গেছে, আর তাই ভূপৃষ্ঠের এই পার্শ্বটায় সূর্যের আলো পড়ছে না। ’ কিন্তু পৃথিবীতে এতবড় একটা ঘটনা ঘটবে আর বিজ্ঞান আগেভাগে কিছুই টের পেল না!—এ বিস্ময়ে তারা বিজ্ঞানকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে। হঠাৎ তাদের টেলিভিশনের কথা মনে পড়ে। টিভি নিউজে নিশ্চয়ই এহেন বিপর্যয়ের খবর এবং বিপর্যয়ের নেপথ্য কারণ ফলাও করে প্রকাশ করা হচ্ছে। যাদের ঘরে টিভি আছে তারা টিভির সুইচ অন করতে গিয়েই বুঝতে পারে, বিদ্যুৎ নেই। কখন থেকে নেই—কেউ বলতে পারে না। কারণ শীতের রাতে তাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়ে না। আলোনগরের বাইরে যাদের আত্মীয়স্বজন আছে—সেসব আত্মীয়দের খবর নেয়ার জন্য কেউ কেউ মোবাইল হাতে তুলে নেয়। নাম্বার ডায়ালও করে। কিন্তু রিং হয় না। পুচকে ছেলে—যারা মোবাইলের নাড়িনক্ষত্র সব বোঝে—তারা বিজ্ঞের মতো জানায়, ‘নেটওয়ার্ক নেই। নেটের একটা দাগও দেখা যাচ্ছে না। ’ কেউ কেউ তখনই পাশের গাঁয়ের খবর নিতে সাইকেলের সিটে পাছা লাগায়। প্যাডেল চাপে। কিন্তু আলোনগরের শেষসীমায় পৌঁছে তারা হতবাক হয়। গভীর এক জঙ্গলে পথ শেষ হয়ে গেছে। কাঁটাযুক্ত বৃক্ষে ভর্তি সেই জঙ্গল। তারা কাঁপতে কাঁপতে ফিরে আসে জনপদে। কেউ কেউ সাইকেল নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে যায় পানির ডোবায়। এইবার সবার দুশ্চিন্তা দ্বিগুণ হয়। একসাথে এত অস্বাভাবিক ঘটনায় তারা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। কার্যত তারা এখন অন্ধকার কবরের বাসিন্দা। সেখান থেকে বের হওয়ার, বাইরের পৃথিবীর খোঁজখবর নেয়ার কোনও অবলম্বন তাদের নেই।

ইমাম সাহেব এবং কতিপয় ধার্মিক লোক জানায়, এ হলো আল্লাহতায়ালার গজব। মানুষের হাতের কামায়। ইমাম সাহেব একটা আয়াতও শুনিয়ে দেয়, ‘যহারাল ফাসাদু ফিল বার্রি ওয়াল বাহরি বিমা কাসাবাত আইদিন নাস। ’ অর্থাৎ ‘জলে এবং স্থলে যা-কিছু বিপর্যয় ঘটে সব মানুষের হাতের কামায়। ’ ইমাম সাহেবের কথা সবাই খালেছ দিলে বিশ্বাস করে। এমনকি কলেজপড়া ইলিয়াস—যে কিনা মাঝেমাঝে আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে খতরনাক কথা বলে—সেও ইমাম সাহেবের হাত চেপে ধরে বলে, ‘এখন তাহলে উপায়!’

কাউকে বলে দিতে হয় না, ধীরে ধীরে গ্রামবাসী ইস্কুলমাঠে জড়ো হয়। তারা আজ ঘোরতর বিপদে নিমজ্জিত। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে প্রয়োজন সম্মিলিত পরামর্শ। ইস্কুলমাঠে সবাই এসেছে। আসেনি শুধু আলোনগরের দুই মাতব্বর—ফরহাদ গাজি আর টিপু সুলতান। অথচ আজকের এই দুর্দিনে গাজি আর সুলতানকেই পাশে দরকার তাদের। কিছু কথা কাটাকাটির পর গ্রামবাসী দু’ভাগে ভাগ হয়ে একভাগ যায় গাজির বাড়ি, আরেক ভাগ যায় সুলতানের বাড়ি। গাজির  একতলা বাড়ি। তেলের ব্যবসায়ী। বাড়ির সাথেই তার তেলের গোডাউন। আলোনগরে সে-ই বেশি পয়সার মালিক। সুলতানের অবস্থাও খারাপ না। মাঠে তার অনেক জমি। জমির ফসলে দিন চলে যায় রাজারহালে।

গ্রামের অর্ধেক মানুষ যখন গাজির কাছে বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে সাহায্য চায়, গাজির ভেতর প্রভুসুলভ আত্মগরিমা উদ্ভাসিত হয়। সে গদিআঁটা চেয়ারে বসে পা নাচায় আর সিগারেট টানে। লোকেরা তার সামনে নতজানু হয়ে বসে পড়ে। গাজির কাজের ছ্যামড়া লোকদের মাঝখানে মাঝখানে কেরোসিনের বড় বড় বাতি রেখে যায়। গাজি সবার দিকে নজর বুলায় আর সিগারেট টানে। সে বুঝতে পারে, গ্রামের সব লোক উপস্থিত হয়নি। বাকিরা কোথায়? ভরাট স্বরে সে জিজ্ঞেস করে, ‘আর সব কোনো?’ উপস্থিতদের একজন নেতৃত্বসুলভ ভঙ্গিতে বলে, ‘আর সবাই সুলতানের কাছে গেছে। ’ গাজির মোটা ভুরুতে এবার গিঁট পড়ে। সে চড়া গলায় বলে, ‘সুলতানের কাছে তাদের কী?’ আগের জন উত্তর দেয়, ‘আমরা যেজন্য আপনের কাছে আইছি তারাও সেজন্য সুলতানের কাছ গেছে। ’ গাজি এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ক্রুদ্ধ চেহারায় পায়চারি করে। বাতির লকলকে আগুনের ছায়া তার মুখে পড়ে। গ্রামবাসী গাজির এই আকস্মিক পরিবর্তিত মুখচ্ছবির শানেনুজুল খুঁজে পায় না। তারা ভয় আর কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে গাজির দিকে। গাজি হঠাৎ হুঙ্কারই যেন ছাড়ে, ‘এই বিপদে আমি তুমাদের সাহায্য কত্তি পারব না। তুমরা সুলতানের কাছে যাও। আমার কাছে কেন আইছ?’ গ্রামবাসী এবার গাজির ক্রুদ্ধতার শিকড়ের সন্ধান পেয়ে যায়। তারা কাঁচুমাচু আর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ওদিকে সুলতানের বাড়িতেও একই ঘটনা ঘটে। সুলতান অভিমানী কণ্ঠে বলে, ‘তুমাদের আমার কাছে কিডা আসতি বলছে। তুমরা গাজির কাছে যাও। এই বিপদে গাজিই তুমাদের ভরসা। গ্রামবাসী অশিক্ষিত হলেও বুঝতে পারে, এই বিভক্তি অনুচিত কাজ হয়েছে। অতঃপর দু’দলই গাজি আর সুলতানের সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকে। তাদের নিচু মাথা দুই মাতব্বরের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেয় যে, তারা অনুতপ্ত। দুইদলে বিভক্ত হয়ে দুই নেতার কাছে যাওয়াটা তাদের ঘোরতর অন্যায় হয়েছে। গাজির সামনের লোকেরা তাদের শরীরী ভাষা দিয়ে বোঝায়, সবার একসাথে গাজির কাছে আসা উচিত ছিল। সুলতানের সামনের লোকেরা বোঝায়, যারা গাজির কাছে গেছে তারা বিরাট অন্যায় করেছে। সবার একত্রে সুলতানের কাছে আসাটাই ছিল কল্যাণকর। এরপর স্পষ্টতই গ্রামবাসী দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একদল গাজির আরেক দল সুলতানের। গাজি এবং সুলতান দু’জনই আনুগত্যশীল দুটি গোষ্ঠী পেয়ে সন্তুষ্ট হয় এবং যে যার গোষ্ঠীকে সাধ্যের মধ্যে সকল প্রকার সুবিধা দেয়ার আশ্বাস দেয়। গ্রামবাসী ঘরে ফিরে আসে।

সূর্য ওঠা বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে আলো এবং খাদ্যের। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ কৃষক। নিজেদের জমি চাষ করে খাবার জোটায়। কিন্তু জনপদ অন্ধকারে ডুবে থাকায় তাদের ক্ষেতের কাজ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে তাদের আয় রোজগার, খাবারদাবারও বন্ধ হয়ে গেছে। আলোনগরের প্রতিটি মানুষই বিপর্যয়ের শিকার। এমতাবস্থায় নিজ নিজ আনুগত্যশীল গোষ্ঠীর দিকে এগিয়ে আসে গাজি আর সুলতান। অন্ধকার দূর করতে গাজি তার লোকদের বিনামূল্যে কেরোসিন তেল বিতরণ করে। সবার বাড়ি বাড়ি মশাল জ্বালিয়ে দেয়। বন্ধ হয়ে যাওয়া গেদুর চায়ের দোকান ফের চালু হয় গাজির উদ্যোগে। দোকানে দুটো মশালের ব্যবস্থা করা হয়। এই দোকানে বসে চা খেতে পারবে শুধু গাজির আনুগত্যশীল লোকেরা। তারা চা খাবে আর গাজির সুনাম করবে। সুনাম বয়ে নেয়ার জন্য লোকও ঠিক করে রেখেছে গাজি। কেউ গাজির দুর্নাম করলে তাকে দোকান থেকে খেদিয়ে দেয়া হবে। সূর্য না-ওঠায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে আছে। গাজির উদ্যোগে বন্ধ হওয়া ইস্কুল আবার চালু হয়। ইস্কুলে ক্লাশটাইমে মশাল জ্বালানো হয়। এই ইস্কুলে পড়বে শুধু গাজির অনুগত লোকদের সন্তান।

ওদিকে সুলতানও বসে নেই। সে তার লোকদের খাদ্যাভাব দূর করতে গোলার ধান বিতরণ করে। বাড়ির সাথে একটা হোটেল খোলে। সেখানে স্বল্পমূল্যে ডালভাত পাওয়া যায়। যারা একেবারেই গরীব তাদের কোনও পয়সাই লাগে না। শর্ত শুধু একটা, লোকদের মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে—সুলতান তাদের সুখে রেখেছে। সুলতান তার আনুগত্যশীল গোষ্ঠীর সন্তানদের পড়াশোনার জন্য বাড়ির সাথে একটা ইস্কুল খোলে। সবাই মারহাবা দেয়। সুলতান শিক্ষানুরাগী। ইস্কুলের অবকাঠামোগত উন্নতি সাধিত হলেও পড়াশোনা শুরু করা যায় না। কারণ সুলতানের ভাণ্ডারে কেরোসিন নেই। আলোর অভাবে পাঠদান ব্যাহত হয়।

কিছুদিন যেতেই গাজির লোকদের ভেতর অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। গাজি পথ দেখার জন্য আলো দিয়েছে কিন্তু পেট চালানোর জন্য খাবার দেয়নি। শুধু আলো দিয়ে তারা কী করবে? কেরোসিন খাওয়া গেলেও না হয় কথা ছিল। দলের মধ্যে ভাঙনের সুর শোনা যায়। কেউ কেউ খাবারের লোভে সুলতানের দলে ভেড়ার চিন্তাভাবনা শুরু করে। সুলতানের লোকদের ভেতরেও সমস্যা। শুধু খেয়ে মানুষ বাঁচে না। অন্ধকারে তারা বউয়ের মুখটাও দেখতে পায় না। বাচ্চাদের পড়াশোনা বন্ধ। সুলতানের দলের ভেতরেও ভাঙনের আভাস। সুযোগ পেলেই কেউ কেউ ভিড়ে যেতে পারে গাজির ঘাটে।

এইসব গুজবের ভেতরেই একরাতে গাজির তেলের গোডাউন আক্রান্ত হয়। কারা যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তেলের ড্রামে। সেই আগুনে পুড়ে যায় গাজির একতলা বাড়ির একাংশ। গাজির ইস্কুলঘর, গেদুর চায়ের দোকানেরও একই পরিণতি বরণ করতে হয়। পুড়ে সব কয়লা। এর পরের রাতে আক্রান্ত হয় সুলতানের খাদ্যের গোলা, খাবার হোটেল। বাতাসে ধান আর সবজি পোড়ার গন্ধ ভাসে। ঠাস ঠাস করে ফোটে বাঁশের তৈরি ইস্কুলবেঞ্চ। সুলতান দোষ দেয় গাজির। গাজি দোষারোপ করে সুলতানের। কে বা কারা এসব করছে সাধারণ মানুষ ঘেঁটে দেখে না। তারা শুধু টের পায়, আবার তারা বঞ্চিত হলো সকল সুযোগ সুবিধা থেকে। তারা আবার ইস্কুলমাঠে একত্রিত হয়। তাদের চেহারায় হতাশা খেলা করে। সবাইকেই নিজ নিজ বয়সের চেয়ে বেশি বয়স্ক লাগে। বুড়োরা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তারা ঘাসের উপর কুঁজো হয়ে ঠেসে বসে। যুবকরা কী নিয়ে যেন উত্তেজিত। তাদের কথা ভেসে আসে। কিন্তু তারা কী বলে বুড়োদের কান পর্যন্ত স্পষ্ট পৌঁছে না। হঠাৎ এক আগন্তুকের আবির্ভাব ঘটে ইস্কুলমাঠে। এর আগে কখনওই দেখা যায়নি তাকে। আগন্তুকের আগমনে কোলাহল থেমে যায়। আগন্তুক সবার সামনে এসে সটান হয়ে দাঁড়ায়। তার পিঠের ঝোলা দেখে ফকির ফকির লাগে। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হয় সে বড়মাপের সাহেব। লাল-ফর্সা গায়ের রঙ। চামড়ার নিচেই যেন বেদানার রস। ছুঁয়ে দিলে চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসবে রক্ত। গায়ের চামড়ার মতো মাথার চুলও লালচে সাদা। কাপালের ওপর বেশ কয়েকটা ভাঁজ। এমন চেহারার মানুষ আলোনগরের কেউ কোনওদিন দেখেনি। চরম হতাশার সময়ও তারা আগন্তুকের ব্যাপারে যথেষ্ট কৌতূহল দেখায়। আগন্তুক ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, ‘আমি জানি তোমরা চরম বিপদের ভেতর আছো। আমি এসেছি তোমাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে। আমি তোমাদের জনপদে ফের সূর্য ওঠাব। তোমরা আবার নির্বিঘ্নে চাষ করতে পারবে। তোমাদের বাচ্চাদের পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি হবে। তোমরা খাদ্যের অভাব দূর করতে সক্ষম হবে। ’

আগন্তুকের কথায় মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফিঁসফিঁসানি ক্রমেই কোলাহলে রূপ নেয়। বুড়োরা বলে, ‘আমরা শান্তি চাই, সূর্যোর আলো চাই, খাবার চাই, ক্ষ্যাতে কাম করার সুযোগ চাই। হে আগুন্তুক আমরা বিরাট বিপদের মুদি আছি। আপনে আমারে রক্ষা করেন। ’

বুড়োদের কথা শুনে আগন্তুকের মুখে হাসি ফোটে। সে তৃপ্তি আর অহঙ্কার নিয়ে বলে, ‘আমিই তোমাদের রক্ষক। ’

তার কথা শেষ হওয়া মাত্র চিৎকার করে ওঠে যুবকেরা। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, ‘আমরা তোকে চিনিনে। তোর সাহায্যোর কুনু দরকার নি আমারে। আমরা মল্লি নিজিরা মরব, বাঁচলি নিজিরাই বাঁচপ। তুই কোন চ্যাটের বাল। তুই এখেনতে বিদায় হ। ’



বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।