ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সুকান্তের কবিতায় তারুণ্যের শক্তি | শামস সাইদ

বিশেষ রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৯ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৫
সুকান্তের কবিতায় তারুণ্যের শক্তি | শামস সাইদ

কবিতা যে মানুষ-মানবতা, জীবন বোধ, মানুষের দুঃখ দুর্দশার ছবি, সমাজের প্রতিছবি, অন্যায়-অবিচারের কথা, সমাজের চিত্র, শোষণ আর অপশাসনের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে তা দেখিয়েছেন সুকান্ত। তার কবিতায় ধারণ করেছেন সময়কে।

উঠে এসেছে সময়ের বাস্তবতা। ফুটেছে সময়ের চিত্র। যদিও কবি বয়সে ছিলেন কিশোর। তবে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর ক্ষুরদার লেখনি থেকে কিছুই বাদ পড়েনি। বয়সে কিশোর হলেও কৈশোরের দেয়াল তাকে অবরুদ্ধ করে রাখতে পারেনি। কৈশোরের দেয়াল তিনি ভেঙেছিলেন। হামার দিয়ে নয়। কলম দিয়ে। লেখনির শক্তি দিয়ে। বিপ্লবের আওয়াজ তুলেছিলেন। তারুণ্যের জয়গান গেয়েছিলেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে। এরপর হারিয়ে গেলেন। অন্ধকারে। কিন্তু তার বিপ্লবী লেখা আজও মানুষকে জাগ্রত করে। প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তোলে। জ্বালানো প্রদীপ আলোর দিশা হয়ে পথ হারা পথিককে পথ দেখায়। তারুণ্যের শক্তিকে সঠিক পথে চলতে শেখায়। কেননা তরুণকে ইতিহাস ডাক পাঠায়। তরুণই প্রথম টের পায় তার মুক্তি আটকে রেখে অন্যায়-অসম ব্যবস্থা হচ্ছে। তরুণের মুখেই নায়কের আভা খোঁজে দেশ ও জাতি। তারুণ্যের লেলিহান অগ্নিশিখাই পারে একটি দেশ, একটি জাতিকে আলোকিত করতে। সমাজের তিমির দূর করতে। দেশ ও জাতিকে নিয়ে যেতে পারে উন্নতির উচ্চ শিখরে। সুকান্ত তারুণ্যের সেই শক্তির কথা নানা ভাবেই প্রকাশ করেছেন তার কবিতায়।

বাংলা সাহিত্যের প্রগতিশীল চেতনার  এই তরুণ কবি ১৯২৬ সালের ১৪ আগস্ট জন্ম গ্রহণ করেন। কলকাতার ৪৩ মহিম হালদার স্ট্রীটের মাতামহের বাড়িতে। পিতা নিবারণ ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সুনীতি দেবীর দ্বিতীয় ছেলে সুকান্ত। জেঠতুতো দিদি রাণীদি নাম রাখেন সুকান্ত। ‘রমলা’ খ্যাত সাহিত্যিক মনীন্দ্রলাল বসুর গল্প ‘সুকান্ত’র নাম অনুসারে। সুকান্তর জন্ম কলকাতায় হলেও তার পৈত্রিক আদিনিবাস বাংলাদেশে। বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়ায়। এদিক থেকে সুকান্ত শুধু বাংলা সাহিত্যের নয় বাংলাদেশেরও অহংকার। পিতৃ পুরুষের আদি ভিটায় কবি এসেছিলেন। বেশ কয়েকবার। তবে সে আসা পৈতৃক আত্মীয়তার সূত্রে নয়। এসেছিলেন রাজনৈতিক কারণে। বয়সে কিশোর হলেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর বিচক্ষণতার কারণে অল্প সময়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে রাজনীতিক প্লাটফর্মে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিলেন।

শৈশব থেকেই সাহিত্য-সৃষ্টির প্রতি সুকান্তর আগ্রহ দেখা যায়। নয়-দশ বছর বয়সে অনেক ছড়া লিখেছেন। সে সময়েই  সর্বমহলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সুকান্তর শিক্ষা জীবন শুরু হয় কলকাতার কমলা বিদ্যামন্দিরে। পরে তিনি বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাইস্কুলে ভর্তি হন। কমলা বিদ্যামন্দির স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্ররা হাতে লেখা একটি পত্রিকা বের করে। সুকান্ত এই পত্রিকার নাম দিলেন ‘সঞ্চয়’। এখানে সুকান্তের লেখা একটি হাসির গল্পও প্রকাশ পায়। এ সময় বিদ্যালয়ে ‘ধ্রুব’ নাটিকার নাম-ভূমিকায় অভিনয়ও করেন। তবে সুকান্তর প্রথম মুদ্রিত লেখা প্রকাশিত হয় বিজন কুমার গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘শিখা’ পত্রিকায়। বিবেকানন্দের জীবনী। লেখা প্রকাশের পর লেখালেখির প্রতি তার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। তবে এ সময় কবির জীবনে নেমে আসে এক বিপর্যয়। কবি তার মাকে হারান। মাকে হারালেও কবি মনোবল হারান নি। এগারো বছর বয়সে সৃষ্টি করলেন রূপক গীতিনাট্য ‘রাখাল ছেলে’। বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন কবি অরুণাচল বসুর সহযোগিতায় ‘সপ্তমিকা’ নামক একটি হাতে লেখা পত্রিকা সম্পাদনা করেন। লেখালেখির পাশাপাশি খেলতেন ব্যাডমিন্টন। সুযোগ পেলেই লেগে যেতেন ব্যাডমিন্টন অনুশীলনে।

১৯৪১ সালে রেডিওতে গল্পদাদুর আসরে সুকান্ত রবীন্দ্রকবিতা আবৃত্তি করে প্রশংসা লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণকালে নিজের লেখা কবিতা পাঠ করেন গল্পদাদুর আসরে। সুকান্ত রবীন্দ্র যুগের কবি হলেও তার লেখায় প্রভাবিত হন নি। তার রচনায় নিজস্বতা ফুটে উঠেছে সৃষ্টির শুরু থেকেই। ক্ষণজন্মা এই কবি শৈশবেই তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাবা নিবারণ চন্দ্র ভট্টাচার্য ব্যবসা করতেন বইয়ের। সেখান থেকেই বইয়ের পোকা হয়ে যান সুকান্ত। একাডেমিক শিক্ষায় তেমন একটা সফলতা অর্জন করতে না পারলেও নিজের শিক্ষা ভাণ্ডার পূরণ করেছিলেন নানা রকম বই পড়ে। সে সব প্রকাশ পেয়েছে তার চিন্তা চেতনায় এবং লেখনির খুরধারার মাধ্যমে। কাব্যসত্তা তার ভেতরে সর্বদা উজ্জীবিত থাকলেও তা প্রকাশ পেয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদি আগ্রাসন, সম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে শাক্তিশালী লেখনিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। লেখেন এসব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে। সে সময়ের চিত্র তুলে ধরেছেন কবিতায়। শব্দ দিয়েও যে সময়ের চিত্র অঙ্কন করা যায় তা সুকান্তই দেখিয়েছেন।

১৯৪৪ সালে আকাল নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার ‘কিশোর সভা’ বিভাগও সম্পাদনা করতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে নিজের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেন। এখানে দেখা যায় সুকান্তর পূর্বসূরী কবিরা নেতিবাদী কাব্য-পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছিলেন। সুকান্ত  তার বিপরীত স্রোত সৃষ্টি করে চল্লিশের দশকে ইতিবাচক জীবন-দর্শনের দ্বারা নতুন পথের যাত্রা শুরু করেন। সারা বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডব, ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনতার সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে স্বদেশে গণ-অভ্যুত্থান, দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলা—এই সবকিছুই ছিল তাঁর রচনার প্রেরণা।

সুকান্ত তাঁর সংগ্রামী চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন তাঁর অবিস্মরণীয় সাহিত্য-সৃষ্টির মাধ্যমে। দেশের মানুষকে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে উৎসাহিত করেছিলেন তাঁর লেখনির দ্বারা। কবিতার মধ্য দিয়ে সুকান্ত গেয়েছেন জীবনের জয়গান। ১৯৪২-এর শেষের দিকে সুকান্ত চলে আসেন ২০ নং নারকেল ডাঙা মেইন রোডে। ১৯৪৪ সালে কাশী যান। সে সময় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪৫-এ প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। এরপর ১৯৪৫-৪৬-এর সমস্ত গণ-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৬-এ পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের বিশেষ চিকিৎসা কেন্দ্র রেড-এড কিওর হোম, ১০ নং রডন স্ট্রীটে নিয়ে যাওয়া হয় কবিকে। এই অসুস্থতার মাঝেও ১৯৪৬-এর পূজাসংখ্যায় ‘স্বাধীনতায় সেপ্টেম্বর ১৯৪৬’ নামে একটি কবিতা লেখেন। কিছুদিন পরে সুকান্ত কিছুটা সুস্থ অনুভব করেন। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন। সেখান থেকে মেজদা রাখাল ভট্টাচার্যের বাড়ি শ্যামবাজারে আসেন। এখানে কবি কিছুদিন থাকেন। এরপর আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভর্তি হলেন যাদবপুর টি. বি. হাসপাতালে। খ.গ.ঐ.১ নং পেয়িং বেডের বাসিন্দা সুকান্ত। এরপর ১৯৪৭ সালের ১৩ মে  যাদবপুর টিবি হাসপাতালেই সমাজের আলো ছড়ানো কবি অন্ধকারে চলে যান।

সুকান্তের সাহিত্য-সাধনার মূল ক্ষেত্র ছিল কবিতা। তার কবিতায় সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা ও বিক্ষোভ ছিল প্রধান বিষয়বস্তু। তাঁর রচনাকর্মে শ্রেণি সংগ্রাম, গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাণীসহ শোষণহীন এক নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছে। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বৈপ্লবিক ভাবধারাটি যাঁদের  রচনায় সমৃদ্ধি হয়েছে, সুকান্ত তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবিতার ছন্দ, ভাষা, রচনাশৈলিও নিখুঁত।

সুকান্তের কবিতায় ফুটেছে তার নিজের জীবনও। জন্মলগ্ন থেকেই  কবি বেড়ে ওঠেন দ্রোহের আগুন নিয়ে। কিশোর বয়সেই ‘ক্ষুধার’ মতো ভয়াবহ শব্দের সঙ্গে পরিচিত হন। সেখান থেকেই কবি ক্ষুধার্ত, নিষ্পেষিত মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠেন। সুকান্ত কবিতার জগতে প্রবেশ করে জীবনের সুন্দর দিক, পৃথিবীর রূপ রহস্য ও মানবিক কল্যাণ বন্দনায় নিজেকে ব্যাপ্ত রেখেছিলেন। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে চেয়েছিলেন পুরো পৃথিবীটাকে বদলে দিতে।



বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৮ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।