ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লাসলো ক্রাসনাহরকাইয়ের সাক্ষাৎকার | ভূমিকা ও অনুবাদ: বিদ্যুত খোশনবীশ

অনুবাদ সাক্ষাৎকার / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৫ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৫
লাসলো ক্রাসনাহরকাইয়ের সাক্ষাৎকার | ভূমিকা ও অনুবাদ: বিদ্যুত খোশনবীশ

ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপি লেখক লাসলো ক্রাসনাহরকাইয়ের জন্ম হাঙ্গেরির গুলা শহরে, ১৯৫৪ সালে। ‘বিশ্বমঞ্চে কথাসাহিত্যে অনন্য অবদান’-এর জন্য এবছর  তাকে ভূষিত করা হয়েছে ‘ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ’-এ।

‘ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ’ কমিটি তার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে মন্তব্য করেছে, ‘তার লেখনির যে দিকটি পাঠককে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় তা হলো অসাধারণ বাক্যবিন্যাস। তার বিস্ময়কর দীর্ঘ বাক্যগুলো বিস্ময়কর-দীর্ঘ ও বন্ধুর পথ অতিক্রম করে যায়। এই পথ অতিক্রমের সময় তার বাক্যের সুর ক্রমাগত রূপান্তরিত হতে থাকে গাম্ভীর্য থেকে উন্মাদনায়, উন্মাদনা থেকে পরিহাসে এবং পরিহাস থেকে বিচ্ছিন্নতায়। এই মহাকাব্যিক বাক্যগুলো প্রতিটি প্যারায় নিরন্তর পুঞ্জিভূত করে রাখে প্রায় সব ধরনের অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত বিষয়কে। এ বিষয়গুলো যতটা মূল্যবহ, ঠিক ততটাই কদর্য ও গীতিময়। ’

লাসলো ক্রাসনাহরকাই প্রকৃত অর্থেই তার কথাসাহিত্যে দীর্ঘ ও জটিল বাক্য ব্যবহার করে অভ্যস্ত এবং তা অবশ্যই তার নিজস্ব শৈলীতে। এই দীর্ঘ বাক্যের সমন্বয়ে তিনি তার সাহিত্যে এমন এক জগৎ সৃষ্টি করেন যা আমাদের কাছে অপ্রচলিত, কখনও কদর্য ও ক্লান্তিকর। তবে বিস্মকরভাবে, সাহিত্যের এই ঝুঁকিপূর্ণ ও জটিল বৈশিষ্ট্য দিয়েই তিনি অর্জন করেছেন বিপুল জনপ্রিয়তা, সক্ষম হয়েছেন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে নতুন করে বিন্যাস্ত করতে ও সমৃদ্ধ করেছেন হাঙ্গেরিয় সাহিত্যকে। সেই সাথে তার সাহিত্যের সুপাঠ্য অনুবাদ মুগ্ধ করেছে ইংরেজি ভাষাভাষী সাহিত্যপ্রেমিদের। এজন্যই তাকে আখ্যায়িত করা হয়, ‘অপ্রীতিকর ও বিষণ্ণ বিষয়কেন্দ্রিক একজন উত্তরাধুনিক কথাশিল্পী’ হিসেবে। লাসলোর এমন অপ্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তিক লেখনিকে তার অনুবাদক কবি জর্জ জিরটেস মূল্যায়ন করেছেন, ‘আখ্যানের ধীরগতির লাভা স্রোতে ও আদর্শের বিস্তৃত এক কৃষ্ণ স্রোতস্বিনী’ হিসেবে। লাসলো ক্রাসনাহরকাইয়ের পাণ্ডুলিপি থেকে নির্মিত স্যাটানট্যাঙ্গো, মেলানকোলি অব রেজিসটেন্স কিংবা তুরিন হর্স চলচ্চিত্রগুলো যারা দেখেছেন তারাও উপর্যুক্ত মন্তব্যগুলোর সাথে একমত হবেন নির্দ্বিধায়।

বিশ্বজনীন এক বিরলপ্রজ ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহরকাইয়ের প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা হাতে গোনা। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন বেশ কয়েকটি আলোচিত ও জনপ্রিয় ছোটগল্প। ক্রাসনাহরকাইয়ের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নগন্য হলেও তার সাহিত্যে চিন্তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী ও সুগভীর। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস: স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫), মেলানকোলি অব রেজিসটেন্স (১৯৮৯), দ্য প্রিজনার অব উরগা (১৯৯২), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯), ফ্রম দ্য নর্থ বাই হিল, ফ্রম দ্য সাউথ বাই লেক, ফ্রম দ্য ওয়েস্ট বাই রোডস, ফ্রম দ্য ইস্ট বাই রিভার ( ২০০৩), ও জিওবো দেয়ার বিলো (২০০৮)। রিলেশন অব গ্রেস (১৯৮৬), ঈসায়াহ হ্যাজ কাম (১৯৯৮) এবং দ্য লাস্ট উল্ফ (২০০৯) ক্রাসনাহরকাইয়ের ছোটগল্পগ্রন্থ।

ক্রাসনাহরকাইয়ের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা কম হলেও তিনি ভূষিত হয়েছেন বহু পুরস্কারে। ‘ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ’-এর আগে তিনি তার সাতানতানগোর ইংরেজি অনুবাদের জন্য ২০১৩ সালে অর্জন করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘বেস্ট ট্রানস্লেটেড বুক অ্যাওয়ার্ড ইন ফিকশন’ এবং মেলানকোলি অব রেজিসটেন্স-এর জন্য জার্মানির ‘বেস্ট বুক অব দ্যা ইয়ার’ পুরস্কার।

অনূদিত এই সাক্ষাৎকারটি মূলত দুটি সাক্ষাৎকারের সংকলন। একটি প্রকাশিত হয়েছিল দি হোয়াইট রিভিও এবং অন্যটি লিট অ্যাক্রস ফ্রন্টিয়ার-এর অনলাইন সংস্করণে, ২০১৩ সালে।
___________________________________

অনুবাদের সুবিধা, অসুবিধা কিংবা বিপদ সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
     : আমি অনুবাদের সুবিধা বা অসুবিধা নিয়ে কথা বলব না কারণ এসবের কোনও অস্তিত্ব নেই। আমি কথা বলব বিপদ সম্পর্কে। আমার মতে, কোনও অনুবাদকর্মকেই মূল রচনার সাথে মিলানো যায় না। অনুবাদ অনুবাদকের নিজস্ব কর্ম, লেখকের নয়। মূল রচনায় লেখক নিজের ভাষায় যা লেখেন সেটাই তার কর্ম। কোনও লেখা অনুবাদক যে ভাষায় অনুবাদ করেন সেটা সেই ভাষায় নতুন এক সৃষ্টি রূপে আবির্ভূত হয়, যার কৃতিত্ব পুরোপুরি অনুবাদকের। নতুন এই সৃষ্টিকর্ম মূল লেখার সাথে কমবেশি মিলে যেতে পারে। যেমনটা মিল পাওয়া যায় একটি পরিবারের সদস্যদের সাথে, যদিও তারা কেউই এক নয়। আর মূল রচনাটির লেখক অর্থাৎ যার লেখাটি অনূদিত হয়েছে তিনি শুধু অনুবাদটি পড়েন। পড়ার সময় তিনি তার লেখার সাথে অনুবাদ কর্মটির কিছুটা মিল খুঁজে পান কিংবা কখনও কখনও অনেকখানি মিল খুঁজে পান। এই মিলে যাবার বিষয়টা যখন মূল লেখকের কাছে ভালো মনে হয় তখন তিনি খুশি হন, আর যখন বাজে ঠেকে তখন তিনি ক্ষুব্ধ হন। আমার জীবনে একবারই ক্ষুব্ধ হবার ঘটনা ঘটেছিল। আমার ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’-এর জার্মান অনুবাদ আমার কাছে খুবই বাজে ঠেকেছিল। আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলাম। তবে করার কিছুই ছিল না। একই লেখা একই ভাষায় দ্বিতীয়বার অনুবাদ খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু এই উদাহরণটি বাদ দিলে আমার লেখার বাকি সবগুলো অনুবাদই আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার সব অনুবাদকই অসাধারণ।

লেখালেখির চর্চা কিভাবে করেন?
     : আমি নির্দিষ্ট কোনও স্থানে বসে লিখি না। মানে, টেবিলে বসে কোনও আইডিয়া পাবার আশায় ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকার অভ্যাস আমার নেই। আমার লেখার সূত্রপাত হয় মাথায়, কারণ সাহিত্য চর্চাই আমার একমাত্র কাজ। এর একটা কারণ আছে। আমি যখন লেখালেখি শুরু করি তখন বেশ কঠিন সময় পার করতে হয়েছিল আমাকে। আমার কোনও টেবিল ছিল না এবং এমনকি একা থাকার মতো পরিবেশও ছিল না। তাই মস্তিষ্কে বাক্য তৈরি করে জমিয়ে রাখতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠি। যতক্ষণ না বাক্যগুলো একটি স্বাভাবিক বাক্য হিসেবে শেষ হতো, ততক্ষণ আমি মনে মনেই সংযোজন-বিয়োজন করতাম। যখন নিশ্চিত হতাম, বাক্যগুলো স্বাভাবিক হয়েছে তখনই কেবল লিখে রাখতাম। আমি এখনও তাই করি। অপরিচিত স্থানে, অস্বাভাবিক সময়ে—আমি প্রতিনিয়ত এভাবেই সাহিত্য চর্চা করি। ভাবনাগুলো গুছিয়ে একেবারে শেষ পর্যায়ে আমি কাগজ-কলম ধরি। আমার লেখায় কাটাছেঁড়ার প্রয়োজন হয় না, কারণ ওই কাজটা আমি মগজেই করে রাখি।

আপনি ছোটগল্পও লিখেন। আপনার ছোটগল্পগুলো কি ইউরোপীও ঐতিহ্য অনুসরণ করে?
     : না। ইউরোপীও ঐতিহ্য নয়, আমি গল্প লিখি আমার নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসরণ করে। আমার এই ঐতিহ্য খুবই ধীরগতির।

‘সাতানতানগো’ (স্যাটানট্যাঙ্গো) অত্যন্ত সফল একটি উপন্যাস। আপনি নিজেও সেরকমটি বলেছেন। কেন এই উপন্যাসকে এত সফল মনে করেন? বিশ্বে কিংবা সাহিত্যে এমন কিছু কি ঘটেছে, যেটা এই উপন্যাসের জন্য সাফল্যের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছে?
     : আমার ধারণা, যে পাঠকরা আমার ও বেলা টার-এর সাতানতানগো সিনেমাটি দেখেছেন আর সেই সাথে আমার মেলানকোলি অব রেজিসটেন্স, ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার ও অ্যানিমেল ইনসাইড পড়েছেন, তারা উপন্যাস হিসেবে সাতানতানগো পড়তে চেয়েছেন। আমার মনে হয়েছে, সাতানতানগো যখন প্রকাশিত হয় তখন পাঠক এরকম একটা কিছুর অপেক্ষাতেই ছিলেন। তারা আড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তা কিংবা কথিত নতুন ধারার ক্লান্তিকর সাহিত্য থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন; তারা এমন একটি বইয়ের  অপেক্ষায় ছিলেন যে বইয়ে বাস্তবতার ছোঁয়া থাকবে। এই পাঠকরা বিনোদনের পরিবর্তে অন্য কিছু চেয়েছেন। তারা জীবন থেকে না পালিয়ে জীবনটা অতিক্রম করতে চেয়েছেন। তারা বুঝতে চেয়েছেন, তাদেরও জীবন আছে; তারা শেষ পর্যন্ত বেদনাদায়ক সৌন্দর্যকেই বেছে নিয়েছেন। আমার ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমাদের মহৎ কোনও সাহিত্য নেই। কিন্তু পাঠকের এ ধরনের সাহিত্যের প্রয়োজন আছে, তবে অবশ্যই তা ঔষধ হিসেবে নয়, ভ্রম হিসেবেও নয়। পাঠকের এমন একজন মানুষ প্রয়োজন যিনি তাদের বলবেন, ঔষধ বলে কিছু নেই।

যদিও স্যাটানট্যাঙ্গো ও মেলানকোলি অব রেজিসটেন্স-এর মধ্যে শৈলীর মিল আছে কিন্তু তারপরও মেলানকোলি অব রেজিসটেন্স-এর বাক্যগুলো আমার কাছে ভিন্ন মনে হয়েছে: অনেক দীর্ঘ ও যতিচিহ্ন বিশিষ্ট। আপনি বলেছিলেন, স্যাটানট্যাঙ্গো লেখার মধ্য দিয়ে আপনি আপনার চারপাশের মানুষের দুঃখের কারণ আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। আপনি কি বলবেন, মেলানকোলি অব রেজিসটেন্স-এর থিম ও বাক্যগঠনের ধারণা আপনার মাথায় কিভাবে এলো?
     : স্যাটানট্যাঙ্গো লিখে আমি খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলাম না। কারণ এটা আমি লিখেছি আমার স্বাভাবিক স্টাইলে। আমি কিছুটা পারফেকশনিস্ট। স্যাটানট্যাঙ্গো অনেকাংশে পরিপূর্ণ উপন্যাস ছিল। কিন্তু এই ‘অনেকাংশে’ শব্দটাই আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। আপনার জানা আছে, প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে শ্রেষ্ঠ হওয়া খুবই চমৎকার বিষয় কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের জন্য ব্যাপারটা ভয়াবহ। একারণেই, ‘অনেকাংশে ভালো’ কিংবা ‘অনেকাংশে সেরা’ উপন্যাস ব্যাপারটা আমার কাছে অসহনীয় ছিল। এজন্যই আমি আবারও চেষ্টা করেছিলাম ‘অনেকাংশে’ শব্দটা বাদ দিয়ে শুধু ‘সেরা’ একটা উপন্যাস লেখার জন্য। আমি যতগুলো বই লিখেছি তার প্রত্যেকটিই ছিল আমার কাছে নতুন এক্সপেরিমেন্ট, নতুন চ্যালেঞ্জ। আমি ভেবেছি, হয়ত আমার এখনও সুযোগ আছে সেই বইটি লেখার যে বইটি আমি লিখতে চেয়েছি। আর এ কারণেই আপনি আমার প্রতিটি বইয়ে আগের বইয়ের চেয়ে ভিন্নতা কিংবা অনেক বেশি ভিন্নতা ও নতুন কিছু খুঁজে পেয়েছেন। আমার জীবনে নিজস্ব একটা পদ্ধতি আছে। আমি সাহিত্যের ভাষা ও মানুষের মুখের ভাষার মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি করেছি কিন্তু প্রতিনিয়ত মানুষের মুখের ভাষার সাথেই বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছি।

আমার বাক্যগুলো দীর্ঘ হয় কারণ আমি বাক্যে ফুলস্টপ ব্যবহার করি না, আমি কমা ব্যবহার করি। মেলানকোলি অব রেজিসটেন্স লেখার মধ্য দিয়ে আমি একটি পরিপূর্ণ বই লিখতে চেষ্টা করেছি। এই বইয়ের বাক্যগুলো আগের বইয়ের বাক্যগুলোর চেয়ে আরও বেশি সুন্দর, যদিও স্যাটানট্যাঙ্গোতে আমি যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছি কিংবা যে বার্তা পাঠককে দিতে চেয়েছি তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। আমি শুধু আমার বাক্যগুলোকে আরও বেশি সুন্দর করে তুলেছি। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা পরিবর্তনের পর, স্যাটানট্যাঙ্গো লেখার পর আমার দর্শনের কোনও পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হয়েছে শুধু আমার ভাষা শৈলী, সুন্দর থেকে সুন্দরতর, কারণ ভাষা শৈলী সবসময়ই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দিয়েছে। ভাষার সৌন্দর্যের প্রতি আমার যে আকাঙ্ক্ষা, সম্ভবত এই বইয়ে আমি তার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছি।

বসবাসের জন্য বার্লিনকে বেছে নিয়েছিলেন কেন?
     : ১৯৮৭ সালে একটু দীর্ঘ সময় নিয়ে বার্লিনে থাকতে হয়েছিল। তখন থেকেই শহরটির সাথে আমার গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। সে সময় পশ্চিম বার্লিন ছিল ‘আহত আত্মা’দের উৎকৃষ্ট আশ্রয়। সব মাধ্যমের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা, এমনকি শিল্পী হতে ইচ্ছুক অনেকেই পশ্চিম বার্লিনে এসে ভীড় করত কাজ করার সুযোগের আসায়। তাছাড়া, এই শহরে বসবাস করার কারণেই নামীদামি সব শিল্পী-সাহিত্যিকদের সাথে আপনি একই পানশালায় যেতে পারছেন, একই টেবিলে বসতে পারছেন—এ বিষয়টাও আমার মধ্যে কাজ করেছিল। ওই সময় যাদের সাথে আমি নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলাম আজও তাদের সাথে সম্পর্কটা টিকে আছে। এখনও আমি ওখানেই আছি কিন্তু তারপরও এই নগরী সম্পর্কে আমার অনুভূতি এখন আর আগের মতো ইতিবাচক নয়। এই নগরী এখন বটতলার শিল্পী-সাহিত্যিকদের আকর্ষণ করে, যারা কোনও শিল্প সৃষ্টি করতে চায় না, শুধু বিক্রি করতে চায়।

বার্লিনে এখন আর সময় কাটান না?
     : হ্যাঁ, সময়কে আমি বার্লিন ও বুদাপেস্টের বাইরের এই ছোট পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছি। বার্লিন এখনও আমার শহর, বন্ধুর মতো, অদ্ভুত বন্ধু। যখন দেশের বাইরে যাই, থাকার জন্য আমি বড় কোনও শহরকেই বেছে নেই। তাই যখন ফিরে আসি তখন বুদাপেস্টের এই পার্বত্য অঞ্চলের মতো ছোট জায়গার প্রয়োজন হয়। এ জায়গাটাকে আমি খুব ভালোবাসি। এখানকার প্রকৃতি খুবই সক্রিয়। আমার বাড়ির সামনে একটি পর্বত, একটি উপত্যকা। স্বর্গীয় নয়, মানবিক। জায়গাটা মানবিক, কারণ উপত্যকার অসাধারণ প্রকৃতির সাথে আপনি একা থাকার সুযোগ পাবেন। আমার বাড়ির সামনে প্রকৃতির এরকম দৃশ্য থাকাটা জরুরি। এখানকার নিস্তব্ধতা কখনও কখনও আমার ভীষণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনার সাহিত্য চর্চায় অনুপ্রেরণা যোগায়?
     : আমি যখন লিখি বা মগজে লেখা সাজাই, তখন জানালার সবগুলো পর্দা নামানো থাকে। আমি যখন কাজ করি তখন শুধু কাজই করি। কাজের সময় আমি প্রকৃতি কিংবা নারীর সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকি না। যারা কাজের মানুষ তাদের জন্য একটি ছোট কিংবা বড় ঘরই যথেষ্ট, সেই সাথে মনোযোগ। আমার কোনও অনুপ্রেরণার প্রয়োজন হয় না।

এই পার্বত্য অঞ্চলেই আপনি ভালো লেখেন?
     : আমি বার্লিন কিংবা এই বাড়িতে লিখি না। আমি লিখি আমার মগজে। গত ছয় সপ্তাহ ধরে আমি একটা ছোটগল্প লিখছি। যখন পুরোপুরি গল্পটি সাজাতে পারব ঠিক তখনই আমি পুরো গল্পটা লিখব, তার আগে নয়।

আপনি যখন দেশের বাইরে থাকেন তখন বিদেশি ভাষা কিভাবে আপনার ভাষার ওপর প্রভাব ফেলে?
     : অন্যের ভাষাও তো একটা ভাষা। ওই ভাষায় যারা কথা বলে তারাও তো মানুষ। আমার আশেপাশে অপরিচিত কোনও ভাষা শুনতে বেশ ভালো লাগে। বিশেষ করে কোনও আরব দেশে। আরবি ভাষা অসাধারণ।

আপনাকে একটা সত্য গল্প বলি। আমি বলতে পারব না কত বছর, তবে জীবনের অনেকগুলো বছর আমি রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়েছি শুধুমাত্র অশুভ’র বিরুদ্ধে মানুষের তৈরি প্রতিরক্ষা স্থাপনা দেখার ইচ্ছায়। এই উদ্দেশ্যে আমি একবার ডেনমার্ক গিয়েছিলাম একটি নগর প্রাচীর দেখার জন্য। রাতে আমি ঘুমাতে পারছিলাম না, তাই ড্যানিশ রেডিও শুনছিলাম। সময়টা হবে রাত একটা থেকে দুইটার মধ্যে। এ সময় একটা অনুষ্ঠান শুনছিলাম যাতে মাঝে মধ্যেই একজন নারী ও একজন পুরুষ চমৎকার কবিতা পড়ছিলেন। অবিশ্বাস্যরকম সুন্দর ও বিরহের কবিতা। দুই সপ্তাহ পর কোপেনহেগেনে ফিরে আমার বান্ধবীকে বললাম, ‘গভীর রাতে কী অসাধারণ সাহিত্যের অনুষ্ঠান হয় তোমাদের দেশে। ’ আমার বান্ধবী বলল, ‘না তো! এমন কোনও অনুষ্ঠানের কথা তো আমি জানি না। ’ আমি বললাম, ‘কিন্তু আমি শুনেছি। ওটা অবশ্যই সাহিত্যের অনুষ্ঠান। ’ ও বলল, ‘না, আমাদের রেডিওতে এত রাতে এমন কোনও অনুষ্ঠান হয় না। আচ্ছা, এখন তো একটা বাজে, রেডিও ছেড়ে আমাকে শোনাও। ’ আমি সেই চ্যানেলটা খুঁজে পেলাম এবং ওকে শোনালাম। ও বলল, ‘এটা তো আবহাওয়ার খবর। ’

কাফকা ব্যতীত আর কী পড়েন?
     : যখন কাফকার লেখা পড়তে পারি না, তখন কাফকাকে নিয়েই ভাবি। যখন কাফকাকে নিয়ে ভাবতে পারি না, তখন কাফকাকে নিয়ে কেন ভাবতে পারলাম না তা নিয়ে অনুশোচনা করি। আর এরকম অনুশোচনা যখন আমার মধ্যে কাজ করে তখন আবারও কাফকার বই বের করি এবং পড়তে শুরু করি। আমার পড়াশোনা এভাবেই চলে। ঠিক একই ঘটনা ঘটে হোমার, দান্তে, দস্তয়ভস্কি, প্রাউস্ট, এজরা পাউন্ড কিংবা বেকেটের ক্ষেত্রেও।



বাংলাদেশ সময়: ১২১৪ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।