ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস | হাসপাতাল কত দূরে (শেষ কিস্তি)

ধারাবাহিক উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৮ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৫
সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস | হাসপাতাল কত দূরে (শেষ কিস্তি) অলংকরণ : ধ্রুব এষ

আগের কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন

দাদাকে ধরে প্রতিমা প্ল্যাটফর্মে নেমে আসতেই একজন লোক এগিয়ে এসে নমস্কার করল। প্রতিমা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গাড়ি দূরে রাখেননি তো?’
‘না না।

হুইল চেয়ারও নিয়ে এসেছি। ’ লোকটি পেছন থেকে ছোট হুইলচেয়ার এনে প্রতিমার দাদাকে বসিয়ে দিল। কুলির মাথায় মালপত্র চাপিয়ে প্রতিমা বললেন, ‘অতনু বাবু, এই স্টেশনটা আপনার পক্ষে নিরাপদ জায়গা নয়। তাড়াতাড়ি চলুন, আমাদের গাড়িতে ওঠার পর নামার জায়গা ঠিক করে ফেলেন। ’ প্রতিমা তার দাদার পেছনে হাঁটতে লাগলেন।

গাড়িতে ওঠার আগে কেউ কেউ তাকিয়েছিল কিন্তু অতনু আমল দেয়নি। ড্রাইভারের পাশে বসে কাচ তুলে দিল সে। পেছনে দাদা এবং বোন। তারও পেছনে মালপত্র সমেত কর্মচারীটি। প্রতিমা দাদাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এসি চালাব?’
‘হুঁ। ’
ড্রাইভার ইঞ্জিন এবং এসি চালু করল। প্রতিমা বললেন, ‘তুমি তো ট্রেনে অতনুকে দেখেছো। ওর খ্যাতির বিড়ম্বনার জন্য অজ্ঞাতবাসে যাচ্ছেন। কিন্তু এখনও জায়গাটা ঠিক করতে পারেননি। ’
‘হুঁ!’
‘আচ্ছা, কাঁকনপুরের নদীর ধারের গেস্ট হাউসে যদি উনি থাকেন তাহলে কেমন হয়?’
মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, ‘না। ’ তারপর বললেন, ‘আমাদের বাগানেও থাকতে পারেন। ’
প্রতিমা বলল, ‘ইস, মাথায় ছিল না। আচ্ছা অতনু বাবু, আপনি কি খুব আরামদায়ক জায়গায় থাকতে চাইছেন?’
‘না। অসুবিধে না হলেই হলো। ’
‘তাহলে ককটপুরে চলুন। এককালে আমাদের জমিদারি ছিল। সেসব চলে গেলেও একটা বড় বাগান, পুকুর আছে। তার মাঝখানে একটা আউট হাউসও, পরিষ্কার ঘর, বিছানা, অ্যাটাচ বাথ, মালীর বউ রান্না করে দেবে। যাবেন?’
‘এ তো মেঘ না চাইতেই জল। ’ অতনু  হাসল! ‘কিন্তু আমার কাছ থেকে রেন্ট নিতে হবে। ’
‘রেন্ট? ওটা তো কখনোই ভাড়া দেওয়া হয়নি। হবেও না। ’
‘তাহলে তো থাকা সম্ভব নয়। ’
মাথা হেলিয়ে বসেছিলেন প্রতিমার দাদা। বললেন, ‘শুনে ভালো লাগল, আপনার যা ইচ্ছা তাই দেবেন। ’
‘দাদা, কী বলছো? রেন্ট নেব আমরা?’ প্রতিমা অবাক হলো।
‘বিনা পয়সায় থাকলে উনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না। এটা ভালো। উনি যা দেবেন তা মন্দিরে দিয়ে দিও। ’

কাঁকনপুর একটা ছোট্ট জনপদ। সেখান থেকে আধমাইল দূরে প্রতিমাদের বাড়ি। প্রতিমা দাদাকে নামিয়ে অতনুকে বলল, ‘আসুন। ’
বসার ঘরে অতনুকে বসিয়ে প্রতিমা দাদাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, ‘আসুন, হাত-মুখ ধুয়ে নিন। ’
‘কেন?’
‘বারে। আজ তো লাঞ্চ খাওয়া হয়নি। ’
অতনু বুঝল তর্ক করে লাভ নেই।

প্রতিমা এলেন না। গাড়ি অতনুকে আরো সিকি মাইল দূরের বাগানবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল। প্রচুর গাছগাছালি, বড় পুকুর, মালী এবং তার বউটি। ব্যবহারও বেশ ভালো। ঘরে স্থির হয়ে বসামাত্র বৃষ্টি নামল। গাছের পাতায় বৃষ্টির শব্দ বাড়ছে। অতনুর মনে হলো ভাগ্যে ছিল তাই এখানে আসতে পেরেছে।

বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে সে তার মোবাইলের দিকে তাকাল। সুইচ অফ করে রেখেছে সে। নিশ্চয়ই অনেক মানুষ তাকে ফোন করে হতাশ হয়েছে, হোক। কিন্তু এখন তার উচিত ছিল একটা ফোন করা। সে যে ভালো আছে, ভালো জায়গায় আছে এই খবরটা মাকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু ফোন অন করতে সাহস পাচ্ছিল না সে। অন করা মাত্র যদি অন্য কারো ফোন এসে যায়? ওই যারা কাজটি করেছিল তারা তো তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। সে কাগজ পড়েছে ফোন অন থাকলে যেখানেই থাকুক, টাওয়ার লোকেট করে তাকে ঠিক ধরা যায়। বিশাল টাকা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে তারা যদি ছেলেবুড়ো পুলিশের কাছে যায়, ফোন অন থাকলে পুলিশ সন্ধান পেয়ে যাবে।

মোবাইল ফোন সরিয়ে রাখল অতনু। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আজ শেষ রাতে যখন বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে তখন নিজেই জানত না কোথায় যাচ্ছে। পুরীর টিকেট না কেটে সে তো দিল্লি বা মুম্বাইয়ের টিকেটও কাটতে পারত। আবার পুরীর ট্রেনে যদি সেকেন্ড ক্লাস পাওয়া যেত তাহলে ফার্স্টক্লাস টিকেট কাটত না। আর তা না কাটলে প্রতিমাদের সঙ্গে দেখা হতো না। একেই কাকতালীয় যোগ বলে!

প্রতিমা বেশ সপ্রতিভ মহিলা। স্মার্ট এবং ঝকঝকে। তার বৃত্তান্ত জানার পর তিনি একবারও কৌতূহল দেখাননি। বলেননি তার দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে বিপদ আছে কি-না বলতে। উল্টো দাদার অনুমতি নিয়ে তাকে এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু যে ক’দিন এখানে থাকতে পারে! চক্ষুলজ্জা বলে একটা ব্যাপার আছে। ওরা টাকা নেবেন না থাকার জন্য, খাওয়ার খরচ নাহয় সে জোর করে দেবে, কিন্তু এই বিশাল বাগানের মধ্যে সে কতদিন থাকতে পারে!

হঠাৎ মাথায় ভাবনাটা এলো। উড়িষ্যার পরে তেলেগু ভাষাভাষীদের বাস। ওখানে বাংলা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। ওখানকার কোনো সমুদ্রের ধারে গিয়ে থাকলে কেমন হয়! দরজায় শব্দ হলো। পাশ ফিরে তাকাল অতনু। মালী চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ‘বাবু, চা। চিনি-দুধ আলাদা এনেছি। ’
‘খুব ভালো। রাখো টেবিলে। তোমার নাম কী?’
‘আজ্ঞে বনমালী। ’
‘তুমি আর তোমার স্ত্রী এখানে থাকো?’
‘আজ্ঞে। ’
‘এখান থেকে বাজার কত দূরে?’
‘ওই সিকি মাইল দূরে। বাবু, রাত্রে কী খেতে ইচ্ছে করে?’
‘তুমি যা দেবে তাই খাব। ’ চায়ের কাপ হাতে নিল অতনু!
‘খাবার তো ছিল না, আজ রাতে ডিম করতে বলি?’
‘বেশ তো!’
‘বৃষ্টিটা নেমে গেল, তা নইলে পুকুর থেকে মাছ ধরা যেত। ’
‘খাওয়া নিয়ে চিন্তা করো না। ’
‘আজ্ঞে, আসি। ’ বনমালী চলে গেল।

বৃষ্টিটা বাড়ল। সেই সঙ্গে ঝড়। জানালাগুলো বন্ধ ছিল, অতনু বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সুপারি গাছের মাথাগুলো ঝড়ের দাপটে একবার এদিক, একবার ওদিক করছে।

আলো মিশে বেরোলেও ঝাপসা দেখতে পেল অতনু। সে মালীর বাড়িটাকে লক্ষ্য করতে পারল। বাগানের অন্যপ্রান্তে গাছপালার ফাঁক দিয়ে চিমটির আলো মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। এ সময় আড়ালে আলোটাকে মুছে দিচ্ছে বারংবার। মালী ওখান থেকে এই বৃষ্টির মধ্যে তার চা দিতে এসেছিল? বেচারা!

তারপরই খেয়াল হলো, লোকটার জামা ধুতি ভিজে যায়নি তো! নিশ্চয়ই ছাতা নিয়ে সে এসেছিল কিন্তু হাতে চায়ের ট্রে থাকলে জলের ছাঁট কি সম্পূর্ণ বাঁচানো সম্ভব? তাহলে কি এই বাড়ির ওপাশের ঘরে রান্না করা হয়? অতনু তার ঘরে ঢুকে চায়ের ট্রে-টা পরীক্ষা করল। না, তাতে এক ফোঁটাও জল পড়েনি।

তাহলে যেখানে আলো জ্বলছিল, সেখান থেকে চা নিয়ে মালী আসেনি! বেকুব বনল অতনু। ঘরের ভেতর টিউবলাইট জ্বলছে। এখানে নিশ্চয় লোডশেডিংও হয় না। তবু সতর্ক থাকা দরকার। মালীকে বলতে হবে একটা হ্যারিকেন জ্বেলে এখানে রেখে যাও, না হলে কয়েকটা মোমবাতি দরকার।

হঠাৎ চিৎকারটা কানে এলো। প্রথমে একটা, তারপর গলা মেলাল অনেকে। এই বৃষ্টিতে নিশ্চয়ই অসুবিধায় পড়েছে শেয়ালগুলো। শেয়ালের ডাক সে টিভি অথবা সিনেমায় শুনেছে। এ রকম বৃষ্টির মধ্যে জঙ্গলে পরিবেশে এই প্রথম শুনতে পেল। প্রথমে মজা লাগলেও একটানা শুনতে শুনতে যখন অস্বস্তি শুরু হলো তখন দরজায় শব্দ শুনে মুখ ফিরিয়ে বনমালীকে দেখতে পেল সে।
বনমালী বলল, ‘শিবারা কাঁদছে, ভয় পাবেন না বাবু। ’
‘শিবা?’
‘শিবা, আপনারা যাকে শিয়াল বলেন। ’
‘এখানে তাদের আস্তানা নাকি?’
‘হ্যাঁ, পাশেই বিল আছে। বিলের ধারে শিবারা থাকে, হায়েনাদেরও ওখানে দেখা যায়। তবে ক্ষিদে না পেলে ওরা বাগানে ঢোকে না। ’
‘সে কী! ক্ষিদে পেলে তো ঢোকে!’
‘ওদের নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না বাবু। আমি তো আছি। রাতে কখন খাবেন? ন’টার সময় খাবার দেব?’
‘দিও। ’

বনমালী দরজা থেকে চলে গেল। হঠাৎ অতনুর মনে হলো ওর রান্নাঘরটা দেখে আসব। সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে অবাক হয়ে যায়। বনমালী বৃষ্টির মধ্যে সেই দূরের আলোর দিকে হেঁটে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ও ছায়া নিয়েই যাচ্ছে, যা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। খারাপ লাগল অতনুর। সে আসায় লোকটির খাটুনি বেড়ে গেছে। এই সময় তীব্র এবং কটু হাসির শব্দ ভেসে এলো বৃষ্টির ভেতর দিয়ে। গায়ে কাঁটা ফুটল অতনুর। এটা কার হাসি? মনে পড়ল, বইয়ে পড়েছিল, হায়েনারা ডাকলে তা হাসির মতো শোনায়। ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে দিল অতনু।

ঠিক ন’টার সময় বন্ধ দরজায় শব্দ হলে অতনু জিজ্ঞাসা করল, ‘কে?’
‘আজ্ঞে, আমি, বনমালী। খাবার এনেছি। ’
দরজা খুলল সে। বৃষ্টি এখনও থামেনি। বনমালী টেবিলে খাবার, জল রেখে ফিরলে অতনু বলল, ‘আজ রাতে আর তোমাকে আসতে হবে না। কাল থালা-গ্লাস নিয়ে যেও। ’
‘আজ্ঞে, ঠিক আছে। ’ বনমালী বেরিয়ে গেল।

দরজা বন্ধ করতে এগিয়ে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল অতনু। বনমালী বৃষ্টির মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছিল, এই সময় বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠায় স্পষ্ট দেখা গেল তার মাথায় ছাতি নেই। ঘুরে টেবিলের কাছে চলে এলো অতনু। ট্রের ওপর তিনটি বড় বাটিতে ঢাকা খাবার, প্লেট, চামচ, গ্লাসে জল। কিন্তু তাদের গায়ে এক ফোঁটা জল লেগে নেই। বনমালী বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে এগুলো এনেছে কিন্তু বৃষ্টির জল পাত্রগুলোকে স্পর্শ করেনি।   দ্রুত দরজা বন্ধ করল অতনু। এই সময় শেয়ালগুলো আবার ডেকে উঠতেই সে খাটের ওপর উঠে বসল।

হঠাৎ মনে হলো, বনমালী জীবিত মানুষ তো? এখানে এসে অবাক ওর বউকে সে দেখতে পায়নি। গ্রামের মেয়েরা সচরাচর পরপুরুষের সামনে বের হয় না বলে তার মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন সন্দেহ হচ্ছে বনমালী এখানে একাই থাকে না তো!

রক্তচাপ যে বেড়ে যাচ্ছিল তা অনুভব করল অতনু। তার হঠাৎ ঘাম হতে লাগল। মাথা ঘুরছে। সে উঠে বাথরুমে গেল মুখে-মাথায় জল দিতে। আলো জ্বেলে বেসিনের কলে খানিকক্ষণ জলে মুখ-মাথা ধোয়ার পর স্বস্তি হলো। সোজা হয়ে আয়নায় মুখ দেখতে গেলে চমকে উঠল সে। তার মুখের ওপর কালো ছায়া ঝুলছে। অস্পষ্ট নাক-চোখ ঠোঁট, অথচ গলা-কাঁধ স্বাভাবিক পরিষ্কার।

হৃৎপিণ্ড এক লাফে গলার কাছে চলে এলো। ঘরের দরজা খুলে দৌড়াতে চেষ্টা করল অতনু। বৃষ্টিতে ভিজছে, পায়ের তলায় কাদা সরে সরে যাচ্ছে কিন্তু সেসবে তার খেয়াল নেই। বাগানের বাইরে রাস্তায় এসে সে পাগলের মতো অন্ধকার দেখতে লাগল। শরীর ভারী হয়ে এলো, মাথা ঘুরছে। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর সে বুঝতে পারল দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি কমে আসছে। ঠিক তখনই দূরের অন্ধকারে দুটো আলোর বিন্দু ফুটল। চোখ ঝাপসা, তবু অতনু বুঝতে পারল বিন্দু দুটো বড় হচ্ছে। গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শেষ শক্তি খরচ করে সে দু’হাত তুলে চিৎকার করতে লাগল গাড়িটাকে থামানোর জন্য।
শেষ পর্যন্ত গাড়িটা থামল। গাড়ির ঢাকনা ধরে কাতর গলায় অতনু বলল, ‘আমাকে একটা হাসপাতালে পৌঁছে দেবেন। আমি খুব অসুস্থ?’
পেছনের দরজা খুলে গেল। অতনু পাগলের মতো পেছনে উঠে বসে হাঁপাতে লাগল।
গাড়িটা ছুটছিল। হাসপাতাল আর কতদূরে!



বাংলাদেশ সময়: ১৫২৭ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।