ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বহ্নি ও বকুলের এইসময় | রুমী কবির (সমাপনী কিস্তি)

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৭ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৫
বহ্নি ও বকুলের এইসময় | রুমী কবির (সমাপনী কিস্তি)

প্রথম কিস্তি পড়তে ক্লিক করুন

বলতে বলতে বকুলের গলা ধরে আসছিল। হঠাৎ আমার দিকে খেয়াল হতেই ও সামলে নেয় নিজেকে।

আমার তখন আবারও অস্বস্তি এসে পীড়া দিতে থাকে। বকুল চুপচাপ বসে থাকে মাথা নিচু করে। শরীফও চিবুকে হাত রেখে নিরুত্তাপ, নিশ্চুপ হয়ে যায় মুহূর্তেই। ঘরটা নিমেষেই থমথমে হয়ে যায়। আমি পরিবেশ স্বাভাবিক করে আনতে বকুলকে জিজ্ঞেস করি, “বহ্নি আপনার মেয়ে বুঝি?”
“হ্যাঁ। ” অল্প হাসে বকুল। তারপর বলে, “ও, তাই তো! বহ্নির সাথে তো আপনাদের পরিচয়ই হলো না! একমাত্র মেয়ে আমার। ”
বহ্নিকে ডাকে বকুল, “বহ্নি! মামনি! এদিকে এসো! তোমার আংকেল ডাকছেন!”
মেয়েটা রান্নাঘর থেকে “আসছি মা” বলে চায়ের ট্রে হাতে করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ধীর পায়ে আমাদের ঘরে ঢোকে। ট্রে-টা সামনের টেবিলে রেখে সালাম জানায় মিষ্টি হেসে। শরীফ তখন বহ্নিকে এক হাতে টেনে নিয়ে পাশের চেয়ারে বসায়। ওর কাঁধে আলতো হাত রেখে বলে, “কোন ক্লাসে পড়ো, মামনি!”
“নাইনে। ”
“বাবার কথা মনে পড়ে না?”
“ওমা! বাবাকে তো আমি দেখিইনি!” বিস্ময় ঝরে বহ্নির কণ্ঠে, “কী করে মনে পড়বে? আচ্ছা, আপনি নাকি বাবার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন?”
“হ্যাঁ আঙ্কেল, আমরা তো একই সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। আমরা দুজন একই গ্রামে থাকতাম, একই কলেজে পড়তাম। ”

বহ্নি হয়ত আলাপে মজা পেয়ে যায়। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা আঙ্কেল, বাবাকে ওরা ধরল কিভাবে? নানা বাড়ির মসজিদের ইমাম আমাদের দেশেরই আরেক বাঙালি নাকি ধরিয়ে দিয়েছে? তার মানে আমাদের নিজের দেশের মানুষই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে?”

শরীফ সঙ্গে সঙ্গে এত প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। একটু ভেবে বলে, “হ্যাঁ, ওরাই ধর্মের নামে নিজ দেশের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ওরাই রাজাকার, আল বদর, শান্তি কমিটি বানিয়েছিল। আর নিরীহ মানুষদের ধরে ধরে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করেছে। থাক সেসব মামনি! তুমি বড় হলে আরো অনেক কিছুই জানতে পারবে। ”

চুপ হয়ে বসে থাকা কিশোরী বহ্নি তখন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বয়সের তুলনায় ওর শরীরটা একটু বেশিই বেড়েছে মনে হয়। চেহারাটা কার মতো হয়েছে? বকুলের কিছুটা পেয়েছে বৈকি। কিন্তু ওর চোখে, মুখে, গড়নে আনোয়ারকে খুঁজে পাওয়া যায় কি? বহ্নি একসময় শরীফের পাশ থেকে উঠে নীরবে পাশের ঘরে চলে যায়।

বকুল হঠাৎ উতলা হয়ে বলে, “এই যা! চা ঠাণ্ডা হচ্ছে যে! নিন। সজল ভাই, প্লিজ!”

চা হাতে নিয়ে আমি শরীফের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির তারিফ করি মনে মনে। মেয়েটার ইন্টারভিউয়ে টিকে গেছে শরীফ।

বকুল বলে, “বাঁচালেন শরীফ ভাই। মেয়েটা মাঝে মাঝেই এরকম বিরক্ত করে। ওর বাবার খুঁটিনাটি জানতে চায়। ক্লাসে তো মেয়েরা ওকে মুক্তিযোদ্ধার কন্যা বলে ডাকে। ”
আমি হেসে বলি, “ভালই তো। আজকাল মুক্তিযোদ্ধাদের তো লোকে ভুলেই যাচ্ছে। ”

শরীফ কিছুক্ষণ আনমনা ছিল। হঠাৎ বকুলের চোখ বরাবর চোখ রেখে বলে, “আচ্ছা, এত দীর্ঘ সময় কী করে লুকিয়ে থাকতে পারলে বলো তো? আমাকে না হয় আনোয়ারের মতো ভালবাসোনি, কিন্তু একজন টিচার হিসেবে বরাবরই তোমার কাছের মানুষ হিসেবেই তো ছিলাম! তাহলে বিপদের দিনগুলিতে আমাকে খবর দাওনি কেন?”

বকুল সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না। একটু ভেবে বলে, “আমাকে বাকি জীবন এভাবেই কাটাতে হবে শরীফ ভাই। বহ্নিকে  গড়ে তুলতে আর ওই শয়তান রাজাকারদের ছায়া থেকে দূরে রাখতেই নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখা ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে বলুন? মাঝে মাঝে ভয় হয়, না জানি কখন গ্রামের লোকেরা আমাদের দেখে ফেলে! তাছাড়া ওই বুড়ো রহমত মোল্লাকে আমি এখনো ভয় পাই। ”

শরীফ বলে, “তা তো পাবেই। শুনলাম ওই হারামজাদাটাই নাকি এবার চেয়ারম্যান হয়েছে, তাও আবার অনেক ভোটে। গ্রামের মানুষগুলো কি এত সহজেই ভুলে যাচ্ছে সব কিছু? নাকি এরা জিম্মি হয়ে আছে এইসব ঘাতক দালালদের বহুরূপী চেহারায়?”

বকুল বলে, “আপনি তো জানেনই, গ্রামের লোকের কত গঞ্জনা সইতে হয়েছে আমার। আনোয়ারকে যেদিন চোখের সামনে মেরে ফেলল, সেদিনই তো বুঝতে পারলাম পুরো ঘটনাটি ছিল রহমত মোল্লার সাজানো নাটক। একাত্তরের যুদ্ধ আমাকে কী দিয়েছে? দেশটা স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমি তো সবই হারিয়েছি! বাসর রাত ফেলে আনোয়ারের যুদ্ধে যাওয়ার দৃশ্য দেখলাম, চোখের সামনে পাকবাহিনী বাবা-মা আর ছোট ভাইটাকে গুলি করে মারল, সেই নির্মম দৃশ্যও দেখলাম। এখন শুধু বেঁচে আছি দুঃসহ জীবন সংগ্রাম আর বহ্নিকে নিয়ে সত্য-মিথ্যার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে। ”

বকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর একটু দম নিয়ে আবার বলে, “রহমত মোল্লার অত্যাচারে টিকতে না পেরে পালিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। বলতে পারেন সিনেমার কাহিনীর মতোই ওই বুড়ো ভদ্রলোকটির কাছে আশ্রয় পাই। নিঃসন্তান বেচারী আমাকে নিজের মেয়ে করে এ বাসাতেই রেখে দিলেন। এরপর স্বাধীন দেশের মাটিতে তার তিন মাস পরই বহ্নির জন্ম হলো। ”
“তা চলছে কী করে, মাস্টারি করেই?” শরীফ প্রশ্ন করে।
“হ্যাঁ, স্কুলের চাকরিটা হঠাৎ করে পেয়ে গেলাম। জগন্নাথ কলেজ থেকে এইচএসসি, বি এ টাও শেষ করেছি। কী করব, বাঁচার জন্যেই আবার পড়ালেখা করতে হলো। ”

শরীফ ‘হুম’ উচ্চারণ করে। কথা বলতে বলতে বকুলের দুচোখ ছল ছল করছিল, ও তা বুঝতে পেরে ম্লান হেসে নিজেকে আবার স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে, “ও! তাই তো! আপনার তো কোনো খবরই নেয়া হলো না শরীফ ভাই! সরি! তা, ছেলেমেয়ে কয়টি আপনার?”
ওদের কথোপকথনে এবার জবাবটা আমিই দিই, “বিয়ে করলে তো!”
বকুল কিছুটা বিব্রত হয় বোধ করি। একটু হাসে, কিন্তু কিছু বলে না। শুধু মায়া ভরা চোখ দিয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে শরীফের দিকে।
শরীফ বলে, “বহ্নি গ্রামের বাড়ির কথা বলে না কিছু?”
“বলেই তো। ও তো উনাকে নানুভাই বলেই জানে। আর দাদা-দাদীর কথা বললে সত্যি কথাটাই বলি, পাক হানাদারদের গুলিতে শহীদ হয়েছেন সবাই। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। আর সে জায়গায় ঘর উঠিয়েছে রহমত মোল্লা। ”
“কিন্তু এভাবে কদ্দিন চলবে বকুল?”
“জানি না শরীফ ভাই। ”
এসময় বয়স্ক মানুষটির খুক খুক কাশির শব্দ শোনা যায়। বহ্নিকে ডাকেন অস্পষ্ট গলায়। বহ্নিকে তখন “আসছি নানা ভাই” বলে ছুটে যেতে দেখা যায়।

শরীফ বলে, “দ্যাখো বকুল, স্বাধীনতার জন্য যদি লাখ লাখ বীর সৈনিক রক্ত দিতে পারে, যদি ধর্ষিতা হতে পারে হাজার মা-বোন, সেখানে বহ্নির দোষ কোথায়? আমাদের মাঝে যদি স্বাধীনতা থেকে থাকে, তবে বহ্নিও আমাদের স্বাধীনতা। ওকে সেইভাবেই মানুষ করে তুলতে হবে। ” শরীফ কথাগুলো বলতে বলতে অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। কথাগুলো তখন বেশ উচ্চকণ্ঠেই উচ্চারিত হয়। বকুল তখন অস্বস্তি বোধ করতে থাকে বহ্নি শুনে ফেলতে পারে সেই আশঙ্কায়; এমনকি পুরো ঘটনাটি যদি আমি নিজেও জেনে ফেলি, সেই অস্বস্তিতে ইতস্তত করতে থাকে। আমি শরীফকে খোঁচা দিই নিচু স্বরে কথা বলতে। শরীফ স্বাভাবিক হয়।

বকুলের ভেতরে সবকিছু মিলিয়ে কী যেন হচ্ছিল তখন। একদিকে একমাত্র সন্তান বহ্নি, আর অন্যদিকে একসময়ের নীরব প্রেমিক শরীফের উপস্থিতি। হয়ত শরীফের ভেতরও একই অনুভূতি তখন। আমার জন্যে কি ওদের কথাবার্তার অসুবিধা হচ্ছে? বকুল তো জানে না আমি ওর সব জানি। কিন্তু ওকে তো আর কোনোভাবেই তা বোঝানো ঠিক হবে না।   আমার উপস্থিতিটা আমাকেই পীড়া দিতে থাকে। বকুল একসময় “একটু বসুন” বলে পাশের ঘরে চলে যায়।

শরীফ আমার দিকে তাকায়। একটা সিগারেট ধরায়। বকুল কি তবে কিছুক্ষণ একা থাকার জন্যেই চলে গেল? নাকি দীর্ঘদিন পর পুরনো স্মৃতির ভারে কান্না চেপে রাখতে পারছিল না?

ভেতরে বকুলের মিহি কণ্ঠ শোনা যায়, “মামনি! ভাত বসাও নি এখনো?”
“না মা! আমি এখুনি যাচ্ছি!”
“শোনো, চাল বেশি দিও, তোমার আংকেলরা খেয়ে যাবেন!”

বহ্নিকে তখন ওর নানা ভাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখা যায়। আমার তখন কেন জানি অসহ্য লাগে সবকিছু। শরীফকে বলি, “দ্যাখ, তোদের মধ্যে আমার থাকাটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। ”

শরীফ দুই ঠোঁটের মাঝে ওর আঙুল চেপে ধরে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করে। কিন্তু আমার তখন আর তর সয় না। শরীফের কাঁধে চাপ দিয়ে বলি, “বকুলকে বলিস পরে একদিন আসব। প্লিজ, বুঝিয়ে বলিস!”

শরীফ অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকায়। আমি শরীফের পিঠ চাপড়ে দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে আসি।

রাস্তায় নেমে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিই। শরীফের দেয়া সিগারেটটা পকেট থেকে বের করে জ্বালাই। এ-ই সেই বকুল। যার কথা শরীফ আমাকে মাঝে মধ্যেই বলত। একাত্তরের জুলাই মাসের কোনো এক বর্ষণ মুখর রাতে আনোয়ার যখন বকুলদের গ্রামের পাশের বড় রাস্তার বিশাল ব্রিজটা মর্টার মেরে উড়িয়ে দিতে এসেছিল, সেই রাতেই অপারেশন শেষে সঙ্গীদের সাথে ফিরে না গিয়ে ছদ্মবেশে দেখা করতে এসেছিল প্রিয়তমা নববধুর কাছে। ভেবেছিল, পাক সেনাদের ভয়ে বাসর ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়া আনোয়ার যদি মুক্তিযোদ্ধার বেশে  বকুলের পাশে দাঁড়াতে পারে—তখন এর চেয়ে মধুর মিলন আর কী হতে পারে! কিন্তু সেই সম্ভাবনাও ভেস্তে গেল সেদিন। বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে থলের ভেতরে লুকিয়ে রাখা এলএমজিটা নিয়ে আনোয়ার ঘরে ঢোকা মাত্রই বকুল আকাশের চাঁদ পাবার মতোই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল। আনোয়ারকে বুকের মাঝে টেনে নিতেই দরজায় ঠক ঠক, ধুম ধাম এলোপাথাড়ি শব্দ এবং মুহূর্তের মধ্যেই দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছিল রহমত মোল্লার রাজাকার বাহিনী। আনোয়ার আর সুযোগই পেল না নিজের অস্ত্র বের করে প্রতিরোধ তৈরি করার। সেরাতেই মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার বন্দি হলো পাক সেনাদের ক্যাম্পে। পরদিন রহমত মোল্লা আসে বকুলের কাছে। বকুলকে প্রস্তাব দেয় যে, মেজর সাহেবকে বকুল নিজে গিয়ে যদি অনুরোধ করে, তাহলে আনোয়ারকে ছেড়ে দিতে পারে। বকুল পাগলের মতো আনোয়ারের জীবন বাঁচাতে তাই করেছিল। হাত-পা বাঁধা বন্দি আনোয়ারের পাশ দিয়েই বকুল পাশের ঘরে বসে থাকা মেজরের ঘরে গিয়েছিল। রহমত মোল্লা সেদিন মেজরের সামনে প্রভুভক্ত চামচা সেজে পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বুঝিয়েছিল, শয্যায় গিয়ে মেজরকে খুশি করতে পারলেই আনোয়ারকে ছেড়ে দেয়া হবে। বকুল সরল বিশ্বাসে অনায়াসে রহমত মোল্লার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল সেদিন। আর অসহায় আনোয়ার পাশের ঘরে বন্দি খাঁচায় আটকে পড়া বাঘের মতো শুধু গর্জন করে করে বকুলকে নিষেধ করেছে। বকুল অবুঝ হলেও আনোয়ার তো ঠিক ঠিকই জানত যে, তাকেও বাঁচিয়ে রাখা হবে না, বকুলকেও রেহাই দেবে না শয়তানগুলো। এর পরের ঘটনাটি ছিল আরও নির্মম। মেজর তার আকাঙ্ক্ষিত পর্বটি সমাধা করে পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে বকুলকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে টেনে নিয়ে আনোয়ারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তারপর একটা সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার পর হঠাৎ পিস্তল উঁচিয়ে একে একে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছিল আনোয়ারের বুকে। তারপর বকুলের আর কিছুই মনে নেই। পরদিন খালের পাড়ে অচৈতন্য বকুলকে পাওয়া না গেলে সেও হয়ত মরে যেতে পারত সেই যাত্রায়।

কিন্তু বেঁচে থেকেও বকুল শান্তিতে থাকতে পারেনি গ্রামে। পাক সেনার সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে আনোয়ার পাকসেনাদের ক্যাম্পে আটক থাকার সময় তাঁকে তালাক দিয়েছে—রহমত মোল্লার এধরনের কুৎসা রটনায় অতীষ্ট হয়ে উঠেছিল বকুল। বাড়িতে ওকে একা অসহায় পেয়ে শ্লীলতাহানিরও চেষ্টাও করেছিল রহমত। বকুল তখন বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। শেষে গর্ভের যে জীবনটা সুপ্তোত্থিত হচ্ছিল, তারই টানে মাতৃত্ববোধ এসে ওকে বাঁচিয়ে রাখে। গ্রাম থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে। নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করে।

শরীফ আমাকে বলত, দ্যাখ সজল, বকুলকে যদি কোনোদিন খুঁজে পাই, তবে ওকে আমি জীবন-সাথী করে রাখব।

আজাদ সিনেমা হলের কাছাকাছি হতেই দেখি ছয়টা-নয়টা শো সবেমাত্র শেষ হয়েছে। লোকজনের ভিড় সেখানে। রাত বেড়েছে বৈকি। একটু একটু শীত লাগছিল। ততক্ষণে একটা মিনিবাস এসে দাঁড়ায়। কেউ নামল না। তবে ধস্তাধস্তি করে লোকজন উঠতে শুরু করল। আমিও শরীরটা গলিয়ে দিই ভেতরে। একটা আসন পেয়ে বসে যাই।

মিনিবাস চলতে শুরু করে। একটা ট্রাক ঘর্ঘর শব্দ করে পাশ কেটে চলে যায়। রিক্সাগুলোর এলোপাথাড়ি ছুটাছুটি-ক্রিং ক্রিং বিরামহীন শব্দ। বাইরে থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে ঢোকে খোলা জানালা দিয়ে। মাথার লম্বা চুলগুলো উড়তে থাকে আমার। ওরা কি আবারও মুখোমুখি বসেছে? শরীফ কি পারবে বকুলকে নিজের করে নিতে? আর বহ্নি? ও-ই বা কী করছিল তখন? সে রাতে রাস্তা কাঁপিয়ে মিনিবাসটা ছুটে  চলছিল ঊর্ধ্বশ্বাসে।

“কী ব্যাপার সজল! একটু আগে পারিশাকে দিয়ে একবার ডেকে পাঠালাম, কোনো সাড়া দিলে না। এবার আমি নিজে এসে তোমার পাশে প্রায় দুই মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি, তবু কোনো নড়চড় নেই, ঘটনাটা কী বলো তো শুনি? কিসের ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছো?”

রেহানার ঝাঁঝালো কণ্ঠে আমার ধ্যান ভাঙে। তন্ময়তার ঘোর কাটতেই দেখি বাইরের বৃষ্টি থেমে গিয়ে সেখানে রাতের বৈদ্যুতিক বাতির উজ্জ্বলতা। বিটুমিনের কালো রঙের রাস্তাটি বাতির আলোয় চিকচিক করছিল তখন।

রেহানা এবার আমার পিঠে হাত রেখে বলে, “লেটস গো, বাডি! বৃষ্টির আমেজে অনেকক্ষণ ঝিম মেরে ছিলে, এবার ডিনার খাবে চলো। ”

আমি সোফা থেকে ওঠে রেহানার পিছু নেই। বহ্নি-বকুলদের স্মৃতির ক্যানভাস চাপা পড়ে যায় ততক্ষণে। খাবার টেবিলে পারিশা বসে আছে। ও তখন তানিশাকে ডাকাডাকি করছিল হোম ওয়ার্ক রেখে খাবার খেয়ে যেতে। প্লেটে ভাত নিতে নিতে রেহানাকে বলি, “তোমার কি মনে আছে রেহানা, একদিন বকুল, বহ্নিদের কথা বলেছিলাম না?”
“ও, হ্যাঁ, তো কী হয়েছে? অনেক দিন আগে একবার বলেছিলে ওদের গল্প। ”
“গল্প হলেও ওদের জীবনে ওটাই ছিল সত্যি। দ্যাখো, আমাদের এই পৃথিবীটা কত ছোট, আর ইন্টারনেটের বদৌলতে আমাদের সব কিছুই আজ হাতের মুঠোয়। ”
“আরে, কী বলতে চাও, ঝটপট বলে ফেলো না মশাই!” রেহানা অনেকটা উতলা হয়ে প্লেট থেকে খাবার মুখে দিতে দিতে আমার দিকে তাকায়।

আমি বলি, “ওই বকুলদের খোঁজ পেয়েছি এতদিন পর। ফেসবুকে ঢুকেই দেখি বকুলের ম্যাসেজ। কিভাবে যেন আমাকে বের করেছে! এখন খুঁজছে আমাকে, জরুরি কথা বলতে চায়। ”
“বেশ তো, কথা বলো। দিয়েছো তোমার ফোন নাম্বার?”
“হ্যাঁ। ”

এরমধ্যেই বোস্টন থেকে পবনের ফোন আসে। আমাদের বড় ছেলে পবন ওখানকার ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। পবন বলতে গেলে বাংলাদেশের সব খবরাখবরই রাখে। মেয়ে দুটোর মতো অতটা আমেরিকান হতে পারেনি সে। এদেশে জন্মগ্রহণ করেও ওর চেতনায়, অস্থিমজ্জায়, স্নায়ুতে পূর্ব-পুরুষের অস্তিত্বই বেশি খুঁজে পাওয়া যায়। তাই বাংলাদেশের কোনো নতুন ঘটনা ঘটলেই সবার আগে ও-ই আমাদের কল দিয়ে জানায়। ফোনটা আমিই রিসিভ করে বলি, “হ্যা,বাবা, বলো। ”
“বাবা, একটা দারুণ খবর!” ওপাশ থেকে পবনের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ।
“কী রে! কী খবর?”
“মনে পড়ে, তুমি একদিন বহ্নি আপা, বকুল আন্টিদের গল্প বলেছিলে না? রাজাকার, বদরদের গ্রেফতারের লিস্টে তোমার সেই গল্পের ভিলেনও ধরা পড়েছে!”
“মানে?”
“বকুল আন্টির গ্রামের সেই রহমত চেয়ারম্যান অ্যারেস্ট হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তাই তোমাকে সেই নিউজটা জানাতেই কল দিলাম। ”
“তাই নাকি? গরম খবর!”
“আমি রাখি বাবা, পরে কথা কথা হবে। ” পবন ফোন ছেড়ে দেয়।

রেহানাও বেশ উৎকণ্ঠিত ছিল ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে। ও বলে, “কী ব্যাপার? পবন কী বলছে?”

আমি নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারছিলাম না। রেহানার একটি হাত শক্ত করে চেপে ধরে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলি, “দারুণ খবর রেহানা! রহমত মোল্লা ধরা পড়েছে। ও এখন জেলে। যাক, অবশেষে বহ্নি, বকুলদের একটা অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে। ”
“আচ্ছা, এই কথা! এতক্ষণে বুঝলাম। বকুল আপা হয়ত এজন্যেই তোমাকে খুঁজছেন। ”

তানিশা ও পারিশা চুপচাপ বসে খাচ্ছিল। দুজনেই আমার দিকে তাকায় কৌতূহলী চোখে। তানিশা মুচকি হেসে বলে, “বাবা, এজন্যেই তোমাকে আজ টোটালি ডিফরেন্ট দেখাচ্ছে। ”  তানিশা মুখ টিপে হাসতে হাসতে খাওয়ার পাট শেষ করে খালি প্লেটটি নিয়ে বেসিনের দিকে চলে যায়। পারিশাও একইভাবে তার পিছু নেয়।

রাতে কিছুক্ষণ টিভি দেখার পর একে একে সবাই বিছানায় চলে যায়। অথচ আমি তখনো টিভির সামনে বসে থাকি। আসলে বকুলের  ফোন আসতে পারে, সেই প্রতীক্ষাতেই ঘুম আসছিল না। রেহানা বেডরুম থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, “সজল ! এখনো আসছো না যে! নিচের লাইটগুলো অফ করে এসো!”

আমি স্ত্রীর কথার উত্তর দিতে না দিতেই আমার ফোনটা বেজে ওঠে। আমি “রেহানা তুমি শুয়ে পড়ো, দেখি কার কল” বলে এক লাফে গিয়ে ফোনটা তুলে নেই।

হ্যাঁ, ঠিক ঠিক বকুলেরই কণ্ঠ। ওপাশ থেকে পরিষ্কার শোনা যায়, “হ্যালো, কে বলছেন?  সজল ভাই?”
“জী, আমি বলছি, আপনি বকুল তো?”
“হ্যাঁ, কতদিন পর! কেমন আছেন আপনারা? ছেলে মেয়েরা ভালো তো!”
“হ্যাঁ, সবাই ভালো। আপনার খবর বলুন। বহ্নি কেমন আছে? দেখতে দেখতে সেই ছোট বহ্নি আজ চল্লিশ বছরের মহিলা, তাই না?”
“জী সজল ভাই। ওর তো দুই বাচ্চা। ছেলেটা সিক্সে পড়ে, মেয়েটা ফোরে। হাজবেন্ড রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের ইঞ্জিনিয়ার। ”
“হ্যা, তা তো হবেই! বহ্নি বড় হতে হতে কদ্দুর এগুলো, সবই কিন্তু এখান থেকে দেখতে পাই। ”
“মানে! বুঝলাম না সজল ভাই। ” বকুলের বিস্ময় ভরা কণ্ঠ।
“ব্যাপারটা খুবই সোজা বকুল, আমাদের দেশের স্বাধীনতার বয়স মানেই তো বহ্নির বয়স, তাই না? যাকগে, আপনি কি এখনও স্কুলের সেই চাকরিটা করছেন?”
“না সজল ভাই, আমি তো গতবছরই রিটেয়ার করলাম। ”
“আচ্ছা, সেই যে আপনাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো, এরপর তো আর শরীফের কোনো পাত্তাই পেলাম না!”

ওপাশ থেকে বকুলের গলাটা ভারী শোনায়। ও জানায়, শরীফের সাথে ওর বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু বহ্নি ব্যাপারটা তখন সহজভাবে নিতে পারেনি। এরপর শরীফ অস্ট্রেলিয়া চলে যায় প্রায় দশ বছর আগে। শরীফ দেশে থাকাকালেই বহ্নির বিয়ে হয়। বিয়েতে অনেক মানুষকে নিমন্ত্রণ করেছিল শরীফ। গত চার বছর আগে অস্ট্রেলিয়াতেই এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এরপর বহ্নির ব্যাপারে আরো কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায় বকুল। আমি তখন উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করি, “কী হয়েছে বহ্নির! কোন সমস্যা?”
“সজল ভাই, আপনি একজন সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক, আপনি প্লিজ আমাকে একটা বুদ্ধি দিন! আমার এখন সত্যি সত্যি বিপদ! এই বয়সে এই ধাক্কা কি করে সামলাব, বুঝতে পারছি না!”
“আসল ব্যাপারটা না বললে বুঝব কী করে? আর হ্যাঁ, এইমাত্র একটা খবর পেলাম, আপনি শুনেছেন কিনা রহমত মোল্লাকে তো অ্যারেস্ট করা হয়েছে!”
“সজল ভাই এজন্যই তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কী করব এখন!” বকুলের কণ্ঠে আর্তি ঝরে।
“তার মানে? এত ভালো খবর!”
“কিন্তু আমার জন্য তো মহা বিপদ! গতকাল টিভি চ্যানেল থেকে এক সাংবাদিক এসে আমাকে ইন্টারভিউয়ের অফার দিয়ে গেছে। আজ সন্ধ্যায় সেই ইন্টারভিউ। ওরা রহমত মোল্লার অত্যাচারের অনেক ঘটনাই জানে এবং আমিও যে একজন ভিকটিম, এটাও কেমন করে যেন বের করেছে। টিভির ইন্টারভিউয়ে একাত্তরের সেই ঘটনাগুলিই উঠে আসবে, তখন বহ্নি যে সব জেনে যাবে বকুল ভাই! আমি এখন কী করব?” বলতে বলতে বকুল কেঁদে ফেলে।

আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না কী বলব বকুলকে। বছরের পর বছর যে পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগই নেই, হঠাৎ কী করে সমস্যার সমাধান আমি দিই? আমি বকুলকে অভয় দিয়ে বলি, “দেখুন, ঘাবড়ানোর কিছু নেই, তো আপনি কি কিছু ভেবেছেন?”

“জ্বী সজল ভাই! আমি এবার পুরো সত্যটি বলে দিতে চাই। এই ভার আমি আর নিতে পারছি না। আমি জানি, আমার বহ্নি বড় হয়েছে, শিক্ষিত হয়েছে, আনোয়ারকেই এখনো সে বাবা বলে জানে, আনোয়ারের হত্যার বিচারও সে সবসময় চেয়ে এসেছে। আজ চল্লিশ বছর বয়সের এই মেয়েটা যখন দেখবে রহমত মোল্লা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে, ওর বিচার হচ্ছে, তখন অবশ্যই ওর অতৃপ্ত মনটা শান্ত হবে। কিন্তু—”
“কিন্তু কী? হ্যালো, বলুন, বলুন আমি শুনছি!”
“আনোয়ার যে আসলেই ওর বাবা নয়, আর”... এইটুকু বলে ইতস্তত করে বহ্নি। তারপর আবার বলে, “তখন বহ্নির কী হবে? ওর স্বামী সংসার?” বকুল আবারো ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

আমার তখন কেন জানি মনে হয়, তবু ভালো, বহ্নি তার আসল সত্যটি জানতে পারবে। সে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক গৌরবময় আত্মজা, তাও নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারবে। আমি বকুলকে সমর্থন করে বলি, “দেখুন, আপনি যা করছেন, তা একদম সঠিক। প্লিজ! ডোন্ট হেসিটেট, জাস্ট ডু ইট! আল্লাহ ভরসা। ”

বকুল আমাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফোন রেখে দেয়। রেহানাও কিছু একটা সিরিয়াস ব্যাপার বুঝতে পেরে নিচে নেমে এসেছে। আমি শুধু আমার স্ত্রীকে বলি, “রেহানা, রাত শেষ হলেই কাল সকালে আমরা টিভিতে একটা চরম সত্যের মুখোমুখি হবার ঘটনা দেখতে পাব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে উঠা বহ্নি তার আইডেনটিটি জানতে পারবে। এরপর বহ্নির চোখে-মুখে ওর মা কী দেখতে পাবে রেহানা?”

রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি তখন একটা উত্তাল বাংলাদেশ দেখি, দেখি একাত্তরের নৃশংস অত্যাচার, হত্যাকাণ্ড, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী যুদ্ধ। দেখি ঢাকার ট্রাইবুনালে রহমত মোল্লার শুনানি, টিভি চ্যানেলের সামনে বসে থাকা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা উৎকণ্ঠিত বকুল, আর দেখি টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা দু’সন্তানের জননী স্বাধীনতা যুদ্ধের ফসল অস্থির-উতলা বহ্নিকে, যে মহিলাটি আত্মস্থ করতে যাচ্ছে নতুন এক অমোঘ সত্যকে।



বাংলাদেশ সময়: ১৪০৭ ঘণ্টা, জুন ২3, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।