ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শুভ্রা ম্যাডাম | ইমন চৌধুরী

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩১ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৫
শুভ্রা ম্যাডাম | ইমন চৌধুরী

শুভ্রা ম্যাডামকে এভাবে আবার পেয়ে যাব কখনও ভাবতে পারিনি। ফেসবুক দেখছি ভারি একটা কাজের জিনিস।

জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে এক এক করে ফিরিয়ে দিচ্ছে আবার। নাম লিখে ক্লিক করলেই চোখের সামনে এক একজন দিব্যি হাজির হয়ে যাচ্ছে।

নেহাত কৌতূহল থেকে শুভ্রা মাহমুদ লিখে একদিন ফেসবুকে সার্চ করছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে নানান রূপে, নানান ঢংয়ে একের পর এক শুভ্রা মাহমুদ হাজির হলেন চোখের সামনে। কিন্তু আমার তো সব শুভ্রা মাহমুদকে প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন কেবল একজনকে। পরিপূর্ণ একজন নারী হয়ে যার আবির্ভাব ঘটেছিল আমাদের কৈশোরে। যাকে দেখে প্রথমবারের মতো আমরা বালক থেকে পুরুষ হয়ে উঠেছিলাম। সেই শুভ্রা মাহমুদকে চাই আমার।

শুভ্রা ম্যাডাম যেদিন আমাদের ফেনী সরকারি পাইলট হাই স্কুলে ড্রইংয়ের টিচার হয়ে এলেন সেদিন শহরে খুব বৃষ্টি ছিল। এক হাতে গোলাপি ছাতা এবং অন্য হাত দিয়ে উরুর ওপর রঙিন শাড়ি মুঠো পাকিয়ে কিছুটা উপরে তুলে স্কুলে প্রবেশ করলেন ম্যাডাম। কাঁধে ঝুলছিল রঙিন ভ্যানিটি ব্যাগ। আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। শুভ্রা ম্যাডামকে দেখে আমাদের দৃষ্টি স্থির হলো তার ওপর। বারান্দায় পা রেখেই তড়িঘড়ি করে ছাতাটা গুটিয়ে রাখলেন ভ্যানিটি ব্যাগে। মাথাটা একদিকে কাত করে বার কয়েক মৃদু স্পর্শে হাত চালালেন চুলে। বালক থেকে আমাদের পুরুষ হয়ে ওঠার জন্য এই একটি দৃশ্যই যথেষ্ট ছিল। আমরা পুরুষ হয়ে উঠলাম।

একসময় তরঙ্গের মতো হাই হিলের শব্দ তুলে পা রাখলেন দোতলার সিঁড়িতে। আমার কানের কাছে মুখ এনে প্রায় ফিসফিস করে জুয়েল বলল, ‘নতুন ম্যাডাম। আজ থেকে আমাদের ড্রয়িং ক্লাস নেবে। ’ জুয়েলের কণ্ঠে খানিকটা উচ্ছ্বাস টের পেলাম। হঠাৎ পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে আরিফ বলল, ‘দারুণ!’ আমি মৃদু হাসলাম। আমি একাই কেবল পুরুষ হয়ে উঠিনি। আমার সহপাঠীরাও শুভ্রা ম্যাডামের আগমনে সেদিন লাইন ধরে সবাই পুরুষ হয়ে উঠেছিল।

দুপুরের টিফিন ব্রেক শেষে আমাদের প্রথম ক্লাসটিই ছিল ড্রইং ক্লাস। নতুন ম্যাডাম আমাদের ড্রয়িং শেখাবেন এ উত্তেজনায় প্রবল আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। অবশেষে তিনি এলেন। আমাদের চোখে তখনও মুগ্ধতা। ক্লাস ভর্তি সবার ওপর চটুল চালে একবার চোখ বুলিয়ে মুখ খুললেন শুভ্রা ম্যাডাম, ‘আমার নাম শুভ্রা মাহমুদ। তোমাদের স্কুলে নতুন এসেছি। আজ থেকে আমি তোমাদের ড্রইং ক্লাস নেব। শুরুতে সবার পরিচয়টা জানতে চাই। একজন একজন করে তোমরা নাম বলবে এখন। ’

আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ম্যাডামের নির্দেশ পালন করতে শুরু করলাম। একের পর এক দাঁড়িয়ে নাম বলতে থাকি। পরিচয় পর্ব শেষে আবারও মুখ খুললেন তিনি, ‘আমার ক্লাসে কিছু নিয়ম মানতে হবে তোমাদের। প্রথমত ক্লাসে হইচই করা যাবে না। সবাই চুপচাপ আঁকবে। আর্ট পেপার এবং রং পেন্সিল ছাড়া কেউ ক্লাসে থাকতে পারবে না। সবাইকে রং পেন্সিল এবং আর্ট পেপার সঙ্গে নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করতে হবে। কারো কাছে এসব না থাকলে তাকে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া হবে। একজনের কাছ থেকে অন্যজন আর্ট পেপার বা রং পেন্সিল কোনো কিছু ধার করতে পারবে না। ’ ইত্যাদি আরও কিছু নির্দেশ জারি করলেন শুভ্রা মাহমুদ। আমরা মন দিয়ে শুনলাম। ওইটুকু বয়সেই যেন আমরা বুঝতে পেরেছিলাম এমন দীপ্তিময় ব্যক্তিত্ব আর স্নিগ্ধ রূপ যার, তার যে কোনো নির্দেশ অকপটে মেনে নেওয়া যায়।

আমরা তখন এও জানতাম, শিক্ষকরা হচ্ছেন পিতা-মাতার মতো। অথচ কেন যেন শুভ্রা মাহমুদকে আমাদের তেমন মনে হলো না। তিনি যেন পুরোপুরি শিক্ষক হয়ে উঠতে পারলেন না আমাদের কাছে। তিনি যতখানি শিক্ষক ছিলেন তারচেয়ে অনেক বেশি নারী হয়ে ধরা দিলেন আমাদের কাছে। তার কোমল চাহনি, হাওয়ায় ঢেউ তুলে তার ছন্দময় হেঁটে যাওয়া, মৃদু শাসন—সবকিছুতেই আমরা প্রবল আকর্ষণ অনুভব করতাম।

আমাদের সেই বয়সটা বড্ড অদ্ভুত ছিল। আমরা তখন বয়ঃসন্ধির দুরন্ত সময় অতিক্রম করছি। কেবল বুঝতে শিখেছি পুরুষের জীবনে কতখানি জুড়ে নারী থাকে। ঠিক সেই দুর্বিনীত সময়ে আমাদের জীবনে এলেন শুভ্রা ম্যাডাম। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করেছেন। নেহাত তরুণীই বলা চলে। আমাদের চেয়ে বড়জোর বছর দশেক বড় হবেন হয়ত। অথবা আরো কম—সাত বা আট। এ আর এমন কী!

আমরা এক একদিন শুভ্রা ম্যাডামের ক্লাসের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। তিনি ক্লাসে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসজুড়ে যেন আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ত। বুকের ভেতর নিষিদ্ধ এক অনুভূতি টের পেতাম আমরা। ম্যাডাম যখন পাশে এসে দাঁড়াতেন আমাদের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেত । আর্ট পেপারে যখন কালার পেন্সিল দিয়ে এঁকে এঁকে দেখাতেন আমরা মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকতাম। ম্যাডামের শরীর থেকে ভেসে আসত দামি পারফিউমের গন্ধ। মেড ইন প্যারিস-ট্যারিস হবে হয়ত। গোটা ক্লাসে সেই মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত।

শুভ্রা ম্যাডামের আগমনে আমাদের স্কুল জীবনের দিনগুলো ক্রমশ আনন্দময় হয়ে উঠল। এক ধরনের নিষিদ্ধ শিহরণ তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আমাদের শরীর এবং হৃদয়ে। হঠাৎ একদিন আততায়ীর গুলির মতো একটি দুঃসংবাদ ছুটে এসে আমাদের এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। শুভ্রা ম্যাডামের বদলির অর্ডার এসেছে। হঠাৎ আসা ঝড়ের মতো আমাদের ছেড়ে, ফেনী সরকারি পাইলট হাই স্কুল ছেড়ে, আমাদের প্রিয় জেলা শহর ছেড়ে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন তিনি। আমাদের মন খুব খারাপ হলো। এক ধরনের বিষণ্ণতায় ডুবে যাই আমরা। আমাদের কিশোর মনে শুভ্রা ম্যাডামের এই বিদায় গভীর রেখা টেনে গেল। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে তার পুরোপুরি মুক্তি মিলল না। এরপর থেকে আমাদের স্মৃতিতে নানান রূপে বারবার ফিরে আসতে থাকেন শুভ্রা ম্যাডাম।

সেই কবে স্কুল জীবনের পাঠ চুকে-বুকে গেছে। চুকে গেছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো। অথচ এখনও আমাদের আড্ডায় শুভ্রা ম্যাডাম যথারীতি প্রাসঙ্গিক। অজান্তেই যেন আমাদের অনুভূতির খানিকটা চিরদিনের মতো দখল করে নিয়েছেন আমাদের প্রথম প্রেম শুভ্রা মাহমুদ।

ফেসবুকে শুভ্রা মাহমুদের দীর্ঘ তালিকা থেকে একজন একজন করে যাচাই করছি। হঠাৎ একটি প্রোফাইল পিকচারে চমৎকার একটি চিত্রকর্ম দেখে মুহূর্তের জন্য স্থির হলাম। ক্লিক করতেই দেড় যুগ পর চোখের সামনে হাজির হলেন প্রিয় শুভ্রা ম্যাডাম। প্রোফাইল পিকচারে মোট তিনটি আলোকচিত্র। এরমধ্যে একটি চিত্রকর্ম। বছর দেড়েকের পুরনো। দ্বিতীয় ছবিটি শুভ্রা ম্যাডামের। প্রায় চার বছর আগে আপলোড করেছেন। ছবিটি তারও অনেক আগে তোলা। সেই মুখ, সেই চোখ, ঠোঁটের কোণে ঝুলছে টোল পড়া সেই চেনা হাসি—শুভ্রা ম্যাডামের ঠিক এই রূপটাই আমাদের চোখে লেগে আছে এখনও।

ম্যাডাম যখন আমাদের পড়াতেন সম্ভবত সেই সময় বা তার কিছু আগে পরে ছবিটি তোলা। তৃতীয় ছবিটি অচেনা এক কিশোরীর। অ্যাড লোকেশনে ম্যাডাম লিখেছেন, আমার রাজকন্যা আমার পৃথিবী—দিয়া আফরিন। মনে হচ্ছে ম্যাডামের মেয়ে। টাইমলাইন থেকে দ্রুত সটকে পড়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। যতটা উৎসাহ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিলাম ততটাই হতাশ হলাম। কারেন্ট সিটি ঢাকা, জেন্ডার ফিমেল, রিলিজিয়াস ভিউজ ইসলাম—এমন দু’একটা কমন তথ্য ছাড়া আর কোনো তথ্য নেই। নিয়মিত ফেসবুকে বসেন বলেও মনে হলো না। তারপরও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম। ফোন দিয়ে একে একে শুভ্রা ম্যাডামকে আবিষ্কারের খবরটি জানালাম আরিফ, জুয়েল, এবং সাইমুমকে। ওরাও বেশ উত্তেজিত। আইডি বের করে রিকোয়েস্ট পাঠাল সবাই। কিন্তু বেশ কিছুদিন পার হওয়ার পরও শুভ্রা ম্যাডামের কোনো সাড়া পেলাম না। তার বন্ধু তালিকায় আমাদের স্থান হলো না। তিনি সম্ভবত আমাদের ইগনোর করলেন। আমরা আশা ছেড়ে দিলাম।

বেশ কিছুদিন পর আবার একদিন ম্যাডামের টাইমলাইনে ঢুকে তার প্রোফাইল পিকচারগুলো দেখছিলাম। এরমধ্যে আর কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই পুরনো তিনটি ছবি। প্রথম দুটি দেখার পর তৃতীয় ছবিতে ক্লিক করতেই হঠাৎ মাথায় বুদ্ধিটা এলো। ছবির অ্যাড লোকেশনে ম্যাডামের মেয়ের নাম দেওয়া আছে। ক্লিক করে বিনা অনুমতিতে ম্যাডামের মেয়ে দিয়া আফরিনের আইডিতে ঢুকে পড়ি। ম্যাডামের ঠিকানা সম্পর্কিত কোনো ক্লু যদি পাই।

এ যাত্রায় খুব একটা হতাশ হলাম না। দিয়া আফরিনের আইডি থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেল। রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্রী সে। হোম টাউন মুন্সিগঞ্জ, কারেন্ট সিটি ঢাকা। কিন্তু শুভ্রা ম্যাডামকে আবিষ্কার করতে কেবল এইটুকু তথ্য যথেষ্ট নয়। মেয়ে যেহেতু রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্রী সে সূত্রে শুভ্রা ম্যাডামের বাসা উত্তরায় হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। ম্যাডামের বাসা খুঁজে পেতে হলে তার মেয়ে দিয়া আফরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো বিকল্প নেই।

সাত-পাঁচ ভেবে দিয়া আফরিনকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম। চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে তার বন্ধু তালিকায় স্থান হলো আমার। পরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুতই ঘটে গেল। দিয়ার সঙ্গে চ্যাটবক্সে আলাপ করে আমার পরিচয় পেশ করলাম। মায়ের প্রাক্তন ছাত্র দেখে দিয়াও বোধহয় খানিকটা উৎসাহিত হলো। ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে চাই—ইচ্ছেটা প্রকাশ করতেই বলল, ‘চলে আসুন যে কোনো দিন। ’

এরমধ্যে দিয়াকে সতর্ক করে দিয়েছি, ম্যাডামের সঙ্গে আমরা দেখা করতে চাই এই খবরটা যেন তিনি কিছুতেই জানতে না পারেন। ম্যাডামকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই। জুয়েল এবং আরিফকে শুভ্রা ম্যাডামের বাসায় যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানাতেই ওরা প্রায় লাফিয়ে ওঠে। ইনবক্সে দিয়া ওর নম্বর দিতেই ওকে ফোন দিই, ‘ম্যাডামকে দেখতে কবে যাওয়া যায় বলো তো?’
‘চলে আসুন, যে কোনো দিন। বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে হলে ভালো হয়। আমাকেও বাসায় পাবেন। ’
‘তোমাদের বাসায় আর কে কে থাকেন?’
‘আর কে থাকবে! আমি আর মা। আর আমাদের কাজের একজন মহিলা থাকেন আমাদের সঙ্গে। ’
‘তোমার বাবা?’
আমার প্রশ্ন শুনে হঠাৎ চুপ হয়ে গেল দিয়া। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল, ‘বাবা আমাদের সঙ্গে থাকেন না। ’ একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো দিয়ার ভেতর থেকে। মুঠোফোনের এপ্রান্তে থেকেও যেন টের পেলাম আমি। আমি দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, ‘দু’একদিনের মধ্যেই আসছি। আসার আগে তোমাকে ফোন করে জানাব। ’
‘ওকে। ভালো থাকবেন। ’ ফোন ছাড়ল দিয়া।

দু’দিন পর দিয়ার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে তিন বন্ধু গিয়ে হাজির হলাম শুভ্রা ম্যাডামের উত্তরার ঠিকানায়। প্রায় পনের বছর পর ম্যাডামকে দেখব। উত্তেজনায় এক ধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল শিরায় শিরায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ডোর বেলে হাত রাখি। অলৌকিক কিছু ঘটে না গেলে আর মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধান। দেড় দশকের তৃষ্ণা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। সেই দীঘল চুল, চেনা মুখ, শরীর থেকে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়া পারফিউমের গন্ধ, উদ্ধত রাজহংসীর মতো চাহনি—এখনও সবকিছু জ্বলজ্বল করছে আমাদের স্মৃতিতে।

বার দুয়েক ডোরবেলে চাপ দিতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল দিয়া। আরিফ এবং জুয়েলের সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিয়ে ড্রইংরুমের সোফায় বসতে বসতে জানতে চাইলাম, ‘ম্যাডাম আছেন তো?’
‘আম্মু এসময় বাসাতেই থাকে। আপনারা বসুন, আমি ডাকছি। ’
‘ম্যাডাম কি আমাদের আসার কথা জানেন?’
‘না, আমি কিছু জানাইনি। আপনারা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছেন—আমারও প্ল্যানটা শুনে মনে হলো আম্মুর জন্য এটা একটা ভালো সারপ্রাইজ হবে। ’

কথা শেষ করে দিয়া ভেতরের ঘরে পা বাড়াল। আরিফ চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করল। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। জুয়েল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোদ্ধাদের মতো দেয়ালে ঝোলানো একটি চিত্রকর্ম দেখছে। গভীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করছি। এক হাতে ছাতা, কাঁধে ঝোলানো ভ্যানিটি ব্যাগ, আরেক হাতে উরুর কাছে মুঠো করে ধরে রাখা শাড়ির খানিকটা, শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়া দামি পারফিউমের গন্ধ—স্মৃতিতে সেই প্রথম দেখা শুভ্রা ম্যাডামের প্রতিচ্ছবি ভাসছে ক্রমাগত।

মিনিট পাঁচেক বাদে পর্দা ঠেলে ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো দিয়া। তার পিছু পিছু এলেন প্রৌঢ়া এক মহিলা। আমরা ঠিক চিনতে পারলাম না। তিন বন্ধু সোফা ছেড়ে উঠে খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেই প্রবীণ নারীটির দিকে। আমাদের চুপ থাকতে দেখে মুখ খুললেন তিনি, ‘আপনারা?’

আমরা তখনও নির্বাক দাঁড়িয়ে। দিয়া বোধহয় আমাদের অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পেরে বলল, ‘আমার আম্মু। আপনাদের ড্রইংয়ের টিচার। ’

জুয়েল এবং আরিফের অবস্থাও আমার মতো। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চায় না আমাদের। কে এই নারী? এ কিছুতেই শুভ্রা ম্যাডাম হতে পারে না। কোথায় সেই উদ্ধত রাজহংসী? কোথায় সেই দীঘল চুল? গভীর সমুদ্রের মতো সেই চোখই বা কোথায়? শরীর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা সেই আলোর বন্যা কই? নেই সেই পারফিউমের গন্ধ। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে যৌবনহীন এক প্রৌঢ়া নারী। এই নারী আমাদের অচেনা।

দ্রুত নিজেকে সামলে নিলাম। হাত তুলে ম্যাডামকে সালাম জানিয়ে একে একে পরিচয় দিলাম। পরিচয় পেয়ে বেশ চমকে গেলেন ম্যাডাম। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমাদের মুখের ওপর। বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে বললেন, ‘খুব ভালো লাগছে এতদিন বাদে তোমাদের দেখে। কে কী করছো এখন?’

অনেকক্ষণ বাদে জুয়েল মুখ খুলল, ‘আমি একটা প্রাইভেট ফার্মে আছি। আরিফ আইনজীবী, ও সাংবাদিক। ’
‘বাহ! গুড, ভেরি গুড! কী খাবে বলো?’
‘শুধু চা হলেই হবে ম্যাডাম। আপনাকে আমরা দেখতে এসেছি। ’
‘ভালো করেছো। আমি তো ভাবতেই পারছি না। তোমাদের স্কুলেই আমার প্রথম চাকরি ছিল। প্রায়ই মনে পড়ে। তোমরা বসো। আমি চা করে নিয়ে আসি। ’ উঠে ফের ভেতরের ঘরে পা বাড়ালেন তিনি। পেছন পেছন দিয়াও গেল। বিষণ্ণ মুখে আমরা একে অন্যের দিকে তাকাই। কারো মুখে শব্দ নেই। ঘোর কেটে যাওয়ারও একটা বেদনা আছে এই প্রথম টের পেলাম।

শুভ্রা ম্যাডামের বাসা থেকে যখন বের হয়ে আসি তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। আমাদের কারো মুখে শব্দ নেই। পনের বছর দীর্ঘ সময়। আমাদেরও পরিবর্তন হয়েছে। আমরা এখন আর কিশোর নেই। ম্যাডামেরও কিছু পরিবর্তন হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরিবর্তন মানুষকে এতটা বদলে দিতে পারে আমাদের জানা ছিল না। সময়ের চেয়ে বড় ঘাতক আর কিছু নেই। সময় আমাদের কৈশোরের প্রিয় শুভ্রা ম্যাডামকে খুন করে চলে গেছে। শুভ্রা মাহমুদ নামে যিনি এখনও দিব্যি বেঁচে আছেন তিনি আমাদের কেউ না। আমরা তাকে স্বীকার করি না।



বাংলাদেশ সময়: ১৫৩১ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।