ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ৫)

ধারাবাহিক রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২, ২০১৫
ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ৫)

পর্ব ৪ পড়তে ক্লিক করুন

এই নিঃসঙ্গতায় |
ভারত সম্পর্কে খুব সীমিত এবং ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে বিলাতি নারীরা ভারতে পৌঁছানোর সাথে সাথেই তাদের অনেক অমূলক ধ্যান ধারণার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। যে বিলাতি নারী তার দেশে ছিলেন মূল জনসংখ্যার প্রধান একটি অংশ সেই নারী যখন ভারতে এসে নিজেকে ছোট বিলাতি গোষ্ঠীর একটি অংশ হিসেবে আবিষ্কার করেন তখন তার ভেতর এক ধরনের ভয় এবং উৎকণ্ঠা কাজ করে।

ভারত তাদের করতলে হলে কী হবে—বিলাতিরা তখন ভারতের ছোট্ট একটি উঠানের বাসিন্দা মাত্র। নিজস্ব ছোট একটি সমাজ, ছোট একটি সীমানার মাঝেই তাদের নিত্য দিনের পদচারণা। বিলাতি সমাজ ততদিনে ভারতের মাটিতে তাদের নিজস্ব রুটি রোজগারের নিশ্চয়তা করে ফেললেও সামাজিক জীবন যাপনে তারা রয়ে গিয়েছিল সংখ্যালঘুর মতোই। বিলাতি নারীদের জন্য এই নতুন, ছোট এবং বিচ্ছিন্ন সমাজে নিজেদের তৈরি করে নিতে একটু সময় লাগাটা ছিল খুবই স্বাভাবিক।



ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারত থেকে ‘দ্যা পাইয়োনিয়ার’ নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ হতো। এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত এ পত্রিকাটির মূল পাঠক ছিল বিলাতি সমাজে বসবাসরত বাসিন্দারা। সেই পত্রিকায় ভারতীয় বিলাতি সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিবন্ধ ছাপা হতো। সেখানে বিলাতি এবং আধা বিলাতি অনেকে চাকরিও করত। এই আধা বিলাতি অর্থাৎ অ্যাংলোদের নিয়ে দুটো কথা বলতে চাই। বিলাতি নারীরা ভারতে পৌঁছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হোঁচট খেতেন, তা হলো ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’ জাতের কিছু নতুন ভারতীয় শংকরদের আবিষ্কার। সেই সময় এসব অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বেশ দাপট ছিল। সরকারি চাকরি, কোর্ট, রেলপথ, ডাকঘরসহ সর্বত্রই তারা ইউরোপিয়ানদের পাশাপাশি চাকরি করার সুযোগ পেত। অ্যাংলোরা ছিল মূলত ইউরোপ এবং ভারতীয় রক্তের মিশ্রণ।



বিলাতি নারীরা আঠার শতকের দিকে ভারতে এসে ভাষাগত দিক থেকেও নতুন কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ভারতে এসে অনেক নতুন নতুন শব্দ তারা তাদের গার্হস্থ জীবনের অভিজ্ঞতায় রপ্ত করেছিলেন। যেমন মফস্বল(mofussil), টিফিন(tiffine), স্টেশন(station), পেগ(cota peg) ইত্যাদি। ভারতে এই শব্দগুলোর অর্থ তাদের মূল দেশ ব্রিটেনের প্রচলিত অর্থ থেকে অনেক আলাদা ছিল। মফস্বল বলতে তারা বুঝতেন শহর থেকে দূরে কোনো উপশহরকে। দুপুরবেলার লাঞ্চকে বলছেন টিফিন। স্টেশন বলতে বোঝানো হতো ইউরোপিয়ানরা বসবাস করে—এমন একটি জায়গা। ছোট পেগ মানেই অল্প পানীয়। তখনকার প্রচলিত ধারণা ছিল যে, বিলাতি সমাজে ভদ্রলোকদের ছোট পেগের বেশি পান করতে নেই। এই শব্দভাণ্ডারগুলো তাদের ধমনীতে জায়গা করে নিয়েছিল প্রাত্যহিক জীবনে নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদেই। কারণ ক্ষুদ্র এই বিলাতি সমাজে বিলাতি নারীদের পরিসর খুব একটা বিস্তৃত ছিল না। বেশিরভাগ সময়ই নিজ বাড়ির বারান্দায় ব্রেকেটবন্দি হয়ে বিভিন্ন রকম গালগপ্প, সংগীত চর্চা, বাড়ির সামনে খেলাধুলা করেই তাদের সময় কাটাতে হতো।

ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারত থেকে ‘দ্যা পাইয়োনিয়ার’ নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ হতো। এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত এ পত্রিকাটির মূল পাঠক ছিল বিলাতি সমাজে বসবাসরত বাসিন্দারা। সেই পত্রিকায় ভারতীয় বিলাতি সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিবন্ধ ছাপা হতো। সেখানে বিলাতি এবং আধা বিলাতি অনেকে চাকরিও করত। এই আধা বিলাতি অর্থাৎ অ্যাংলোদের নিয়ে দুটো কথা বলতে চাই। বিলাতি নারীরা ভারতে পৌঁছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হোঁচট খেতেন, তা হলো ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’ জাতের কিছু নতুন ভারতীয় শংকরদের আবিষ্কার। সেই সময় এসব অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বেশ দাপট ছিল। সরকারি চাকরি, কোর্ট, রেলপথ, ডাকঘরসহ সর্বত্রই তারা ইউরোপিয়ানদের পাশাপাশি চাকরি করার সুযোগ পেত। অ্যাংলোরা ছিল মূলত ইউরোপ এবং ভারতীয় রক্তের মিশ্রণ। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিলাতি পুরুষরা ভারতীয় নারীদের বিয়ে করে ভারতে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলেন। পরবর্তীতে ভারতে আগত বিলাতি নারীরা অ্যাংলোদেরকে নিজেদের প্রতিযোগিতার আসনে আবিষ্কার করেন এবং বিষয়টিকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন না। যে কারণে ক্লাবে, অফিস আদালতে, ট্রেনে বা ট্রামে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের দেখলে বিলাতি নারীরা মুখে ভদ্রতার মুখোশ এটে মুখ ঘুরিয়ে রাখতেই ভালোবাসতেন। অন্যদিকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা শরীরে ভারতীয় রক্ত থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ‘ইংলিশ’ ভাবতেই বেশি পছন্দ করত এবং ভারতীয়দের কাছ থেকে নিজেদের যথাসম্ভব দূরে সরিয়ে রাখত। এদের মধ্যে যারা ইউরোশিয়া গোত্রভুক্ত—তাদের প্রবণতা ছিল নিজেদের ‘ইউরোপিয়ান’ হিসাবে দাবি করা। সে কারণে আর্মেনিয়ানরা ইউরোপিয়ান নাকি এশিয়ান—এ নিয়ে বহুকাল পর্যন্ত ইউরোপের বাজারে তর্ক চালু ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারত থেকে ইউরোপিয়ানদের এই জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসান হতে অনেক সময় লেগেছিল।

১৮৮১ সালে ভারতে আদমশুমারিতে দেখা যায় সেখানে ইউরোপিয়ান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল মাত্র এক লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার। তখন ভারতের মোট জনসংখ্যা পঁচিশ কোটি। এমনকি চল্লিশ বছর পর ইউরোপিয়ানদের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় মাত্র এক লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজারে। এতেই বোঝা যায়, ইংরেজরা শাষকের দণ্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও জনসংখ্যার দিক থেকে তারা ছিল কতই না ক্ষুদ্র আর নগন্য! ভাবুন, রবার্ট ক্লাইভ যখন বাংলার নবাব সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে পলাশীর মাঠে যুদ্ধ ঘোষণা করেন তখন তার সৈন্য সামন্তের সংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে তিন হাজারের মতো। অন্যদিকে সিরাজ উদ দৌলার সৈন্য সংখ্যা পদাতিক এবং নৌবহর ছিল পঞ্চাশ হাজার। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই অল্প সংখ্যক ইউরোপিয়ানরা তাদের ছল চাতুরি এবং দক্ষতা সবকিছু কাজে লাগিয়ে ভারত শাষণে নিজেদের নিয়োগ করেছিল।



ঊনিশ শতকের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, কলকাতায় ইউরোপিয়ানদের সংখ্যা ছিল দশ হাজার, বোম্বেতে বারো হাজার আর মাদ্রাজে ছয় হাজার। ১৯১১ সালে রাজধানী হওয়ার পর দিল্লিতে ইংরেজ বসতির সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। তবে বিপুলসংখ্যক বিলাতিরা কর্মক্ষেত্রে বড় শহর বেছে নিলেও অনেকের ভাগ্যে ‘মফস্বল’-এর মতো পিছিয়ে থাকা ছোট শহরও পড়েছে। চাকরিসূত্রে সেসব শহরেই তাদের জীবন যাপন করতে হয়েছিল। ধর্মপ্রচারক, পোস্ট মাস্টার, শিক্ষক, সেবিকা—এ ধরনের পেশার অনেক ইংরেজই শহরতলিতে নিজেদের জীবন কাটাতে বাধ্য ছিলেন। দেখা যেত সেসব জায়গায় বসবাসরত বিলাতি নারীরা ভারতীয় সমাজের বিভিন্নরকম ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রথায় অংশ নিতেন ভালোবাসতেন। যেহেতু মফস্বল শহরে তাদের তেমন কিছু করার ছিল না—সে কারণে সময় কাটানোর জন্য তাদের বিভিন্নরকম ফন্দি ফিকির তৈরি করতে হতো।



সংখ্যায় অল্প হওয়ার কারণে ইউরোপিয়ানরা তৎকালীন ভারতের প্রসিদ্ধ শহরগুলোকেই বসবাস করার জন্য বেছে নিয়েছিল। শহরগুলোর মধ্যে কলকাতা, বোম্বে, মাদ্রাজ, দিল্লি ছিল অন্যতম। ঊনিশ শতকের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, কলকাতায় ইউরোপিয়ানদের সংখ্যা ছিল দশ হাজার, বোম্বেতে বারো হাজার আর মাদ্রাজে ছয় হাজার। ১৯১১ সালে রাজধানী হওয়ার পর দিল্লিতে ইংরেজ বসতির সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। তবে বিপুলসংখ্যক বিলাতিরা কর্মক্ষেত্রে বড় শহর বেছে নিলেও অনেকের ভাগ্যে ‘মফস্বল’-এর মতো পিছিয়ে থাকা ছোট শহরও পড়েছে। চাকরিসূত্রে সেসব শহরেই তাদের জীবন যাপন করতে হয়েছিল। ধর্মপ্রচারক, পোস্ট মাস্টার, শিক্ষক, সেবিকা—এ ধরনের পেশার অনেক ইংরেজই শহরতলিতে নিজেদের জীবন কাটাতে বাধ্য ছিলেন। দেখা যেত সেসব জায়গায় বসবাসরত বিলাতি নারীরা ভারতীয় সমাজের বিভিন্নরকম ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রথায় অংশ নিতেন ভালোবাসতেন। যেহেতু মফস্বল শহরে তাদের তেমন কিছু করার ছিল না—সে কারণে সময় কাটানোর জন্য তাদের বিভিন্নরকম ফন্দি ফিকির তৈরি করতে হতো। সরকারি চাকুরে হওয়ার কারণে নিয়মিত বদলিতে তাদের ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ঘুরতে হতো। নতুন রাজ্যের নতুন ভাষা, নতুন সংস্কৃতিও আয়ত্ত করতে হতো তাদের।

বলার অপেক্ষা রাখে না, বিলাতি নারীদের জন্যে এটা ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে যারা কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন তাদের ভাবসাব ছিল অন্যরকম। ১৯১১ সালের আগ পর্যন্ত ভারতের রাজধানী থাকায় তখন সব ইউরোপিয়ানদের চোখ থাকত কলকাতার দিকে। যদি কোনোমতে কলকাতায় একটা চাকরি বাগে আনা যায় তাহলে তো কথাই নেই!  তবে বিলাতি সমাজ কলকাতায় থাকুক আর মফস্বলেই থাকুক, তারা তাদের নিজস্ব একটি সমাজ গড়তে সবসময়ই বেশ সচেষ্ট ছিল। নারীরা পুরুষদের পাশাপাশি নিজেদের সামাজিক করে তোলার জন্য আশপাশের বিভিন্ন ইউরোপিয়ানদের খোঁজ খবর নিতেন। এনি উইলসন নামের এক বিলাতি নারীর স্বামী ১৯০০ সালে পাঞ্জাবের জেলা কমিশনার ছিলেন। তিনি তার এক বন্ধুর কাছে লেখা চিঠিতে লিখেছেন, কিভাবে তিনি সারাক্ষণই তার চোখ বাড়ির প্রবেশ পথের দিকে রাখতেন—যদি কোনো বিলাতি সঙ্গ পাওয়া যায়—এই আশায়। বিলাতি নারীদের আপ্রাণ চেষ্টা থাকত ভারতের মূল সংস্কৃতির সাথে মিশে কাজ করার কিন্তু সমস্যা ছিল ভারতীয়দের প্রতি তাদের অবিশ্বাস। ভারতীয়দের তারা সবসময়ই সন্দেহের চোখে দেখতেন। সে কারণে নিজ বাড়ির আঙিনাই ছিল তাদের একমাত্র রাজত্ব। সেই রাজ্যে বিলাতি নারীরা অপেক্ষায় বসে থাকতেন—কবে বিলেত থেকে চিঠি আসবে। তারা কেউ ঘরে বসে পিয়ানো বাজাতেন, কেউ বই পড়েই সময় কাটিয়ে দিতেন। সন্দেহ নেই এই নিঃসঙ্গতা মোটেও তাদের কাম্য ছিল না। তারপরও ভারতের সম্পদের প্রতি তাদের যে অদম্য লোভ—অবলীলায় তা ছেড়ে আসাও অত সহজ ছিল না!

পর্ব ৬ পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।