ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শারদ শিউলি কাননে | শফিকুল কবীর চন্দন

প্রকৃতি ও পুরাণ ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৫
শারদ শিউলি কাননে | শফিকুল কবীর চন্দন

ঐ আসলো আশ্বিন
শিউলি শিথিল
হাসলো শিশির দুর্বাঘাসে...

শরৎকে কেউ কেউ বলেন শিল্পী ঋতু—বাংলার প্রকৃতি তার অপার রূপ বিলিয়ে দিয়েছে এই ঋতুতে। বাংলার ষড়ঋতুতে শারদ প্রাতের স্নিগ্ধতায় কবি রবীন্দ্রনাথের শরৎ মুগ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে তার সঙ্গীতে—‘তোমায় দেখেছি শারদ প্রাতে’।



বাংলা মাসের ৫ম-৬ষ্ঠ ভাদ্র ও আশ্বিন মাস মিলে শরৎ। ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু হলো শরৎকাল এবং এই শরৎকালে ফোটে ফুল। সাদা ফুল শিউলি। দেখা যায় কাশের দোল। সঙ্গে থাকে ঢাকের বোল।

নীলাকাশে তখন উড়ে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে হাজির শরৎ। শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা। ’ মেঘ রোদের ছায়ার খেলা, শিউলি ফুল, দুলতে থাকা কাশবন। পূজোর আয়োজনের হাঁকডাক জানিয়ে দেয় শরৎ এসেছে। প্রকৃতিতে তখন সার্বত্রিক শরৎআবহ।

আমাদের প্রত্যেক বাংলা মাধ্যমে পড়া বাঙালি ছেলেমেয়ের এ এক আলাদা সুখটান রবি ঠাকুরের লেখা সহজ পাঠ, প্রথম ভাগ এর ‘এসেছে শরৎ’—

এসেছে শরৎ হিমের পরশ
লেগেছে হাওয়ার পরে
সকাল বেলায় ঘাসের আগায়
শিশিরের রেখা ধরে।
আমলকীবন কাঁপে যেন তার
বুক করে দুরু দুরু
পেয়েছে খবর পাতা খসানোর
সময় হয়েছে শুরু।
শিউলির ডালে কুঁড়ি ভরে এলো
টগর ফুটিল মেলা
মালতীলতায় খোঁজ নিয়ে যায়
মৌমাছি দুই বেলা।

শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক। সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আলোছায়ার খেলা দিনভর এইসব মিলেই তো শরৎ। শরতের স্নিগ্ধতা এক কথায় অসাধারণ! জলহারা শুভ্র মেঘের দল যখন নীল, নির্জন, নির্মল আকাশে ভেসে বেড়ায়  তখন আমরা বুঝতে পারি শরৎ এসেছে।

সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে, শুভ্র কাশের আঁচল উড়িয়ে, কণ্ঠে শিউলি ফুলের মালা দুলিয়ে শরৎ আসে প্রকৃতি জুড়ে। মাঠে সবুজ ধান ক্ষেতের নয়নাভিরাম দৃশ্য, ধানের শীষে আগামী দিনের ফসলের বারতা। শরতের শান্ত ও স্নিগ্ধ রূপ মনে এনে দেয় এক প্রশান্তির পরশ। দিনের উজ্জ্বল রোদ্দুরের ঝিকিমিকি আর রাতের ধবল জ্যোৎস্নাস্নাত রূপ মনোহরা।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎ নিয়ে প্রচুর কবিতা-গান রচনা করেছেন। তাঁর লেখায়—

শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।
শরৎ তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে
বনের-পথে লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।

শরতের কাশফুলে আকর্ষিত হয় না, এমন কাউকেই হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাশফুল নদী তীরে বনের ধারে গ্রামের ও প্রান্তে অপরূপ শোভা ছড়ায়। এমন অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পুলকিত করেনি এমন মানুষ খুঁজে মেলা ভার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন—

আজি কি তোমার মধুর, মুরতী
হেরিণু শরৎ প্রভাতে হে মাতা
বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ ঝরিছে অনল শোভাতে।

আবারও রবীন্দ্রনাথ—

এসো শরতের অমল মহিমা, এসো হে ধীরে।
চিত্ত বিকশিবে চরণ ঘিরে
বিরহ তরঙ্গে আকুলে সে দোলে
দিবাযামিনী আকুল সমীরে।

শরৎ-এ মুগ্ধ কবি আরো লেখেন—

শরতে আজ কোন অতিথি এলো প্রাণের দ্বারে।
আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে...।

বিরহ আক্রান্ত হয়ে বুঝি কবি লিখেছেন, ‘দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ শরতের ভোর হাওয়ায়। ’

অনেকের মতে, শরৎকালে মনে নেচে ওঠে উৎসবের আমেজে। কেননা মাঠে মাঠে সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলমলানি কৃষকের মনে জাগায় আসন্ন নবান্নের প্রতীক্ষা। আলোক-শিশিরে-কুসুমে-ধান্যে বাংলার প্রকৃতিও হেসে ওঠে তখন। আর বাঙালি হিন্দুর সেই প্রাণের উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা তো আছেই। সাথে থাকে শিউলি ফুল। কাশের দোল। ঢাকের বোল।

কুসুমের আশে মন ধায় গো...

আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়
ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো
আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে, রহে না আবাসে মন হায়
কোন কুসুমের আশে কোন ফুলবাসে সুনীল আকাশে মন ধায় গো।

তবে রবীন্দ্রনাথ যে কার জন্য এত জন্ম বাউল হয়ে ভিতরে ভিতরে এতটা উদাস ছিলেন কে জানে—শরতে নীল আকাশ, নদীর পাড় আর বাতাসের সুগন্ধে ছড়িয়ে যাবে শরৎবাবুর স্মারকলিপি। ষড়ঋতুর এ দেশে প্রতিটি ঋতুরই রয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। ঋতুর বাড়তি পার্থক্য ফুটে ওঠে ফুলে। শরতে সাদা কাশফুল আর শিউলির আধিপত্য। একটু ঘুরে আসা যাক শারদীয় কানন থেকে।

হৃদয়ে ছিলে জেগে,
দেখি আজ শরৎ মেঘে।
কেমনে আজকে ভোরে
গেল গো গেল সরে
তোমার ঐ আঁচলখানি
শিশিরের ছোঁওয়া লেগে॥
কী যে গান গাহিতে চাই,
বাণী মোর খুঁজে না পাই।
সে যে ঐ শিউলিদলে
ছড়াল কাননতলে,
সে যে ঐ ক্ষণিক ধারায়
উড়ে যায় বায়ুবেগে॥

ঋণ শোধ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শিউলির শুভ্র ফুলগুলি রাতে ফোটে এবং সকালে ঝরে যায়। শরৎ ও হেমন্ত কালের শিশির ভেজা সকালে ঝরে থাকা শিউলি অনেকেরই প্রিয়!

শরতের শান্ত ভোর। শিশিরভেজা মৃণ্ময় বিছানায় রাশি রাশি শিউলি ফুল। যেন খসে পড়েছে রাতের ঝলমলে তারা। মাটিতে মিশে গেছে তার গন্ধ। ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে নামে শিউলি ফুল কুড়োতে। আর পাল্লা দিয়ে চলে মালা গাঁথার প্রতিযোগিতা। জাফরানি বোঁটার দুধসাদা ছয় পাপড়ির এ ফুল রাতে প্রাণ পায় আর সকালে আত্মাহুতি দিতে ঝরে পড়ে।

কবি জীবনানন্দ দাশ শরতের চরিত্রের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন প্রিয়তমাকে। কাজী নজরুল ইসলামও শরতে হারানো প্রিয়াকে অনুভব করেছেন। লিখেছেন—

শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ
এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই...।


পুষ্পপুরাণ পারিজাত ওরফে শিউলি ||
পারিজাত নামটা কি অচেনা ঠেকছে? আসুন তবে জেনে নেই পারিজাত বৃক্ষ কথা। পারিজাত, স্বর্গের ফুল। মহাভারত, বিষ্ণু পুরান এবং ভগবত পুরানে একাধিকবার পারিজাতের উল্লেখ পাওয়া যায়।

পুরাণ পাঠ ১
পারিজাত সে তো মর্ত্যের নয়, স্বর্গের ফুল, গোলোকে বিষ্ণুর সোনার সিংহাসনের আকাশ সুগন্ধে মাতিয়ে রাখে। আর কারণে-অকারণে পায়ের কাছে ঝরে পড়ে পড়ে ধবধবে গালিচা বিছিয়ে দেয়। তাই তো অমন নাম পারিজাত!

পারিজাতকে মর্ত্যে আনার কাজটি করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, করেছিলেন বললে ভুল হবে, একরকম করতে বাধ্য হয়েছিলেন!

শুনেই চমক লাগল তাই না? ভাবছেন, শ্রীকৃষ্ণ তো স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার, কত কী কঠিন কঠিন কাজই না করে গেছেন তিনি। তাঁকে বাধ্য হতে হলো, এ অসম্ভব কাজটি করল কে?

কে আবার? তাঁর দুই রাণী রুক্মিনী আর সত্যভামার কাজ! গল্পটির শুরু কিন্তু ঝগড়াঝাঁটি দিয়ে। সেই একই ঝগড়া, কে বড়? যার আসল মানে হলো, শ্রীকৃষ্ণের সকল রাণীর মধ্যে প্রিয়তমা কে? সত্যভামা? না কি রুক্মিনী?

দুজনেই জোর গলায় রাজ্যের সব রকমারী দাবি করতে লাগলেন।

একজন বলেন, তাঁর বলার অপেক্ষা শুধু কৃষ্ণ তাকে গজদন্তের প্রাসাদ গড়িয়ে দেবেন একরাত্তিরের মধ্যে।
আর একজন বলেন, তাঁর মুখের কথা খসলেই কৃষ্ণ একশ’ পক্ষীরাজে টানা রথ এনে দাঁড় করিয়ে দেবেন দুয়োরের পাশে।

এমনি করে কথায় কথায় কথা বেড়ে বেড়ে পাহাড়প্রমাণ হয়ে গেল।

খবর পেয়ে কৃষ্ণ যখন এসে পৌঁছোলেন,তখন সেসব দাবির বহর মর্ত্যলোক ছাড়িয়ে দেবলোকে উঁকিঝুঁকি মারছে! দুজনেই এসে চোখে কাজলজল উজাড় করে, মুখভার করে বললেন, “যদি ওকে চাও ওর কাছে থাকো, আমি তবে ছাড়ি হাত।
আর, যদি ভালোবাসো তবে এনে দাও স্বর্গের পারিজাত। ”

সব্বোনাশ! শুনেই তো শ্রীকৃষ্ণের চক্ষু চড়কগাছ! স্বর্গের পারিজাত! তাকে পৃথিবীতে আনাই তো মহাশক্ত কাজ! ‘এনে দাও’ বললেই তো আর এনে দেওয়া যায় না। তার ওপর এনে দেবেনই বা কাকে? রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে তো আরেকদিকে। আর তার চেয়েও বড় কথা, প্রাণের ভয় বলেও তো একটা বস্তু আছে কৃষ্ণঠাকুরের!

ভাবনায় ঘুম উড়ে গেল শ্রীকৃষ্ণের চোখের পাতা থেকে। রাতভর ঘুম আসে না। কী করেন, কী করেন, কী করে সামলানো যায় দুজনকে? শেষমেশ অনেক ভেবে ভোররাতের দিকে এক দারুণ ভাবনা ঝিলিক দিয়ে উঠল, একগাল হেসে শ্রীকৃষ্ণ চললেন পারিজাত আনতে।

ভোরবেলা, ঘুম ভেঙে সত্যভামা দেখলেন যে তাঁর আঙিনার দক্ষিণকোণের পাঁচিলধার আলো করে রয়েছে অ-পূ-র্ব এক অজানা ফুলের গাছ। সারা প্রাসাদ ম ম করছে স্বর্গীয় সুরভিতে। আর পাঁচিলের ও’ধারে, রুক্মিনীর উঠোনের উত্তরকোণের শিশিরভেজা ঘাস জুড়ে বিছিয়ে আছে সাদার উপর ছোট্ট ছোট্ট কমলা ফুটকি দেওয়া একখান নরম গালিচা, পারিজাতের গালিচা।

পুরাণ পাঠ ২
হিন্দু পুরান অনুযায়ী সমুদ্র মন্থনের সময়ে এই স্বর্গীয় ফুলটি উঠে এসেছিল! আবার অন্য একটি মিথ অনুযায়ী দেবতা কৃষ্ণ এই ফুল স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিল। দেবরাজ ইন্দ্রের বাগানে ছিল পারিজাত ফুলের গাছ। একবার কৃষ্ণের দুজন স্ত্রী রুক্মিনী ও সত্যভামার মধ্যে এটা নিয়ে কিছু ক্যাচাল হলো! সত্যভামা কৃষ্ণকে বললেন, ইন্দ্রের বাগানের পারিজাত ফুল তাঁর চাই! তখন কৃষ্ণ স্ত্রী আদেশ শিরোধার্য মনে করে ইন্দ্রের বাগান থেকে পারিজাতের একটা ডাল চুরি করে নিয়ে আসলেন। এতে রাগ করে ইন্দ্র অভিশাপ দেন যে, এই গাছে ফুল ফুটলেও ফুলের কোনো বীজ হবে না! এই পারিজাত ফুলই হলো আমাদের চিরচেনা শেফালি বা শিউলি ফুল!

তবে যদি আমরা প্রাচীন শাস্ত্র দেখি তবে পারিজাত যে শিউলি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। কারণ অমরাবতী নামে ইন্দ্রের যে উদ্যানের বর্ণনা আছে, সেখানে পারিজাত বৃক্ষ, মন্দার, সন্তানক, কল্পবৃক্ষ আর হরিচন্দন এই চারটি গাছের নাম আলাদা করেই উল্লেখ করা হয়েছে।

শিউলি ফুল, গাছে থাকতে এই ফুলের সৌন্দর্য চোখে পড়ে না। এই ফুল চোখে পড়ে গাছ থেকে ঝরে পড়ার পর। তবে অন্যান্য ফুলের সাথে এই ফুলের পার্থক্য এই যে সূর্যের মুখ না দেখতেই শিউলি ফুল ঝরে যায়। নিছক মালা গাথা ছাড়া শিউলি ফুলের কোনো কদর থাকে না। কেন যে সূর্য ওঠার আগে শিউলি ফুল ঝরে যায় তার কোনো কারণ জানা যায় না। তবে কিংবদন্তিতে আছে—


১৫২০-৪০ খ্রিঃ এর একটি পুথিচিত্র। এখানে কৃষ্ণের স্বর্গ থেকে পরিজার বৃক্ষ হরণের দৃশ্য

কিংবদন্তী ১
কিংবদন্তী আছে কৃষ্ণের দুই স্ত্রী—সত্যভামা ও রুক্মিণীর খুব ইচ্ছে তাদের বাগানও পারিজাতের ঘ্রাণে আমোদিত হোক। কিন্তু পারিজাত তো স্বর্গের শোভা! কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে চান। তাই লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে এনে সত্যভামার বাগানে রোপণ করেন, যার ফুল রুক্মিণীর বাগানেও ঝরে পড়ে সুগন্ধ ছড়ায়।

এদিকে স্বর্গের রাজা ইন্দ্র তো ঘটনাটা জেনে খুব রেগে যান! তিনি বিষ্ণু অবতারের ওপর গোপনে ক্রুদ্ধ ছিলেন। এই অছিলায় তিনি কৃষ্ণকে শাপ দেন কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই কিন্তু ফল কোনোদিনও আসবে না, তার বীজে কখনো নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না।

কিংবদন্তী ২
আর একটি গল্প থেকে জানা যায় পারিজাতিকা নামে এক নাগরাজার অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যা সূর্যের প্রেমে পড়ে তাকে কামনা করেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সূর্যকে না পেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। তার দেহের ভস্ম পারিজাতবৃক্ষ রূপে ফুটে ওঠে। যে কিনা নীরব ব্যর্থ প্রেমের প্রতীক! সূর্যের স্পর্শমাত্র যে ঝরে পড়ে অশ্রুবিন্দুর মতো।

পৃথিবীর বুকে আপনি তার দুঃখের চিহ্ন দেখবেন শত শত অশ্রুবিন্দুর মতো, সে সুগন্ধি ছড়িয়ে থাকে চারদিকে, আমরা এখন তাকে শিউলি রূপে দেখি তার শুভ্র দেহে গৈরিক বসনে।

শিউলি চরিত ||
দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে পশ্চিমে বাংলাদেশ, ভারত, উত্তরে নেপাল ও পূর্বে পাকিস্তান পর্যন্ত এলাকা জুড়ে দেখতে পাওয়া যায়। শেফালি নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের রাষ্ট্রীয় ফুল। শিউলি গাছ নরম ধূসর ছাল বা বাকল বিশিষ্ট হয় এবং ১০ মিটারের মতো লম্বা হয়ে থাকে। গাছের পাতাগুলো ৬-৭ সেন্টিমিটার লম্বা ও সমান্তরাল প্রান্তের বিপরীতমুখী থাকে। সুগন্ধি জাতীয় এই ফুলে রয়েছে পাঁচ থেকে সাতটি সাদা বৃতি ও মাঝে লালচে-কমলা টিউবের মতো বৃন্ত। এর ফল চ্যাপ্টা ও বাদামি হূদপিণ্ডাকৃতির। ফলের ব্যাস ২ সেন্টিমিটার এবং এটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগে একটি করে বীজ থাকে। এই ফুল শরত্কালে ফোটে। রাতে ফোটে, সুগন্ধ ছড়ায়  এবং সকালে ঝরে যায়। শরৎ ও হেমন্ত কালের শিশির ভেজা সকালে ঝরে থাকা শিউলি অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য তৈরি করে। শিউলি ফুল শরৎকালের অন্যতম অনুষঙ্গ।

শিউলি, শেফালি অথবা শেফালিকা, সংস্কৃতিতে বলে পারিজাত আর বাংলায় বলে শেফালি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এবং থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি, রাজ্য প্রতীক বা রাষ্ট্রীয় ফুল। বৈজ্ঞানিক নাম Nyctanthes arbor-tristis. লাতিন Nyctanthes-এর অর্থ হচ্ছে ‘সন্ধ্যায় ফোটা’ এবং arbor-tristis-এর মানে হচ্ছে ‘বিষণ্ণ গাছ’। সন্ধ্যায় ফোটা আর সকালে ঝরা ফুলের মাঝে বিষণ্ণভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটাই এই রকম নামকরণের কারণ বলে ধারণা করা হয়। শিউলিকে কখনো কখনো tree of sorrow বা ‘দুঃখের বৃক্ষ’ও বলা হয় কারণ দিনের আলোতে এই ফুল তাদের উজ্জ্বলতা হারায়।

শিউলি গাছ নরম ধূসর ছাল বা বাকল বিশিষ্ট হয় এবং ১০ মিটারের মতো লম্বা হয়। গাছের পাতাগুলো ৬-৭ সেন্টিমিটার লম্বা ও সমান্তরাল প্রান্তের বিপরীতমুখী থাকে। সুগন্ধি জাতীয় এই ফুলে রয়েছে পাঁচ থেকে সাতটি সাদা বৃতি ও মাঝে লালচে-কমলা টিউবের মতো বৃন্ত। এর ফল চ্যাপ্টা ও বাদামী হৃদপিণ্ডাকৃতির। ফলের ব্যাস ২ সেন্টিমিটার এবং এটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগে একটি করে বীজ থাকে। ঔষধি হিসেবে ব্যবহার হয় শিউলির বীজ, পাতা ও ফুল। এই ফুল বোঁটা শুকিয়ে গুঁড়ো করে পাউডার বানিয়ে হালকা গরম পানিতে মেশালে চমৎকার রঙ হয়।

শরৎ ও হেমন্ত কালের শিশির ভেজা সকালে ঝরে থাকা শিউলি অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য তৈরি করে।

প্রচলিত নাম Night- flowering Jasmine (নাইট ফ্লাওয়ার জেসমিন), Harsingar (হারসিঙ্গার), কোরাল জেসমিন, পারিজাত, শেফালিকা, পারিজাতা, পারিজাতাকা, রাগাপুস্পি, খারাপাত্রাকা, প্রজক্তা ইত্যাদি।

বাংলা ভাষায়—শিউলি বা শেফালি, সংস্কৃত ভাষায়—নালাকুমকুমাকা, হারসিঙ্গারাপুস্পক, সুকলাঙ্গি, রাজানিহাসা, মালিকা, অপরাজিতা, বিজয়া, নিসাহাসা, প্রহার্ষিনী, প্রভোলানালিকা, বাথারি, ভুথাকেশি, সীতামাঞ্জারি, সুবাহা, নিশিপুস্পিকা, প্রযক্তা, প্রযক্তি, তামিল ভাষায়—পাভাঝা মাল্লি বা পাভালা মাল্লি। ওড়িয়া ভাষায়—গঙ্গা শিউলি, মনিপুরী ভাষায়—সিঙ্গারেই, অসমিয়া ভাষায়—শেওয়ালি (শেৱালি) ইত্যাদি।

অন্যপাঠ ||
নারদ পারিজাতপুষ্প কৃষ্ণকে দিলে তিনি তা স্ত্রী রুক্মিণীকে পড়িয়ে দেন... সে কথা শুনে সত্যভামার অভিমান হয়...তিনি আহার নিদ্রা ত্যাগ করেন, কৃষ্ণ এসে তার মানভঞ্জন করেন এবং পারিজাত বৃক্ষ উপহারের আঙ্গিকার করেন...শ্রীকৃষ্ণের সুরপুরী গমন করেন...শ্রীকৃষ্ণের সাথে ইন্দ্রের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ শুরু হয়।

অবশেষে—এতশুনে গোবিন্দের দিকে তাকিয়ে শিব বলেন—আমাকে দেখে অন্তত ক্রোধ ত্যাগ করুন, হে যদুনাথ! অজ্ঞান হয়ে দেব সুরপতি ইন্দ্র আপনার সাথে যুদ্ধে মত্ত হয়েছেন। আপনিই তাকে ইন্দ্রত্ব দিয়েছেন। বারবার বিপদে তাকে রক্ষা করেছেন। নিজের অর্জিত বৃক্ষ যদি বিষবৃক্ষ হয় তবু তাকে নিজে হাতে নষ্ট করা সমুচিত নয়। পারিজাত পুষ্প নিয়ে যেতে চান যান।

কিন্তু ইন্দ্র সম্পর্কে আপনার জ্যেষ্ঠ ভাই, সে সম্মান তাকে আপনার দেওয়া উচিত। আমার অনুরোধ রাখুন।

নারায়ণ শিব বাক্য স্বীকার করে শিবকে নিয়ে ইন্দ্রস্থানে গেলেন। কৃষ্ণ বিধান মতো কনিষ্ঠ হওয়ায় ইন্দ্রকে প্রণাম করলেন।

হৃষ্ট মনে দেবরাজ ইন্দ্র কৃষ্ণের কোলে পারিজাত বৃক্ষ দান করে বলেন—যতদিন আপনি অবনীমণ্ডলে (পৃথিবীতে) থাকবেন ততদিন এই বৃক্ষ আপনার সাথে থাকবে। তারপর পারিজাত বৃক্ষ পুনরায় স্বর্গপুরে ফিরে আসবে।

এই বলে দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গে চললেন। সত্যভামার দিকে তাকিয়ে ইন্দ্রাণী শচীদেবী হাসলেন। মহাদেবের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণ ইন্দ্রকে সম্মান দেখালে ইন্দ্র পারিজাত কৃষ্ণকে দান করেন। মিথ-পুরান, কিংবদন্তি, গল্প-গাঁথা হয়ে সেই থেকে পারিজাত হাজির হয় প্রতি বছর ভাদ্র -আশ্বিনে বাঙালির শারদ শিউলি কাননে।



বাংলাদেশ সময়: ১৩২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।