ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

জুতা না পরেও রফিক হারিয়ে যেতে পারে | মুহম্মদ ইমদাদ

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৫
জুতা না পরেও রফিক হারিয়ে যেতে পারে | মুহম্মদ ইমদাদ

কানায়-কানায় ভরা নদী আহ্লাদে সতেরোখানা হয়ে রফিকদের লম্বিকলার ঝাড়ের তলেও কী যেন খোঁজে। একটু আগেও সে কলার ঝাড়ের কাছে বসে নদীকে দেখেছে।

দেখতে দেখতে একবার মনে হইছে লায়লার শরীর খারাপ। লায়লা বলেছে। নদীর পাড়ে বসে লায়লার শরীর খারাপের কথা মনে এসেছিল বলে রফিককে আমরা তার নাগর টাইপের কিছু ভাবার কারণ নাই। লায়লা যুবতী আর সুন্দরী আর লম্বা আর কেশবতী আর ফর্সা আর কত ছেলের বুকের সুবাস আর ক্ষেতওয়ালের কইন্যা—রফিক জানে। রফিকের সম্পদ বলতে গাঙপাড়ে একটা টংদোকান, দোকানের পিছে লম্বিকলার একটা মাঝরি ঝাড়, আর বুড়া মা, আর বাবা নাই, আর বিয়ে হয়ে গেছে ইমরানা আপার।



রাত তিনটায় নদী ভাঙল। লম্বিকলার ঝাড়সহ রফিকের টংদোকান এখন কই আছে নদী ছাড়া কেউ জানে না। রাস্তায় হালকা বৃষ্টির মাঝে রফিকের পাশে তার আম্মা। আশেপাশে কে আছে কে নাই তা কেউ জানতেও চাইবে না। সকাল হলে কোন দিকে যাওয়া যায় ভাবা যাবে। চায়ের-দোকান খোলা আছে। দিনে চা আছিলো এক টাকা কাপ, এখন রাত ৪টায় পুরা ২ টাকা। রফিক তার আম্মারে একটা চা হাতে দিয়ে বলে “বনরুটি খাইবা?”



ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে ভাটির দিকে তাকালে তার মনে হবে পলিগুলানো-হলুদ-জলরাশি যাব যাব করলেও আসলে কিন্তু যাচ্ছে না। ব্রিজের ওপর থেকে উজানের দিকে তাকালে তার মনে হবে পলিগুলানো-হলুদ-পানির-পাহাড় মুহূর্তে উধাও হয়ে যাবে, এই দুনিয়ায় তারা থাকবে না পণ করেছে। কিন্তু পানির-পাহাড় যাচ্ছে না মনে হলেও যায়, কিন্তু শোঁ শোঁ আওয়াজ, স্রোত সব কিছুরে তার কাছে একটা প্রাণহীন ছবির মতো লাগে। হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটায় তার শীত করে। সে পানি-দেখা রেখে চলে অসে বাজারের দিকে। জাইদ মামুর সাথে দেখা হলে সে পানির কথা না-বলে নিজের অজান্তে বলে বসে “মামু বিয়া করমু না। ”

জাইদ মামু তার কথা শুনছে বলে মনে হয় না। জাইদ যাচ্ছে ব্রিজে। পানির কী অবস্থা? পানি বাড়ছেই। বাচ্চাকাচ্চারে তাদের মামুর বাড়ি রেখে আসতে হবে। রফিক গাঙপাড় ধরে মিশে যায় একটা জটলায়। জটলা নদীরে নিয়া চিন্তা করতেছে। চিন্তায় সে শামিল হলো। কিন্তু তা দৈহিক শামিল। তার মন লায়লার বাড়ির নারিকেল গাছের তলে যে জবাফুলের গাছ ঠিক তার কাছেই। সে মনে মনে বলে “বিয়া করি কী লাভ। ”

গ্রাম প্রায় শিশু ও নারীশূন্য। এখন বিকাল ৩টা। লায়লা যাচ্ছে তার আব্বার সাথে। তার নানাবাড়ি লংলা। লংলায় নদী নাই। পানিও নাই। ক’দিন পরে আসবে কে জানে। রফিক লম্বিকলার ঝাড়ের পাশে বসে লায়লার যাওয়া দেখে। লায়লা যে যাচ্ছে তা লায়লার আব্বারে দেখে মনে হইছে, লায়লারে দেখে না।

রাত তিনটায় নদী ভাঙল। লম্বিকলার ঝাড়সহ রফিকের টংদোকান এখন কই আছে নদী ছাড়া কেউ জানে না। রাস্তায় হালকা বৃষ্টির মাঝে রফিকের পাশে তার আম্মা। আশেপাশে কে আছে কে নাই তা কেউ জানতেও চাইবে না। সকাল হলে কোন দিকে যাওয়া যায় ভাবা যাবে। চায়ের-দোকান খোলা আছে। দিনে চা আছিলো এক টাকা কাপ, এখন রাত ৪টায় পুরা ২ টাকা। রফিক তার আম্মারে একটা চা হাতে দিয়ে বলে “বনরুটি খাইবা?” আম্মা না-সূচক মাথা নাড়লে সে আকিজ বিড়ির জন্য আগুন আনতে একটু দূরে গেল। এবং ফজরের আজান হয়ে গেল এবং তারা লংলার পথে হাঁটল, কিন্তু লাংলা গেল না, তারা গেল মেদিনীমল। তার আম্মার চাচার বাড়ি।

২৬দিন পরে রফিক গ্রামে এলো। লায়লা এসেছে কিনা সে জানে না। তার সময় নাই। তার মাটির ঘরের পুবের দেওয়াল পড়ছে পেয়ারা গাছের ওপর আর উত্তরের দেওয়াল পড়ছে ঘরে ভিতর। এই অবস্থায় তার মাথায় লায়লা-টায়লা নাই। রিলিফ বলতে পাইছে মাত্র দশ সের চাউল আর এক সের ডাইল আর কয়েকটা চকলেট। চকলেট কে খাবে? বিক্রি করে দিছে।

পান-বিড়ির দোকান একটা দিছে। বিক্রিবাট্টা নাই বললেই চলে। মানুষের হাত খালি। তার আম্মার চাচা ১৩০টা দিছিলেন। ওইটা তার পুঞ্জি। সাপ্তা খানেক দোকানদারি করে রফিক বুঝে গেল মরা ছাড়া আর পথ নাই। সে কামে লেগে পড়ল। এই পয়লা সে কারো বাড়ি কামে গেল। গরুর ঘাস কাটতে গিয়া পয়লা দিনেই হাতে আঙুল একটা প্রায় দুই টুকরা। তবু তার কাম করতে হবে। আম্মার লাগি তার খুব খারাপ লাগে।

বাজারে একটা গোপন খবর চলতে আরম্ভ করছে প্রায় সাতদিন হইল। রফিক জানল সাতদিন পর সোমবার সন্ধ্যায়। লায়লার পেটে বাইচ্চা। নানাবাড়িতে ঘটনাটা ঘটছে। গত সোমবারের আগের শুক্রবারে ডাক্তারের কাছে গেছিল। এখন তার শরীর খুব খারাপ। তার আব্বা বাজারে আসতেছেন না। এই খবর বাজারে এনেছে তাদের ঘরের আটমাইয়া কামলা জব্বার।

রফিক মনে মনে বলে ‘মিথ্যা কথা। লায়লা একটা পবিত্র মেয়ে। তার ওপর এমন তখমত যারা তুলতেছে আল্লা তাদের ওপর গজব ফেলব। ’

ফালগুন মাসের প্রথম শুক্রবার আজ। লায়লার বিয়ে। লায়লার বর তার মামাতো ভাই আকদ্দস আলী। বয়স ৩৯ বছর। কাতার ছিলেন। গত দেড়বছর যাবৎ দেশে আছেন। লায়লার আব্বা রফিককে বলেছিলেন “রফিক আমার বড় কইন্যার বিয়া, শুক্রবারে থাকিছ। ” রফিক বলছে “থাকমু চাচা। আগের দিন রাইতেই যামু। কাম-কাজ লাগলে করতে হইব না?” চাচা বলেছেন, “আইছ বেটা। তুরা তো আমার নিজের মানুষ। তর আম্মারে আইতে কইছ। ”

রফিকের ইচ্ছা ছিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লায়লার বিয়েতে যাবে। রাতে গরু কাটবে। গরু কাটলে দুনিয়ার কুকুর চলে আসে বাড়িতে, কুকুর তাড়াবে। লাইট-টাইট ঠিকমতো জ্বলতেছে কিনা সারারাত হেঁটে হেঁটে দেখবে। লায়লার আব্বা খুশি হবেন। মনে মনে বলবেন ‘রফিক ছেলেটা বড় ভালা। ’ শার্ট ইস্ত্রি দিয়ে এনেছিল। চাচাতো ভাই জুয়েলের একটা প্যান্ট এনে ধুয়ে রেখেছিল। চুল কি কেটেছিল? কেটে থাকতে পারে। লায়লার বিয়ের দুইদিন আগে মঙ্গলবার দুপুরে রফিক গাঙপাড়ে গেল। কেন গেল। কারণটা ঠিক জানা গেল না। কিন্তু সে যে গেছে তা একদম ঠিক। তারে যেতে দেখছেন পুবের বাড়ির আজমানের আম্মা, হানিফের বউ এমনকি রেজানের ছোট ছেলে সুমনও। তার পরনে লুঙ্গি আছিলো। গায়ে একটা হলুদ গেঞ্জি। পায়ে জুতা আছিলো কি আছিলো না কেউ বলতে পারে না। সেটা অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। জুতা ছাড়াও মানুষ হারিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সে তো ছোট ছেলে না।

লায়লার বিয়ে হয়ে গেল। রফিকের হারিয়ে-যাওয়ার ঘটনায় এলাকায় খুব তোলপাড় হলো কিন্তু কারো কিছু আসলো-না, গেলও-না। সবকিছু ঠিকমতোই চলল। লায়লা তার স্বামীর বাড়ি থেকে এসে আড়াইদিন থেকে গেল। পুবের বাড়ির আব্দুল চাচার একটা মেয়ে হলো। খুব সুন্দর মেয়ে। দেখলে পেটের ভুখ পড়ে। এলাকার কোথাও কোনো সমস্যা হলো না। সমস্যা হলো ইমরানা আপার আর তার আম্মার। আর রফিকের শালিক পাখিটার। ইমরানা আপা একদণ্ড বসে থাকার পাত্রী না। তার ভাই নাই! আপা এরে বলেন, তারে বলেন। গাঙপাড়ে যান, কবিরাজের বাড়ি যান...। কোথায় না-যান তা আপাই জানেন। অথচ তার পেটে সাত মাসের বাচ্চা। রফিক বলেছিল, “আপা তোর মেয়ে হইলে আমারে দিয়া দিছ। আমি পালমু। ” আপা কী মনে মনে বলেছিল, “নিজে খাইতে পারে না, আবার ভাগনি পালব?” না। বলে নাই। কী আদর তার ভাগনা-ভাগনিকে রফিক করে তা সবাই জানে। তার জানের জান। শালিক পাখিটা অবশ্য কোথাও যায় না কিন্তু তার খাওয়া-দাওয়া হারাম, খালি ডাকে। কারে ডাকে কেউ না-জানলেও রফিকের আম্মা খুব ভালো করে জানেন আর জানেন ইমরানা আপা।

রফিক হারিয়ে গেছে এই খবর লায়লা পেয়েছে কিনা, রফিক যেমন জানে না, ঠিক তেমনি আমরাও জানি না। গত মঙ্গলবার একটা লাশ ভেসে উঠেছিল কাউকাপন বাজারের কাছে। কার লাশ কেউ চিনতে পারে নাই। রফিকের লাশ মনে করে লাশটাকে দাফন করা হয়েছে জামে মসজিদের পাশের গোরস্তানে। কিন্তু রফিকের আম্মা বলেন “না, আমার পুত মরতো পারে না। হে আছে। ” ইমরানা আপা অবশ্য রফিকের লাশ পেলে যেমন কান্নাকাটি করার কথা তেমনই করেছেন। পচা লাশ জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না।

রফিক নিখোঁজ হওয়ার ৪মাস পর তার আম্মার ইন্তেকাল হলো। ইমরানা আপার বাড়িতেই তিনি মরলেন। কবরও দেয়া হলো মেয়ের বাড়ির গোরস্তানে। মরার আগে বলেছিলে একবার, “রফিক আমার মুখে একফোঁটা পানি দে বাবা। ” পানি কে দিয়েছিল তার জানার কথা না। কিন্তু তিনি রফিকের হাতেই শেষ জলপান করেছিলেন।

লায়লা তার বরকে নিয়ে গ্রামে ঘুরতে বের হয়েছে, ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছে রফিকদের বাড়ি। আসার ইচ্ছা ছিল না। রফিকদের উঠান দিয়ে গেলে পথ কম লাগবে, তাই ওদিকে আসা। লায়লার কোলে তার সাত মাসের ছেলে। সাথে তার ছোটবোন মেরিনাও আছে। মেরিনা বলল “আপা, ওই দেখ্ পেয়ারাগাছ। চল নিয়া যাই। ” লায়লা আপা বলে, “গাছ তো রফিকরার”... লায়লার কথা শোনার আগেই মেরিনা চলে গেল পেয়ারা গাছের তলে। পিছে পিছে বাচ্চা কোলে-লায়লা, লায়লার পিছে তার বর।

গাছে পাতার চেয়ে পেয়ারা বেশি, পেয়ারার পাশে একটা শালিক পাখি। রফিকের পাখিটা এখনো আছে। সে কোথাও যায়নি। তার ধারণা রফিক মরে নাই। একদিন ফিরে আসবেই। রফিক যে নিখোঁজ হয়েছিল এই বিষয়ে তারা কোনো কথা বলল না। না মেরিনা, না লায়লা। হয়ত ভুলে গেছে। ভুলে যাওয়া মানুষের স্বভাব। রফিকের পাখি দেখে লায়লার ছেলে খুব মজা পেল। যদিও সে জানে না এই পাখিটা কার। কার জন্য বসে আছে পেয়ারার ডালে।

পাখিটা মনে মনে বলল, “লায়লার ছেলে না তুমি? তোমার আম্মা খুব ভালো মেয়ে। খুব পবিত্র। মানুষজন খারাপ বলতে চাইছিল। কিন্তু সে খারাপ না। তুমিও সুন্দর। এত পেয়ারা আমি একলা খেতে পারব না। তোমারা নিয়ে যাও। ” পাখি খুব কিঁচিরমিচির করল। ছেলে আনন্দ পেয়েছে দেখে তার মা’ও খুব খুশি।

তারা যখন যাচ্ছে তখন পাখিও কোথাও যাবে বলে উড়ল কিন্তু কোথাও গেল না। রফিক যদি এসে না পায় তারে?



বাংলাদেশ সময়: ১৫২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।