ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

একগুচ্ছ কবিতা | মজনু শাহ

কবিতা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৫
একগুচ্ছ কবিতা | মজনু শাহ

১.
হয়ত তাদের অন্য নামে আলো দেয় চাঁদ,
কথা কিম্বা কাঠবিড়ালির দাস তারা, মেষপালকের অনুসারী—
সেইসব প্রেতযোনি পৃথিবীর ধুলো মেখে
চাঁদের ভিখারি।

২.
শব্দই অস্তিত্ব তার, বীজ, গর্ভঘুম, মেঘমালা—
কোনো বন্দি বুলবুল যত ধ্বনি তোমাকে পাঠায়
কোনো নটরাজ এই দ্যাবাপৃথিবীর কেন্দ্র ফুঁড়ে
উঠেছে যখন, ভাবো, সব আদি শব্দ মৃত্যুঞ্জয়ী;
গ্রহান্তরে তারা উড়ে যেতে যেতে পাখিদের ভাষা।


অতি ধূসরতা যদি শব্দরঙ মেনে নিতে পারো
যদি পুনর্বার চোখ মেলো এই গুহা-শহরের
মধ্যে ঢুকে, শুধু বিচ্ছুরণ, শুধু নৈঃশব্দ্য প্রণয়, 
তুমি তারই অপেক্ষায় বুড়ো হয়ে গেলে বাস্তবিক
হাঁটার দূরত্বে চাইলে ঝর্ণা, কোনো বিখ্যাত নির্বোধ
যেভাবে সংকল্প করে যে-রূপে সম্ভোগ করে শব্দ
সেই সুনির্মম পথ অপরূপ দস্যুমেঘেদের
ঝরাপাতার আসন বেছে নেয় গূঢ় কোনো ভাঁড়
আনারকলির মতো মরে যায় শব্দেরা তখন—

৩.
চিত্তাকাশ টলোমলো কোথা আছ গোপন শিক্ষক?
সমুদ্র ইঙ্গিত করে আর আমি পলায়ন করি
গোলাপ নির্গত হয় আর আমি পলায়ন করি—

৪.
কমলা রঙের এক ভাষার অধীন তুমি আছো,
এই দগ্ধবনে যত পথ ফিরেছে তোমার দিকে,
তারা অন্য কোনো ভাষা, অন্য মাধুর্যের ধূলি মেখে
অনন্তে শায়িত। কবে সাক্ষ্য দেবে চূড়ান্ত নশ্বর
সেইদিকে পেতে রাখা রক্তচোখ বুঁজে আসে ক্রমে।
দারু, দ্রাক্ষা, দুধ আর বাগর্থের লোভে কোনোদিন
হাঁটি নি তোমার দিকে। গানহীন পাখিদের ভিড়ে
রয়ে গেছি, তবু কোন অবসরে আসক্তি জেগেছে
শব্দে, যেন বোবা পার্শ্বচর ভ্রম থেকে উঠে ফের
বেদনার উপযোগী মৃগয়ার স্বপ্নে গেল ডুবে।
তোমার ভাষার বর্ম প্রতিধ্বনিময় পাষাণের
তোমার ভাষার ধূলি ঋষিবিড়ালের সারা গায়ে,
তবু এই দগ্ধবনে ফিরে এসে দেখো সমস্ত মুকুল
ঝরে পড়ছে ঘাসে স্রোতে আর আমাদের ইস্তেহারে।

৫.
আজ সুফি-ধূলিকণা যত আছে এখানে ওখানে
বাতাসে গভীরভাবে অন্ধ হতে হতে উপস্থিত।
ভ্রমণশীল উদ্ভিদ, এত কেন ভয় হেমন্তকে?
ভ্রমণশীল পাহাড়, কার হাত থেকে ঐ রুটি
গর্ধবের পিঠে জমা হয় তুমি তার কিছু জানো?
গরম রুটির গন্ধ-ভরা এই আয়না-সমাধি
কেন যে পাহারা দেই আমি আছে যদি এত বুলবুলি,
রক্তাক্ত সমাধানের দিকে এত কারা ছুটে যায়,
তস্করতাপূর্ণ চক্ষু মুদে ফের ধূলিকণা হও—

৬.
শালফুলের গন্ধে ভরে উঠল এই অ্যাম্ফিথিয়েটার। হেসে চলেছে
বর্ণচোরা। কুঞ্জ নামের মেয়েটি তাকে থামানোর চেষ্টা করছে।
আরো কে কে এলো রে, রত্নপাথরে হেলান দিয়ে আছে বুঝি
কোনো অন্ধ চাঁদ! চাইছি এখন বুনোগদ্য, দেবতার হাসি, ঘুম আর
সমস্ত রুমঝুম। যে-ছন্দে ভ্যাগাবন্ড ঘোরে জঙ্গলে। গানে গানে
ফর্দাফাই হয় বুলবুলি। যে-ছন্দে মুছে যায় উড়ন্ত ঈগলের কায়া।
অসীমের দিকে ঝাঁপ। ডিপ্রেশন, প্রিয়। ছায়াযুদ্ধ, আবার মেনে নিও... 

৭.
আরো কিছুদিন বাদামগাছের মতো থাকো। এর বেশি চেও না।
ছিন্নমুণ্ডু উড়ে এসে পড়বে হয়ত পায়ের কাছে। ভয় পেও না।   
মনে করো বিবাহের ঘুড়ি হারিয়ে যাচ্ছে আকাশে। পেত্রার্কার সনেটরীতি 
এখন বাঁচাতে পারবে না তোমাকে। খুঁজে পাবে না তোমাকে আর কোনো
আয়েশা। তোমার সঙ্গী হবে শুধু খড়ের মাদুর। আর সব একে একে
পথের বাঁকের মতো মুছে যাবার জন্যে প্রস্তুত।   শান্তভাবে দেখো শেষটুকু, 
এই জোনাকিদের দুর্গ আর তাকে ঘিরে ঘুম ফুরিয়ে যাওয়া পাখিদের
কৃষ্ণনীলাভ ওড়াউড়ি।

৮.
কাঠের বাক্সে সে গুছিয়ে রাখছে কৃষ্ণচূড়া, বিড়বিড় করে বলছে,
আ হর্স! আ হর্স! মাই কিংডম ফর আ হর্স...
গ্রহণ করো আমার এই রক্তবসন্ত, আর যত ট্র্যাজেডি,
তুমি হে কৌন ফরিস্তা, কৌন পরিন্দা দেখা দিচ্ছো হাওয়ায়,
রাজা সিমুর্গ তোমাকে চেনে? পাখিদের ভিড়ে তোমার
নৌটংকিবাজি মুছে যায়। ময়দানে, সারি সারি কবর,
ধরে নাও এরাই কোনো শিল্পের চূড়ান্তে পৌঁছেছে। তোমার মুখ থেকে
সরে যাচ্ছে ক্রমে হ্যালোজেন ফগ, জ্বলে উঠছে শব্দের অঙ্গার।
তবু কেন আজ কৃষ্ণচূড়ার মধ্যে ফিরে গেলে তুমি,
আজ কেন আমার কবিতার পাশে বসে থাকে জল্লাদ!  

৯.
ক্যাসিনো টেবিলে হয়ত কারো জন্যে অপেক্ষা করছে
একটি কাকাতুয়া। এখানে আমি
প্রহরীর অধিক কিছু নই। দমকা হাওয়ায়
তাসের রানির পিছে উড়ে গেল তাসের জোকার।
জোকারের পিছে রাজা উড়তে গিয়ে পড়ে রইল মেঝেয়।
চোঙা লাগানো গ্রামোফোনে কে বেজে উঠবে এখন,
আঙুরবালা, না গহরজান?

১০.
তোমাকে আচ্ছন্ন করে মৃত্যুনির্জন ওই রামধনুময় পঙক্তি,
শব্দাতিরিক্ত ধ্বনির ভর। অবেলায়, পেতে চাইছো বুঝি
একটা অন্যরকম ভাষাছবি। ভাষাভ্রমরের উন্মাদ চলন।
নীল রঙে হুটোপুটি খেয়ে একটা বানর সারাটা বিকেল ধরে
তোমার কবিতাগুলো বিবেচনা করে দেখেছে। রক্তের মধ্যে
ধূধূ কোনো সুর বেজে উঠল যেন, মুছে গেল রামধনু।
তোমার ফর্দাফাই কবিতার স্তূপের ওপর এখন বিষ্ঠাত্যাগ করে
চলে যাচ্ছে সেই বিজ্ঞ বানর। এরপর শুধু জুনিপোকার ওড়াউড়ি
রাত্রির সমাধিক্ষেত্র জুড়ে। কোনো শব্দ নাই আর। অভ্র-ঝরা
যে-অবয়ব সঙ্গী হতে চেয়েছিল, তাকে আর কোথাও খুঁজে
পাবে না তুমি। শোনো,  তুমি এক অলীক ভ্রমণার্থী বৈ কিছু নও।



বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।