ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ইলিয়াসের গল্প: আড়মোড় ভেঙে সব মধ্যবিত্ত জাগে | মেহেদী উল্লাহ

বিশেষ রচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৪, ২০১৬
ইলিয়াসের গল্প: আড়মোড় ভেঙে সব মধ্যবিত্ত জাগে | মেহেদী উল্লাহ

নতান্ত্রিক সমাজজাত বিত্তবান ও বিত্তহীন শ্রেণির মাঝামাঝিতে অবস্থানরত, প্রত্যক্ষ উৎপাদন সম্পৃক্তহীন, শিক্ষা-সংস্কৃতি পরিশীলিত, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অভিন্ন জনসম্প্রদায়কে মধ্যবিত্ত হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশ এসেছে গ্রামভিত্তিক জীবন কাঠামো থেকে, যাদের কাছে গ্রাম অপেক্ষা শহুরে জীবন অধিক আকর্ষণীয়।

সংঘাতমুক্ত নির্বিবাদী শান্তিময় জীবন-যাপনে পরিতৃপ্ত থাকতে চায় এই সকল মানুষ। তারা অন্যকিছুতে মাথা না ঘামিয়ে জীবনের আরামপ্রিয়তায় সর্ব শিখরে যেতে যায়। তাঁদের স্বার্থচেতনা অত্যন্ত প্রবল ও আত্মকেন্দ্রিক। মূলত, খোলসযুক্ত মধ্যবিত্ত জীবনের আড়মোড় ভেঙে দিয়েছেন ইলিয়াস তাঁর গল্পে। ষাটের দশকে আমাদের ছোটগল্পের অঙ্গনে যে কয়জন প্রতিভাধর শিল্পী আবির্ভুত হয়েছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) তাঁদের অন্যতম।

তিনিই বোধ হয় প্রথম, কোনো রাখ-ঢাক ছাড়া মধ্যবিত্তের জীবনকে পাঠকের সামনে সাদাচোখে উন্মোচন করার সাহস দেখিয়েছেন। অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬), খোঁয়ারি (১৯৮২), দুধভাতে উৎপাত (১৯৮৫), দোজখের ওম (১৯৮৬), জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল (১৯৯৭) এইসব গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোতে ঘুরে-ফিরে এসেছে, যে জীবন মধ্যবিত্তের। এ বিষয়ে ‘উৎসব’, ‘ফেরারী’, ‘খোঁয়ারি’, ‘অসুখ-বিসুখ’, ‘তারা বিবির মরদ পোলা’, ‘কীটনাশকের কীর্তি, ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’, ‘দোজখের ওম’, ‘ফোঁড়া’, ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল’, ‘কান্না’, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’, ‘দুধ ভাতে উৎপাত’, ‘পায়ের নিচে জল’ প্রভৃতি গল্প পড়া যেতে পারে।



পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে ব্যক্তির প্রকৃত স্বরূপই তিনি চিহ্নিত করেছেন। গল্পে মমতাশূন্য নির্দয় মানুষের উপস্থিতির কারণে রোমান্টিকতা নেই। তাঁর গল্পে জীবনের উপস্থিতি কখনো পুরোপুরি ব্যক্তিনির্ভর। খাপ খাওয়াতে না পারার যন্ত্রণায় চরিত্র হয়ে পড়ছে বিষণ্ণ। আবার কখনো, বঞ্চনা ও সামাজিক বৈষম্য ব্যক্তি সংকটের জন্ম দিচ্ছে অথচ ব্যক্তি নির্বিকার। অন্যদিকে, শ্রেণিসমাজ ব্যক্তিকে লুণ্ঠন করছে, আর পাল্টা ব্যবস্থা নিতে রুখে দাঁড়াচ্ছে চরিত্র, সেরকমটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে



পুরনো ঢাকার সড়ক, পুরনো বাড়ি, বাড়ির ঘাস, সড়কের পাশের সাইনবোর্ড, গলি-উপগলি পর্যন্ত মানুষের মতো প্রাণবন্ত রূপ পেয়ে চরিত্র-মর্যাদা লাভ করেছে। যে জীবনে রয়েছে ব্যর্থতা, হতাশা, হঠকারী, প্রতারক ও প্রভাবিতের এক আদিম সমাজের মতো সমন্বয়—সেই জীবনের আলেখ্য তাঁর গল্প। বিস্তৃত জনজীবনের ও জনপদের হঠকারী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতিক্রিয়া, সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক চিন্তা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, ব্যর্থ জীবনের ভগ্নতা, হতাশা, অতৃপ্তি ও তা থেকে উত্তরণের প্রাণান্তকর অরুচিকর চেষ্টা ও নোংরা কৌশল, সৌখিনতা ও ভদ্রতার মুখোশের অন্তরালে অভিনেতা ও গ্রামীণ সমাজের নিরন্তর সংগ্রামী জীবন তাঁর গল্পে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে।

ব্যক্তি সমাজেই বাস করে, ব্যক্তির সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রের একটি আন্তঃসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সম্পর্কের বোঝাপড়ার ভেতর দিয়ে তৈরি হয় ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের অবস্থান। ইলিয়াসের গল্পে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের সুর এরকম—নিজের সঙ্গে নিজের, সমাজের, রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার সঙ্গে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব-সংঘাতের স্বরূপ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প।

সংঘাতের রূপটি তাঁর গল্পে কখনো প্রকাশ্য, অবৈরীমূলক, বৈরীমূলক অথবা প্রত্যক্ষ। দ্বন্দ্বের কারণে ব্যক্তি পরাস্ত, ধ্বস্ত, পঙ্গু, নিজের চরিত্র বিনাশে তৎপর, নিজের বিকাশ সঞ্চয়েও অক্ষম। অন্তর্গত ও বহির্মুখী নানা সংকট প্রোথিত রয়েছে জীবনের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত ও শ্রেণি অবস্থানে। সমাজের মধ্যেই খুঁজতে হয় মানুষের উত্থান ও অবস্থান। ইলিয়াস সমাজের মানুষের জীবনযাপন, বাঁচা-মরা, নির্মাণ-বিনাশ, সংস্কৃতি-রাজনীতি ও শিল্পসাহিত্যের বাস্তবতা নিয়ে বাংলা ছোটগল্প সাহিত্যের স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী লেখক। মধ্যবিত্তের সম্ভাবনা ও সম্ভাবনাহীনতাকে যুগপৎ জীবন্ত করার প্রয়াসে তাঁর লেখনীই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ছোটগল্পে সর্বোত্তম।

মূলত, শহরে শরীরে শরীর লাগিয়ে একে অন্যের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে বাস করে জব্দ হওয়া মানুষ। দেশের কোনো না কোনো গাঁও গ্রাম থেকে হতশ্রী পুরনো মফস্বল ঘুরে শেকড় ছেঁড়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষকে আসতে হয়েছে প্রতারক শহরের বুকে। যেসব হাড্ডিসাড় ক্ষুধা ও খরার আগুনে দগ্ধ গ্রামের হাজার ফাটলের শুকনো জমিতে খাটছে, মরছে, জমি বেছে, নিঃস্ব হচ্ছে তাদের আহাজারি জীবন থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। আবার শহরের যে অংশে একদা ছিল খানদানীর বাস, শরীকদের উপস্থিতি, কি নবাব সর্দারদের সাধের বসত তা এখন পচে গলে একাকার। এমন সব পরিপ্রেক্ষিতের লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। অভিযোগ ছিল, তিনি শুধু পুরনো ঢাকার কথাকার। কিন্তু, অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়ে তিনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কৃষক নিয়ে গল্প লিখে নিজের শহুরে ঝুলিতে গ্রামকেও তুলে নেন।

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে ব্যক্তির প্রকৃত স্বরূপই তিনি চিহ্নিত করেছেন। গল্পে মমতাশূন্য নির্দয় মানুষের উপস্থিতির কারণে রোমান্টিকতা নেই। তাঁর গল্পে জীবনের উপস্থিতি কখনো পুরোপুরি ব্যক্তিনির্ভর। খাপ খাওয়াতে না পারার যন্ত্রণায় চরিত্র হয়ে পড়ছে বিষণ্ণ। আবার কখনো, বঞ্চনা ও সামাজিক বৈষম্য ব্যক্তি সংকটের জন্ম দিচ্ছে অথচ ব্যক্তি নির্বিকার। অন্যদিকে, শ্রেণিসমাজ ব্যক্তিকে লুণ্ঠন করছে, আর পাল্টা ব্যবস্থা নিতে রুখে দাঁড়াচ্ছে চরিত্র, সেরকমটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

গোটা নগরজীবন উঠে এসেছে ‘উৎসব’ গল্পে। গল্পটিতে যুগপৎ ধানমন্ডির বর্ণাঢ্য ও পুরনো ঢাকার পূতিগন্ধময় জীবনচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা শহরের উচ্চ ধনিক শ্রেণি হতে শুরু করে পুরনো ঢাকার একেবারে প্রান্তিক মানুষগুলো পর্যন্ত এ গল্পে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এ গল্পের মূল চরিত্র আনোয়ার আলি নিম্নবর্গের প্রতিনিধি। জীবনের সকল স্বপ্ন-সাধ তার অধরা। ধানমন্ডির এক অভিজাত বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ পায় সে পুরনো  বন্ধুত্বের সূত্র ধরে। বৌভাত খেতে গিয়ে অতৃপ্ত আনোয়ারের আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে ‘ভালো ভালো মেয়ে’। তাদের সঙ্গে আলাপ এবং সমস্ত বাড়ির অভিজাত আমেজ সপ্তাহখানেক শরীরে সুখ উদ্রেক করবে বলে ভেবে থাকলেও নিজের সরু গলিতে ফিরে এসে মানুষ ও কুকুরের অপকর্মে সে বিরক্ত হয়ে পড়ে। সে বিয়ে বাড়ির অভিজাত পরিবেশ ও পুরনো ঢাকার পরিবেশের তুলনা করে মনে মনে। তার পুরনো ঢাকার বিষয়ে গা ঘিন ঘিন করে। এমনকি তার নিজের স্ত্রী সালেহাকেও অভিজাততন্ত্রের সঙ্গে মেলায় সে এবং ঘৃণা করে। চাকচিক্য দেখে এসে ঘরের সাদামাটা স্ত্রী সালেহার সঙ্গমুখ তার ভালো লাগে না। অতঃপর সে সালেহার সঙ্গে রতিক্রিয়া করলে তার কল্পনায় থাকে আধুনিক রূপযৌবনবতী নারীরা।

তবুও তার যৌন চেতনা তেমন সক্রিয় হয় না। এমন সময় রাস্তার হৈ হুল্লোড় শুনে সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আর দেখে সিনেমা হলের শো ভাঙা মানুষ মজা করে দু’কুকুরের রতিক্রিয়া দেখছে। কুকুরদের রতিক্রিয়া দেখে আনোয়ার আলির যৌনস্পৃহা জাগে। ঘরে ফিরে সালেহাকে কাছে টেনে নেয়। মূলত এই গল্পে একজন মানুষের যৌন অবদমনের দশাগ্রস্ততা প্রকাশিত হয়েছে। সে কামনা করে অভিজাত নারী, অথচ তার কামনা চরিতার্থ করতে না পেরে এমন দশায় পৌঁছেছে।

পুরনো ঢাকার জনজীবন নিয়ে লেখা ইলিয়াসের আরেকটি গল্প ‘যোগাযোগ’। এ গল্পে রোকেয়া তার পিতা সোলায়মান আলীর সঙ্গে মামার অসুস্থতার খবর শুনে মামা বাড়ি যায়। ছেলেকে রেখে যায় স্বামী হান্নানের কাছে। সেখানে গিয়ে সে শৈশবের স্মৃতিতে ডুবে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়। শৈশবের এই গ্রাম থেকেই রোকেয়ার মা নুরুন্নেসা বৌ হয়ে সোলেমান আলীর বাড়িতে গিয়েছিল এবং এক সময় সন্ধ্যাবেলায় সে তার মাকে দেখতে পায়।

এভাবে মৃত মায়ের স্মৃতি রোকেয়ার মনকে অশান্ত করে করে তোলে। ঘরে ফিরে শোনে হান্নানের টেলিগ্রাম এসেছে, তার ছেলে ছাদের কার্নিশ থেকে পড়ে গিয়ে বেশ আঘাত পেয়েছে। রোকেয়া দ্রুত ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করে। রোকেয়ার মনস্তত্ব, শহুরে সভ্যতার নানা দুর্বিষহ রূপ, হাসপাতালে চিকিৎসা সেবায় অনুন্নত অবস্থা—ইলিয়াস তা তুলে ধরেছেন। ঢাকার হাসপাতালগুলো মানুষ মারনের ফ্যাক্টরি হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এ গল্পে মূলত, পিতা সোলায়মান আলী, মা নুরুন্নেসা, ছেলে খোবান, স্বামী হান্নান, মতিমিয়া বাবুর্চি, সেতারা এদের দারিদ্র্যের বর্ণনা পাশ কাটিয়ে পারস্পরিক স্নেহ, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা, মায়া ইত্যাদি আবেগকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

‘কীটনাশকের কীর্তি’ গল্পটি গ্রাম্য বালিকা অহিমুন্নেসার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। তার মর্মান্তিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গল্পকার শোষক শ্রেণির শোষণের চিত্রকে গল্পে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অহিমুন্নেসা কীটনাশক বিষ পান করে আত্মহনন করলে ছোট ভাই রমিজালীর মনে ভীষণভাবে দাগ কাটে। রমিজালী  ঢাকার এক বিত্তবান ব্যক্তির বাসায় কাজ করে। রমিজালী বোনের আত্মহত্যার খবর পেয়ে নিজের বাড়িতে যাবে এ সিদ্ধান্ত নেবার পরও রমিজ সাহেবের কাছে তার আর্জি পেশ করতে পারে নি। মূলত নিম্নবর্গের ভাষা অভিজাতের সামনে অনুচ্চারিতই থেকে যেতে চায়—একারণেই সে নিম্নবর্গ। রমিজের মনের সকল কথা কোথায় যেন এসে থেমে যাচ্ছিল।

ছুটি চাইতে না পারায় রমিজ রেগে যায় বোনের প্রতি। তার বোনের সর্বনাশ করেছে মিরধা বাড়ির ম্যাট্রিক পাস, সে কারণে হাফিজুদ্দিনের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পরও ম্যাট্রিক পাস তার বোনের সংসার টিকতে দেয় নি। অহিমুন্নেসা তখন কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করলে একটা বিজাতীয় আক্রোশে রজিম সাহেবের মেয়ের মুখে রাউমের গুঁড়ো দিতে চায়। সে সফল হয় না, বরং বেদম মার খায়। এ গল্পে রমিজ, মতিন ড্রাইভার, সোনামিয়া ড্রাইভার এরা সবাই নিম্নবর্গ।

পুরনো ঢাকার অলি-গলি আর এখানকার মানুষের জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নানা দিক স্পষ্ট হয় ইলিয়াসের ‘দোজখের ওম’ গল্পে। রোগগ্রস্ত বৃদ্ধ কামালউদ্দিনের যন্ত্রণাতুর হৃদয়ের করুণ আর্তি ও পৃথিবীতে যে অসহনীয় জ্বালা যন্ত্রণা তারই রূপ দান করেছেন গল্পকার। জীবন সায়াহ্নে এসে বৃদ্ধ কামালউদ্দিন যখন অসুস্থ শরীর নিয়ে ফেলে আসা দিনের হিসেব মেলাতে বসে তখন তার সামনে পাপ-পুণ্য এসে চক্রাকারে ঘুরপাক খায়। সংসারের হাজারও সুখ-দুঃখের কথা, মৃত স্ত্রীর কথা তার হৃদয়ে খচ্খচ্ করে। কামালউদ্দিনের পেশা ছিল দর্জিগিরি। ফেলে আসা অতীত জীবনের নানা ছোট-খাটো ন্যায় অন্যায় মৃত্যু শয্যায় তার মনকে নাড়া দিতে শুরু করে। অসহায় কামালউদ্দিন মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকে। কাশতে কাশতে দম বন্ধ হবার দশা হলে বাম হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরে। বুকের কষ্টটা দমাবে কোন হাত দিয়ে? সেখানে চিনচিন করে। দম বের হয়ে যাওয়ার অবস্থা।

জীবিত থেকেও যেন দোজখের সাজা ভোগ করে কামালউদ্দিন। শারীরিক এ অসহায়তার যে নরক যন্ত্রণা তিলে তিলে ভোগ করে কামালউদ্দিন, তার সঙ্গে যোগ হয়ে মানসিক যন্ত্রণা। নিম্নবর্গের এই প্রতিনিধি চরিত্রটিকে যুদ্ধ করে যেতে হয় মৃত্যু পর্যন্ত। এত যন্ত্রণা আর অসহায়ত্বের পরও তার একছেলে আমজাদ যখন মৃত পুত্র আকবরের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের ভিটা থেকে উচ্ছেদের পরিকল্পনা করে তখন দুনিয়াদারীর অসহ্যকর পরিবেশে কামালউদ্দিন গর্জে ওঠে প্রতিবাদ করে, ‘তর চাচারে কইস, দাদায় অহন তরি বাঁইচা আছে। ’

সম্পদের অসম বণ্টন ব্যবস্থা বোঝার জন্য উৎকৃষ্ট ‘ফোঁড়া’ গল্পটি। এ গল্পে মার্কসীয় তত্ত্বের আড়ালে অসাধারণভাবে  উঠে এসেছে নিম্নবর্গের মানুষের জীবন কথা। যে জীবন শহরের। এছাড়া গল্পে জাতীয় জীবনের অন্যতম দুটি সংকট, বেকারত্ব ও চাকরি থেকে ছাঁটাই প্রাধান্য পেয়েছে। কারখানার ছাঁটাই হওয়া অসুস্থ শ্রমিক নইমুদ্দিন, তার রিকশাওয়ালা মামাতো ভাই এমনকি জনৈক পার্টিকর্মী মামুন এরা সবাই চালিয়ে যাচ্ছে জীবনযুদ্ধ। জীবনের জীবিকার অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনানিপাত করছে। নইমুদ্দিনের ছাঁটাই হওয়া, রিকশাওয়ালা মামাতো ভাইয়ের ফোঁড়ার কারণে রিক্সা টানতে না পারা এবং মহাজনের কাছ থেকে তিরিশ টাকা ঋণ নেওয়া সবই বাস্তবতার নিরিখে, জীবন থেকে নেওয়া।

মূলত, এই সব জীবন, যারা জীবনের চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে, তাদের কাছ থেকেও মহাজন সুদ খেতে ছাড়ছে না, রক্ত চুষে নিচ্ছে। তাকে দশ টাকা লাভ দিতে হয়। লেখক এই গল্পে সমাজে সম্পদের অসম বণ্টন ব্যবস্থাকে ফোঁড়ার মধ্যে জমে থাকা যন্ত্রণাদায়ক পুঁজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এভাবেই মধ্যবিত্তের জীবন মোহমুক্তভাবে নির্মাণ করেন তাঁর ছোট গল্পে, সেই সঙ্গে মধ্যবিত্তের জীবনকে আরো পরিষ্কার করে তুলে ধরবার জন্য গল্পে নিম্নবিত্ত শ্রেণিটিকেও কাজে লাগাতে ভোলেন না।



বাংলাদেশ সময়: ১৬০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।