ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

উৎপল পাঠের কিছু নোট (২): পুরী সিরিজ পর্ব | জহির হাসান

ধারাবাহিক রচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৬
উৎপল পাঠের কিছু নোট (২): পুরী সিরিজ পর্ব | জহির হাসান

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

ৎপল আমার কাছে কবিতায় তার ব্যক্তিগত শব্দের জগতের ব্যবহার নিয়া অনেক কথাই তুলছিলেন। উনি কইছিলেন ছোটকালের গ্রামের অনেকের ডাক নাকি এখনো শুনতে পান কান পাতলেই।

অতীতের আচ্ছন্নতা নয় ইহা, বরং সেই জগতের লগে তার একটা যোগাযোগ তৈয়ার করবার চাইতেন কবিতায়। নিম্নবগীয়পনা এই জীবনের প্রতি আদি টান চিরকাল কাজ করছিল। কলকাতার জীবনকে পেছনে রাখি উনি এদিক ওদিক ঘুরতেন। তাদের কাছেই কিছু শিখার আছে বলি মনে করতেন। তার এই ঘোরাঘুরি যেন স্মৃতির দিনহাটাতেই রাত-দিন ঘোরা। সেইসব নিম্নবর্গীয় মানুষের ওম নেওয়া ছিল তার একটা বড় কাজ। কবিতা-টবিতা ওনার কাছে ছিল একটা গৌণ বিষয়। আমরা সেইসব আলোচনায় পরে ফোড়ন কাটিব।

২.১
উৎপলের মধ্যে কিছু জগতের প্রতি টান আদি পাপের মতোই কাজ করে। তার কবিতার মধ্যে সেইসব জগতের থাকি বাক্য আসি মিশি যায় ভেড়ার দলে যেন ছদ্মবেশি ভেড়া সাজি। সেইসব জগৎগুলিনের হদিশ নেবার চেষ্টা করি। তানা হইলে তার কবিতার ভাবগতি ধরা যাইবে না।

কখনো কখনো উনি স্ট্রিট রিয়ালিটির জগতের কথা কইতেন। সেই স্ট্রিট রিয়ালিটি একটা ব্যাপক ব্যাপার। সেইখানে শব্দের জগৎ ইমেজের জগৎ অনুবাদ হই আসে কসমোসেন্ট্রিক, থিয়োসেট্রিক ও লোগোসেনট্রিকতায়।



‘বসন্তে এনেছি আমি হাবা যুবকের হাসি’ খামোখাই উনি পাগলের কায়কারবারের বর্ণনা দেন নাই। বসন্ত চিরাচরিত প্রেমিক-প্রেমিকার জাগি উঠার ঋতু। ভোমরার ফুলের গৌরব এই ঋতুর কায়কারবারের প্রখ্যাত বিষয়। সুপ্তি ঘুম জরা থাকি জাগি উঠার কাল। কবি আমদানি করতেছেন হাসি নিজের মধ্যে। কিন্তু তাহা হাবা যুবকের। এর অর্থ কী? কারণ এই যুবক যদি চালাক হতো তাহলে বুদ্ধিদীপ্ত হাসি দিয়া ফেলত। তাহলে সমস্যা হই যাইত এই কবিতার লাগি। এইখানে হাবা যুবকের একটানা বাক্য প্রক্ষেপণ—মূলত পুরীসিরিজের কবিতাগুলির ফরমকে জায়েজ করি নেবার হাসি। এই পাগলের হাবা হাসি জারির কারণ হইল এই কবিতা যাতে কিছু প্রলাপমুখর কথা বাক্য হই ওঠে। উৎপল এই বিষয়ে জানাইতেছেন: ‘পাগলের প্রলাপে যে-মন্ত্রোচ্চারণ লুকিয়ে থাকে, দরিদ্রের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার পর তার মুখ থেকে, অনিয়ন্ত্রিত ভাষায়, যে লৌকিক অভিশাপ ঝরে পড়ে—আসুন, আমরাও এই ভাষায় পরস্পরকে অভিবাদন জানাই



২.২
জীবনানন্দ দাশকে উৎপল নিছিলেন তার কবিতায়। কেউ কেউ জীবনানন্দের গন্ধ পান উৎপলে। কবিতায় উৎপলিক এভিনিউ চলি গেছে জীবনানন্দের ঘরের ভিতর দিয়া বটে। জীবনানন্দরে ইমেজের কবি হিসেবে পাঠ করতেন উৎপল। জীবনানন্দের ইমেজের ব্যবহার কবিতায় উৎপল মানি নিছেন।

জীবনানন্দ উৎপলের একখান জানালা। সেই জানালা দিয়া খণ্ড ইমেজারির ‘র’ ব্যবহারের টেকনিক উৎপল জীবনানন্দের থাকি নিয়াছিলেন। কবিতায় প্রকৃতির থাকি চয়নকৃত নীরব বিচ্ছিন্ন ইমেজের আগমন জীবনানন্দীয় লাগে পাঠকের কাছে।

ইমেজের স্বপক্ষে উৎপলের নিজের বক্তব্য শোনা যাক :

‘কবিতা নিজেকে ঘিরে যে অস্তিত্ব-জটিল বাস্তবতা তৈরি করে তাকে আমরা প্রতিবিম্ব, প্রতিফলন, ছায়াপাত ব’লে স্বীকার করে নিলে খানিকটা স্বস্তি পাব। কেননা আমাদের জানতে বাকি নেই যে সামান্য বাতাসে, জলবাসী প্রাণীদের সামান্য নড়া-চড়ায়, ওই সুখী, স্থির পুকুরের ছবিটি টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কবিতার বাস্তবতা যেন ভেঙে-পড়ার জন্যেই সৃষ্ট হয়। আবার প্রতিফলনেই সে নিজেকে পুনর্গঠিত করে। আরেক বাস্তবতা সৃষ্ট হয়। তখন হয়ত সূর্য আরেকটু হেলে পড়েছে, বাতাস বাঁক নিয়েছে, এবং জলজ প্রাণ আরো গভীর স্তরে অন্তর্হিত হয়েছে। অথবা, রূঢ়ভাবে বলা যায়—জল শুকিয়ে গেছে, শুকনো পাতা উড়ছে, শকটের চাকা ফেটে দু-খান হয়ে পড়ে আছে। আর স্মৃতিবিভ্রম তৈরি করছে কবিতা। ওই দৃশ্যের উপর দিয়ে, গ্রীষ্মের দগ্ধ অরণ্যে লুকিয়ে-পড়া এবং ধরা-পড়ে যাওয়া মানবমানবীর আর্ত চিৎকারের মতো, পাগল হাসির মতো, যে শব্দ-উপমা-অলংকারের ধ্বনি বাতাসে ভেসে চলেছে—তাই কবিতা। ’

২.৩
উৎপলের শব্দের জগৎ নিয়া ইতোমধ্যে কইছি যেমন, ‘ছেলেবেলায়, বিছানায় শুয়ে শুয়ে, বহু ঘুমহীন রাতে শুনেছি চৌকিদার হেঁকে যাচ্ছে ‘বস্তিওয়ালা জাগো...কোঠিওয়ালা জাগো...। ’

এছাড়া উনি কইছিলেন, আমি রাস্তায় গিয়া চোখ বন্ধ করি দাঁড়াই, তারপর কত রকমের আপাত বিচ্ছিন্ন শব্দ শুনতে পাই। যেন অন্ধের কানই চোখ। এইভাবে কবিতায় আমরা দেখি উৎপল চোখ নির্ভরতা থাকি কানের দিকে তথা শব্দের জগতের দিকে হাঁটছেন। এই জিনিসটা উনি কবিতায় ব্যাপক ব্যবহার করছেন। তার শেষের দিকের কবিতায় এই জিনিসটার ব্যাপকতা বেশি দেখতে পাওয়া যায়। পুরী সিরিজের কবিতায় এই জিনিসের আনাগোনা রক্ষা করছেন কবিতার গীতিধর্মীতার মধ্য দিয়া। কানের মধ্যে ঢুকে যায় গান তারপর দৃশ্য তৈয়ার হয়। সুরে মিশি যায় দৃশ্য। সুরারোপিত কবিতা এইখানে আছে। পাঠ নয় কবিতা শোনারও। কানে শোনা জগৎ কবিতায় আসি মেশে চোখে দেখা জগতের স্রোতে। তবু সেই জিনিসগুলার হদিস করিব পরের প্রতিটি কবিতার একক আলোচনায়।

‘ভাষাবিদরা বলেন আমাদের মৌলিক চিন্তা, আত্মপ্রকাশকালে, ধ্বনিনির্ভর, শব্দায়িত বা শব্দাংশ-শাসিত। কেউ কেউ বলেন পূর্ণবাক্য রূপেই সেসব চিন্তা অর্ধচেতন-অবচেতন মন থেকে ভেসে ওঠে। ’

‘আমাদের অন্তঃস্থলের দিকে তাকাতে হবে। ভাষা আমার অবচেতনে নিহিত। এমন কেউ কেউ দাবি করেন যে আমাদের অবচেতন ভাষার মতোই গঠিত। তাহলে, আমরা দু-ধরনের যাত্রা বা সন্ধানের কথা বলছি একটি বাইরের দিকে, লোকসমাজের দিকে—অপরটি নিজের মনোজগতের গভীরে। ’

শব্দ জগতের প্রতি উৎপলের টান নিয়া আরো লম্বা লম্বা তাঁরই নিজ বক্তব্য দেয়া যাইতে পারে।

২.৪
আধুনিকতা বা সেকুলারইজম ধর্ম হিসেবে কাজ করতে থাকে যবে ধর্মরে সরাইয়া দেয়া হইল কর্তৃত্বের জায়গা থাকি। বস্তু তার ধর্ম ত্যাগ করবার পারে না। কোনো কারণে সে পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ধর্ম ধারণ করে বটে তা তাহার স্বভাবের না। সেকুলাররা তাদের বাপদাদার ধর্মরে ত্যাগ করি নতুন ধর্ম ধারণ করে বটে তাতে শতভাগ লৌকিকতা রক্ষা হয় না। ফলে কেউ মার্কসের মুরিদ হন, কেউ ফ্রয়েডের অবচেতনার ব্যাখ্যার নিচে ঘুমান। কেউ লাকানের, কেউ লালনের হই জগতের তত্ত্বরে পান,... আরো অনেকে অনেকের হই ধর্মপালন ও প্রচার করি থাকেন। ধর্মীয় এই মিথকেন্দ্রিক মডেলের বাইরে আমরা যাইতে পারি না! যাহোক, আমাদের মধ্যে লৌকিকতা তলে তলে ধর্ম আকারে কাজ-কর্ম চালাইয়া যাইতে থাকে। আর আমরা এক লৌকিকতার মর্যাদা দিয়া ধর্মের তাঁবুর থাকি দূরে আকাশ, গাছ, ছায়া, নদী, স্তব্ধতা, ভাষা, জ্ঞান, নিঃসঙ্গতা, মওত, জীবন, সংশয় নামের দেবদেবীগের নানা রকমের গুণগানসহ  আর্র্কিটাইপে আশ্রয় নিতে থাকি। এইভাবে আমরা নানা পদের  সেকুলারগণ পূজা-আর্তি করি থাকি। আমাদের অধিবিদ্যাচর্চা অব্যাহত রহে। আমাদের ভাষার কারবারের তলায় এই ধর্ম রক্ত আকারে প্রবাহিত হয়। যেন বস্তু-ভাবের অবিচ্ছেদ্য চিরজড়াজড়ি। পরে আমরা কয়েকবার বলিব যে উৎপলের মধ্যে কালেকটিভ আনকনসাস বা যৌথঅবচেতনা ধর্ম আকারে তারে গাইড করছে।

২.৫
এক্ষণে এই কিসিমের উৎপলের আরো তিনখান জগৎবিশ্বাসের অবতারণা করা যাইতে পারে। তিনি এইগুলারে কয়েকবার বলবার চেষ্টা করছেন অনেকের কাছে। তার কবিতার ব্যাখ্যার পাঠের ক্ষেত্রে এই চিন্তাগুলিনরে পাশ কাটায়ে গেলে অবুঝের কাজ হইবে। চিন্তার ইতিহাস নাকি তিন রকমের কেন্দ্রিকতার মধ্যে ঘুরপাক খাইছিল যথা—আদি যুগের কসমোসেন্ট্রিক(ব্রহ্মাণ্ডকেন্দ্রিক আদি চিন্তা, কার্যকারণ, সৃষ্টিরহস্য, মানুষ মরার পর কোথায় যায় এই রকম চিন্তা) চিন্তা, মধ্যযুগের থিয়োসেন্ট্রিক (দেবদেবীকেন্দ্রিক চিন্তা—দেবদেবীদের ওপর মানুষের বৈশিষ্ট্যারোপমূলক চিন্তা) আর আধুনিক যুগের লোগোসেনট্রিক (জ্ঞানকেন্দ্রিক চিন্তা যার থাকি ইউরোসেন্ট্রিজম আসছে)।   এখন আমাদের মধ্যে এই তিন ধাচের চিন্তাই কাজ করে।

উৎপল বলতেছেন, সমস্যা হলো কবি, শিল্পী ও ভাবুকদের নিয়ে। তারা কিছুই হারাতে রাজি নন।

‘যৌথ অবচেতনের কথা যদি পরিষ্কারভাবে বলি যে, এই তিনটে স্মৃতি মানে কসমোসেন্ট্রিক, থিয়োসেন্ট্রিক, লগোসেন্ট্রিক আমরা  আমাদের মাথার মধ্যে রেখে দিয়েছি। এবং এই তিনটেতে আমরা অবাধ যাতায়াত করি’।

এই যে লেখিয়েরা কিছুই ফেলাইতে পারে না। তারা ধরে রাখবার চায় এই চিন্তা উৎপল করছেন তার ঐতিহ্যের প্রতি, আম জনতার ইতিহাসের প্রতি, স্মৃতির প্রতি চিরটানের খাতিরের কারণে। তার উল্লিখিত এই তিন জগতের মধ্যে গতায়াত ঘটে যৌথঅবচেতনের কেচ্ছা থাইকে।

২.৬
যৌথ-অবচেতনের ওপর উৎপলের আস্থা যদিও পরে আসি কাটি গেছে। কিন্তু পুরী সিরিজের কাণ্ডকারখানা ঘটাইতে যৌথ-অবচেতনের চিন্তা অনেক সুবিধা দিয়াছিল। উৎপলের ইতিহাসবোধ বর্তমানতায় লীন।   যৌথ অবচেতনে সময়ের ধারণা মুহূর্ত দ্বারা খণ্ডিত নয়। উহা যেন সার্কুলার কিছু। ফলে সময় সেল্ফের সাথে থাকে। সকলকালই বর্তমান। ফলে অতীত তথা সকল ছিল তার কাছে আছের মেলা। বর্তমান আছে বলেই অতীত আছে। কারণ অতীত বর্তমানের নির্মিত একটি মডেল মাত্র। মানসচোখে বর্তমান-অতীত-ভবিষ্যৎ একই রেখায় বিদ্যমান।

চোখ দিয়া আমরা বর্তমানের ছবি তুলি। দৃশ্য এই কবির কাছে গভীর আবেদনময়ী জিনিস। দৃশ্য কবিকে নির্মাণে তাগিদ দেয়। ফলে ‘অপর’ কর্তৃক নির্দেশিত হওয়া ‘আমি’র স্পেস রাশি আমির অবচেতনকে পড়ার সুযোগ করি দেয়। বিষয়টি আবার এক রৈখিকও নয়। কখনো কখনো উৎপল ইতিহাসের অংশ- অতীতের অংশ হিসেবে নিজেরে প্রকাশ করছেন।

একবার কে যেন উৎপলরে জিগাইছিলেন, যিশুর বাড়ির হাঁস এই যে কবিতাখানি লিখলেন, যিশু আসলে কোনো হাঁস পুষতেন নাকি? উৎপল কইছিলেন, আমিও জানি না। তার মানে তথ্য আকারে উনি ইতিহাসরে নেন নাই। যেন মনে হয় ইহা বুঝি ছিন্নভিন্ন ইতিহাস সম্মত কল্পনা। এইকালে কোনো এক লোক নাম যিশু সে হাঁস পুষিত। সে একই সাথে ঐতিহাসিক বাইবেলীয় যিশুও যেন। বর্তমান যিশু অতীত যিশুর জন্মদাতা। এই যিশু না থাকিলে সেই যিশু নাই থাকিত যেন এইরূপ। উৎপল কালরে নিয়া এইমত নাড়াচাড়া করছেন তার কবিতায়।

এই যে ঐতিহাসিক জিনিসপত্রের কবির ইচ্ছা কল্পনামাফিক কবিতায় ব্যবহার তা ঐতিহাসিকদের যুক্তিতর্ক, বাছবিচার, ঘটনা নির্মাণে তথ্যের ব্যবহার তেমন পাত্তা না দিয়াই করছেন। এতে হিস্টোরিসিটি রক্ষা হইল কিনা তা নিয়া তিনি চিন্তিত নন। ঐতিহাসিকতা রক্ষার ভার সাহিত্যের নহে, বরং কল্পনার মুক্তি ঘটিল কিনা তা নিয়া কবিদের ভাবিত হওন দরকার।

পুরী সিরিজে সিট্রম অব কনসাসনেস এবং যৌথ অবচেতনের কিংবা উভয়ের মিশেলে উনি আমাদেরে পরিবেশন করছেন অনেক কবিতা।

যেইখানে কবিতাগুলির নিচে লুকানো গল্পগুলি ধারাবাহিক না। দৃশ্যরাজি যা বর্তমানের তা অতীতকে টানি আনে সমুদ্র স্নানে। ফলে স্নান কেন অবচেতনাময়। তাও ভাবিবার! সামুদ্রিক চেতনার কবি কইছেন ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ উৎপলকে। গুহ অবচেতনার কাহিনীরে পুরী সিরিজের সাথে তেমন জড়ান নাই। আমি পুরাই জড়াইবার চাই। আমরা সবাই একই ইতিহাসের মধ্যে বাস করি যৌথ অবচেতনরে যদি উৎপলের মতো মান্য করি। উৎপলের সেই ভালো মানুষিকতায় পরে ভাটা পড়ছিল যখন ইরাকে তথাকথিত যৌথবাহিনী বোমা মারছিল। পরে উনি যৌথ অবচেতনার লগে ইতিহাসরে বিদায় দিছিলেন। তখন উনি আর ইউরোপীয় চিন্তার তেমন আর ভক্ত নন।

এখন চিন্তার এই মডেলগুলা কবিতারে যদি শাসনই করে তাইলে কবিতার মুক্তি ঘটে, নাকি চিন্তাশক্তির কাছে কল্পনা ইঁদুর সাজে? এইপর্বও ভাবিবার আছে।

২.৭
প্যারানয়েড রোগীর মতো একক বাস্তবের বিকল্প বাস্তব প্রণয়ন বা আঁকড়াইয়া ধরা যেন উৎপলের কবিতায় দেখা যায় না। আধুনিকতা বিকল্পহীনতার জগৎ। আধুনিকতার বিকল্প আধুনিকতাই।

বরং উৎপল একটি ঘটনার বা ন্যারেটিভের বহু বহু ন্যারেটিভে বিশ্বাসী। অবশ্য তার ব্যাখ্যায় পাঠক সেই ন্যারেটিভগুলা তৈয়ার করি নেবেন। পাঠকের ইমাজিশন তার ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাসবোধ থাকি সে তা করিবে। ফলে কবি তার কবিতারে মালে পুরা গাদাগাদি ঠাসি ভরি রাখবেন তিনি সেইডা চান না। বরং কবিতা পাঠে পাঠকের কোনো ভূমিকা থাকিবে না উৎপল এতে রাজি নন। উৎপলে তাই বিশেষের ব্যবহার একটি ইমেজের ন্যারেটিভ।

‘একটা ইমেজ আমি কমপ্লিট করি না। আমার পাঠকের ওপর আমার গভীর বিশ্বাস। আমার ধারণা, বাকি অর্ধেকটা পাঠক নিজেই পূর্ণ করে নেবে। আমার লেখা পড়ে কেউ মানসিকভাবে সক্রিয় হবে না এটা হয় না, পাঠককে কিছু না কিছু দিতে হবে। ’

২.৮
উৎপল বাক্য নিয়া খেলছেন। এইটা ছিল তার বড় একটা প্রজেক্ট। বাক্যকে আমি আক্রমণ করি। এই কথা উনি কইছেন কয়েকবার। উনি বাক্য লিখছেন কমা, ড্যাশ, জিজ্ঞাসা সহযোগে। দেখা যায় কমার পর কমা দিতেই আছেন বাক্যে। কিংবা অনেকগুলা কমার পর দাড়ি। উৎপলের কমলকুমারীয় কায়দার অতিরিক্ত কৌশলে প্রচলিত বাক্যের বিকাররে আক্রমণ করছিলেন কবিতায়। সেই আক্রমণে বাক্য তার কবিতায় নানা ভঙ্গি নিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। আলোচ্য পুরী সিরিজের উৎসর্গ কবিতাখানায় কোনো যতিচিহ্নই রাখেন নাই।

‘বসন্তে এনেছি আমি হাবা যুবকের হাসি’ খামোখাই উনি পাগলের কায়কারবারের বর্ণনা দেন নাই। বসন্ত চিরাচরিত প্রেমিক-প্রেমিকার জাগি উঠার ঋতু। ভোমরার ফুলের গৌরব এই ঋতুর কায়কারবারের প্রখ্যাত বিষয়। সুপ্তি ঘুম জরা থাকি জাগি উঠার কাল। কবি আমদানি করতেছেন হাসি নিজের মধ্যে। কিন্তু তাহা হাবা যুবকের। এর অর্থ কী? কারণ এই যুবক যদি চালাক হতো তাহলে বুদ্ধিদীপ্ত হাসি দিয়া ফেলত। তাহলে সমস্যা হই যাইত এই কবিতার লাগি। এইখানে হাবা যুবকের একটানা বাক্য প্রক্ষেপণ—মূলত পুরীসিরিজের কবিতাগুলির ফরমকে জায়েজ করি নেবার হাসি। এই পাগলের হাবা হাসি জারির কারণ হইল এই কবিতা যাতে কিছু প্রলাপমুখর কথা বাক্য হই ওঠে। উৎপল এই বিষয়ে জানাইতেছেন: ‘পাগলের প্রলাপে যে-মন্ত্রোচ্চারণ লুকিয়ে থাকে, দরিদ্রের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার পর তার মুখ থেকে, অনিয়ন্ত্রিত ভাষায়, যে লৌকিক অভিশাপ ঝরে পড়ে—আসুন, আমরাও এই ভাষায় পরস্পরকে অভিবাদন জানাই। ’

কিন্তু তার মানে পাগলের হয়ে কবির বাক্যগুলা হাবা নয় তত।

‘হস্তচালিত প্রাণ তাঁত সেই আধোজাগ্রত মেশিনলুম’ এই হলো ক্রেস্টাল শব্দদল। তারে নিয়া বাক্যের ঘূর্ণি উঠছে, ফেনানো আছে বহুত তা আবার স্ট্রিম অব কনসাসনেসের বহুতর বাক্যের ঘূর্ণন পাশে জড়ো হয় অন্য বাক্যের খড়কুটাগুলি ইমেজ আকারে। যেন এক আছর করা জিনে পাওয়া পাগল লোকটি খাঁটি কথা কইতেছেন। তাহা এলোমেলো স্বভাবের। কিন্তু কোথায় যেন মিলতেছে না! তাই অমিলরে সামলাইতে গিয়া যেন বাক্যের মানিক রতন পাওয়া গেল কত কত। এই প্রাপ্তি সূচনা করতে থাকল বাংলা কবিতার নতুন ভাষার আঙ্গিকের পয়দা।

বাংলা কবিতার ফরম নিয়া উৎপল বলতেছেন এইভাবে, মূলত উনি কচ্ছেন এক অর্থে নিজেরই কবিতা নিয়া।

‘মাইকেল থেকে জীবনানন্দ—সবাই বর্জিত হলেন। তবে কি আমরা জেগে উঠলাম মধ্যযুগে-মঙ্গলকাব্যে, কাশীরাম দাসে, ভারতচন্দ্রে? না। কবিতা, অর্থাৎ গত কয়েক দশকের কবিতা ভরে গেল বহুবাচনিকতায়—এলোমেলো, গঠনহীন, উচ্ছৃঙ্খল, শতকৌণিক কথোপকথনের অনুপ্রবেশে। কবিতা হয়ে উঠল সর্বভাষিত আলোচনা বা ডিসকোর্স—যেখানে প্রলাপের একটি মাননীয় স্থান আছে এবং পাঠককে বুঝে নিতে হবে পাগলটি সে নিজেই। ’

মানে দাঁড়াইল কবিতা যেন বাক্যের বহুবাচনিকতার কার্নিভাল। কার্নিভাল রসসৃষ্টি আর আনন্দের  আবাহন। উৎসর্গের কবিতাখানিতে ‘মেশিনলুম’ এইখানে ‘আধোজাগ্রত’ কেন? এই প্রশ্ন রাখা যায়। ‘মেশিনলুম’ আধোজাগ্রত থাকলে কবির সুবিধা। তাতে তিনি চেতনের আর অবচেতনের রহস্যের মধ্যে গোসল করার সুবিধা লইতে পারেন। এবং উৎপল এই অবচেতনের সুযোগ পুরা পুরী সিরিজে নানাভাবে নিছেন। আধুনিক মানুষের কাশী-মক্কাশরীফ হইল এই অবচেতনের পুরী।

উৎসর্গের কবিতাখানিরে গল্পে অনুবাদ করবার চেষ্টা করি। ধরি নিই উৎপল এই কবিতায় কলকাতার এক রসিক আমুদে যুবকের কাহিনী পাড়তেছেন। যুবকই কইব তারে। কারণ তার আবার প্রেমিকা আছে। তার প্রেমিকা জন্মদিনে তাকে রক্তকরবী পাঠায়। কিন্তু সেই আমুদে যুবকের ভারী গম্ভীর রবীন্দ্রনাথকে পড়ার সময় নাই। এই যুবকের ছিল পাড়া সম্পর্কের এক খুড়োমশাই। যার নাম কালুবাবু। সেই কালুবাবু এখনো মরেন নাই। এই খুড়োমশাইয়ের আবার রবীন্দ্র রচনাবলীর হেন খণ্ড নাই পড়া নাই।   প্রায় ২২ খণ্ডই মুখস্থ। কারণ তিনি প্রায় মাতৃগর্ভ থাকি রাবীন্দ্রিক। এরকম একজন লোক বাঁচি থাকতে খামোখা সময় অপচয় করি কেন রক্তকরবী পড়তে হবে। জীবন্ত বই থাকতে কাগজে লিখা বই পড়ি কী লাভ! সো, আমাদের যুবক পড়বেন না যতই তার প্রেমিকা বড় ভালোবাসি তারে রিবনে বাঁধায়ে বড় যতনে এই মহান নাটকখানি তাহারে পাঠাক! অতএব রক্ত করবীর স্বাদ যুবক কালীবাবুর জিহ্বা দিয়াই নিবেন—এই ভরসা করে আছেন। তবে কালীবাবু মরি গেলে ঝামেলা বাঁধবে। কারণ তখন রক্তকরবীসহ রবীন্দ্ররচনাবলীর সকল ব্যাখ্যার জন্য অন্য কারো দ্বারস্থ হইতে হবে। অথবা নিজেকেই পড়ি নিতে হবে রক্তকরবী কিংবা অন্যসব রচনাবলী।

কিন্তু এই প্রেম একদিন ছিল। এখন আর বোধ হয় নাই। তাই তার মাথা বিগড়াই গেছে। এখন বসন্ত আসলে পথের কিনারে দাঁড়ায়ে পাগলের হাসি হাসে। লোকজনে দেখে। এসব অনেক আগের কথা। যখন কলকাতায় রেলে করি চিঠির বস্তা নামিত। কেউ কাউরে চিঠি লিখলে প্রাপক ঠিকমতো পাইবে কিনা তার অনিশ্চয়তা ছিল। সেই প্রেমের দিনগুলিতে কতকিছুই না ছিল! মেঘেরা ডাকত ভীষণ। রেলে ১৮/১৯ মাইলের টিকিট কাটি প্রায় ১৫০ মাইল মতো ঘোরা যাইত কিংবা অল্প রেলে চড়িই বেশি ঘোরার অভিজ্ঞতা নেয়া যাইত। তাতকল ছিল কলকাতায় তখন। সেই হাতেবোনা তাতের দিন! সেই তাতের কাপড় কিছু জাগি কিছু ঘুমে, যেন আধোজাগ্রত! হায়, কত তাতশ্রমিক জেলে গেল! কত সংগ্রাম ছিল তাহাদের দাবি দাওয়া নিয়া! তাদের জেলে একবার অনেক চুলকানি হইল! তারা জেলের ভিতর গন্ধক মিশ্রিত জলে স্নান করছিল প্রাণ ভরে! আজো করে বোধ হয়।

সেই সোনাঝরা প্রেমময় দিনে কত উচাটন উট ছিল! রেডিও শোনা হইত! টেলিভিশনের বালাই ছিল না! এন এত উচাটন ছিল তবু কখনো প্রেমিকার বুকে কিংবা প্রেমিকার নদীতে স্নান করা হইত না! সেইসব প্লেটনিক ভালোবাসার দিন! কারণ তখন হাতচিঠির যুগ। প্রেম-ভালোবাসা চিঠিতেই ছিল। সেই প্রেমভরা যুবকের আজ মন কেন ভাঙি গেল হায়!

কবিতাখানি শেষ হইল এইভাবে : ‘আর কি চাইতে পারো কলকাতায় তাতকল ছাড়া তুমি চেয়েছো কবিতা’। এখন শেষ লাইনে আসি বোঝা গেল এই প্রেমে ব্যর্থযুবক, বসন্তে হাবার মতো হাসতেছে আর অবচেতনে দিনগুলা রিট্রিভ করতেছে। সে আসলে কেউ নহে এই যুবক আসলে হাতে কবিতা বোনেন তাঁতকলে, তাঁতকলগুলার ফিনিসড প্রডাক্ট হইল ‘কবিতা’। মোটকথা আমরা পাগলা গোছের এক প্রেমিক কবির যুবকবেলার অবসেশন পাইলাম এই কবিতায়।

এই হইল পুরী সিরিজের উৎসর্গ কবিতার একটা পাঠ। এর আরো পাঠ আরো আরো পাঠকের কাছে উৎপল আশা করেন। এই কবিতায় কালিবাবুর উপস্থিতি হাস্যরস তৈয়ার করছেন। রাবীন্দ্রিক গোরু সরেন মার্কালোকদের জাড্যভাবরে একটু ঝাঁকি দিছেন।

কবিতায় পাগলের স্মৃতিচারণ ফলে এলোমেলো বাক্যচয়নের স্বাধীনতা উৎপল নিছেন। এই বহুবাচনিকতার ‘ব্যবসায়’ উৎপল তার সকল কবিতায় করছেন। ফলে উৎসর্গ কবিতাখানি পুরী সিরিজের একটি চাবি কবিতা যা দিয়া পুরী সিরিজের দরজা খোলা যাইবে।

চলবে। ..



বাংলাদেশ সময়: ১৯২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৬

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।