ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রেখে দিলাম নাম তোমার ‍|| তাসলিমা আক্তার

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬
রেখে দিলাম নাম তোমার ‍||  তাসলিমা আক্তার ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

-মাম্মি, একুশে ফেব্রুয়ারি কী হয়?
-তুমি আজকাল বড্ড বেশি বাজে বকো, আরিয়ান। রাইট ডাউন মাই বয়, রাইট ডাউন- এ ফর অ্যারোপ্লেন বি ফর ব্রেদ।


বেলজিয়ান টাইলসে ছলকে পরা চায়ের দাগ টিস্যুতে যত্নে তুলতে ব্যস্ত শেহনাজের  অসহিষ্ণু কণ্ঠ। মন্দিরে তপস্বীনির মত ধ্যানস্থ এই বাড়িটি। নৈঃশব্দে নীরব। হালকা সবুজাভ রংয়ের পুরো বাড়ি। শেহনাজের প্রিয় রং। অনেক যত্নে বেড়ে উঠেছে এ বাড়ির শরীর। কাজের প্রয়োজনে পল্লবকে যেতে হয় বহুদেশ। যেখানে যা সুন্দর পেয়েছে তা এনে পল্লব সাজিয়েছে শেহনাজের প্রিয় বসত। বসার ঘরের ঝালরখানা টার্কিশ। ঝনঝনিয়ে শব্দ হলে মনে হয় যেন কঙ্গনে কঙ্গন কথা কয় কিনকিন। মিশরীয় টেরাকোটায় মিশে আছে কোনো তরুণী রাজকন্যার কান্না। ঘড় ফেলে সামনে এগুলে সুদৃশ্য লন। সবুজের ভেলভেটে মোড়ানো দেহ। ঝিরঝির বাতাসে দোল খায় কিশোর ঘাসের ছায়া। পাশে ছোট মত পরীখা। মৌসুমে পদ্ম ফুল ফোটে। সাদা কিংবা লাল ফুলের উপর হলুদ ডানার প্রজাপতি খেলা করে। মাটির বুকে একটুকরো স্বর্গ উপহার দিয়েছিল শেহনাজকে পল্লব। প্রিয়তমা প্রেয়সী। ওদের একমাত্র ছেলে আরিয়ান। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্লে গ্রুপে যায়।

ফেব্রুয়ারি মাস। এ মাসে উৎসবের শেষ নেই। ফ্রেন্ডশিপ ডে, টেডি বেয়ার ডে, ভেলেন্টাইনস্‌ ডে। আজ কুড়ি তারিখ। ধীরে ধীরে রাত বাড়ে। আবহাওয়ায় শীতলত‍াটা কমে এসেছে। গরম পড়তে শুরু করেছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রটা পিঁই ইইই... একটানা একঘেয়ে শব্দ করে চলে। পল্লব যথারীতি কাজের জন্যে দেশের বাইরে। এই বিকেলেই স্কাইপে আরিয়ানের সাথে কথা হল,
-হাউ আর ইউ ডুয়িং মাই ডার্লিং বেবি?
-আই অ্যাম ডুয়িং ভেরি ফাইন ড্যাডি, বাট মিসিং ইউ। কাম ব্যাক সুন। আই রিয়েলি মিস মিস ইউ ড্যাডি।

শেহনাজ আর পল্লবের পরিচয় লন্ডনে। দু’জনেই কুইন ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। শেহনাজের বিষন্নতা ছুঁয়েছিল পল্লবকে। বলেছিল, “তুমি কষ্ট বিলাসী। অকারণে দুঃখ পেতে ভালোবাসো”। হিরকের শরীরেও স্বেদবিন্দু জমে। মুক্তা ফলানোর কষ্ট শুধু ঝিনুকই জানে। কার বুকে কী লালন করে, হায় কে জানে। গহনে কোনো স্বপ্ন কিংবা ভাঙন।

সেদিন কুড়ি ছিলো না, ফেব্রুয়ারির একুশ। ফেব্রুয়ারির একুশ এলে সকলে এক হয়ে যায়। এরচে’ আলোজ্জ্বল প্রভাত বছরে বোধকরি আর আসে না। মেয়েতে ছেলেতে যুবায় বুড়োয় ফারাক নেই আজ। সকলে এক হয়ে যায়। শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়া হলুদ গাঁদার ডাল তরুণীর আলতা পরা রঙিন নগ্ন পায়ের সঙ্গে মিলেমিশে এক অদ্ভুত মায়া তৈরি করে। একুশ আসবে বলেই ফাল্গুন মাস ফুলে ফুলে সাজে।

ক’দিন ধরেই ফুরসৎ নেই কোনো। না খাওয়া, না শোওয়া। অন্তরীণ রেখেছে সব। সজল আর তার বন্ধুরা স্কুলের মাঠে শহীদ মিনার বানিয়েছে। পড়াশোনায় প্রতিবারই মেধা তালিকায় নাম থাকে সজলের। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। শরীরে বাড়ন্ত সজলকে সত্য’র চেয়ে অনেক বেশি বড় মনে হয়। হাসিতে মেধার সঙ্গে সুস্পষ্ট ভাবুকতার ছাপ। স্কুলের বার্ষিক খেলায়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-কবিতা আবৃত্তি গান সবটাতেই তার অবাধ বিচরণ। তীরহারা এই ঢেউ’র সমবেত গানের শক্তিমান ও লিড সুরটায় যখন সে টান দেয়, শ্রোতার চোখে তখন পদ্মার ঢেউ বাধ ভাঙে। ছ'টা বাজতে চললো। সকল প্রস্তুতি শেষ। তবু কিসের যেন এক অস্থিরতা। প্রতি পাঁচ মিনিটে একবার সে স্কুলের গেটের দিকে তাকাচ্ছে। ভোরের আকাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে। আজকের আলোটা কি একটু অন্যরকম। যেন দীর্ঘ জ্বর তাপের পর কপালে মায়ের স্পর্শের মতোই মিঠে। মিষ্টি সেই ফিকে আলোয় কার ছায়াটি ধীরলয়ে গেট পেরোয়। কালো পাড়ে সুতোয় বোনা সাদা শাড়ি। কপালে খুব বড় একটা কালো টিপ। তার ভেতরে লাল রংয়ে দু’টো সংখ্যা লেখা ‘২১’। মেয়েটির নাম শেহনাজ। একই স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এতোক্ষণে সজলের চোখের মনি স্থির হয়। মন শান্ত হয় ফাল্গুনের হিমেল বাতাসের মতো।

-সে কি? তোমরা এখনো কিছুই ঠিক করতে পারো নি? মেয়েরা না এলে কি আর তোমরা কিছু ঠিক করে গোছাতে পারো। দেখ, ফুলগুলো কেমন অগোছালো পড়ে আছে।
-এলেন মাতাহারী। মাগো, আমরা সব অকর্মন্যের দল। আপনি যখন দয়া করে একবার এসে পড়েছেন, আর চিন্তে নেই।

সজলের কটাক্ষে হেসে উঠে সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রভাতফেরির যাত্রা শুরু হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই উপস্থিত। সবার মাঝে কেমন একটা শোক শোক আনন্দ। শোক হারানোর আর আনন্দ অর্জনের। দিয়েছি অনেক প্রাণ, অনেক রক্ত। পেয়েছি যা তাওতো কম নয়। আদরের ছোট বোনটিকে নিজের মত করে ডাকার আনন্দ। মিছিলটিকে তিনটা অংশে ভাগ করা হয়। তিনভাগে শিক্ষকের সঙ্গে আছে তিনজন ছাত্র ভলান্টিয়ার। প্রথম মিছিলটার সামনে থাকে সজল আর শেহনাজ। স্কুলের গেট পেরিয়ে, গলিটার মোড় পেরিয়ে মিছিল এগোয়। প্রভাত ফেরি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...’। সকলে খালি পায়ে। সকলের হাতে নৈবেদ্য। সকলের মাথা শ্রদ্ধায় অবনত। সকলের মন আনন্দে উদ্বেলিত। মিছিলটা এখন মহাসড়কে উঠে এসেছে। ব্যস্ত সড়ক। দুষ্টু শিশুরা হঠাৎ হুড়োহুড়ি শুরু করে আনন্দের স্ফুরণে। সামলাতে গিয়ে শেহনাজের হাত ছুঁয়ে যায় সজলকে। খানিক চোখে চোখ- কথা হয় কোনো শব্দ উচ্চারণ না করেও। আকাশের সীমা পেরিয়ে সে কথা ছড়িয়ে যায়। দৃষ্টির মুগ্ধতায় হারায় দু’জনে। ক্ষণিক মাত্র। দুষ্টু ছেলে টুটুলের হাত ছিটকে পড়ে যায় তার সুতোয় বাধা একমুঠো কৃষ্ণচূড়া। শিশুটি সেটা আনতে দৌঁড়োয়। হাত কয়েকের ব্যবধানে একটি ট্রাক ছুটে আসে দুরন্ত গতিতে। পরে শোনা গিয়েছিল, ট্রাক ড্রাইভারটি ছিল মাতাল। সজল প্রাণপনে এগিয়ে যায়। পেছনে শেহনাজ, তার পেছনে মিছিল। টুটুলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় সজল। আর উদ্ভ্রান্ত বেগের ট্রাকটি ততক্ষণে সজলের খুব কাছে। ঘাতক ট্রাক নাকি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্‌র মুখ। আমতলা, একশ, চৌচল্লিশ ধারা। ট্রাক আরও এগোয়- মিছিলের উপর বুলেট ছুটে ছুটে আসে। মাটিতে রফিক-জব্বারের নিথর দেহ আর সজলের রক্তাক্ত মুখ এক হয়ে যায়। প্রভাত ফেরির ছাত্র শিক্ষকের চিৎকার আর সেদিনের বিক্ষোভের ৠালির উপর টিয়ার গ্যাস বুলেটের শব্দ এক হয়ে যায়। মিশে যায় পাহাড়ে সাগরে।

সময়ের সাথে পৈশাচিকতার রূপ বদলায়। স্থান-কাল-পাত্রের ভেদ শুধু। আজো মুক্তি মেলেনি। সেদিন যেমন জিন্নাহ আর তার দুঃশাসন ছিল, আজ তার জায়গা করেছে মাতাল পরিচালকের নিস্পেষণ। সালাম-বরকতের অবস্থান নেয় সজল কিংবা সজলেরা। কোলের ওপর মাথা রাখা সজলের তরুণ রক্তে শেহনাজের সাদা শাড়ি ভিজে যায়। চিৎকার করে সে বলে, “সজল চলে যেওনা”। সজলের বুজে আসা চোখ। ঠোঁটের কোণে সেই চিরায়ত হাসিটি ধরে রাখা। যেন বলে যায়, “টুটুলদের কোনো ভাবনা নেই, যতদিন রফিক আছে, যতদিন তাদের প্রতিভূ সজল আছে, যতদিন মানুষ আছে”।

আরিয়ান তখনও পড়ে চলেছে, বি ফর ব্রেদ, এস ফর স্টপ। ছেলেকে সযতনে দুঃসহ স্মৃতির কাছ থেকে দূরে রাখে। শেহনাজ তার ছেলেকে হারিয়ে যেতে দেবে না সজলের মত কোনোদিন। বাইরে রাত বাড়ে। সেই ঘটনার পর আর কখনো শেহনাজ কোনো মিছিলে যায়নি। না কোনো গান, না কোনো কবিতার দু’লাইন। কিচ্ছু গায় না-আবৃত্তি করে না। তবু আজ বিছানায় শুয়ে কী এক অস্থিরতায় ছটফট করে সে। আরিয়ানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকায়। আহা, কী মায়াময় একটা মুখ। রাত ঘন হয়। দূরে কোথাও থেকে বাতাসে ভেসে আরে সেই সুর, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি। ’

শেহনাজ ত্রস্তে বিছানা ছাড়ে। জানালাগুলো বন্ধ করে ঘরটিকে শব্দরোধী করার প্রয়াস চলে। মগজের ভেতর থেকে ছড়িয়ে সে সুর শরীরের কোষে কোষে নেচে বেড়ায়। কে যেন ডাকে, কী যেন ডাকে। ভূতের আছরগ্রস্তা বালিকার মত শেহনাজ বলে “নাহ, আমি কিছু শুনবো না। আমি কোত্থাও যাবো না”।

ফজরের আজান হয়। ঘুমহীন একটা রাতের পর অস্থির নারীমূর্তি। রাস্তায় প্রভাত ফেরির মিছিল। শেহনাজ খোলা ছাদে উঠে আসে। ভোরের বাতাসে দীর্ঘশ্বাস নেয়। গাছ থেকে তুলে আনে নিজ হাতে ফোটানো একটি টকটকে লাল গোলাপ। নিশিগ্রস্তার মত দৌঁড়ে বাড়ির নিচে নেমে তারপর মিছিলের সাথে মিশে যায়। সকলের সাথে মিশে যায় তার কণ্ঠস্বর। কোনটা কার গলা আলাদা করে চেনা যায় না। শুধু শতকণ্ঠে অনুরণিত হয় সেই বিলাপ, ‘আ আআ আ আআ আ আআ...!’

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৬
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।