ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

অতিথির আগমনে বাধা নয় | কাদের পলাশ

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২২ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১৬
অতিথির আগমনে বাধা নয় | কাদের পলাশ

উভাত। চারিদিকে উৎসব পরিবেশ।

কনে পক্ষের মেহমান আসতে একটু দেরি হচ্ছে। তবে নিজস্ব মেহমানরা খেয়ে নতুন বউ দেখে অনেকেই বিদায় নিয়েছে। আমরা দুই ভাই মোলাকাত করে মেহমানদের বিদায় জানাচ্ছি। নিজস্ব মেহমানদের চাপ অনেকটাই কমে গেছে। বাবা ব্যস্ত বাবুর্চি ও পাতিল নিয়ে। মা বোনেরা ব্যস্ত বউ সাজাতে। কনে পক্ষের লোকজনের অপেক্ষায় রাস্তায় এসে দাঁড়াই আমরা দুই ভাই।



বউভাতের দিন বর কনেকে কনে পক্ষের সাথে নিয়ে আসা হয়—এটা গ্রাম বাংলার নিয়ম। অবশ্য এ নিয়ে দুই বেয়াইয়ের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়। আমার বাবা বলেছিলেন, একে তো আজ শনিবার, আবার সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সন্ধ্যার আগে বাড়ি থেকে নতুন বউ বের করা ভালো না। কাল সকালে ছেলে মেয়েকে আমি পাঠিয়ে দেব। কথা শুনে শ্বশুর মহাশয় ক্ষেপে যান।



আশপাশে তাকিয়ে বড় ভাই আমায় বলল, নতুন অতিথির আগমনে কোনো বাধা নয়। আমাদের মানুষের প্রয়োজন আছে। আমি দ্রুত কথাটা বুঝে উঠতে পারলাম না। বিব্রত মনে ভাবি, বউভাত অনুষ্ঠানে নতুন অতিথিদের বাধা দিতে যাব কেন? ভাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনে কনেপক্ষের মাইক্রোকার এসে থামল। সামনে এগিয়ে কুশল বিনিময় করি। শ্বশুর মহাশয়ের পায়ে ধরে সালাম করতে গেলে তিনি আমায় বুকে জড়িয়ে ধরেন। আমার বুকটা আনন্দে ভরে ওঠে। যেন আরো একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেলাম। যদিও আমাকে তার অন্য দুই জামাইয়ের চেয়ে কম যোগ্য ভাবেন তিনি। ঘটক মারফত বিষয়টি আমার জানা আছে। তবে এতে আমার কোনো আফসোস কিংবা দুঃখ নেই। ভুলই শুদ্ধতার পথ বাতলে দেয়। একদিন তিনি নিশ্চয়ই আমাকে বুঝতে পারবেন।

বউভাতের দিন বর কনেকে কনে পক্ষের সাথে নিয়ে আসা হয়—এটা গ্রাম বাংলার নিয়ম। অবশ্য এ নিয়ে দুই বেয়াইয়ের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়। আমার বাবা বলেছিলেন, একে তো আজ শনিবার, আবার সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সন্ধ্যার আগে বাড়ি থেকে নতুন বউ বের করা ভালো না। কাল সকালে ছেলে মেয়েকে আমি পাঠিয়ে দেব। কথা শুনে শ্বশুর মহাশয় ক্ষেপে যান। শেষ পর্যন্ত তিনি কোনোভাবেই রাজি হলেন না। অবশেষে সন্ধ্যা মুহূর্তেই রওনা হই মাইক্রোকারে চড়ে। বাড়ির খানিকটা দূরে থাকতে বড় ভাই ফোন করে বলেন, কী বলেছি মনে আছে?
- না ভাই, কী যেন বলেছিলেন?
- ভুলে গেলে চলবে না। বলেছিলাম, নতুন অতিথির আগমন যেন মসৃণ হয়। কোনো বাধা দেয়া চলবে না।
আমি না বুঝেই বলি - আচ্ছা ঠিক আছে। আপনারা আড়াইদিন পর এসে আমাদের নিয়ে যাবেন কিন্তু।
- আর রাতের বেলায় ঘর থেকে বের হোস না। বিয়ের বছর অনেক সমস্যা আছে।
- কী সমস্যা।
- এখন জানার দরকার নাই। পরে এমনিতেই বুঝে যাবি। তোকে এখন যা বলছি তাই করবি।
- আচ্ছা ঠিক আছে ভাই।

শ্বশুরবাড়ি পৌঁছতে রাত প্রায় পৌনে নয়টা বাজে। আমার আপন শালা-শালি নাই। তবে স্ত্রীর নিকট আত্মীয়ের কিছু ছোট ভাইবোন আছে। সবাই শ্বশুরালয়ে প্রবেশ করার পর আমি ঢুকতে গেলেই বাঁধে বিপত্তি। দরজার সামনে দুই শালা ও এক শালি বসে যায় টেবিল পেতে। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার সাথে ছোট দুই ফুফাত ভাই ছিল। অবশ্য তাদের ঘরে ঢুকতে দিয়েছে। দুই দুলাভাই পরে আসার কথা। কিন্তু এখনো এসে পৌঁছায়নি। আমি আটকে আছি ঘরের দরজায়। আমি দুলা, তাই কিছু বলতেও পারছি না। মনে মনে বলি এটা কোন ধরনের অসৌজন্যতা। পরে বুঝতে পারি ঘরে ঢুকতে হলে বকশিস দিতে হবে। ঘরে ঢুকতেও টাকা দিতে হবে অথচ তারা আমাকে কোলে করে ঘরে তোলার কথা। অবশ্য এও ঠিক যে, একেক অঞ্চলে একেক পদ্ধতি, একেক কৌশল মজা করার। আমার স্ত্রী ঘরে ঢুকে হৈ হুল্লোড় শুরু করে দিয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি, এ নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই।

পরে শালা-শালিদের বকশিস দিচ্ছি বলে টেবিল ধাক্কা দিয়ে দ্রুত ঘরে ঘরে ঢুকে যাই। তারাও নাছোড়বান্দা। আমি যতই কথার প্রসঙ্গ পাল্টাই, তারা ঘুরে ফিরে বারবার বকশিসের কথাই তুলছে। অবশেষে ভাংতি নেই বলে ঘরের বাইরে আসি। বাড়ির পাশে একটা চা দোকানে বসলাম। চা খাওয়ার অভ্যাস নাই। এমনকি পান চা সিগারেটও। সবই অবশ্য খেয়েছি। কখনো কোনো স্বাদ পাইনি। তারপরেও দোকানে তো খালি মুখে বসে থাকায় যায় না। দোকানির ক্ষতি হয়। কারণ আমার বসার জায়গায় অন্য কেউ বসলে হয়তো তার কিছু বিক্রি হতো। লাভও হতো। আমি এক কাপ দুধের অর্ডার করি। চায়ের কাপে চিনি দিয়ে দুধ ঢেলে টংটাং টংটাং শব্দ খুব ভালোই লাগল। সিরামিকের কাপ আর লোহার চামচের ছন্দময় সুর সব দোকানে প্রায় একই রকম। অথচ কোনো সূত্র নেই, কোনো ব্যাকরণ নেই। দুধে চুমুক দিতেই ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। এর মাঝেই বাড়ি থেকে মায়ের ফোন।
- বালা আচত বাবা... বলে কেঁদে দেয় মা।
- ভালো আছি, আপনি কাঁদছেন কেন?
- না এমনিতেই। কইলজাডার ভিতরে কেন যেন খালি খালি লাগে। মায়া লাগে, পরানডা কাঁন্দে। বালা লাগতাছে না, তাই ফোন কচ্ছি।
- মা আমি ভালো আছি, আপনি শুধু শুধু চিন্তা করছেন।
- নারে বাজান বুকটার ভেতর ছেক ছেক লাগে। তয় বাজান একটা কথা, আমগো কিন্তু মানুষ লাগব। আঁর এত্ত বড় বাড়ি, উডানডা খাঁ খাঁ করে। নাতি নাতকুর দৌড়াইব ফালাইব আঁই পরাণ খুইলা দেইখমু। তয় বাজান আমগো কিন্তু মানুষ লাইগব। কতাডা আবার মনে কইরা দিলাম।

মাকে কোনো মতে বুঝিয়ে ফোনটা রাখি। একটু দেরি হলেও মা ও বড় ভাইয়ের কথার মিল খুঁজে পাই। বড় ভাই বিয়ে করেছেন অনেক আগে। দুইটা মেয়ে আছে। পাঁচ বছর আর চার বছর। কী এক সমস্যার কারণে বড়ভাবীর আর সন্তান হবে না। তাই সবাই আমার ওপর ভরসা করে আছে। অথচ আমি একটা কষ্ট সহিষ্ণু মানুষ। কখনো কোনো জিনিস সহজে পাই না। আমার বেলায় তীব্র আকাঙ্ক্ষার জিনিস খুব দেরি করে ধরা দেয়। তবে দেরিতে হলেও সফল হই। আমি স্বজনদের তড়িৎ চাহিদায় একটু বিব্রত হই। কারণ এটা তো আমার একার কাজ নয় যে, জোর করে করে ফেলব। তাছাড়া সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাটাই এখানে বড় বিষয়।   তারপরেও রাতে ঘুমাতে যাবার সময় স্ত্রীকে মা ও ভাই তথা পরিবারের ইচ্ছার কথা বলি। সে কিছু বলল না। চুপ করে শুনল।

বিয়ের একবছরপর স্ত্রী অন্ত্বঃসত্তা হলো। আমার কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা করে কনসিভের বিষয়টি নিশ্চিত হই। যদিও আমি খুব আনন্দিত হতে পারলাম না। কারণ জীবনে কখনো এত সহজে কোনো কাজে সফল হতে পারিনি। অবশ্য আমার স্ত্রীও খুব খুশি না। পরে বুঝতে পারি অন্তত দুই তিন বছর পর সন্তান নেবে এমনটাই ইচ্ছে ছিল তার। তাই এ খবর তার মনে খুব আনন্দ দিতে পারেনি।

অবশ্য আমি মনে মনে খুব খুশি হয়েছি। তবে কাউকে বুঝতে দেইনি। স্বপ্ন আঁকতে শুরু করি সাদা মনের খোলা আকাশে। নাম রাখি ইচ্ছে মতো আবার পাল্টাই। বুকের ভেতর গজিয়ে ওঠে নতুন পৃথিবী। মার্কেটের দোকানগুলোতে ছোট বাচ্চাদের পোশাক দেখে মনে আনন্দ জাগে। হাত দিয়ে ধরে দেখি ছোট ছোট পোশাক। কী এক অলীক সুখ অনুভব করি। আবার হঠাৎ থমকে যাই, কী এক অজানা ভয় আগলে ধরে আমাকে! আমি নীরব হয়ে যাই। কারণ আমার কপালে তো অত সহজে সুখ ধরা দেয় না। যখনই ভয় আসে তখনই শুধু সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করি।

মধ্য রাত। ওর গোঙানির শব্দ শুনে আমার ঘুম ভাঙে। পেটে ব্যথা করছে। সামান্য ব্লিডিংও হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছিনা কী করব। কাঁচাঘুম ভাঙ্গা চোখে সেই অচেনা ভয় জেগে উঠল মনে। মুহূর্তেই স্বপ্নের সাদা আকাশকে ঢেকে দিল গাঢ় কালো অন্ধকার। টেনশনে রাতে আর এক ফোঁটা ঘুমাতো পারি না। আমার তাড়না দেখে স্ত্রীরও একটু মন খারাপ হয়। ধারণা করি মনের গহীনে একটা অদৃশ্য টান পড়েছে। তাই একটু বিষণ্ণও দেখা গেল ওকে। পরদিন সকালে আমার মোটরসাইকেলে করে হাসপাতালে নিয়ে যাই। ছয় মিনিটের পথ প্রায় আধাঘণ্টা সময় লাগে। খুব ধীরে মোটরসাইকেল চালাই। এ সময়টুকু দুজনের মাঝে একটাও কোনো কথা হয় না। দুইজনই চিন্তিত—কী হয় এ-ভেবে। হাসপাতালে পৌঁছে কনসিভের রিপোর্ট হাতে দিয়ে ডাক্তার আপাকে বিষয়টি খুলে বলি। তিনি তাৎক্ষণিক আল্ট্রাসনোগ্রামের পরামর্শ দিলেন।

সরকারি হাসপাতালে সাধারণত রোগের পরীক্ষা নিরীক্ষা সাধারণত স্টাফদের খেয়ালখুশি মতো হয়। টেস্টের মূল্য যদিও কম, কিন্তু সীমাহীন দুর্ভোগ। তাই সস্তার অপেক্ষায় না থেকে একটা প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাম করালাম। হাঁটতে কষ্ট হবে বিধায় তাকে হাসপাতালের বারান্দার একটি টেবিলে বসিয়ে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার আপার কাছে যাই। ডাক্তার আপা রিপোর্ট দেখে যা বললেন তা শোনার জন্য আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। আমি ডাক্তার আপার রুম থেকে বের হতেই দেখি; উৎকণ্ঠা নিয়ে ও আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করে, কোনো সমস্যা নেই তো?

আমি বললাম আরে না, সমস্যা হবে কেন? আচ্ছা বলো তো দেখি আমাদের ছেলে হবে না মেয়ে?
- ছেলে।
- কী নাম রাখবে? না না থাক তুমি বলো না। কারণ নামটা আমিই রাখব। এখন বাড়ি চলো। আর শোনো, আগামীকাল হাসপাতালে আরেকবার আসতে হবে।
- কেন?
- না মানে, ওই যে তোমার একটু পেট ব্যথা করেছিল। এ জন্য। আমি ওকে কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না। ডাক্তার আপা পরীক্ষা করে গর্ভাশয়ে জমাটবাঁধা রক্তা ছাড়া প্রাণের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পেলেন না।



বাংলাদেশ সময়: ১৬২৩ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।