ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সুখ | রাবেয়া বসরী

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২২ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৬
সুখ | রাবেয়া বসরী

সেই বিকেল থেকে ময়নাদের এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। এখন রাত প্রায় ন’টা বেজে গেছে শহরের ঘড়িতে।

ঘরের বাইরে উঠোনে এসে বসে আছে ময়না তার তিন সন্তান নিয়ে। তার স্বামী মইনুল এখনও ফেরেনি। দুশ্চিন্তায় কেটে যায় আরও এক ঘণ্টা। মইনুল উঠোনে এসে পা রাখতেই বাড়িতে বাতি জ্বলে ওঠে। সেই আলোয় ওরা চারজন দেখে মইনুলের হাতে আজ অনেক বাজার। বড় একটা মাছের লেজ বের হয়ে আছে ব্যাগের মাথায়।

ময়নার তিন ছেলের চোখ চকচক করে ওঠে। তিনজনই লাফিয়ে ওঠে। হাত তালি দিয়ে বলে, বাজান মাছ লইয়া আইছে। আইজ রাতে মায় মাছ রানবো। আইজ মাছ দিয়া পেট ভইরা ভাত খামু। মইনুল বাজারের ব্যাগ ময়নার হাতে দিতে দিতে ছেলেদের খুশি দেখে দু’চোখ ভরে। ময়না জিজ্ঞেস করে, এত রাইত হইল যে আফনের, এত বাজার করার ট্যাকা কই পাইলেন?



মইনুল গোসল সেরে এসে তার ছেলেদের নিয়ে গল্প করতে বসে। আর ময়না মাছ রাঁধে। ভাত ফুটায়। ময়নার রান্না শেষ হয়ে এলে সবাই মিলে একসাথে আজ খেতে বসে। ছোট ছেলে বলে, আইজকা আমরার বড় আনন্দ, না বাজান?



মইনুল বলে, আইজ খবরের কাগজ বেইচ্চা কমিশন পাইছি। দুনিয়ায় যুদ্ধ লাগছে, কোন এক বড় নেতারে মাইরা ফালাইছে, বেবাক মাইনষেরে মাইরা লাইতাছে, নাডক করে এক মাইয়ার এক গুপন কীসব খবর বাইর হইছে, এক টেরেনের মইধ্যে বোমা ফাডাইছে, এক বাড়িত ঢুইকা সব মাইনষেরে খুন কইরা লাইছে... এই খবরগুলান লইয়া আইজ কাগজ বাইর হইল বিয়ান বেলা। হেইডা লোকে খুউব কিনল। হেই খুশিত ম্যানেজার সাবে আমারে কমিশন দিছে। হেই ট্যাকায়ই তো বাজার কইরা লইয়া আইলাম।

ময়না কৌতুক করে, ওমা আফনে দি এইহানেও খবর কইতে লাগছেন। এইহানে কেডা কিনব আফনের কাগজ! মইনুলের ছোট ছেলে বাবার হাত ধরে বলে, বাবা তুমি আইজকা আমগোরে ঐ গপটা আরেকবার হুনাও। মায়ের রান্ধন হইয়া গ্যালে আমরা সবতে মিল্ল্যা খাইতে বহুম। মইনুল গোসল সেরে এসে তার ছেলেদের নিয়ে গল্প করতে বসে। আর ময়না মাছ রাঁধে। ভাত ফুটায়। ময়নার রান্না শেষ হয়ে এলে সবাই মিলে একসাথে আজ খেতে বসে। ছোট ছেলে বলে, আইজকা আমরার বড় আনন্দ, না বাজান? মইনুল হাসে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে। বলে, খাও বাজান প্যাট ভইরা খাও। সবার খাওয়া শেষ হলে ময়না সব গুছিয়ে উঠোনে এসে বসে।

ছেলেরাও তাদের বাবাকে ডেকে নিয়ে বলে, বাজান, মায়েরে একখান গীত হুনাইতে কও তো! ময়না গান ধরে। আকাশে খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে। রাত অনেক। বস্তিতে অনেকেই হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছে। চারিদিকে অন্ধকারে চাঁদের জোছনায় সব কিছু সুন্দর লাগে মইনুলের। তারপর একসময় ওদের তিন ছেলেই ঘুমিয়ে গেলে মইনুল ময়নার হাতে একটা নতুন রঙিন ছাপার শাড়ি তুলে দেয়। ময়নার যেন আর খুশি ধরে না। বলে, ও খোকার বাপ, তোমার আইজ কী হইছে! এতকিছু! মইনুল বলে, সব তো তমাগো লাইগ্যাই। আইজ কত চিৎকার কইরা কইরা খবর গুলান কইছি বইলাই তো মাইনষে আইয়া আইয়া খবর জিগাইছে আর কাগজ কিনছে। ময়না সোহাগ দেখিয়ে বলে, আমি তোমার লাইগা পানি গরম কইরা আনি। তুমি ইকটু কুলি কইরা লও। আরাম লাগব গলাডার মইধ্যে।

একসময় পৃথিবীর এই প্রান্তে আরও রাত নামে। মইনুল ময়নাকে পৃথিবীর কত খবরই যে শোনায়। ময়নার গর্ব হয়, তার স্বামী কত কিছু জানে। ময়না চোখ বড় বড় করে বলে, দুনিয়াত এত্ত কিছু হইতাছে! ময়না মইনুল আজ অনেক রাতের পর আবার কাছে আসে। একসময় ওরা ঘুমিয়েও পড়ে। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে যুদ্ধ বাঁধে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলে, বাস স্টেশনে, পার্কে বোমা ফাটে, মানুষই তো মারে আর মানুষই তো মরে। সেই খবরে মইনুল ময়নাদের ঘরে নিষ্পাপ সুখের রাত নেমে আসে চিরকাল।



বাংলাদেশ সময়: ১৩২৩ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।