ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বহুজাতিক সংস্কৃতি ও সৈয়দ মুজতবা আলী | ফজলুল হক সৈকত

পাঠ ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৯ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৬
বহুজাতিক সংস্কৃতি ও সৈয়দ মুজতবা আলী | ফজলুল হক সৈকত

ম্যরচনার জন্য বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলী (জন্ম : ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪; মৃত্যু : ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪) একটি স্থায়ী আসন অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন। ভারতের শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী এবং জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে, ১৯২৭ সালে, কাবুলের কৃষিবিজ্ঞান কলেজে ফারসি ও ইংরেজি ভাষার প্রভাষক পদে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন।

অতঃপর তিনি জার্মানি, মিশর এবং ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, ইসলামের ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। এছাড়া পাকিস্তান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে এবং ভারতের রেডিওতে মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলা ভাষায় সৈয়দ মুজতবা সরস-মার্জিত-বুদ্ধিদীপ্ত সাহিত্যধারার প্রবর্তক। ব্যঙ্গ ও রঙ্গ-রসিকতায় তার রচনা প্রদীপ্ত। ভ্রমণকাহিনি, উপন্যাস, সাহিত্য-সমালোচনা ও মননশীল প্রবন্ধ মিলিয়ে তার বিপুল সংখ্যক রচনায় পাণ্ডিত্য ও সৃজন-সামর্থ্যের বিচিত্র অভিব্যক্তি লক্ষণীয়। অন্তত দশটি ভাষায় দক্ষতা অর্জনকারি এই বিরল-প্রতিভা বাঙালি বিদ্বৎজন ভাষাতত্ত্ব ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় রেখে গেছেন।

সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশে (১৯৪৯), ময়ূরকণ্ঠী (১৯৫২), চাচাকাহিনী (১৯৫৯), শবনম (১৯৬০), টুনিমেম (১৯৬৩) এবং কত না অশ্রুজল (১৯৭১) বহুল পঠিত ও নন্দিত বই। দেশে-বিদেশে উপন্যাস না-কি ভ্রমণকাহিনি—এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে যেভাবেই বিবেচনা করা হোক-না-কেন গ্রন্থটিকে ভ্রমণ-উপন্যাস বললে বোধকরি কারো তেমন কোনো আপত্তি থাকবে না। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো বইটিতে লেখক ভূগোল ও প্রকৃতির বিবরণ, জীবন ও সংস্কৃতির বিশেষণ এবং মানবগতির বিচিত্র স্বভাবের যে অনুপুঙ্খ, হৃদয়গ্রাহী ও আনন্দঘন উপস্থাপনা হাজির করেছেন, তাতে তার চিন্তা এবং পরিবেশনশৈলীর নৈপুণ্যে পাঠক বিস্মিত না হয়ে পারে না। দেশে-বিদেশে হয়তো তার জীবন-অভিজ্ঞতার এক বিশ্বস্ত বিবরণ; সে অর্থে এটি জীবন-ঘনিষ্ঠ সাহিত্যের কাতারে দাঁড়াতে পারে অনায়াসে। গ্রন্থটির ইংরেজি বা ফরাসি কিংবা চাইনিজ অথবা হিন্দি ভাষায় অনুবাদ হলে বিশ্ব সাহিত্যের বিরাট উঠানে বাংলা সাহিত্য এবং সাহিত্যস্রষ্টা সম্বন্ধে নতুন ধারণার জন্ম হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।



পাঠানদেরকে মুজতবা আলী অত্যন্ত অলস, আড্ডাবাজ বললেও তারা যে আরামপ্রয়াসী নয় এবং তাদের বিলাসিতাও যে সীমা ছাড়ায় না, সে কথা বলতে ভোলেননি। গালগল্প আর লম্বা আড্ডায় মশগুল থাকার স্বভাবের ভেতরে তাদের অকৃত্রিম দেশপ্রেম আবিষ্কার করে লেখক বিস্মিত হয়েছেন। অনুর্বর ভূমির এইসব বাসিন্দারা ব্যবসা-বাণিজ্যে বড়ই অপরিপক্ব। অভাবের তাড়নায় লুটতরাজ মাঝে-মধ্যে করে বটে; তবে আন্তরিকতায় অতুলনীয়



উত্তম পুরুষে বিবৃত এই বইয়ে ভ্রমণরত এক বাঙালির আত্ম-জবানিতে লেখক তুলে ধরেছেন তার অভিজ্ঞতার ডালি। বইটির প্রায় শুরুতে, একজন বাঙালি অফিসারের বহির্দেশ ভ্রমণের সূচনাপর্বকে তিনি বর্ণনা করছেন গল্পকথকের অনুভবের আলোয়: ‘গাড়ি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম যে ভাবনা আমার মনে উদয় হলো, সেটা অত্যন্ত কাপুরুষজনিত—মনে হলো, আমি একা। ’ মুজতবার পরিবেশ-অনুভব এবং ভাষা-কাঠামো বেশ স্বাস্থ্যবান। পরিণত লেখকের কলম থেকেই বেরোতে পারে এরকম অভিব্যক্তি। অনভিজ্ঞ এই ভ্রমণকারির অবস্থা বোঝানোর জন্য তিনি যে তুলনা ও বর্ণনাচাতুর্যের সহায়তা নিয়েছেন, তা বড়ই উপভোগ্য। মুজতবা জানাচ্ছেন:

‘আর বাড়িয়ে বলব না। এই তালতলাতেই আমার এক দার্শনিক বন্ধু একদিন বলেছিলেন যে, এমেটিন ইনজেকশন নিলে মানুষ নাকি হঠাৎ অত্যন্ত স্যাঁৎসেঁতে হয়ে যায়, ইংরিজিতে যাকে বলে মডলিন—তখন নাকি পাশের বাড়ির বিড়াল মারা গেলে মানুষ বালিশে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। বিদেশে যাওয়া আর এমেটিন ইনজেকশন নেওয়া প্রায় একই জিনিস। ’

মেহমানদারি করতে হলে টাকা থাকা-না-থাকা যে জরুরি কোনো বিষয় নয়—ইচ্ছাটাই আসল ব্যাপার, তা পাঠানদের একটা অতিপ্রিয়, দৃষ্টিগোচর, বৈশিষ্ট্য। পাঠানদের খানাপিনার প্রতি অতি-আসক্তি আর আতিথেয়তা বা আন্তরিকতার কথা জানাতে সৈয়দ কোনো রকম কার্পণ্য করেননি। যাত্রাপথের একদিনের অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন:

‘সেদিন গল্পের পাবনে রৌদ্র আর গ্রীষ্ম দুই-ই ডুবে গিয়েছিল। আর কী খানাপিনা! প্রতি স্টেশনে আড্ডার কেউ না কেউ কিছু না কিছু কিনবেই। চা, শরবৎ, বরফজল, কাবাব, রুটি, কোনো জিনিসই বাদ পড়ল না। কে দাম দেয়, কে খায়, কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। আমি দু’একবার আমার হিস্যা দেবার চেষ্টা করে হার মানলুম। বারোজন তাগড়া পাঠানের তির্যকব্যূহ ভেদ করে দরজায় পৌঁছবার বহু পূর্বেই কেউ না কেউ পয়সা দিয়ে ফেলেছে। ’

পাঠানদেরকে মুজতবা আলী অত্যন্ত অলস, আড্ডাবাজ বললেও তারা যে আরামপ্রয়াসী নয় এবং তাদের বিলাসিতাও যে সীমা ছাড়ায় না, সে কথা বলতে ভোলেননি। গালগল্প আর লম্বা আড্ডায় মশগুল থাকার স্বভাবের ভেতরে তাদের অকৃত্রিম দেশপ্রেম আবিষ্কার করে লেখক বিস্মিত হয়েছেন। অনুর্বর ভূমির এইসব বাসিন্দারা ব্যবসা-বাণিজ্যে বড়ই অপরিপক্ব। অভাবের তাড়নায় লুটতরাজ মাঝে-মধ্যে করে বটে; তবে আন্তরিকতায় অতুলনীয়। মুজতবা লিখছেন:

‘তবে একটা কথা বলে নেওয়া ভালো। পাঠানের ভিতরে বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়ায় যে তফাৎ, সেটুকু সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক। অনুভূতির জগতে তারা একই মাটির আসনে বসে, আর চিন্তাধারায় যে পার্থক্য সে শুধু কেউ খবর রাখে বেশি, কেউ কম। কেউ সেক্সপীয়র পড়েছে, কেউ পড়েনি। ভালোমন্দ বিচার করার সময় দুই দলে যে বিশেষ প্রভেদ আছে, মনে হয়নি। আচার-ব্যবহারে এখনো তারা গোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত সনাতন জান-দেওয়া-নেওয়ার পন্থা অনুসরণ করে।

ফসল ফলে না, মাটি খুঁড়লে সোনা চাঁদি কয়লা তেল কিছুই বেরোয় না, এক ফোঁটা জলের জন্য ভোর হবার তিন ঘণ্টা আগে মেয়েরা দল বেঁধে বাড়ি থেকে বেরোয়, এই দেশ কামড়ে ধরে পড়ে আছে মূর্খ পাঠান, কত যুগ ধরে, কত শতাব্দি ধরে কে জানে? সিন্ধুর ওপারে যখন বর্ষার বাতাস পর্যন্ত সবুজ হয়ে যায় তখন তার হাতছানি পাঠান দেখেনি? পূরবৈয়া ভেজা ভেজা হাওয়া অদ্ভুত মিঠে মিঠে গন্ধ নিয়ে আসে, আজ পর্যন্ত কত জাত তার নেশায় পাগল হয়ে পুব দেশে চলে গিয়েছে—যায়নি শুধু মূর্খ আফ্রিদি মোমন্দ। ’

ব্যক্তি-স্বাধীনতা এবং জাতিগত সাংস্কৃতিক ব্যাপারাদির পরিচয় তুলে ধরতে মুজতবা আলী কোনো কার্পণ্য করেননি। যেমন বিভিন্ন জাতির কারবারি কায়দা সম্বন্ধে তার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা এরকম: ‘একটা জিনিসে পাঠানে বাঙালীতে মিল দেখতে পেয়েছি সেইটে আপনাকে বলছি, শুনুন—এখানে যে রকম কারবার পাঞ্জাবী আর শিখদের হাতে, কলকাতায়ও কারবার বেশিরভাগ অ-বাঙালির হাতে। আর বাঙালী যখন ব্যবসা করে তখন তার কায়দাও আজব। ’

মানুষের সরলতা বিষয়ে বলতে গিয়ে লেখক এক প্রবাদসম বাক্য তুলে ধরেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন—যে ব্যক্তি নিজের অজ্ঞতাকে ঢাকবার চেষ্টা করেন, তার চোখে অপরের মূর্খতা ধরা পড়ে না। গল্পনির্মাতা লিখছেন: ‘চোখের সামনে ধরা আপন বন্ধমুষ্টি দূরের হিমালয়কে ঢেকে রাখে। ’ বাংলার অপার সৌন্দর্যের প্রকৃতির কথা স্মরণ করে লেখক বারবার আপুত হয়েছেন; বাংলাদেশের প্রাকৃতিক শোভা সম্বন্ধে নিজের মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন—রবীন্দ্রনাথ না-কি এই প্রকৃতির অপরূপ সৌকর্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষ্য:

‘স্বয়ং কবিগুরু বাঙালীর অচেনা জিনিস বর্ণনা করতে ভালোবাসতেন না। পাহাড় বাংলাদেশে নেই—তার আড়াই হাজার গানের কোথাও পাহাড়ের বর্ণনা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। সমুদ্র বাংলাদেশের কোল ঘেঁষে আছে বটে কিন্তু সাধারণ বাঙালী সমুদ্র দেখে জগন্নাথের রথ দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে কলা বেচার মতো করে—পূরীতে। ... তবু এ সব হলো বাঙালীর কিছু কিছু দেখা—সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস নয়। কিন্তু শীতের দেশের সবচেয়ে অপূর্ব দর্শনীয় জিনিস বরফপাত, রবীন্দ্রনাথ নিদেনপক্ষে সে সৌন্দর্য পাঁচশ’ বার দেখেছেন, একবারও বর্ণনা করেননি। ’

একজন কাবুল অভিমুখে অভিযাত্রী বাঙালি পথে পথে কুড়িয়েছেন নানান অভিজ্ঞতা, বিচিত্র কথামালায় আটকে-থাকা হাসির খোরাক আর শিক্ষণীয় সব ব্যাপার। আর তা সরল-বর্ণনায় শেয়ার করেছেন তার পাঠকের সাথে। জাতিগত-বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে তিনি মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন দেশের প্রবাদও প্রয়োগ করেছেন। যেমন লিখছেন:

ফার্সিতে প্রবাদ আছে, ‘দের আয়দ্ দুরস্ত আয়দ্’। অর্থাৎ ‘যা কিছু ধীরে-সুস্থে আসে তাহাই মঙ্গলদায়ক’।
আরবিতেও আছে, ‘অল অজলু মিনা শয়তান’। অর্থাৎ কিনা ‘হন্তদন্তহওয়ার মানে শয়তানের পন্থায় চলা’।
আরবি ভাষায় একটা প্রবাদ আছে ‘ইয়োম্ উস্ সর্ফ, নিস্ফ্ উস্ সর্ফ’—অর্থাৎ কিনা ‘যাত্রার দিনই অর্ধেক ভ্রমণ’। পূর্ব বাঙলায়ও একই প্রবাদ প্রচলিত আছে। সেখানে বলা হয়, ‘উঠোন সমুদ্র পেরলেই আধেক মুশকিল আসান। ’

আফগান মুলুকের বর্ণনা করতে গিয়ে সেদেশের প্রকৃতির বিরূপতা এবং অধিবাসীদের দুর্ভাগ্যকে লেখক তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সরল ও স্বাভাবিক বিবরণের আলোয়। পাঠক যেন অনায়াসে প্রবেশ করছে বর্ণনাকারীর দেখা ও চেনা ওই ভুবনের অপরিচিত পরিবেশে। মুজতবা আলী লিখছেন:

‘কী দেশ! দুদিকে মাইলের পর মাইল জুড়ে নুড়ি আর নুড়ি। যেখানে নুড়ি আর নেই সেখানে চোখে পড়ে বহুদূরে আবছায়া আবছায়া পাহাড়। দূর থেকে বলা শক্ত, কিন্তু অনুমান করলুম লক্ষ বৎসরের রৌদ্রবর্ষণে তাতেও সজীব কোনো কিছু না থাকারই কথা। ... পোকামাকড়, কোনো প্রকারের প্রাণের চিহ্ন কোথাও নেই—খাবে কী, বাঁচবে কী দিয়ে? মা ধরণীর বুকের দুধ এদেশে যেন সম্পূর্ণ শুকিয়ে গিয়েছে; কোনো ফাটল দিয়ে কোনো বাঁধন ছিড়ে এক ফোঁটা জল পর্যন্ত বেরোয়নি। ’

অবশ্য এই ধূ ধূ মরুভূমির দেশে কাবুল নদীর নিরিবিলি স্রোত পরিব্রাজক এই লেখকের মনে দাগ কাটে। বাঁক নিয়ে ছলছল করে বয়ে চলা এই নদীর পাড়ে মেলেধরা সবুজের আঁচল, পলিমাটির ওপরে সামান্য ফসলের উদার হাতছানিতে বিস্মিত আর পুলকিত না হয়ে পারেননি তিনি। নদীর এই মায়াজড়ানো পথচলা আর তীরে রস বিলিয়ে যাওয়ার মৃদুধ্বনিতে যেন ভ্রমণ-পিয়াসী বাঙালি মুজতবা খানিক স্বস্তি ফিরে পেয়েছিলেন। তার সেই অমিত আনন্দের কথা পাঠককে জানাতে ভুল করেননি; আর কেবল অবগত করেই ক্ষান্ত হননি—আপন অনুভবের কাতারে যেন দাঁড় করিয়েছেন পাঠককেও। কে জানে, জলের ভাষায় হয়তো তিনি অজানা কোনো ডাক শুনেছেন; সে আহ্বান বোধকরি ভাগ করে নিতে চেয়েছেন অন্যের সাথেও। প্রসঙ্গত, তিনি নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে-ওঠার কথাও বলেছেন। তার বিবরণ থেকে খানিকটা পাঠ নেওয়া যাক:

‘কাবুল নদী আমার কাছে সৌন্দর্য উপভোগের বস্তু ছিল। তার গান শুনতুম, আর নাচ দেখতুম। তার লুটিয়ে-পড়া সবুজ আঁচলের এক প্রান্তে আসন পেতে বসতুম। এখন আমাদের অন্য সম্পর্ক। আচ্ছা বলুনতো, অমাবস্যার অন্ধকারে যখন কিছুই দেখা যায় না, তখন আপনি কখনো নদীর পাড়ে কান পেতে শুয়েছেন?’

গ্রন্থটিতে ভ্রমণের আনন্দ ও অজানাকে জানবার সুধারসের পাশাপাশি গভীর পর্যবেক্ষণের অনুভবে পরিবেশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির হাল-হকিকত। আফগান, হিন্দুস্থান, ইরান কিংবা চীন বিষয়ে ইংরেজদের মনোভাব ও রাজনৈতিক অভিপ্রায় কী, তারও নিবিড় পর্যবেক্ষণ ধরা পড়ে লেখকের বর্ণনায়। স্বাধীন আফগানের মানুষের জীবনের চালচিত্র প্রকাশ করতেও তিনি কোনোরকম কুণ্ঠাবোধ করেননি। জীবন-অভিজ্ঞ সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশে বইটিতে কিছু প্রবাদসম বাক্য পাঠকের নজর কাড়ে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিরলস চর্চা আর জীবনকে ও মানুষকে নিবিড়ভাবে দেখবার বাসনা থেকে লেখকের যে অভিজ্ঞতার সঞ্চয়, তা থেকেই বোধকরি উৎসারিত হয়েছে এসব কথামালা বা প্রৌঢ়ক্তি। কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে:

কোনো দেশের গরিব মেয়েই পর্দা মানে না, অন্তত আপন গাঁয়ে মানে না।
ইংরেজ এবং অন্য হরেক রকম সাদা বুলবুলিকে আফগান পছন্দ করে না।
পরের অপকার করিলে নিজের অপকার হয়।
বাঙালি আর কিছু পারুক না পারুক, বাজে তর্কে খুব মজবুত।

কবিতা-লগ্নতা কিংবা বলা চলে লেখকের কবি-স্বভাব এই বইটিতে স্পষ্ট। বর্ণনাভঙ্গিতে এবং মধ্যে মধ্যে নিজের লেখা ও সংগ্রহ করা কবিতা জাহির করার মাধ্যমে তার সে প্রবণতাটাই প্রকাশ পায় মাত্র।

ভ্রমণ-উপন্যাস দেশে-বিদেশে সৈয়দ মুজতবা আলী পরিবেশন করেছেন এক ভিন্ন স্বাদের কাহিনি। ভ্রামণিক অভিজ্ঞতাকে তিনি গল্প আকারে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন দক্ষ শিল্পীর কৌশলী আঁচড়ে। বহুভাষাবিদ পণ্ডিত মুজতবা পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতি সম্বন্ধে পরিচিত থাকবেন—এমনটাই স্বাভাবিক। আর তাই, অতি সহজভাবে তার কাহিনি-বিবরণেও স্থান পেয়েছে নানান জাতি ও সংস্কৃতির প্রলেপ আর আভাস। সৈয়দ মুজতবার এই উপন্যাসটি সচেতন ও সাবধানী পাঠককে, খুব সহজেই পৌঁছে দেয় অভিজ্ঞতা ও আনন্দের এক বিরাট উঠানে।



বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।