ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রফিক আজাদের মৃত্যু : কবি-লেখকরা যা বললেন

শিল্প-সাহিত্য ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৩ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৬
রফিক আজাদের মৃত্যু : কবি-লেখকরা যা বললেন

ষাটের দশকের কবি রফিক আজাদ শনিবার (১২ মার্চ) দুপুর ২টা ১০ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মারা যান। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি থেকে ওই হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে ছিলেন তিনি।



তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে শোকে বিহ্বল দেশের কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীসহ নানা স্তরের মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও শুরু হয় তাকে নিয়ে লেখালেখি। রফিক আজাদের বিখ্যাত কবিতা থেকে উদ্ধৃত করেও পোস্ট দেন অনেকে।

রফিক আজাদের মৃত্যুতে তাঁর দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠজন—কবি জাহিদ হায়দারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘রফিক আজাদ ছিলেন বিদ্রোহী, রাগী এবং ভিন্ন মেজাজের একজন কবি। বহুরাত আমরা একত্রে কাটিয়েছি। অনেক গল্প করেছি। তিনি ছিলেন সর্বাঙ্গে আধুনিক একজন কবি আর মানুষ হিসেবেও ছিলেন বড়। ’

স্মৃতিচারণা করে জাহিদ হায়দার বলেন, ‘১৯৭৩ সালে রফিক আজাদ তখন বাংলা একাডেমির সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকার-এর কবিতা অংশটা দেখেন। আমাকে একদিন আরো অনেকের সামনে থেকে আলাদা ডেকে নিয়ে উত্তরাধিকারে পাঠানো আমার একটি কবিতার ছন্দের ভুল ধরিয়ে দিলেন। দুটো মাত্রায় সমস্যা ছিল, তিনি আমাকে বিকল্প ক’টি উপায়ও বাতলে দিলেন। আসলে রফিক আজাদ তরুণ কবিদের অনেকখানি এগিয়ে দিতেন। ’

রফিক আজাদ সম্পর্কে কবি খালেদ হোসাইনের মন্তব্য: ‘কবি রফিক আজাদ কখনোই কবিতার মূল ধারা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেন নি। প্রচলিত ছন্দে তার ছিল অসাধারণ দক্ষতা। অহেতুক আধুনিক হতে যান নি। সাবলীল বিদ্রোহ বা ক্ষোভ থেকেও কবিতা লিখেছেন। আধুনিকতা তার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এসেছিল। তিনি ছিলেন সমকালীন ও ভবিষ্যতস্পর্শী। ’

কবি ফরিদ কবির বলেন, ‘ষাটের দশকে ভালো কবিদের সংখ্যা বেশি। আমরা যখন লিখতে আসি তখন রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রথম সারির। এরমধ্যে নাগরিক জীবন যাপন-নির্ভর আধুনিক কবিতার একটা উদ্বোধন ঘটে মূলত রফিক আজাদের কবিতার মধ্যদিয়ে। তার লাইফ স্টাইলের মধ্যেই সামাজিক নানা ধরনের ট্যাবুকে অস্বীকার করার একটা প্রবণতা বা সাহস ছিল। আমি মনে করি নতুনদের উচিত রফিক আজাদকে আরো মনোযোগী হয়ে পাঠ করা। ’

কবি ও গল্পকার কাজল শাহনেওয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ করলে রফিক আজাদ সম্পর্কে বললেন, ‘রফিক আজাদ ছিলেন সত্যিকারের একজন কবিব্যক্তিত্ব। জীবন যাপনেও তার কবি চরিত্রটিই সামনের দিকে থাকত। যদিও আমরা তার খুব একটা স্নেহ পাই নি, একধরনের দূরত্ব ছিল। আমরা ছিলাম লিটল ম্যাগাজিন কেন্দ্রিক, অন্যদিকে রফিক আজাদ তখন দেশবিখ্যাত কবি। অবশ্য পরবর্তীকালে এ নিয়ে তিনি আফসোস করেছেন। স্বীকার করেছেন, আগে থেকেই যোগাযোগটা থাকতে বা হতে পারত। আমি বলব, রফিক আজাদকে নিয়ে, তাঁর কবিতা নিয়ে, এবং তাঁর ও তাঁর কবিতার সময়টা নিয়ে ভাববার অনেক কিছু আছে। ’

কবি আলফ্রেড খোকন বলেন, ‘রফিক আজাদের সঙ্গে অনেক দিনের সম্পর্ক, অনেক স্মৃতি আমাদের। মনে আছে আমেরিকাতে গিয়ে কবি শহীদ কাদরীকে যখন ফোনে ধরিয়ে দিই, ফোনেই তাঁর (রফিক আজাদের) সে কি কান্নাকাটি! এরকম আবেগপ্রবণ ছিলেন। ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন মানুষ। ’

স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘একবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম নিজের কবিতা নিয়ে আপনার কোনো বেদনার জায়গা আছে কি? বললেন, আছে আর সেটা হলো “ভাত দে হারামজাদা” সংক্রান্ত বেদনা। তার মতে, আরো সব ভালো ও গুরুত্বপূর্ণ কবিতা থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ মানুষই তাঁকে এ লাইনটির কারণেই চেনে এবং এ লাইনটি দিয়েই মূল্যায়ন করে।

এ লাইনটি তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেলেও এ লাইনটিই তার অন্য অনেক কবিতা থেকে মনোযোগী পাঠকের দৃষ্টি সরিয়ে ফেলেছিল বলে মনে করতেন তিনি। ’

কবি কামরুজ্জামান কামু রফিক আজাদ সম্পর্কে বেশি কিছু বললেন না। সম্ভবত এ বাক্যটিকেই যথেষ্ট মনে করে—‘রফিক আজাদের মৃত্যু আমাকে ভারাক্রান্ত করেছে। ’

এদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও কবিকে উদ্দেশ্য করে ও সম্মান জানিয়ে অনেকে লিখেছেন। এরমধ্যে কবি ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল তাঁর ফেসবুক স্টেটাসে লেখেন: ‘প্রিয় রফিক আজাদ, দুপুরের ঠিক এই সময়টাতেই আমরা কতিপয় ছন্নছাড়া সংসারপালানো মানুষ একত্রিত হতাম আমাদের প্রিয় আড্ডায়। কাকতালীয়ভাবে প্রতি শনিবার আড্ডা থাকত ভর-ভরন্ত সংসারের মতো।

জাকারিয়া চৌধুরী (জ্যাক ভাই), সিকদার আমিনুল হক, হাবিবুল্লাহ সিরাজী, শিহাব সরকার, বাদল রহমান, ফারুক ভাই, ডঃ করিম, ডঃ আলী, মামুনুর রশীদ, সঞ্জীব চৌধুরী, রউফুল হাসান, অমিত হাবিব, এবং অতিআবিশ্যিকভাবে কবি রফিক আজাদ। আরো অনেকেই, কেউ নিয়মিত, কেউবা অনিয়মিত। আমি ছিলাম আড্ডার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য।

কথা বলতে বলতে দুপুরের চনমনে রোদ চোখে নিয়ে আমরা কতিপয় জানালা দিয়ে দেখতাম চলমান শহর, ধাবমান জীবন। মেতে উঠতাম গান, কবিতা, সাহিত্য, রাজনীতি, জীবন অথবা নিদেনপক্ষে পরচর্চা নিয়ে।

এইমাত্র ইমদাদুল হক মিলন ভাই ফোনে জানালেন, রফিক ভাইয়ের পক্ষে আর আমাদের আড্ডায় আসা সম্ভব হবে না! আড্ডা হবে রফিক ভাই, আবারও আড্ডা হবে। ওখানে বাদলদা, সিকদার ভাই, সঞ্জীবদা, রউফুল ভাই আছে, তুমি যাবে বলে। আমরাও হয়তো পথে জড়ো হচ্ছি সেই আড্ডায় আসব বলে। তুমি থেকো। আবার অন্য কোথাও যেও না। ’

কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল তাঁর ফেসবুক স্টেটাসে লিখেছেন, ‘বর্ণাঢ্য এক জীবন কাটিয়ে গেছেন আপনি। আজীবন তরুণ, আজীবন প্রতিবাদী, আজীবন আপোসহীন। শিশুর মতো সরল একটা মন ছিল আপনার, কাছে গেলেই তা বোঝা যেত। নিজের মনটিও হয়ে উঠতো শুদ্ধ-নির্মল-নিষ্কলুষ—আপনার সান্নিধ্যে গেলে। আমাদের অভিবাদন গ্রহণ করুন, কবি। ’

১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কবি রফিক আজাদ। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়ই ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বাবা-মার কঠিন শাসন উপেক্ষা করে ভাষা শহীদদের স্মরণে খালি পায়ে মিছিল করেছিলেন।

চিরদিনই প্রতিবাদী এই কবি তার দ্রোহকে শুধু কবিতার লেখনীতে আবদ্ধ না রেখে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জাতির চরম ক্রান্তিকালে, ১৯৭১ এ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনের সৈনিক হিসেবে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেন তিনি। কর্মজীবনে রফিক আজাদ বাংলা একাডেমির মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’র সম্পাদক ছিলেন। ‘রোববার’ পত্রিকাতেও রফিক আজাদ নিজের নাম উহ্য রেখে সম্পাদনার কাজ করেছেন। এছাড়া টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনাও করেন তিনি।

রফিক আজাদের প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে, ‘অসম্ভবের পায়ে’, ‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে’, ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

এ কাব্যের জন্য ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক পান তিনি। সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন হুমায়ুন কবির স্মৃতি (লেখক শিবির) পুরস্কারসহ আরও বেশ কয়েকটি পুরস্কার।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৮ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।