ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সময়ের আয়নায় আবুল মনসুর আহমদ | ফজলুল হক সৈকত

আলোচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৬
সময়ের আয়নায় আবুল মনসুর আহমদ | ফজলুল হক সৈকত

আবুল মনসুর আহমদ একজন সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক। ১৮৯৮ সালে জন্ম নেওয়া এ সাহিত্যিক ১৯৭৯ সালের ১৮ মার্চ পরলোকে পাড়ি জমান।

তাকে নিয়ে ২০১৫ সালে একটি বিশেষ সংখ্যার আয়োজন করে ইমরান মাহফুজ সম্পাদিত লিটলম্যাগ ‘কালের ধ্বনি’। এই বিশেষ সংখ্যার উপর আলোচনা লিখেছেন ড. ফজলুল হক সৈকত। আবুল মনসুর আহমদের প্রয়াণদিবসে তার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে আলোচনাটি বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো।

কালের ধ্বনি। একটি লিটলম্যাগ। জন্ম ২০১০ সালে। সম্পাদক ইমরান মাহফুজ। ফেব্রুয়ারি ২০১৫-তে বেরিয়েছে ৫ম সংখ্যা। আগে ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হলেও বিষয়গুণে ও সম্পাদনা চাতুর্যে এই সংখ্যাটি হয়ে উঠেছে বিশেষ ও অনন্য। সমকাল এবং উত্তরকালে প্রাসঙ্গিক রাজনীতিক-সাহিত্যিক ও সমাজচিন্তক আবুল মনসুর আহমদকে ঘিরে এই বিপুলায়তন আয়োজন সত্যিই চমকপ্রদ ঘটনা। ছোট কাগজের ভুবনে এমন বড়ো ব্যাপার খুব বেশি একটা দেখা যায় না। ব্যক্তির বড়ত্বের মাপ আর সময়ের দাবির কারণেই এই প্রকারের প্রকাশনার প্রয়োজন পড়ে। তরুণ ও প্রতিশ্রুতিশীল সাহিত্য-সাধক মাহফুজ সেটি অনুধাবন করতে পেরেছেন।

রাজনীতি, সাংবাদিকতা এবং সাহিত্যের প্রতি অপার নিষ্ঠা আর সমাজ-গঠন ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার চলমান সংগ্রামে নিবেদিত-প্রাণ এক সাধক আবুল মনসুর আহমদ (জন্ম: ০৩ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮ ধানিখোলা, ময়মনসিংহ; মৃত্যু: ১৮ মার্চ ১৯৭৯ ঢাকা)। কখনো রাজনীতির মঞ্চে ও সরকারের মন্ত্রিসভায়, কখনো সংবাদপত্র সম্পাদনায় বা কলামে, কখনো সাহিত্যে, কখনোবা আইনজীবী হিসেবে নিজের নামের মহিমা প্রচার ও প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করেছেন এই মনীষী। ১৯৩০-৩৮ সময়কালে ময়মনসিংহ জজকোর্ট ও কলকাতার আলীপুর জজকোর্টে আইনপেশায় নিয়োজিত থাকার সময়টুকু বাদ দিলে ১৯২০ থেকে প্রায় আমৃত্যু ছয় দশককাল তিনি চিন্তা-মনন ও কর্মে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিশারদ এবং সাহিত্যিক আলেক্সন্দর সল্জনিৎসিন, যিনি নৈতিকশক্তি আর প্রাতিস্বিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে বন্দিশিবির থেকেও শিল্পের গোলাপ ফুটিয়েছেন, ১৯৭০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার গ্রহণকালে বক্তৃতায় বলেছেন,
‘আদিম মানুষের মতো কেউ একজন, এক অদ্ভুত সামুদ্রিক প্রাণীকে- সে এক অদ্ভুত হয়তো বালির মধ্যে লুকিয়ে ছিল, অথবা এমন কিছু যা হঠাৎ করেই আকাশ থেকে পড়েছে- বেশ অদম্য আর বক্র, আবার বোধহীনের মতো চকচকে, ভেতর থেকে উজ্জ্বল প্রভা বেরিয়ে আসছে, একেক সময় একেক রূপ নিচ্ছে, মনে হচ্ছে, যেন  একে যে-কোনো রূপেই ব্যবহার করা যাবে, হাতের মুঠোয় নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ওঠে... সে রকমই শিল্পকে আমরা আমাদের হাতের মুষ্ঠিতে ধরে রেখেছি, আত্মপ্রত্যয়ীর মতো মনে করি- এ আমাদের নিজস্ব সম্পদ, এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ন্ত্রণ করি, একে নতুনত্ব দিই, পুনর্নির্মাণ করি, এর ফতোয়া দিই, টাকার জন্য বিক্রি করি, একে নিয়ে প্রভাবশালীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা করি এবং বিনোদনের সামগ্রীতে পরিণত করি বিভিন্ন সঙ্গীতের আসরে আর রাতের ক্লাবগুলোতে এবং এক সময় এটি গতিনিরোধক কিংবা লাঠিতে পরিণত হয়, দিক-পরিবর্তনের রাজনীতির অথবা ক্ষীণ সামাজিক প্রয়োজনে। ’ (হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত, নোবেল-ভাষণ: বাক্ থেকে পামুক (পাঁচ মহাদেশের দশ সাহিত্যরথী), ঢাকা, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ: একুশে বইমেলা ২০০৮, পৃষ্ঠা- ৫৩)

আবুল মনসুর আহমদের রাজনীতিলগ্নতা এবং সাংবাদিক ও সাহিত্যিক দায়বোধের বিবেচনায় এই কথাগুলো বিশেষভাবে স্মরণ করার প্রয়োজন পড়ে। মধ্যবিত্ত কৃষক-পরিবারের সন্তান আবুল মনসুর আহমদকে জীবনের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে নানান প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে। তার কর্ম-পরিসরের পুরোটি ভুবনজুড়ে সমানতালে চলেছে রাজনীতি-সাধনা ও সাহিত্যচর্চা। তিনি তার প্রতিবেশকে ধারণ করেছেন প্রজ্ঞা আর আশাবাদের প্রবল তাড়নায়। সমাজচিন্তক মনসুর ছিলেন সোসিও-পলিটিক্যাল রাইটার। সাধারণ মানুষের বোধের ভুবনে আলোড়ন তুলতে চেয়েছিলেন এই দার্শনিক। কখনো কখনো তিনি আবেগতাড়িত হয়েছেন, হয়েছেন নিজের ধর্ম ও জাতির প্রতি পক্ষপাতি। কিন্তু সর্বোপরি তার লক্ষ্য ছিল শান্তি, উদার-নৈতিকতা ও মানবতাবাদ। আর সাধনার সমস্ত প্রহর জুড়ে তিনি নির্ভর করেছেন আত্ম-অনুভব আর আত্ম-বিশ্বাসের ওপর। তিনি সময়ের এক নিরন্তর যাত্রী। যেন একটা দূরগামী ট্রেন সময়ের বিশাল প্রান্তর পেরিয়ে স্টেশন থেকে স্টেশনে নিয়ে গিয়ে অবশেষে নামিয়ে দিয়েছে এক জংশনে। পথ পেরোনোর সময় এত মুখ এত ছবি দেখেছেন তিনি- তার সবগুলো সামাজিক-রাজনৈতিক অভিজ্ঞানকে আশ্রয় করে হয়ে উঠেছে তার সাহিত্যের উপাদান। কোনো আত্মপ্রচার বা কীর্তিগাথা নয়, মনসুর এঁকেছেন স্রেফ জীবনের ছবি। জীবনের ছবি আঁকতে গিয়ে তিনি পরিচিত ভুবন থেকে আর জীবন-জিজ্ঞাসা থেকে সংগ্রহ করেছেন সারি সারি খণ্ডচিত্র। চিত্রগুলো হয়তো ক্ষুদ্র, আঁচড়গুলো মিহি, কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক অপূর্ব কাহিনি-ছবি।
 
দার্শনিক আবুল মনসুর আহমদের কীর্তি ও সাধনা নিয়ে কম-বেশি আলোচনা-সমালোচনা-গবেষণা যে হয়নি, তা নয়। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত (ফেব্রুয়ারি ২০১৫) লিটলম্যাগ কালের ধ্বনির বিপুলাকৃতির আবুল মনসুর আহমদ সংখ্যা বিদ্বৎসমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। কালের ধ্বনি: দুর্লভ কথক আবুল মনসুর আহমদ শিরোনামের এই সাময়িক পত্রিকাটির সম্পাদকের কর্ম-পরিকল্পনা, পরিবেশনকৌশল ও চিন্তাশীলতা বর্তমান সংখ্যাটিকে সাময়িকতাকে পেরিয়ে নিয়ে যাবে কালান্তরের বিস্তৃত প্রান্তরে। কবি ও কথাশিল্পী জীবনানান্দ দাশের জন্মশতবর্ষে ১৯৯৯ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভাব ও অনুষ্টুপ এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত উত্তরাধিকার-এর বিষয়-বিন্যাস এবং আয়তনের বিশালতার কথা আমরা প্রসঙ্গত স্মরণ করতে পারি। সময়ের প্রয়োজন যে সৃজনশীলতা ও চিন্তাশীলতাকে আশ্রয় করে, অন্বেষণ করে তার প্রমাণ এইসব সাহিত্যপত্র। সমাজে ও রাষ্ট্রে ‘অদ্ভূত আঁধার’ বাসা বাঁধলে যেমন জীবনানন্দকে স্মরণ না করে উপায় থাকে না, তেমনই রাজনৈতিক দুর্বলতা আর সংবাদপত্র ও সাহিত্যের সীমাবদ্ধতার কালে আবুল মনসুর আহমদকে ঘিরে এই বিস্তর আয়োজন প্রাসঙ্গিকই মনে হয়। সম্পাদক নিশ্চয় কারো ফরমায়েশে বা অনুরোধে এ কাজ করেননি। সমকালের তাগিদই তাকে এই মনীষীর জীবনদর্শন আওড়াতে উদ্বুদ্ধ করে থাকবে। শুধু কলেবরের দিকে সম্পাদক নজর দিয়েছেন, এমনটি ভাবা যায় না। তিনি চেষ্টা করেছেন প্রখ্যাত গদ্যকারিগর এবং পরিচিত প্রাবন্ধিকদের আলোচনা-সমালোচনায় পৃষ্ঠা সংখ্যা বৃদ্ধি করতে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো- বড় মাপের মানুষের মূল্যায়নে বড় সাইজের কাগজ বেরুবে- এমন চিন্তাকে বোধ হয় ইমরান মাহফুজ পাত্তা দেননি। তিনি সম্ভবত চিন্তাবিদ ও সমাজচিন্তক আবুল মনসুরকে পাঠকের চোখের আয়নার সামনে দাঁড় করাতে চেয়েছেন।

কালের ধ্বনির এই সংখ্যায় ‘গুণীজন কহেন কথা...’ পর্বে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মূল্যায়ন থেকে আবুল মনসুরের জীবন ও চিন্তার খণ্ডচিত্র তুলে ধরার প্রয়াস আছে। ৩৫ জন ব্যক্তির মনসুর-বিচার ভাবনার চুম্বক-অংশ (নিবন্ধকারের অভিমত) তুলে ধরেছেন সম্পাদক। প্রসঙ্গত, কাজী নজরুল ইসলামের রচনা-অংশটি উদ্ধৃত করছি: ‘এমনি আয়নায় শুধু মানুষের বাইরের প্রতিচ্ছবি দেখা যায় কিন্তু আমার বন্ধু শিল্পী আবুল মনসুর যে আয়না তৈরি করেছেন, তাতে মানুষের অন্তরের রূপ ধরা পড়েছে। ’ আর অন্নদাশঙ্কর রায়ের অভিমতটি এরকম: ‘আয়না লিখিয়া আবুল মনসুর আহমদ প্রাতঃস্মরণীয় হইয়াছিলেন। ফুড কনফারেন্স লিখিয়া তিনি অমর হইলেন। ’- মানুষের প্রবৃত্তির নিবিড়-পর্যবেক্ষণে আবুল মনসুর যে অভিজ্ঞ এবং তিনি যে অমর শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেছেন, সে-বিষয়ে বোধ করি আজ তার প্রতিপক্ষ বা শত্রুরও সন্দেহ নেই।

আবুল মনসুর আহমদ লেখালেখি শুরু করেছেন বিশ শতকের বিশের দশকে। তখন সাহিত্য-শিল্পের প্রবল পরিবর্তনের সময়। কল্লোল যুগের লেখকেরা সক্রিয়, ছিল মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র শিখা (১৯২৬)। সাংবাদিকতা, রাজনীতি আর লেখালেখি চলেছে সমানতালে। তবে, ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সত্তরের দশকের প্রায় শেষ অবধি সক্রিয় রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে আমৃত্যু লেখালেখিতে ব্যাপৃত ছিলেন। সমকালীন বাঙালি মুসলমান সমাজের দুঃখ-দুর্দশা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, অনাচার-কুসংস্কার প্রভৃতি তাকে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছে। কেবল ধর্মচিন্তায় নয়- প্রায় সমগ্রজীবন এবং সমস্ত ভাবনা জুড়েই বর্তমান ছিল তার স্বাজাত্য-প্রীতি। তিনি সমাজকে দেখেছেন ব্যক্তির অভিমত, চিন্তা আর নানান প্রবণতার ভেতর দিয়ে। তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ আয়না (প্রথম প্রকাশ: ১৯৩৫)। ‘ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি’ ধারণা লালনকারী সমাজ-সাধক আবুল মনসুর আহমদের চিন্তা ও চোখ প্রসারিত ছিল নানান দিকে ও বিচিত্র বাঁকে। গল্প-উপন্যাস ছাড়াও কবিতা এবং নাটক-নির্মাণের দিকে তার বিশেষ ঝোঁক পাঠকের নজর কাড়ে। একটা বিশেষ কালপর্বের রাজনৈতিক-সামাজিক তরঙ্গক্ষুদ্ধ ঘটনাপ্রবাহের কালদ্রষ্টা আবুল মনসুর আহমদ। ১৯২০ থেকে ১৯৭৯- প্রায় ৬০ বছরের ঘটনা-নির্যাস নিংড়ে-নিংড়ে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন সাহিত্যে, আত্মজীবনীতে। যাপিত জীবনের চালচিত্র উপস্থাপনে তার রচনায় কোনোরকম কৃত্রিমতার প্রলেপ নেই। কখনো গল্পের খণ্ডছবিতে, কখনো উপন্যাসের বিরাট ক্যানভাসে, কখনো মননশীল রচনায় কিংবা বক্তব্যের প্রৌঢ়-ভঙ্গিতে সমাজকে তুলে এনেছেন পাঠক-শ্রোতার সামনে। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের বিচিত্র বাঁক-পরিবর্তনেও তিনি সাহিত্যচর্চা থেকে দূরে সরে যাননি। নিরন্তর সাধকের মতো কাজ করেছেন। সাহিত্যকে গ্রহণ ও প্রতিপালন করেছেন কৃষ্টির আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মবিকাশের লীলাভূমি হিসেবে। আর উত্তরকালের প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন চিন্তার কিছু উপাদান এবং বিচরণের খানিক খোলা বারান্দা।

স্মৃতিকথায় বাবার কথা বলতে গিয়ে ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদের যোগ্য উত্তরসূরি মাহফুজ আনাম ‘একজন শিক্ষক’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন: ‘আমাদের বেছে নেয়া জীবন দর্শনে তার হস্তক্ষেপ না করার মধ্য দিয়ে আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতায় পিতার প্রতিশ্রুতির পরাকাষ্ঠা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমি মনে করতে পারি না যে তিনি কখনও আমি বা আমার কোনো ভাইয়ের ভবিষ্যত নিয়ে তাঁর কোনো পরিকল্পনার কথা বলেছেন। কাজেই আমার সাংবাদিক হওয়া সম্পূর্ণই আমার নিজের সিদ্ধান্ত কিন্তু জানতাম সিদ্ধান্তে তিনি অনেক আনন্দিত হয়েছেন। এটা আমাদেরকে আরও কাছাকাছি এনেছে এবং বিতর্কের দিনগুলোতে শুরু হওয়া সম্পর্ককে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। আমার প্রথম লেখার কথা মনে আছে এবং মনে আছে যে, তিনি কিভাবে সেটা সবসময় হাতে রাখতেন। এখন আর আগের মতো তাঁকে লেখাগুলো দেখাই না। তাঁকে তা পড়বার জন্য পরের দিন পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। জানতাম তিনি পড়বেন এবং তাঁর মন্তব্যের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতাম। যেদিন তিনি মনে করতেন যে লেখাটি ভালো হয়েছে, অনেক অনেক খুশি হতেন। আমি বাড়ি ফিরে আসতে আসতে তিনি পড়ে ফেলতেন আর বিশেষ জায়গাগুলি পেনসিলে চিহ্ন দিয়ে, লেখাটি কেটে নিয়ে আমার জন্য তৈরি বিশেষ ফাইলে রাখতেন। যখনই লিখতাম, জানতাম যদি কেউই না পড়ে, সারা দুনিয়ায় অন্তত একজন আছেন যিনি লেখাটি পড়বেন। ’ (পৃ. ৪৭৬)

সম্পাদকীয় থেকে কিছুটা পাঠ নিচ্ছি পত্রিকাটির প্রকাশের দায় ও দায়িত্ব সম্বন্ধে ধারণা নেওয়ার জন্য: ‘দুঃসময়ে মানুষ চেনা যায় বটে, কিন্তু নিজের মাথা ঠিক রাখা দায় হয়ে ওঠে। তারপরও কেউ যদি হয় ছাপোষা মানুষ, গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো সাহিত্যের ভূত কাঁধে সওয়ার হয়; তাকে যুদ্ধটা করতে হয় নিজের সাথেই। বিশ শতকের সবার জন্যই একথা সত্যি। দু’টো কাঠি এগিয়ে আবুল মনসুর আহমদ একজন ভিশনারি বুদ্ধিজীবী হিসেবে জাতিকে যেমন পথ দেখিয়েছেন তেমনি আবার প্রকৃত রাজনীতিবিদ হিসেবে একুশ দফা রচনা, যুক্তফ্রন্ট গঠনে অন্যতম সংগঠক হিসেবে কাজ করা, পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা (যার ২১ দফায় অনেকাংশে লিপিবদ্ধ ছিল) প্রচারে ভূমিকা রেখে নন্দিত। ’

গবেষণার ক্ষেত্রে এই ধরনের আয়োজন-প্রকাশনা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অ্যাকাডেমিক পড়ালেখায় নতুন মাত্রাও যোগ করতে পারে। সাহিত্যিক মূল্যায়ন, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, সাংবাদিকতা, জীবন-দর্শন, ভাষা এবং ধর্ম-দর্শন বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, আইনজীবী, নাট্য-রচয়িতা, স্মৃতিকথা প্রভৃতি পর্বে বিষয়-বিন্যাস করে কালের ধ্বনি লিটলম্যাগটিকে আবুল মনসুর আহমদের একটি পরিপূর্ণ মূল্যায়নচিত্র হিসেবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সম্পাদক। পরিশিষ্টে তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনা স্থান পাওয়ায় এবং বিশেষত, গুণীজনের মতামতের অংশবিশেষ ও সংবাদ প্রতিবেদন যুক্ত হওয়ার কারণে কাগজটির তাৎপর্য খানিকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবুল মনসুর আহমদের মৃত্যুর পরদিন দেশের বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্র শোক সংবাদ, সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সেসব লেখায় উঠে আসে চিন্তাবিদ এই মানুষটির প্রতি সমকালের লোকদের শ্রদ্ধার ব্যাপারাদি। কালের ধ্বনি সেইসব কথামালা আবার আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। পুত্রবধূ ডা. লুৎফুন নাহার আনামের দু’টি এবং নাতি আহমদ মসিহুল আনামের একটি নিবেদিত কবিতা কালের ধ্বনিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সব মিলিয়ে, সাহিত্যপ্রেমিক সম্পাদক ইমরান মাহফুজের চেষ্টাটি চমৎকার হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।