ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সেন্টু ভাইয়ের সান্নিধ্য, গৌরব ও গ্লানি | সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

শ্রদ্ধাঞ্জলি ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪১ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১৬
সেন্টু ভাইয়ের সান্নিধ্য, গৌরব ও গ্লানি | সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

প্রথম দেখা
ত্তর দশকের শেষ দিকে যখন ঢাকায় এসে লেখালেখি শুরু করি, তখন আমার নামের শেষাংশ ‘দুলাল’ ছাপতে রাজি হলেন না ইত্তেফাকের আল মুজাহিদী, দৈনিক বাংলার আফলাতুন এবং উত্তরাধিকারের কবি রফিক আজাদ। বেলাল ভাই মানে বেলাল চৌধুরী তখন সচিত্র সন্ধানীর দায়িত্বে।

তাকে এই দুঃখের কথা বলার পর তিনি সচিত্র সন্ধানীর প্রচ্ছদকাহিনী লিখতে দিলেন, ‘নামের নামাবলি’। বিশ্বের লেখকদের প্রকৃত নাম, ছদ্মনাম, লেখক নাম, নামের পরিবর্তন, নামের নামান্তরের রহস্য নিয়ে একটি দীর্ঘ রচনা লিখি আশি দশকের প্রথম দিকে। তাতে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’রও পুরো নামের কথা উল্লেখ ছিলো। তার নাম ছিলো ‘আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ খান ওরফে সেন্টু’। লেখাটি প্রকাশের পর খুব হৈচৈ পড়েছিলো। আর সেইসময় বেলাল ভাই জানালেন, সেন্টু ভাই তোমাকে খুঁজছেন! আমি তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সরকারি পত্রিকায় সম্পাদনা বিভাগে যোগ দিয়েছি। আমার অফিস সচিবালয়ে, সেন্টু ভাইও সেখানে। তখন তিনি সম্ভবত যুগ্ম-সচিব। পরদিন দেখা করতে গেলাম। পেলাম কোমল সান্নিধ্য। আমার মতো একজন তরুণকে খুব খাতির করলেন। খোঁজখবর জানলেন। চা-বিস্কুট খাওয়ালেন। গল্প করলেন এবং আসার সময় উপহার দিলেন অ্যালবাম আকারের দু’টি কবিতার বই, 'আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি' এবং 'বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা'। এর প্রকাশক গাজী শাহাবুদ্দিন, মনু ভাই।

দু’টিই যথেষ্ট
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর এই আলোচিত বই দু’টি ছাড়া বাকী কবিতার বইগুলো হচ্ছে- সাতনরী হার, কখনো রং কখনো সুর, কমলের চোখ, সহিষ্ণু প্রতীক্ষা, মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ, আমার সময়, আমার সকল কথা, প্রেমের কবিতা ও নির্বাচিত কবিতা। কিন্তু 'আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি' এবং 'বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা'শীর্ষক কালজয়ী কবিতাই অধিক সমাদৃত। এই কবিতা দু’টিকে আর কোনো কবিতাই ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। যা আধুনিক বাংলা কবিতার ভাণ্ডারে মূল্যবান সংযোজন। স্নিগ্ধ, সহজ-সরল, সুন্দর ও সাবলীলভাবে সাজানো কবিতা। তবে পুনঃ কথনেপূর্ণ!

‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।

তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।

জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।

... আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো
আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো?’

এতে ‘উনুনের আগুন, প্রবহমান নদী, মাছের সঙ্গে খেলা, মা’য়ের কোলে শুয়ে গল্প শোনা, গর্ভবতী বোনের মৃত্যু, যুদ্ধে যাওয়া ভাই, পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত, মৃত্তিকার গভীরে কর্ষণ, অবগাহিত ক্ষেত্র, বীজ বপনের কথা, দুগ্ধবতী শস্যের পরিচর্যা, শস্যদানা, শস্যহীন প্রান্তর, শ্রাবণের মেঘ, বর্ষণের স্নিগ্ধ প্রলেপ, বারিসিক্ত ভূমি, পলিমাটির সৌরভ, সুপ্রাচীন সংগীত’ শব্দসমূহ থেকে কবিতার বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট।

মনিরুজ্জামান এই কবিতা সম্পর্কে বলেন, ‘জন্মভূমি, জন্মভূমির ঐতিহ্য, মা ও কবিতা সম্পর্কে প্রশংসা বাক্য উচ্চারিত হয়েছে। ফলে কবিতাটি দেশপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত বহন করে। তার ইচ্ছা থেকে যে সত্যটি আমরা আবিষ্কার করি তা হলো আনন্দময় উচ্ছ্বাস দ্বারা কবিতাকে ভালোবাসতে হবে। কবিতা জীবনে এক অনিবার্য উপকরণ। কবিতা জীবন, সমাজ, রাষ্ট্রে এক সুন্দর অবিসংবাদিত পরিবেশ তৈরি করে। যেমন- উক্ত লাইনগুলোতে কবিতা ও স্বাধীনতার গুরুত্ব ও গৌরবগাঁথা ব্যক্ত হয়েছে। আবার তাঁর কবিতায় ক্ষোভ ও বিষণ্নতা পরিলক্ষিত হয়’।

(আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ: এক কিংবদন্তী কবি/ মনিরুজ্জামান, দৈনিক জনতা, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ঢাকা)। আর 'বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা' কবিতার প্রতিটি বাক্যে, বুননে, ব্যঞ্জনায় কাদা মাটির খাঁটি ঘ্রাণে, গৌরবে পরিপুর্ণ! এতে তিনি মাঠ, মাঠের মানুষকে নান্দনিক ভাবে তুলে ধরেছেন।

গ্লানি
জাদরেল স্পিকার জব্বার খানের সন্তান আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ অত্যন্ত রুচিশীল উচ্চপদস্থ আমলা ছিলেন। কখনো সচিব, কখনো প্রশাসক, কখনো রাষ্ট্রদূত, কখনো মন্ত্রী। কিন্তু তার প্রধান পরিচিতি কবি হিসেবে। স্বৈরাচার এরশাদের আমলে এরশাদ হঠাৎ একদিন ‘কবি’ হয়ে গেলেন। দেশের প্রগতিশীল কবিরা তখন স্বৈরাচারবিরোধী তীব্র আন্দোলনরত। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ থেকে শুরু করে তরুণ কবিরা গঠন করেন ‘কবিতা পদাবলী’। আর তার প্রতিপক্ষে গড়ে ওঠে ‘কবিকণ্ঠ’। সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, আবুল খায়ের মোসলেউদ্দিন, ইনরান নূর, মোফাজ্জল করিম, হুসাইন মুহম্মদ এরশাদরা আয়োজন করেন এশিয়ান কবিতা উৎসবের। আমলা হবার কারণে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহও এই গ্রুপে ছিলেন। সেইসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের টালমাতাল অবস্থায় বাংলা একাডেমিতে প্রভাতী একুশে কবিতা পড়তে যান এরশাদের কৃষি ও পানিসম্পদ মন্ত্রী আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তখন মোহন রায়হানের নেতৃত্বে সেন্টু ভাইকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তখন তিনি দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। এই নিয়ে এরশাদ ‘অ্যাকশন’-এ যেতে চাইলে সেন্টু ভাই তাতে রাজি হননি। কারণ, তিনি অনেকটা নিরীহ, শান্তিপ্রিয় ও নরম মনের মানুষ ছিলেন। সেই কোমলতা তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়।

শেষ দেখা
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর  জন্ম ১৯৩৪ সালের ০৮ ফেব্রুয়ারি আর পরলোকে পাড়ি জমান ২০০১ সালের ১৯ মার্চ। কিন্তু মৃত্যুর আগে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে কোমায় ছিলেন, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সেইসময় তাকে দেখতে গিয়ে একটি গদ্যকবিতা লিখেছিলাম। আজ সেই কবিতাটি মনে পড়ছে, ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের প্রার্থনায় তৃষ্ণার্ত প্রাণ সুখ-শান্তিতে যৌথ বন্দি, দুই খণ্ডিত বাদামের ঘর। গৃহের ভেতর শাদা কালোর খেলা। দিনরাত্রির এক সন্ধ্যার সন্ধিক্ষণে আলো ও ছায়ার পুলসেরাতের মাঝখানে ঝুলে আছে যেনো জালে আর জলে, আটকে লটকে আছে বাদুরের চিত্রকল্প! জীবন-ঘুম-মৃত্যু মিশ্রিত রোদবৃষ্টির যুগল নিবাস’।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।