ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বাংলাদেশের ভাস্কর্য চর্চা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ | রিঙকু অনিমিখ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৬
বাংলাদেশের ভাস্কর্য চর্চা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ | রিঙকু অনিমিখ

শিল্পকলার যতোগুলো শাখা এর মধ্যে ত্রি-মাত্রা প্রায়োগিক কারণে অন্য শাখাগুলোর চেয়ে ভাস্কর্যের কদর একটু বেশি। প্রথম দিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই ভাস্কর্য চর্চার সূচনা।

তখনও ভাষা পায়নি উচ্চারণের পরিশীলতা, পায়নি বর্ণ-পরিচয়। সেই গুহাকালেই মানুষ শিল্পচর্চা শুরু করে। মূলত তা শিল্পচর্চা ছিলো না, ছিলো বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ- আজকে যাকে যাদু-বিশ্বাস বলা হচ্ছে। আদিমকালে মানুষের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ছিলো প্রকৃতি। শিকার তার প্রধানতম মাধ্যম। আর এই শিকার খুব সহজ ছিলো না। খাবারের নিশ্চিত ব্যবস্থা না থাকায় না খেয়েই থাকতে হতো দিনের পর দিন। তাদের বিশ্বাস ছিলো, পশু-পাখির প্রতিকৃতি সঠিকরূপে উপস্থাপন করতে পারলে শিকার সহজ হয়ে যাবে। বশ মানবে। বস্তুত, এই ধারণা থেকেই শিল্পকলার উদ্ভব। তখনকার বিশ্বাসই আজকের ধর্ম, অনুরূপ তখনকার যাদুই আজকের শিল্প। পরবর্তীকালে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে তা নির্ভেজাল শিল্পবোধ ও সৌন্দর্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।  

‘ভেনাস অফ উলেনডর্ফ’ সবচেয়ে প্রাচীন ভাস্কর্য। আনুমানিক ২৪ হাজার থেকে ২২ হাজার খ্রিস্টপূর্ব সময়কালের। এটি অস্ট্রিয়ার উলেনডর্ফ অঞ্চলে পাওয়া আদি মাতৃকামূর্তি। সেই প্রাগৈতিহাসিক মাতৃকামূর্তির পর যুগ যুগ কাল পার হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়কালে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য। বিশ্ব শিল্পকলার সমৃদ্ধিতে ভাস্কর্যের অবদান অপরিসীম। প্রতিটি সময়, স্থান ও গোত্রের নিজস্ব জীবন পদ্ধতির ইতিহাস ধারণ করে এসেছে এইসব ভাস্কর্য। মানুষ নেই, অথচ সেই আদিম মানুষের সান্নিধ্য এখনও পাওয়া যায় তাদের নির্মিত ভাস্কর্যের স্পর্শে।

ভাস্কর্যের ইতিহাস বহু পুরনো হলেও বাংলাদেশে এর চর্চা বেশিদিনের নয়। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে পাল বংশের হাত ধরে এই ভূখণ্ডে ভাস্কর্য শিল্পের সূচনা। বিশ্ব শিল্পাঙ্গনে ভাস্কর্যের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। কিন্তু আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে শিল্পমাধ্যম হিসেবে ভাস্কর্য কিছুটা নতুন। ১৯৬৫ সালে চারু ও কারু মহাবিদ্যালয়ে ভাস্কর্য বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভাস্কর নভেরা আহমেদের হাত ধরে বাংলাদেশে ভাস্কর্য চর্চার শুরু। পরে ভাস্কর আব্দুর রাজ্জাকের প্রচেষ্টায় ভাস্কর্য শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বর্তমানে দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভাস্কর্য বিভাগটি চালু রয়েছে।

বাংলাদেশে ভাস্কর্যচর্চা গণ্ডিবন্ধ। সিংহভাগ ভাস্কর্যই আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নির্মিত। তবে সবই বাস্তবধর্মী অর্থাৎ মূর্ত, যদিও শিল্প স্বচ্ছ বাস্তবতার চেয়ে এর আড়ালের রুঢ় বাস্তবতাকেই দাবি করে। যা মানুষের ভাবনাকে জীবনের কঠিন ও গুপ্ত বাস্তবতার দিকে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের ভাস্কর্যে যা একেবারেই অনুপস্থিত। ভাস্কর নভেরা আহমেদ এই ধারার প্রথম ও সফল নির্মাতা। পরবর্তীতে এদেশে বিমূর্তধারার ভাস্কর্যচর্চা মিইয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে ভাস্কর্যশিল্পের বাণিজ্যিক কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। শিল্পী নিজেই এখানে প্রতিষ্ঠান। হামিদুজ্জামান খান, শামীম সিকদার, মৃণাল হক, শ্যামল চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া নামি-অনামি অনেক তরুণ শিল্পী এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রে সাধারণত ব্যবহৃত হয় কাঠ, মাটি, পাথর, ধাতু, বালি, সিমেন্ট, ফাইবার, কংক্রিট ইত্যাদি। তবে ভাস্কর্যের কৌশলের সঙ্গে সঙ্গে উপরকরণেরও পরিবর্তন এসেছে। ক্ষেত্র বিশেষে কাচ, প্লাস্টিক, নেট, লোহা, স্টিল ইত্যাদি উপকরণও ভাস্কর্যের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।  

কয়েকটি ধাপে ভাস্কর্য নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। প্রথম কাজটি সম্পন্ন হয় কাদা-মাটি দিয়ে। শিল্পী নিজ হাতে নিখুঁতভাবে এই কাজটি করেন। এরপর মাটিনির্মিত ভাস্কর্যটি কয়েকটা ভাগে ভাগ করে জিপসাম প্লাস্টার দিয়ে ডাইস বানানো হয়। পেশাদার কিছু লোক ডাইস তৈরির কাজ করে থাকেন। এটা তাদের অন্যতম জীবিকা। এই ডাইস থেকেই তৈরি হয় মূল ভাস্কর্য।  

কিছুদিন আগ পর্যন্তও ভাস্কর্য শিল্প ছিলো ধনী ও বুদ্ধিজীবী মহলের সৌখিনতার বিষয়। কিন্তু বর্তমানে এর বিষয়বস্তুর উৎকর্ষ ও ব্যবহারের ভিন্নতায় ভাস্কর্য শিল্প গণমানুষের আপনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শুধু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাতেই নয়, এখন বড় বড় প্রতিষ্ঠান, কলকারখানার সামনে, বাড়ির আঙিনায় এমনকি বিভিন্ন শো-রুমগুলোতেও ভাস্কর্য নির্মাণের আগ্রহ বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে পার্ক। শো-পিস হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হচ্ছে ভাস্কর্য। এজন্য গড়ে উঠছে আলাদা বিপণনকেন্দ্র। শিল্পী নিজেও হতে পারেন উদ্যোক্তা। গড়ে তুলতে পারেন শো-রুম। আমাদের দেশের শিল্পীদের নির্মিত ভাস্কর্য বাইরের দেশেও রফতানি হচ্ছে। এ শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত রয়েছেন তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিগুলোতে নজর দিলে মাধমটির আরও উন্নতির সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৬
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।