ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভ্রমণগদ্য-৮

হংসবৃত্তান্ত ও ইউনিভার্সিটি অব অরেগন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০৫ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৬
হংসবৃত্তান্ত ও ইউনিভার্সিটি অব অরেগন

আজ আমাদের ইউজিন ভ্রমণের মূল আকর্ষণ অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়। তিন শ’ একর জায়গাজুড়ে বনানীময় সবুজ ক্যাম্পাস নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় ১৮৭৬ সালে।

নয়ন জুড়ানো সবুজ মাঠ, স্থাপত্যকারুকাজময় নতুন ও শতবর্ষী হল, প্রশাসনিক ভবন, গবেষণা সেন্টার, ইনস্টিটউট ও ল্যাব পর্যটকের প্রেক্ষণবিন্দুতে ঘুরে দেখা একদিনের কাজ নয়। ক্যাম্পাস ট্যুরে চোখ জুড়ানো ভবন পেছনে রেখে সবুজ চত্বরে দাঁড়িয়ে ছবির পোজ দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য নয় বরং এর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যটি উপভোগ করার জন্য সকালের সোনা রাদে বেরিয়ে গেলাম। অরেগন গ্রাজুয়েট পুত্র পল্লব মাহমুদের সহায়তা ক্যাম্পাস ট্যুর আমাদের জন্য সহজ করে দিলো। উইলামেট নদী তীরে ইউজিন শহরটি গড়ে উঠেছে স্বনামখ্যাত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব অরেগনকে কেন্দ্র করে। এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ই এ শহরের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার প্রাণশক্তি। ‘বি এ্যা ডাক’ বা ‘হাঁস হও’ স্লোগানে ইউনিভার্সিট অব অরেগন-ইউএফও তিন শ’ বিষয়ের ওপর ডিগ্রি দিচ্ছে। দেশ-বিদেশের পঁচিশ সহস্রাধিক ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে হাঁস বা ডোনাল্ড ডাকের সমর্থক হতে আসছে বছর বছর। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণায় নিবেদিত বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক জীবনযাত্রা ও মানবসভ্যতার প্রায় সব দিকের ওপর আলোকপাত করে শিক্ষা গবেষণা করে যাচ্ছে নিরন্তর। শহরের ব্যবসা, বাণিজ্য, জীবনযাত্রায় এমন কোনো বিষয় নেই, যার সঙ্গে ইউএফও যুক্ত নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হচ্ছে শহরের বৃহত্তম অটজেন স্টেডিয়াম, ইনডোর স্টেডিয়াম ম্যাথিউ নাইট এরিনা নামে ঢাউস বাস্কেটবল মিলনায়তন, নাইট লাইব্রেরি, জর্ডান শিনজার শিল্প জাদুঘর, পার্ক, উন্মুক্তস্থান ও অন্যান্য স্থাপনা। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে ১৩ নম্বর এভিনিউয়ে ঢুকলাম। এই অ্যাভিনিউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে পূর্বপশ্চিমে চলে গেছে। ডানে বামে বিভিন্ন ভবন ও কমপ্লেক্স। অ্যাভিনিউর বামদিকে প্রথমে লিলি’জ বিজনেস কমপ্লেক্স দেখলাম। বিজনেস স্টাডিজ বিভাগের ক্লাস ও গবেষণা সেন্টারগুলো এখানে। নতুন ভবনটির কাঁচঘেরা ফটক দেয়ালে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো ইংরেজি অক্ষর ‘ও’ উৎকীর্ণ। কমপ্লেক্সটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক বহন করছে বলে  দর্শনার্থী ও শিক্ষার্থীরা এর  সামনের খোলা জায়গায় জমায়েত হন, কোলাহল করেন, ছবি তোলেন। বিজনেস কমপ্লেক্স বাঁয়ে রেখে ডানদিকে ফাঁকা চত্বরে নাইট লাইব্রেরি ও জর্ডান শিনজার শিল্প জাদুঘর। এগুলো দেখে আমরা অ্যাভিনিউর বাম দিকে কয়েকটি ভবন ও চত্বর পেরিয়ে ভেতরের দিকে ডেডি হলের সামনে গেলাম। এ রাজ্যের প্রথম ফেডারেল জাজ ম্যাথিউ ডেডির নামে এই ভবনটি নামকরণ করা হয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভবন। ইতালিয়ান স্থাপত্যরীতিতে ইটের পর ইট বিছিয়ে কলাম ছাড়া ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। দেড় শ’ বছর ধরে শত সহস্র শিক্ষার্থীর শিক্ষাগ্রহণের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ হওয়ার গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডেডি হল। এর সামনের গাছগুলোর বয়সও কয়েকশ বছর। অদূরেই লুকি সায়েন্স কমপ্লেক্স। অভ্যন্তরীণ পথসংযুক্ত অনেকগুলো আলাদা আলাদা ভবন নিয়ে সায়েন্স কমপ্লেক্স । বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর শিক্ষা ও গবেষণা হয় এখানে। ভবনগুলোর নামও চমৎকার। কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের নাম ডি স্যূটস, ভূতত্ত্ব বিভাগের নাম ক্যাসকেড। এ রকম উইলামেট, অরেগন, ক্লামাথ, প্যাসিফিক, লরেন্স নামের ভবনগুলোতে রসায়ন, পদার্থ, জীববিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের শিক্ষা ও গবেষণা চলছে। আমরা ভবনের ভেতর দিয়ে দেখতে দেখতে পদার্থবিদ্যা বিভাগের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বিভাগের প্রবেশমুখে ডিসপ্লে বোর্ডের ভেতরে বিশ্বের সব পদার্থের অমূল্য প্রদর্শনী আমাদের তাক লাগিয়ে দেয়। আমাদের দলের পল মাস্টার্স শেষ করেছে, তুসু ক্লাস নাইনে। ফিজিক্সে দু’জনের আগ্রহের কারণে তাদের চোখ আটকালো এই বোর্ডে। আমরা ডিসপ্লে বোর্ডে সংরক্ষিত বিশ্বের ধাতু ও পদার্থগুলো দেখতে লাগলাম। কোনটা পানি, কোনটা সোনা, কোনটা তামা, কোনটা অক্সিজেন, কোনটা পটাশিয়াম এসব প্রশ্নে আমাদের অস্ফুট ধ্বনি উঠছিলো এরকম, কই কই অক্সিজেন কই... অন্যজন, পেয়েছি, ওই তো ওই্ তো!ক্যাসকেড নামে গুচ্ছ পাহাড় আছে উইলামেট ভ্যালিতে। এই ভ্যালির চমৎকার প্রকৃতির মধ্যে ইউজিন জনবসতি। ক্যাসেকড নামে ভবনে জিওলজি বিভাগ। দেখলাম, ভেতরে বসে গবেষণারত বেশ কয়েকজন গবেষক। বিভাগের বাইরে ডিসপ্লে বোর্ডে ভূগর্ভের সব খনিজসম্পদ ও পাথর- যা মানবসভ্যতায় অমূল্য ঐশ্বরিক উপাদান হিসাবে যোগ হয়েছে, তার প্রদর্শনী করা হয়েছে। প্রতিটি খনিজ পাথরের গায়ে প্রাপ্তিস্থান ও সংগ্রহের সাল লেখা। ভূগর্ভে কতো ধরনের খনিজ আছে, তা এই অমূল্য পাথর ও খনিজের বিপুল সংগ্রহ না দেখলে বোঝা যায় না। শিক্ষা ও গবেষণাকালে অরেগনের শিক্ষার্থীরা এগুলো সংগ্রহ করেছেন। বর্তমান ও আগামীর শিক্ষার্থীদের জন্য যা এক অতুল শিক্ষা উপকরণ। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ- সে কয়লা, চুনাপাথর, কঠিনশিলা, লিগনাইট হোক কিংবা অমূল্য পাথর...সবই আমাকে প্রাণিত করে। আমাদের দেশের মূল্যবান খনিজ এখনও অজানা। আবিস্কৃত খনিজের মধ্য রয়েছে গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর, সিরামিকসহ নানা সম্পদ। যদিও এ সম্পদের অনেকগুলো অবহেলিত, উন্মোচন অপেক্ষায় কিংবা অনাহরিত। জিওলজি বিভাগে বিশ্বের নানা ভূপ্রকৃতি থেকে আহরিত খনিজের বিশাল সম্ভার আমাকে উৎসাহিত করলো। একই সঙ্গে এক্ষেত্রে আমাদের পশ্চাদপদতা পীড়িত করতে লাগলো। এই ভাবনার মধ্যে ক্যাম্পাসের অন্য বিভাগের দিকে পা বাড়ালাম। এই লেখা শুরু করেছি হাঁস প্রসঙ্গ উল্লেখের মধ্য দিয়ে। অরেগন রাজ্যের প্রকৃতি অসংখ্য জীববৈচিত্র্যের আঁধার। ৩৬ প্রজাতির বুনোহাঁস এ রাজ্যের উল্লেখযোগ্য প্রাণিসম্পদ। অরেগন-ইউজিনের আকাশ, নদী, বন, পাহাড় তাই লাখ লাখ হংসপ্রজাতির অভয়ারণ্য। শিকারের ক্ষেত্রেও শখের শিকারিদের নানা বিধিনিষেধ মানতে হয়। এই হংসকে তুলে ধরার জন্য হোক আর অন্য কারণে হোক অরেগন বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেট দলগুলোর মাস্কাট হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে ওয়াল্ট ডিজনির বিশ্বখ্যাত চরিত্র ‘ডোনাল্ড ডাক’ নামের হলুদ ঠোঁটের কার্টুন হাঁস। ফুটবল, বাস্কেটবল, টেনিস, গলফসহ সব খেলার ক্ষেত্রেই রয়েছে অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্ন ভিন্ন টিম। ডোনাল্ড ডাক মাস্কাটটি হচ্ছে এই দলের সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয় ও ঐক্যের প্রতীক। ডোনাল্ড ডাকের রঙে রঙিন জার্সি, টুপি, ব্যাগ ও স্যুভেনির অরেগন শিক্ষার্থীসহ সমর্থকদের আরাধ্য। চাহিদা মেটানোর জন্য ক্যাম্পাসসহ নানা জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে চেইন ডাক স্টোর। অরেগন শিক্ষার্থীদের প্রেরণা ‘ওয়ান্স এ্যা ডাক ইজ অলঅয়েজ এ্যা ডাক’। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম স্লোগান বি এ্যা ডাক, বা ‘হংস হও’। সদ্য সমাপ্ত সমাবর্তনেও বলা হলো, ‘ডাক’ হিসেবে তোমরা এতোদিন বিশ্ববিদ্যালয় নামের পুকুরে ছিলে, ডিগ্রি পাওয়ার পর এখন কর্মজীবনের বিশাল সমুদ্রে গিয়ে পড়লে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেলো, অরেগন ডাক নামের অ্যাথলেট দলগুলোর জয়-পরাজয় ইউজিনসহ পুরো আমেরিকার টি-টেবিল আলোচনার অন্যতম বিষয়। সব বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজের রয়েছে আলাদা মাস্কাট। হোটেল, রেস্তোরাঁ সর্বত্র  আলোচনার কেন্দ্রে থাকে ডাকের সঙ্গে অন্য মাস্কাটের জয়-পরাজয়ের তুলনা। ডাক দল নিয়ে আপডেট থাকা এখানে পৌরুষের প্রতীক।

আমাদের বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের প্রতীক ‘টাইগার’র  মতো এই অরেগন ডাক। এ নিয়ে আলোচনা বিতর্কে অংশ নিতে পারে না যে, তাকে পাত্তা দেয় না সমর্থকরা। এ কারণে পরিচ্ছদ ও চেতনায় ডোলান্ড ডাকের রঙে নিজেদের করে রাখে আপাদমস্তক রঙিন।

**গড়াই থেকে উইলামেট। । নদী নির্জন বুনো পথ পরিভ্রমণ
**ইউজিন শহর। । দরজায় অচেনা আগন্তুক
**আলোকচিত্রের জন্য মার্কিন মুলুকে

**আমেরিকায় বয়ে নেওয়া বাক্সভরা আবেগ
** চিকেন চাইতেই এলো সিগারেট!
** সাড়ে তিন ঘণ্টার উড়াল ও ম্যাদোনা

বাংলাদেশ সময়: ০৫০১ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৬
আইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।