ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কালজয়ী গানে যুগে যুগে ঈদের আনন্দ (দ্বিতীয় পর্ব)

সৈয়দ ইফতেখার আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২২ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০১৬
কালজয়ী গানে যুগে যুগে ঈদের আনন্দ (দ্বিতীয় পর্ব)

ঢাকা: বাংলার ঘরে ঘরে আজ ঈদের আনন্দ। সবাই মেতেছে উৎসবে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা দোলাচল থাকলেও এই একটি দিন যেন আনন্দকে আপন করে পাওয়ার!

ধনী-গরিব প্রত্যেকের জন্য গত ৮৪ বছর ধরে এই পবিত্র ঈদ আমেজে জাগানিয়া সংগীত নজরুলের সেই বিখ্যাত ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...’।

গানটির মাহাত্ম্য কতোখানি হলে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবারই পছন্দের হয়ে উঠতে পারে জাতীয় কবির এ অমর সৃষ্টি! যা আজও ভাবলে অবাক করে। গানের প্রথম গায়ক আব্বাস উদ্দিন আহমেদের স্মৃতিচারণ থেকে উঠে আসে এর সৃষ্টির ইতিহাস।

আব্বাস উদ্দিন একদিন কাজী নজরুল ইসলামকে বলেন, ‘কাজীদা, এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল- এরা উর্দু কাওয়ালি গায়, তাদের গান শুনি বেশ বিক্রি হয়। এ ধরনের বাংলায় ইসলামি গান হলে কেমন হয় দাদা? তারপর আপনি তো জানেন- কীভাবে আপনাকে কাফের-ইসলামবিরোধী বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে অগ্রহণযোগ্য করে রাখার চেষ্টায় আদাজল খেয়ে লেগেছে একদল কট্টর’।

আব্বাস উদ্দিন নজরুলকে আরও বলেন, ‘আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান’।

কথাটি কবির মনে লাগলো। কবি ঘরে ঘরে জয়গান তুলে দিলেন!

বিদ্রোহী কবি তার চেতনায় জেগে উঠলেন। নজরুল পাল্টা বললেন, ‘আব্বাস, তুমি ভগবতী বাবুকে বলে তার সময় নাও, আমি গান কখন লিখবো তা বলতে পারছি না। তিনি সময় দিলে আমি ভেবে দেখবো’।

পরে আব্বাস উদ্দিন আহমেদ ভগবতী বাবুকে-অর্থাৎ গ্রামোফোন কম্পানির রিহার্সাল-ইন-চার্জকে জানালেন। কথাটি শুনে তিনি এক শব্দে ‘না’ করে দিলেন। জানিয়ে দিলেন, ‘ওসব গান চলবে না। এমন গান বাংলায় হতে পারে না’।

তখন অবশ্য ভগবতী লাভ-ক্ষতি চিন্তা করেননি। প্রচলিত ধারণা থেকে সরাসরি না করে দেন। এতে মনের দুঃখ মনেই চেপে গেলেন আব্বাস উদ্দিন।

এর প্রায় ছয় মাস পর বৃষ্টি ভেজা দুপুর। আব্বাস উদ্দিন গ্রামোফোন কম্পানির রিহার্সালে গেলেন। গিয়ে দেখলেন, বৃদ্ধ ভগবতী বাবু, বৃদ্ধা আশ্চর্যময়ীর সঙ্গে বেশ হাসি-খুশি গল্প করছেন। আব্বাস উদ্দিন নমস্কার দিতেই ভগবতী বললেন, বসুন। তিনি তার রসাপ্লুত মুখের দিকে চেয়ে ভাবলেন, এখনই তো মনে হয় উত্তম সুযোগ।

আব্বাস উদ্দিন আবারও বলে ফেললেন। বলে দিলেন তার সেই পুরনো কথা। ‘যদি কিছু মনে না করেন- সেই যে বলেছিলাম- ইসলামি গান দেওয়ার কথা, আচ্ছা একটা পরীক্ষা করে দেখুন না, যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কী’?

এতে ভগবতী বাবু হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি! আচ্ছা, করা যাবে’।

তখন পাশের ঘরে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন। ইন্দুবালা তার কাছে গান শিখছিলেন। আব্বাস উদ্দিন নজরুলকে বললেন, ‘ভগবতী বাবু রাজি হয়েছেন’।

নজরুল বলে উঠলেন, ‘ইন্দু, তুমি বাড়ি যাও, আব্বাসের সঙ্গে কাজ আছে’। এরপর ইন্দুবালা চলে গেলে নজরুল এক ঠোঙা পান আর চা আনতে বললেন সহকারী দশরথকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধা ঘণ্টার মধ্যেই লিখে ফেললেন ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...’। ব্যস হয়ে গেলো গান। তখনই সুর যোগ করে শিখিয়ে দিলেন আব্বাসকে।

এরপর আবার পরের দিন লিখলেন ‘ইসলামেরই সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর’। গান দু’টি লেখার ঠিক চারদিন পরই রেকর্ড হয়। তবে কেমন যেন অধৈর্য হয়ে যান নজরুল। তার চোখে-মুখে উত্তেজনা ও আনন্দ খেলা করতে থাকে।

যেদিন ‘ও মন রমজানের’ রেকর্ড ছিল সেদিন পর্যন্ত গানটি ঠিক মতো মুখস্থ হয়নি আব্বাসের। তখনকার দিনে যন্ত্র ব্যবহার হতো শুধু হারমোনিয়াম ও তবলা। নজরুল যা লিখেছিলেন, মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর ঠিক আব্বাস উদ্দিনের চোখ বরাবর সে কাগজখানা ধরলেন তিনি নিজেই। আব্বাস উদ্দিন গেয়ে চললেন। হতে থাকলো প্রথম ইসলামি গান রেকর্ড।

নজরুল ১৯৩১ সালের শেষের দিকে গানটি লেখেন। রেকর্ড হওয়ার মাস দুয়েক পরই ছিল পবিত্র ঈদ-উল ফিতর। আর ঈদের সময়েই রেকর্ডটি বাজারজাত করে গ্রামোফোন কোম্পানি। রেকর্ড নং-৪১১১, প্রকাশকাল ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। সে রেকর্ডটির সুবাদেই আজ থেকে প্রায় ৮৪ বছর আগে শ্রোতাদের কানে কানে প্রথমবারের মতো পৌঁছে যায় ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি। আর কালজয়ী এ গানেই যুগে যুগে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি হতে থাকে প্রতিটি বাঙালি হৃদয়ে।

পুরো গানটি

ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তোরে মারলো ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ।

**ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ

বাংলাদেশ সময়: ০৭১৮ ঘণ্টা, জুলাই ০৭, ২০১৬
আইএ/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।