ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সাহসী সত্তর/ পর্ব-৩

শিহাব সরকার: বনগহনের নিবিড় হাতছানি 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০১৬
শিহাব সরকার: বনগহনের নিবিড় হাতছানি 

শিহাব সরকার: বনগহনের নিবিড় হাতছানি 
কাজী জহিরুল ইসলাম 

বাংলা কবিতায় ব্যাপকভাবে স্লোগানের অনুপ্রবেশ ঘটেছে সত্তরের দশকে। এই দশককে উচ্চকিত, কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে, স্লোগানসর্বস্ব কবিতার দশক হিসেবেও সনাক্ত করেছেন।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই দশকে স্লোগানসর্বস্ব কবিতা যা লেখা হয়েছে তার অধিকাংশই লিখেছেন পঞ্চাশ এবং ষাটের কবিরা। কবিতায় স্লোগান কতোটা গ্রহণযোগ্য সে এক অন্য বিতর্ক, আজ সেই বিতর্কে না গিয়ে এই দশকের ক’জন প্রধান কবির একজন কবি শিহাব সরকারের কবিতা নিয়ে আলোচনা করবো, তার কবিতায় স্লোগান কতোটা এসেছে তা দেখার চেষ্টা করবো এবং তার কবিতার বৈশিষ্ট্য শনাক্তকরণে সচেষ্ট হবো। হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং দাউদ হায়দার এই দশকের কবি হলেও এই তিনজন কবিকে সত্তরের কবি হিসেবে যতোটা না দেখা হয় তার চেয়ে বেশি দেখা হয় ও আলোচনা-সমালোচনা করা হয় তাদের অন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে।  

সত্তরের কবিতার মূল সুর থেকে শিহাব সরকার বিচ্ছিন্ন থেকেছেন, সম্ভবত সচেতনভাবেই। অর্থাৎ শিহাব সরকারের কবিতা উচ্চকিত-তো নয়ই, বরং খানিকটা যেনো বেশিমাত্রায় ম্রিয়মান। তিনি মূলত রোমান্টিক ধারার কবি। এক ধরনের মুগ্ধতার ঘোরে আচ্ছন্ন তার কবিতা। ভাষাটি সাবলীল কিন্তু নিস্তরঙ্গ।  

‘হাইরাইজ উঠে গেলো, কোথায় মাটি, গাছতলা
আমাদের গলির মুখে ট্রাক থেকে
নামে ইট কাঠ লোহা বালু
উঠছে ছ’তলা শপিং কমপ্লেক্স
হলুদ বাড়িটা ভাঙা হয়ে গেছে
নন্দী কুটিরের নাম মুছে যাবে পাড়ায়,
কোন সালে উঠেছিলো এ বাড়ি
জানা যেতো বরুণ নন্দীর কাছে
তাঁর ছেলেরা আছে কলকাতা, শিলিগুড়ি

শ্যাওলা-ভেজা প্রাচীন ইটের স্তূপ সুরকি।
বাড়ি ভাঙা হয়ে গেছে
ফটকে বকুল গাছ লাল ধুলোতে ছাওয়া
দীর্ঘশ্বাস চাপে তরুণ স্থপতি-
দালান না ভেঙ্গেও দালান তোলা যায়
শতাব্দীর ধ্বনি লেগে ছিলো বাড়িটার গায়ে

কোনো বাড়ি থাকে না চিরতরে
বৃষ্টি রৌদ্র হাওয়ার নুন বুনো গুল্মলতা
আর সময়ের ক্ষুধার কাছে দালানের
স্পর্ধা ও যৌবন নিভে আসে’

(কবিতাঃ এইসব বাড়ি, কাব্যগ্রন্থঃ মেরিলিন ঐ যে গুহা)

‘সময়ের ক্ষুধার কাছে দালানের/স্পর্ধাও যৌবন নিভে আসে’ এই পঙক্তিদ্বয়ের মধ্য দিয়ে কবিতাটি পৌঁছে যায় এক ভিন্ন উচ্চতায়। তিনি পাঠকের বোধে প্রচণ্ড নাড়া দিয়ে শুনিয়ে দেন নির্মম সময়ের ঘণ্টাধ্বনি। সকল স্পর্ধাই শেষপর্যন্ত সময়ের কাছে অসহায়, নতজানু। একই গ্রন্থের অন্য একটি কবিতায়ও তিনি সময়কে টেনেছেন নির্মমতার চালিকা শক্তি হিসেবে। ‘অবশেষে স্মৃতি সব খায়, যদিও/ থাকে চকিত মুখ, গানের কলি, অন্ধকার নদীও/ সহজ ঘুমের রাত্রিকে খুব টালমাটাল করে,/ ধূসর ক্যানভাসে অবিরল পাতা ঝরে/ মধ্যরাতে ঘুমুবার আগে শুভ্র রুমালে হলুদ/ স্মৃতির নিঃশ্বাস পড়েছে, বুকে কোথাও বুদবুদ,/ দাগ থেকে যায়, তিন যুগ পরেও মুছবে না?/ স্মৃতির ভিতরে পরম বাঁচা, ভাঁড়েরা তা বুঝবে না’ (ক্রিসেন্থিমাম)। কবিতাটির শেষ শব্দ গুচ্ছ, ‘ভাঁড়েরা তা বুঝবে না’ অভিব্যক্তিটি বাহুল্য, অনভিপ্রেত। এই শব্দগুচ্ছে কবির অসহিষ্ণু ব্যক্তি চরিত্রের প্রকাশ ঘটেছে। অন্তমিলের স্বার্থে অনেক কবিই এমন অপরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন, একজন প্রকৃত কবিকে এইসব বিষয়ে সচেতন থাকতে হয়।  

তিয়াত্তর সাল থেকে বিরাশি সাল পর্যন্ত রচিত কবিতাগুলো নিয়ে বেরিয়েছে শিহাব সরকারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লালযৌবনদিন’। এই গ্রন্থটিই মূলত আমাদের সাহায্য করে খুঁজে পেতে সত্তরের শিহাব সরকারকে। গ্রন্থটির শিরোনামে সত্তর পুরোপুরি উপস্থিত। সদ্যস্বাধীন দেশের কুড়িউত্তীর্ণ এক টগবগে তরুণের কাব্যগ্রন্থের শিরোনামে ‘লালযৌবন’ খুবই সঙ্গত এবং তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু কাব্যগ্রন্থটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই ‘লালযৌবন’কোথাও হারিয়ে যায়, সেখানে ভেসে ওঠে শান্ত, স্নিগ্ধ, ধীর-স্থির এবং বেশ খানিকটা পরিণত কবির অবয়ব।

‘নদীর ধারে যেতে যেতে মনে হয় যাচ্ছি জলভ্রমণে
বহতা স্রোতের প্রতি তোমার কী অদ্ভুত গাঢ় টান,
নদী একদিন পাহাড় তছনছ করে ছুটে এসেছে
আমাদের লোকালয়ে
তার দু’ধারে সমাহিত নিগুঢ় জনপদ।
দেখে আমরা চিত্তে খুব সুখ পাই

মানুষের পদ্মা ভোলগা দানিয়ুব ইত্যাদি প্রচুর
টলটলে উদ্দাম নদী আছে
জল আমাদের পূর্বপুরুষের ধমনীতে
কামনার ঝড় তুলেছিলো
একসঙ্গে অনেক জল দেখে উদাস হয়ে পড়ি
বুকের ভিতরে এমন করে!’
(চাঁদের আশ্চর্য ভূত) 

‘মধ্যদুপুরে এইসব মিশ্র তৎপরতা দেখে
আমার পায়ের ডিম শক্ত হয় ক্রমশ
উদ্ধত হয়ে ওঠে শিরদাঁড়া
চিৎকার করে বলি, আমার কোনো স্মৃতি নেই দাহ নেই
আমি শুধু বাঁচবো।
বন্ধু পরমাত্মীয় থেকে রক্ত বৈরী
যেখানে যাই খুব ভালোবাসা-টানমমতা-টান
তারপর সন্ধ্যা হয়, রাত যত বাড়ে
আকাশ কেবলি উঁচুতে উঠতে থাকে’
(রাত যত বাড়ে)

‘মোমবাতি জ্বেলে তুমি বসে আছো, আমাকে
গতরাতের উল্টানো ইজেল, তছনছ দোপাটি বাগান
দেখাবে বলে আলো উঁচু করে ধরেছিলে
চেতনা চৌচির করে কেন
এইসব অশ্লীলতা, রক্ত, জালিয়াতি…

তার চেয়ে ওষ্ঠে বিষ ছোঁয়ালে না কেন?’
(অন্ধকারে হরিৎ প্লাবনে)   

প্রথম কবিতাটিতে কবি নদীপ্রসঙ্গে মানুষের ভেতরের নদীর উদ্দামতাকে তুলে এনেছেন। ‘মানুষের পদ্মা ভোলগা দানিয়ুব ইত্যাদি প্রচুর/ টলটলে উদ্দাম নদী আছে’। সেই নদীতে ঢেউ ওঠে, কখনো উথাল-পাথাল ঢেউ, সেই ঢেউয়ে পাড় ভাঙে, মন ভাঙে আবার জেগে ওঠে প্রত্যাশার নতুন চর। নদী যেমন ভাসিয়ে নিয়ে যায়, আবার আমাদের ফসলের/প্রত্যাশার ভূমিকে করে তোলে উর্বরা, নদীতে জেগে ওঠা নতুন চরে নতুন জীবনের উন্মেষ ঘটে। কবিতাটি পাঠককে এমন অনেক ভাবনার গভীরে নিয়ে যায়, এলোমেলো করে দেয়। তবে কবিতায় ‘ইত্যাদি’ শব্দটি খানিকটা অকাব্যিক প্রয়োগ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। ‘রাত যত বাড়ে’ কবিতাটির কয়েক ছত্রে খানিকটা বিপ্লবের আভাস দেখা গেলেও তা মোমের স্নিগ্ধ আলোর মতোই রোমান্টিক। ‘আমার কোনো স্মৃতি নেই দাহ নেই/ আমি শুধু বাঁচবো। / বন্ধু পরমাত্মীয় থেকে রক্তবৈরী/ যেখানে যাই খুব ভালোবাসা-টান মমতা-টান/ তারপর সন্ধ্যা হয়, রাত যত বাড়ে/ আকাশ কেবলি উঁচুতে উঠতে থাকে’ পঙক্তিগুচ্ছে, যেন পূর্বনির্ধারিত এবং অবধারিত, নিয়মের টানেই মুখ থুবড়ে নেতিয়ে পড়ে বিপ্লব, সমর্পিত হয় প্রেমে। কখনো কখনো প্রেমেও মানুষ হয়ে ওঠে বিপ্লবী, হয়ে ওঠে আগ্রাসী। ‘অন্ধকারে হরিৎ প্লাবনে’ কবিতায় সেই আভাস জেগে উঠলেও তা ‘চেতনা চৌচির করে কেন/ এইসব অশ্লীলতা, রক্ত, জালিয়াতি…’ প্রশ্নের ঘায়ে যেন আত্মহননের পথই বেছে নেয়।

সত্তরের দশকের এই কবি বিপ্লবের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন, ‘বিপ্লব ও ক্লোরোফরমে’ কবিতাটি লিখে। ‘আমাদের মাঝখানে আর কখনো ছিল না এমন মসৃণ সেতু/ পুরুষ তার নারীকে নিয়ে যাচ্ছে গহীন মধুচন্দ্রিমার তীরে/ এসব আবোল তাবোল বশীকরণের চাপে/ রক্তে জমে গিয়েছে অনেক চোলাই মদ/ তুমি কি জানো বিপ্লব ও ক্লোরোফরমে দূরত্ব খুব বেশী নয়?’ এরপর ক্লোরোফরমের প্রভাবে কবি শিহাব সরকারের বিপ্লব ঘুমিয়ে পড়ে চিরদিনের মতো।

রোমান্টিক ধারার এই কবি পয়ার রচনায় দক্ষতা অর্জন করেছেন একেবারে গোড়া থেকেই। অক্ষরবৃত্ত এবং মুক্তক ছন্দেই তিনি লিখেছেন তার আধিকাংশ কবিতা। আঙ্গিকগত বৈচিতত্র্যহীনতা কবি শিহাব সরকারের একটি দুর্বল দিক। গদ্যছন্দে পয়ার রচনা করতে গিয়েও তিনি তার নিজস্ব একটি কাব্যভাষা নির্মাণ করতে পারেননি। তাই তাকে একজন স্বতন্ত্র কবি হিশেবে সনাক্ত করা উত্তর প্রজন্মের জন্য কষ্টসাধ্য হবে। ত্রিশের এবং পঞ্চাশের কবিদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে তার কবিতায়। রয়েছে ঔপনিবেশিক শব্দপ্রীতি।  

কদাচিৎ দেখি তিনি তার নিজস্ব আঙ্গিনা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছেন, তবে সে চেষ্টা খুব সফল হয়নি।  অল্প কিছু সমিল পঙক্তি রচনার চেষ্টা করেছেন সেখানেও নবিশসুলভ ভুল রয়ে গেছে। এরকম কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে।

মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত ‘জয় হবে দীর্ঘশ্বাসে’ কাব্যগ্রন্থের ‘দেখতে দেখতে’ কবিতায় তিনি ‘মেঘে’র সাথে ‘চেখে’ এবং ‘দীঘি’র সাথে ‘লিখি’ অন্তমিল ব্যবহার করেছেন। ‘বসন্ত বাছে মানুষ’ কবিতায় ‘ডাকি না’ এর সাথে তিনি অন্তমিল দিয়েছেন, ‘মাছিকে না’। ‘স্যুভেনির’ কবিতায় তিনি ‘নীরব মৃত্যু’র সাথে ‘আমারও মৃত্যু’ অন্তমিল দিয়েছেন। ‘শান্তি যা তা বনগহনে’ কবিতায় তিনি ‘কুশলী’র সাথে ‘বুলি’ এবং ‘পাতা ঝরা’ র সাথে মিল দিয়েছেন ‘সালোমেরা’ শব্দের।  

শিল্পতরু থেকে প্রকাশিত ‘করো গান বন জ্যোৎস্নার’ কাব্যগ্রন্থের ‘এ মুকুটে’ কবিতায় যখন তিনি ‘দাড়ান রাজা’র সাথে ‘মানায় রাজা’ মিল দেন তখন এটাই স্পস্ট হয়ে ওঠে যে অন্তমিল নির্মাণে এই কবি একেবারেই আনাড়ি।  

যে গদ্যছন্দ পঞ্চাশের কবিদের বিচরণক্ষেত্র তাকেই আরাধ্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন শিহাব সরকার। সেখানেই তিনি স্বচ্ছন্য্ম। গদ্যছন্দের ভুবন থেকে বেরিয়ে এসে আঙ্গিকগত বৈচিত্র নির্মাণের প্রয়াসে তিনি খানিকটা সফলতা অর্জন করেছেন এই মাত্রাবৃত্তের কবিতাটিতে- 

‘সহসা আমার ইচ্ছে হলো এক লহমা থামি
ফণীমনসায় রক্তাক্ত, জানেন অন্তর্যামী
ভুল বুঝবার অবকাশে রাত্রি দীর্ঘ হয়
ফুল থেকে দূরত্ব বাড়ে, খারাপ হাওয়া বয়।

‘এই বিরতি ভুডু নৃত্যের, খুলিতে মদ খাওয়ার
তড়িতি ওকে ত্যাজ্য করো, সব নগ্ন-অনাচার’,

কথায় কথায়, ভ্রমণে বা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে
ঝরায় ওরা মরিচগুড়ো পতিতজনের ত্বকে
এমন হবে জেনেই খুঁজি অমাবশ্যার কোল
তেমন পাপ করেছি কই, অযথা কল্লোল।

বিস্মরণের মুহূর্তগুলো কোন নদীতে যায়?
বনগহনের হাতছানিতে যুবতী নিরুপায়।

এ ধরণের রহস্য কিছু থাকুক ধমনীতে
মনপবনের নাও ছুটেছে প্রলয় রজনীতে।

এমনও হতে পারে কিন্তু, ফিরে আসবো না
সে মনও মরে, শখ ছিলো যার নির্জনে জাল বোনা। ’
(প্রলয় রজনীতে, কাব্যগ্রন্থ: ব্যাবিলন এক্সপ্রেস)

অন্য অনেকের মতো তিনিও অগ্রজ কবিদের নিয়ে বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন, এটি তার অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধেরই বহিপ্রকাশ যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি পঞ্চাশের দুই প্রধান কবি শহীদ কাদরী এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখেছেন যথাক্রমে, ‘টেলিফোনে শহীদ কাদরী’ এবং ‘চলি হে, চলি কোলকাতা, চলি কৃত্তিবাস’। তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়েও একটি কবিতা লিখেছেন, ‘আজ বর্ষবরণের যত উৎসব’। তিনটি কবিতাই সংকলিত হয়েছে তার ‘ব্যাবিলন এক্সপ্রেস’ কাব্যগ্রন্থে।  

নতুন ধরণের উপমা, উৎপ্রেক্ষা, নতুন ধরনের শব্দবিন্যাস শিহাব সরকারের কবিতায় তেমন পরিলক্ষিত হয় না। বরং তিনি কিছু বিদেশি শব্দ এবং বিদেশি নাম ব্যবহার করে আধুনিকতার জানান দিতে চেয়েছেন বলেই মনে হয়েছে, যা ত্রিশের এবং পঞ্চাশের কবিদের একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো। ভাল কবিতায় পঙক্তির যে শক্তি থাকে যা পাঠকের বোধকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়, স্যামুয়েল কোলরিজের ভাষায়, ‘শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাস’, তা শিহাব সরকারের কবিতায় বিরল হলেও একেবারে অনুপস্থিত নয়। ‘তোমার ক্ষত্রিয়’ কাব্যগ্রন্থের ‘চলে এসো মঞ্চের পেছনে’ কবিতাটির ভিন্ন উপস্থাপন পাঠককে আন্দোলিত করে-

‘তুমি যেখানেই থাকো নমিতা
এলোমেলো সাজঘরে প্যান্ডেলের মাঝখানে লোলুপ জটলায়
এক্ষুণি চলে এসো মঞ্চের পেছনে
তোমার জন্য পৃথিবীর সমস্ত ঘড়ি
এগারোটা ঊনষাট মিনিটে স্থির হয়ে আছে
তোমার জন্য আমরা আজ ঘুমুতে পারছি না

গাছ ও পাখিদের আরো একদিন আয়ু কমে গেলো
বুড়ো হয়ে এলো বামন
খঞ্জ বদমাশ, তুচ্ছ ও মহামানবেরা
পৃথিবী ও তারাপুঞ্জের বলয়ে বৃত্তাকার ঘুরে ঘুরে
লক্ষ কোটি আলোকবর্ষের একটি মুহূর্তে
আরো কিছুটা ম্লান হয়ে এলো চাঁদ

তুমি কেন এই ভৌতিক মুখোশের নাচে
নৃত্যপটীয়সী অমোঘ নায়িকার ভূমিকায় ডুবে আছো
এইসব বিচলিত যৌনকাতর যুবকেরা
ভোরবেলা তোমার ছিন্নভিন্ন শরীরের ছাই, ঘৃণা ও বমন থেকে
তুলে আনবে বিনাশী পদ্মের প্রতীক,
আমাদের শৈশবের বুক ফেটে যাচ্ছে
তোমার মা ও মাতামহীদের অভিশপ্ত জারজ ফুলের ঘ্রাণে

আমরা তোমাকে মধুর মৃত্যুর মতো চাই সাধারণ বাঙালী নারী
তোমার জন্য নমিতা, শুধু তোমার জন্য
পৃথিবীর সমস্ত ঘড়ি...’

এই কবিতায় তিনি বিষয়বস্তুকে একটি গল্পের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন এবং শেষের দিকে গিয়ে প্রত্যাশাটি ব্যক্ত করেছেন। কখনও কখনও কবিতায় গল্পের দাবি প্রবল হয়ে ওঠে, কবি শিহাব সরকার এই বিষয়ে উদাসীন থেকেছেন আধিকাংশ সময়েই। একই কাব্যগ্রন্থের ‘তুমি ও তোমার কাকাতুয়া’ কবিতাটিকেও তিনি একটি গল্পের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন বলে তার বিবরণমূলক কবিতার ভিড়ে এটিও উজ্ব্ ল হয়ে ওঠে।

‘উত্থান হয়ে গেল কাল
নতুন দেয়াল উঠছে, রাস্তায় আলোকোজ্জ্বল কাতান, জামদানী
জন্মদিনের মঞ্চে বিষণ্ণ হচ্ছেন কবি, বড় একা
তুমি ও তোমার পোষা কাকাতুয়া
আমার পদ্যে চমৎকার উপমা হবে’

এই গল্পের শ্লেষটি আরো তীব্র হয়ে ওঠে কবিতার শেষ অংশে গিয়ে যখন কবি বলেন-

‘শহীদ মিনারে একজন অনার্য ফুল দিতে এসেছিলো বলে
অপর আর্যরা ক্রোধে ঘৃণায় ভেঙে দিতে চায় মিনার স্তম্ভ
দীঘির নীচে পড়ে থাকা শিল্পকলার গৌরব
একদিন ভোরে উঠে আসবেই
বসে থাকতে থাকতে এক’শ পেরুলো বোকা প্রত্নতত্ত্ববিদ
কাঁচাসোনা রোদে তোমার ও আমার রাষ্ট্রদ্রোহিতা আশ্চর্য স্বাভাবিক’

বনগহনের এক নিবিড় হাতছানি তার কবিতার শরীরজুড়ে বসন্তের হাওয়ার মতো দুলতে দুলতে প্রবাহিত হচ্ছে, একই তালে, একই লয়ে। স্নিগ্ধটার এই ঘোর পাঠককে সহজেই কাছে টানে, নিমগ্নতার আবেশ তৈরি করে কিন্তু বৈচিত্য্ হীনতার কারণে তা পাঠককে দীর্ঘসময় ধরে রাখতে পারে না। এই নিস্তরঙ্গ সুন্দর একসময় একঘেয়ে হয়ে আসে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ০৮, ২০১৬
এসএনএস

** সানাউল হক খান: একজন স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পী
** 
** আবিদ আজাদ: বহুমাত্রিক কবি

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।