ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

‘গান আইল্যান্ড’: মনসার অভিশাপ, দেশান্তর, জলবায়ু পরিবর্তন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৭ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২০
‘গান আইল্যান্ড’: মনসার অভিশাপ, দেশান্তর, জলবায়ু পরিবর্তন

জরৎকারুমুনেঃ পত্নী ভগিনী বাসুকেরপি।
আস্তিকস্য মুনের্মাতা মনসাদেবি নমোহেস্তুতে।। 
 প্রাচীন প্রার্থনা মন্ত্র 

Water is anything but calm, quiet or tranquil. It is a restless element– Amitav Ghosh, author 

Bangladeshis would rather swim in the ocean and reach Italy than come to [any other country]- Syed Muazzem Ali (1944-2019), veteran diplomat

সমুদ্রযাত্রা সবসময়েই অমিতাভ ঘোষকে আকর্ষণ করেছে। ‘আইবিস ট্রিলজি’ তাঁর একটি মহৎ সৃষ্টি। মহাচীনের সাথে আফিম যুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমুদ্র-বাণিজ্য নিয়ে সী অফ পপিস (২০০৪), রিভার অফ স্মোক (২০১১), ফ্লাড অফ ফায়ার (২০১৫) নামের এই বিশালকায় উপন্যাসত্রয় একুশ শতকের একটা বড় সাহিত্য অর্জন নিঃসন্দেহে। এই সমুদ্র-প্রীতির ধারাবাহিকতায় বাঁদাবন আর লোনাপানির টান অমিতাভকে সুন্দরবনের দিকেও টেনেছে। তার পূর্বতন “দ্য হাংরি টাইড” (২০০৪) উপন্যাসেও সুন্দরবন প্রেক্ষাপটে ছিল। 

অমিতাভের সাম্প্রতিকতম রচনা “গান আইল্যান্ড”-এও (২০১৯) রয়েছে সেই বাঁদাবন, লোনাপানি, ম্যানগ্রোভ আর কর্দমাক্ত সলিলের উপাখ্যান। এই উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘বন্দুকী সদাগর’ এবং তাকে ঘিরে ফেনিয়ে ওঠা মিথ।

সুন্দরবনের ভেতরে কোনো এক চরের উপকণ্ঠে একটি প্রাচীন দেউলের সন্ধান পান উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট দীননাথ দত্তের বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়া। কোনো এক অদ্ভুত কারণে বইপড়ুয়া দীননাথ, আমাদের দীনু, ছুটে গেলেন সুন্দরবনের জলা-জঙ্গল পেরিয়ে সেই মন্দিরের বা ধামের খোঁজে। দীনু, ম্যানহাটান-ভিত্তিক একজন ‘রেয়ার-বুক ডিলার’– প্রাচীন ও লুপ্তপ্রায় গ্রন্থের ব্যবসা করে তিনি চলেন। পিএইচডি করেছেন মঙ্গল-সাহিত্যের বিষয়ে। পৈতৃক ভিটা যদিও মাদারিপুরে, কিন্তু সেটা তাকে কোনো অতিরিক্ত পিছুটান দেয় না। তার পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা কলকাতাতেই। ম্যানহাটান আর কলকাতা– এই মোটামুটি তার চরাচর। বিবাহ-টিবাহ নেই, খুচরো সম্পর্ক, আর তরুণ বয়সের অসমাপ্ত একটি প্রেম, নায়িকা নকশালের অন্তর্দ্বন্দ্বে নিহত হন। তো এই বন্দুকী সদাগরের ধাম খুঁজতে গিয়েই দীনুর পরিচয় পিয়ালীর সাথে, যে কিনা একজন মেরিন বায়োলজিস্ট। সুন্দরবনের ফ্লোরা ও ফনা নিয়েই তার গবেষণা এবং অ্যাক্টিভিজম। তাদের একটি সংগঠন আছে- পরিবেশ বিষয়ক, তারাই দীনুর জন্য সুন্দরবনে অভিযানের ব্যবস্থা করে দেয়। সেখানে গিয়ে সে ঐ প্রাচীন ধামটি খুঁজে পায়।  

মজার ব্যাপার, হিন্দুদের ধাম হলেও সেটির রক্ষণাবেক্ষণ করে এক মুসলমান মাঝি। তার নাম রাফি, বয়সে সদ্য-তরুণ, অবশ্য সে ঐ দায়িত্বটি পেয়েছে বংশ পরম্পরায়, মূলত তার পিতামহ এই দায়িত্বে ছিল। সেখান থেকে বন্দুকী সদাগরের গল্পটাও দীনু উদ্ধার করে কিছুটা। বন্দুকী সদাগর মধ্যযুগের একজন সদাগর ছিল, ‘বিষহরী’- সর্পদেবী মনসার ভয়ে সে বঙ্গদেশ ত্যাগ করে সমুদ্র-বাণিজ্যে বহু দেশ ভ্রমণ করে। এর মধ্যে আছে- তালমিছরি দ্বীপ, শিকল দ্বীপ, কড়ি’র দ্বীপ, রুমালী দ্বীপ ইত্যাদি। কিন্তু বাণিজ্যে গিয়ে ঝড়ে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে এক পর্যায়ে বন্দুকী সদাগর বন্দি হয় পর্তুগিজ হার্মাদদের হাতে। তাদের হাত থেকে গিয়ে পড়ে এক রহস্যময় চরিত্রের কাপ্তেন ইলিয়াসের হাতে। কাপ্তেন ইলিয়াস অভিজ্ঞ নাবিক, তিনি বন্দুকী সদাগরকে মুক্তি দেন। কিন্তু নানা দুর্বিপাকের ফেরে শেষতক বন্দুকী সদাগর সুন্দরবনের ঐ প্রত্যন্ত দ্বীপে মনসার নামে এই মন্দির বা ধাম প্রতিষ্ঠা করে সর্পদেবীর অভিশাপ থেকে মুক্তি নেন।  

গান আইল্যান্ড উপন্যাসের প্রচ্ছদ

মিথের দুয়েকটি কবিতা যতটুকু উদ্ধার করা যায়, তা থেকে দীনু দেউলটির সময়কাল ১৬০৫ থেকে ১৬৯০ এর মাঝামাঝি নির্ধারণ করে। ভারত মুলুকে তখন সম্রাট জাহাঙ্গিরের রাজত্ব। তো ঐ মন্দির আবিষ্কার করতে গিয়ে সেখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটে। দীনু দত্তের সহযাত্রী সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ টিপুকে কালকেউটে সাপে দংশন করে। সাপের বিষে কাহিল হলেও পিয়ালীর তুরন্ত ব্যবস্থা গ্রহণে অবশ্য টিপু শেষ পর্যন্ত বেঁচে যায়। কিন্তু ঐ সময়ে টিপুর ওপর কিছু একটা ভর করে এবং এরপর থেকে সে মাঝেমধ্যেই এমন সব ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করে বা সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে, মনে হয় যেন কেউ এটা তাকে আগেই জানিয়ে দিচ্ছে বা স্বপ্নে বলে দিচ্ছে। যা হোক, ঐ মিথ, এই ঘটনা, ইত্যাদি দীনুকে বেশ ভালোই মোহাচ্ছন্ন রাখে কিছুদিন। সে তার কাজেই মনোনিবেশ করতে পারে না অনেকদিন। ভাবখানা এমন যে দীনু মনসার খপ্পরে পড়ে গেছে, শুধুমাত্র ঐ ধামে গিয়ে অনুসন্ধান করেই। এমতাবস্থায় তার মেন্টর প্রফেসর গিয়াচিন্তার ব্যবস্থাক্রমে একটা কাজে ভেনিসে যাবার সুযোগ হয়য় তার। ভেনিসে অনেক অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী আছে। অন্য দেশেরও আছে, কিন্তু বাংলাদেশ একটা আলাদা নজর পায়। জলবায়ু সংক্রান্ত ঝুঁকির মুখে এই দেশটি অগ্রগণ্য বলেও এই নজর পড়ে।  

তো ভেনিসের এই অভিবাসীদের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ইতালিয়ান দক্ষিণপন্থী ও উদারপন্থীদের মধ্যে একটা টানাপোড়েন আছে। সেটা নিয়েই একটা তথ্যচিত্র বানানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। যেহেতু আমাদের দীনু বাংলাভাষী, গবেষকও বটেন, উপরন্তু প্রফেসর গিয়াচিন্তার প্রভাবশালী সুপারিশ– সব মিলিয়ে তার সেখানে যাওয়াটা হয়ে উঠল। এখানেই শেষ হয় উপন্যাসের প্রথম পর্ব।  
..

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সেই থেকে চাঁদ সদাগর আর বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী এ অঞ্চলের যাত্রাপালার অংশ। “গান আইল্যান্ড” উপন্যাসে অমিতাভ ঘোষ সুচারুভাবে সেই চাঁদ বণিকের পালাকে পুনঃসৃজন করেছেন। বন্দুকী সদাগর নামের চরিত্রটি চাঁদ সদাগরের আলোকেই আঁকা। মনসা দেবীর কোপে পড়ে সে সমুদ্র-বাণিজ্যে ঝুঁকে পড়ে। লৌকিক সাহিত্যে মনসা আশ্রিত আরও কিছু উপাখ্যান আছে বটে, তবে চাঁদ সদাগরের কাহিনীই মুখ্য। সম্ভবত এখানে চাঁদ সদাগরের একটি কাহিনী এবং বেহুলা-লখিন্দরের আরেকটি কাহিনী মিলেমিশে একটি বৃহৎকাব্য হয়েছে। খুব সম্ভবত এই সাহিত্যের পেছনে বাস্তবের কোনো যোগসূত্র আছে। তবে সে বাস্তবতাকে খুব একটা সন্ধান করে লাভ নেই, সাহিত্যের মোড়কে আজ সে বাস্তব যে কোথায় লুকিয়ে গেছে! তার চেয়ে এই সাহিত্যের স্বাদই অনেক সুমধুর। তবে “গান আইল্যান্ড” উপন্যাসে জলবায়ু একটা মুখ্য ভূমিকা রাখে।
  
বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্যের বিষয়ে আমার দীর্ঘকালের আগ্রহ। “গান আইল্যান্ড” পড়তে গিয়ে সেই পুরনো আগ্রহ আবার মাথাচাড়া দিল। এই সুযোগে আমরা একটু মনসাপুরাণ ঘেঁটে আসি। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য এক বিরাট ঐতিহ্য। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে টানা প্রায় অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্রের কাল পর্যন্ত মঙ্গলকাব্যের যুগ বলা যায়। মঙ্গলসাহিত্যের মধ্যে দেবী মনসা, চাঁদ সদাগরের কাহিনী এবং বেহুলা-লখিন্দরের উপাখ্যানই প্রধান। সেটা বাংলার লৌকিক স্তর থেকে সমাজের ওপরিতল পর্যন্ত বিধৃত। দেবী মনসা চান মর্ত্যে তার পূজা ও প্রসার। এ জন্য তিনি চাঁদ সদাগরকে বেছে নেন। চম্পাই নগরের বণিকদের মধ্যে চাঁদ খুবই প্রসিদ্ধ। তাছাড়া এর আবার একটি স্বর্গীয় আখ্যান আছে। স্বর্গেই সব ঠিক করা হয়েছে, অমুকের অভিশাপে তমুক মর্ত্যে এসে পূজা করবে ইত্যাদি। কিন্তু শিবের পূজারী চাঁদবাবু কিছুতেই মনসার ভয়-ডরে কাবু হয় না। তার বিশাল বাণিজ্যবহর কালীদহে ডুবে যায়, মারা যায় ছয় পুত্র। সে সহায় সম্বলহীন হয়, তবুও মনসাকে পুজো দেয় না। মনসার কোপানলেই তার সপ্তম পুত্র লখিন্দরকে বিবাহ-বাসরে সাপে কাটে। স্ত্রী বেহুলা স্বামী লখিন্দরকে নিয়ে ভেলায় ভেসে চলেন, তাকে পুনর্জীবন দেবার আশায়। শেষ পর্যন্ত সবই হয়, লখিন্দরও বেঁচে ফেরে, চাঁদ সদাগরও হৃত সম্পদ ফিরে পায়, আর বাম হাতে ফুল নিয়ে মনসাকে পূজা দেয়। বাধ্য হয়েই।  

 বাংলার পটচিত্রে বেহুলা-লখিন্দর

চাঁদ সদাগরের এ কাহিনী বহু পুরনো। কিন্তু এ কাহিনীর সাথে বাইবেলের যব বা ইসলামী ঐতিহ্যের আইয়ুব (আঃ)-এর কাহিনীরও সাদৃশ্য আছে। যবের কাহিনিতে অবশ্য সাপ বা মনসা নেই, কিন্তু দৈব-দুর্বিপাকে পড়ে সন্তান ও সম্পদ হারানো, ধৈর্যের পরীক্ষা, শেষে সবকিছু ফিরে পাবার মতো ব্যাপার আছে। মঙ্গলকাব্যে অবশ্য দৈব-আজ্ঞার মুখে পুরুষকারের ইগো দেখানো হয়েছে, কিন্তু সব শেষে মৃদু আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যবনিকাপাত হয়। এভাবে স্বর্গের অভিপ্রায়ও রক্ষা পায়। কিন্তু এসব থেকে মধ্যযুগের বাংলার অসাধারণ কবিবৃন্দ অসামান্য সাহিত্যরস সৃজন করেছেন – লোক ঐতিহ্য বর্ণনায়, পাতিব্রত্য চিত্রণে, মেয়েলি কথার অঙ্কনে। বাংলার লোক ঐতিহ্যের এবং পাঁচালি সাহিত্যের বিকাশে এর অবদান অসামান্য। মধ্যযুগের, বলা যায় পূর্ব মধ্যযুগের বাঙালি জীবনের একটা ভালো স্ন্যাপশট পাওয়া যায় মঙ্গলকাব্য থেকে।  

মঙ্গলসাহিত্যের ঐতিহাসিক ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, “হিন্দুধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সংঘাতের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ যেমন সংস্কৃত পুরাণগুলির সৃষ্টি হয়েছিল, বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের সঙ্গে মুসলমান সমাজের প্রথম সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মঙ্গলকাব্যগুলির উদ্ভব হয়”। মনসাপূজার প্রচলন, চাঁদ সদাগরের আখ্যান, সর্পপূজা এসবই খুব কৌতূহলজনক বিষয়। সর্পপূজা ভারতীয় ভূখণ্ডে বহু প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত বলে ধারণা করা হয়, বিশেষ করে প্রাক-আর্য সময় থেকেই। সম্ভবত প্রথমে জীবিত সাপের পূজা, তারপরে সাপের সাথে সংশ্লিষ্ট গাছের পূজা (সীজ মনসার গাছ), তারপর নির্দিষ্ট সর্পপূজা এবং প্রধানত মাতৃকা দেবীর সাথে এর অন্বয় হতে দেখা যায়। তবে যজুর্বেদে সর্পবিদ্যা একটি অবশ্য পাঠ্যবিষয় এবং অথর্ববেদে সর্প বিষয়ে কয়েকটি মন্ত্র রচিত হতে দেখা যায়। এর অর্থ বৈদিক প্যান্থিয়নের মূল ধারায় সর্পদেবীর ব্যাপারটা ছিল না, এটা পরে পুরাণযুগে পোক্তভাবে এসেছে, যখন বৈদিক আর্যদের সাথে এ দেশীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ হতে শুরু করে। মনসাদেবীর নাম কিন্তু আগে দেখা যায় না– প্রাচীন সংস্কৃত অভিধানে নেই, পাণিনিতে নেই, রামায়ণ-মহাভারতে নেই, প্রাচীন পুরাণে নেই। দ্বাদশ শতাব্দীর পরবর্তী পুরাণে ও অভিধানে মনসার নাম দেখা যায়। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে, খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে মনসাদেবীর পূজা বাংলায় প্রচারিত হয়। একাদশ শতাব্দীতে সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠার সময়ে এবং পরে দ্বাদশ শতাব্দীতে দেবীর মাহাত্ম্যসূচক পুরাণ রচিত হয়। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলা মঙ্গলগানের পালারূপ বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি আত্মপ্রকাশ করে। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে বৃহদাকারে মঙ্গলকাব্য রচিত আকারে দেখা যায় (পরিশিষ্ট-১)। মনসাদেবীর কল্পনার মূলে বৌদ্ধ মহাযানী শাস্ত্রে উল্লিখিত জাংগুলিতারা এবং বাসুকি ভগিনী জরৎকারুর সংমিশ্রণ বা আশ্রয় আছে বলা যায়। এরা প্রত্যেকেই সর্পদেবী বা বিষহরীর তুল্য কাজে নিয়োজিত ছিল। মনসার নামটি এলো কোথা থেকে? স্পষ্ট এটা অনার্য শব্দ থেকে উদ্ভূত। মনসার আখ্যানের নামগুলিও অনার্য প্রকৃতির – বেহুলা, সোনকা, লখিয়া, সায়বেনে ইত্যাদি। বিহারের প্রাচীন রাজগৃহের ধ্বংসাবশেষে একটি মন্দিরে নারীরূপা নাগিনীমূর্তি দেখা গেছে। এই মন্দিরটির নাম ‘মনিয়ার মঠ’ এবং এর তারিখ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক। মনিয়ার নাম থেকে মনসা আসতেই পারে। তবে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক প্রদেশে ‘মঞ্চাম্মা’ নামে সর্পদেবীর পূজা প্রচলিত আছে। এই মঞ্চাম্মা বা মনিয়ার থেকেই মনসা এসেছে বলে অনুমান করা যায়। কেননা দাক্ষিণাত্যে সর্পপূজার বেশ চলন আছে। এছাড়া রাঢ় অঞ্চলের বীরভূমে প্রচুর মনসামূর্তি দেখা যায়। তাই সাহিত্যের ইতিহাসবিদদের মতে রাঢ়ের বীরভূম থেকে বিহার হয়ে মনসা কাহিনী বাংলায় আসে। এর সাথে ভূ-তাত্ত্বিক ও নদীপথের বিবরণ এবং রাজনৈতিক ইতিহাসও জড়িত (যেমন তুর্কি আক্রমণে পিছু হটে সেনবংশ পূর্ববঙ্গের দিকে হটে আসে, সেইসাথে মনসা মঙ্গলের কাহিনীও আসে, কাব্য রচয়িতাদের বংশপরিচয়েও রাঢ় থেকে আসার কথা স্পষ্ট আছে)।  

 মনসা মূর্তি
এবার যদি এই আখ্যানের দিকে তাকানো যায়, তাহলে বেশ কিছু মজার বিষয় দেখা যাবে। রাজ-রাজড়া ছেড়ে হিন্দু বৈশ্য সদাগরের ব্যাপারে দেবীর আগ্রহের কারণ কী? সদাগররা কোন সময়ে এতো গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন? অতো গুরুত্বপূর্ণ ছিলেনই বা কেন? এর কিছু প্রচ্ছন্ন কারণ ছিল। মনসামঙ্গল যে সময়ের কাহিনী বলে পণ্ডিতদের বিশ্বাস, সে সময়ে বাঙালির সমুদ্র এবং নৌ-বাণিজ্য খুব প্রচলিত ছিল। সম্ভবত এটা বৌদ্ধযুগের কাহিনী (পরিশিষ্ট-১)। কেননা মঙ্গলকাব্য রচয়িতাদের বিবরণ দেখে মনে হয়- নৌ-পথগুলির বর্ণনা, ডিংগি বা জাহাজ নির্মাণের বিষয়াদি তখন অনেকটা বিস্মৃত, স্মৃতির মিথ থেকে সেগুলো লেখা হয়েছে। সম্রাট অশোকের সময় থেকে পাল আমল পর্যন্ত দীর্ঘকাল হিন্দু দেবদেবীরা ছিলেন প্রচ্ছন্ন। সেই সময়ে সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ কোনো হিন্দু রাজন্যই ছিলেন না যাকে নিয়ে বৃহৎ পরিসরে কাব্য রচনা করা যায়। ফলে হিন্দু সমাজের জন্য তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন বৈশ্য বণিকরাই। সেই হেতু চাঁদ বণিকের প্রতি এতো আগ্রহ। কিন্তু একটা জিনিস –মনসামঙ্গল এবং অন্যান্য মঙ্গল সাহিত্যের বিষয়ে সাহিত্যের ইতিহাসবিদগণ এবং অন্যান্য পণ্ডিতদের অনেক বিশ্লেষণ চোখে পড়লেও চাঁদ সদাগর কিংবা কালকেতু উপাখ্যানে বর্ণিত প্রাচীন বাংলার বিবিধ নৌ- ও সমুদ্র-বাণিজ্যের কোস্টাল ট্রেডিং রুটগুলির আধুনিক বর্ণনা নেই। মঙ্গলকাব্যে ব্যবহৃত বাণিজ্য রুটগুলির ভূ-তাত্ত্বিক এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষণও জরুরি। তাহলে আমরা সেই সময়কার মাইগ্রেটরি প্যাটার্নটাও বুঝতে পারতাম। এটা আমাদের জলবায়ুজনিত আধুনিক দেশান্তরের সামাজিক বিশ্লেষণেও কাজে লাগতো। প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসে এই ট্রেডিং রুটগুলির নিশ্চয়ই গুরুত্ব আছে।     
    
..

আমরা আবার “গান আইল্যান্ডে” ফিরে যাই। এই উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব পুরোটাই ভেনিসের প্রেক্ষাপট। এতে ভেনিসের ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের বর্ণনা আছে। সেখানকার ইহুদি বসতির ইতিহাস, মধ্যযুগের রাজনৈতিক অবস্থা, এছাড়া বিশেষ করে ‘লিটল আইস এইজের’ ডামাডোল বেশ আলোচিত হয়েছে। ‘লিটল আইস এইজের’ ব্যাপারটা ছিল যে, সপ্তদশ শতাব্দীতে কোনো একটা মহাজাগতিক কারণে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেশ কিছুটা কমে যায়। ফলে ঐ সময় (১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে শুরু) জুড়ে, বিশেষ করে ইউরোপে বেশ জাঁকিয়ে শীত পড়েছিল। এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে– জলবায়ু সংক্রান্ত অবশ্যই– বেশি বেশি অগ্ন্যুৎপাত, সৌর সক্রিয়তা কমে যাওয়া, মহাসামুদ্রিক স্রোতের দিক বদল ইত্যাদি। ফলে সেই সমটাকেও একটা জলবায়ু বিষয়ক টার্নিং-পয়েন্ট বা সন্ধিকাল বিবেচনা করা যায়। পাঠক স্মরণ করুন, লেখক কিন্তু বন্দুকী সদাগরের মিথটিকেও ঐ সময়েই স্থাপন করেছেন, এবং প্রকারান্তরে তিনি জলবায়ু পরিবর্তনকেই প্রেক্ষাপটে তুলে এনেছেন। যা হোক সেই সময়কার ভেনিসের বর্ণনা আর প্রাচীন ইহুদি ঘেটোর মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পথ বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে আচমকা সেই পরবাসে দীনুবাবুর সাথে দেখা হয়ে যায় রাফির। হ্যাঁ, রাফি, সেই সুন্দরবনের তস্য ধামের মাঝি রাফি। কিমাশ্চর্যম্‌! 

এই পর্বে এরকম আরও কয়েকটি আধিদৈবিক চমক আছে আর আছে যবনিকাপাত। যা হোক সুন্দরবনের রাফিকে আর যাই হোক, দীনুবাবু ভেনিসে প্রত্যাশা করেনি, ফলে তার একেবারে হতবাক অবস্থা। সে একটা দার্শনিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়। একুশ শতকে যদি এইরকম মঙ্গলকাব্য মার্কা আলৌকিক ঘটনা ঘটে তাহলে তার দোষ কী! 

এরপর ঘটনা-প্রবাহে দীনু জানতে পারলেন, রাফি আর সেই সাপের দংশন খাওয়া টিপু একত্রেই দেশ ত্যাগ করে। প্রথমে তারা ভারত থেকে বাংলাদেশ যায়, সেখান থেকে আবার ভারত, পাকিস্তান, ইরান সীমান্ত দিয়ে তুরস্কে প্রবেশ করে। অবশ্য টিপু তুরস্কে ঢুকতে না পেরে মিশরে চলে যায়, আর রাফি ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ ঘুরে ভেনিসে উপনীত হয়। তথ্যচিত্রের কাজ করতে গিয়ে আরও কয়েকজন বাংলাদেশী অভিবাসীর সাথে কথা বলে দীনু জানতে পারলেন এরকম আরও কয়েকটি চ্যানেলে দীর্ঘ পথে দুর্গম গিরি-কান্তার মরু-দুস্তর পারাবার পেরিয়ে বঙ্গসন্তানেরা ইউরোপে, বিশেষ করে ইতালিতে হাজির হচ্ছে। এরকম অন্তত তিনটি ভয়ংকর যাত্রাপথের বিবরণ এই পর্বে ঔপন্যাসিক বর্ণনা করেছেন। এর একটি পরিশিষ্ট-২’এ হুবহু তুলে দেওয়া হলো, যা দেখে পাঠক বুঝতে পারবেন কতখানি বিপজ্জনক সে পথ। সে যাত্রার পথিকেরা কতটা কাঠিন্যের মধ্য দিয়ে যায়, জীবন-মৃত্যু-পায়ের-ভৃত্য করে চলা এ পথে বন্ধু হারানো কী মর্মান্তিক হতে পারে। এই বর্ণনা না পড়লে বোঝা যাবে না মানবতার বলি ঠিক কীভাবে হয়, কারা করে, কীভাবে করে, কেন করে। এই পরিক্রমা পড়ে এটাও বোঝা যায়, অমিতাভ কী পরিমাণ ফিল্ড-ওয়ার্ক করেছেন এই বিষয়টা নিয়ে। ইতালি প্রবাসী শ্রমিকেরা বৈধ-অবৈধ উপায়ে নিজ নিজ দেশ ত্যাগ করেছে এবং মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। পদে পদে তাদের ঋণের জালে বেঁধে ফেলা হচ্ছে। গন্তব্যে পৌঁছেও নতুন নতুন জালে আটকে যাচ্ছে তারা, স্থানীয় মাফিয়ারা তাদের ক্রীতদাসে পরিণত করছে। এভাবে প্রাচীনকাল থেকেই চাঁদ সদাগর, বন্দুকী সদাগর কিংবা রাফি– সবাই সমুদ্রসহ বিবিধ মাইগ্রেটরি রুট বা দেশান্তরের পথ বেয়ে দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। প্রাচীনকালে ছিল কল্পিত মনসাদেবীর বিপদ, আর এ কালের মনসা যেন এই মাফিয়ারা! 

এ পর্বে কিছু থ্রিল আছে উপন্যাসে, টানটান উত্তেজনা আছে, অতিলৌকিক ঘটনা আছে, বায়োলুমিনেসেন্স এবং ডলফিনের বিচিং আছে, মাফিয়াদের চোখরাঙানি আছে, আছে বিচিত্র মাকড়সার জাল আর পিয়ার সূক্ষ্ম আহ্বান। উপন্যাসের সমাপ্তিও আছে।

..

‘গান আইল্যান্ড’ উপন্যাসটির আখ্যান চমৎকার। পাঠককে ধরে রাখে। আগেই বলেছি, একটা থ্রিল আছে। লেখকের শব্দ নিয়ে চমৎকার মারপ্যাঁচ আছে, যেটা বন্দুকী সদাগরের দ্বীপের সাথে ভেনিসের আশ্চর্য যোগসূত্র স্থাপন করে। অমিতাভ ঘোষ সর্বদা চেয়েছেন জলবায়ু সমস্যাকে সামনে রেখে সাহিত্য রচনা করতে। এই আকাঙ্খা তার পূর্বতন প্রবন্ধ-গ্রন্থ ‘দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট’-এও (২০১৬) প্রকাশ পেয়েছে। ঐ গ্রন্থে তিনি জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে সাহিত্যে, নন-ফিকশনে, জীবনে, রাষ্ট্রচিন্তায় ও ইতিহাস গবেষণায় আসতে পারে কিংবা আসা উচিত সেসব নিয়ে আলোচনা করেছেন। আগেই বলেছি, সুন্দরবন অমিতাভের পুরনো আকর্ষণ বিন্দু। সাম্প্রতিক বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ বনাঞ্চল হলো সুন্দরবন, সেখানকার ইরাবতী ডলফিন ও অন্যান্য ফনা। আচমকাই পরিবর্তনের মুখে পড়েছে সেখানকার মানুষের জীবনধারা ও নদীর গতিপথ। ওদিকে উন্নয়নের প্রহসনে উজানে চলছে শিল্প-কারখানার বর্জ্যজনিত দূষণ। এইসব আলাদা আলাদা প্রপঞ্চের মিলিত ফল পড়ে মানুষের জীবনেও। পড়তে বাধ্য।  
সুন্দরবন
সুপ্রাচীনকাল থেকেই দেশান্তরে মানুষের অভিবাসন চলেছে। আগে হয়তো রাজনীতির কারণে দেশান্তরি হতে হয়েছে, হয়তো নতুন রাজা এসেছে, যার অত্যাচারে পালাতে হচ্ছে। কিংবা কে জানে হয়ত দেবীর অভিশাপের আড়ালে রয়েছে পরিবেশ বিষয়ক অনুচ্চ বিপর্যয়। সেকালে তো পারিবেশিক বিপর্যয়ের তুল্যমূল্য নির্ধারণের কোনো উপায় ছিল না। বাতাসে কী পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাড়ছে সেটা জানার এবং মাপার কোনো উপায় ছিল না। ফলে যা কিছু বিপ্রতীপ ঘটনা তার সবই নিশ্চয় দৈব-কৃপার অভাবই হবে। সেটা ভাবাই সহজ। যেখানে দেশান্তরের কারণ রাজা-বাদশা, জলদস্যু, সমাজ– যা কিছু প্রকাশ্য– সেখানে তা তো স্পষ্ট বলা যায়, বিশেষ করে কাব্যে, মহাকালের বিচারের অংশ হিসেবে। যেখানে তা বলা যায় না, সেটা নিশ্চয় দৈবলীলার লোকোত্তর বহিঃপ্রকাশ। ফলে সেকালে অস্বাভাবিক কারণে, কিংবা হয়তো নিতান্তই সহজাত কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সামুদ্রিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ভাগ্য-বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে সামুদ্রিক মরীচিকা (কমলে কামিনী দর্শন) কিংবা দেব-দেবীর অভিশাপ কিংবা নিছক পাওনাদারের ভয়কে হয়তো চিহ্নিত করা যায়। ফলে সেকালেও যেমন, তেমনি একালেও দেশান্তর ঘটছে। আমরা এর একটা গালভরা নাম দিয়েছি অধুনা– ক্লাইমেট রেফুজি। পূর্বের মনসাদেবীর অভিশাপ থেকে পলায়ন বলুন আর আধুনিক জলবায়ু সমস্যা থেকে পলায়ন বলুন– দেশান্তরই ঘটছে। ফলে মধ্যযুগের মনসাদেবীর ছোবল ফিরে ফিরে আসে মানব সদাগরের জীবনে।  

..     

‘গান আইল্যান্ড’ গল্পটির কিছু দুর্বলতাও আছে। প্রোটাগনিস্ট চরিত্রটি খারাপ নয়, দীননাথ দত্ত নিঃসঙ্গ পুরুষ, কিন্তু তিনি বড্ড ভীতু। স্থান-কাল-পাত্র ভেদ বিবেচনা না করেই রজ্জু-ভ্রমে-সর্প দেখছেন তিনি। ঘটমান চাঞ্চল্যকর ঘটনায় বিভিন্ন প্যাটার্ন খুঁজছেন, বাতিলও করছেন, কিন্তু তার, বা লেখকের, সে যৌক্তিক প্রচেষ্টা দুর্বল। মনসাই যেন পুতুলের সুতো হাতে নাচাচ্ছে। মনে হয়, লেখক যেন একটু জোর করে আধিদৈবিক অতিলৌকিক প্রপঞ্চ নিয়ে আসছেন। সাপ আর মাকড়সায় তিনি মাইগ্রেটরি প্যাটার্নও দেখছেন, আবার দৈবদুর্বিপাকও ফেলে দিচ্ছেন না। পটভূমিতে কী যেন একটা আছে। কখনও ‘শ্যাডোজ’, কখনও ‘সামথিং ডার্ক’। উপন্যাসের সকল চরিত্র বা ঘটনার ভেনিসে গিয়ে মহাসমাপতনও বিচিত্র মনে হয়। তাছাড়া বন্দুকী সদাগরের সেই ধাম যা সাড়ে তিনশ’ বছর ঝড়-জল উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকল, সেটা কিনা প্রোটাগনিস্টের চাক্ষুষ দেখার কয়েক বছরের মধ্যেই ঝড়ে-বন্যায় মুছে গেল! এই একুশ শতকে ভেনিসে যদি আপনাকে মনসার ছায়া-কল্পনা দেখানো হয়, সেটা কিঞ্চিত বিসদৃশ ঠেকে। এই ব্যাপারগুলো উপন্যাসে বড় দুর্বলতা আনলেও একটা উত্তেজনা লেখক আমদানী করতে পেরেছেন, পুরাতন মঙ্গলসাহিত্যকে তিনি আধুনিক উপন্যাসে নিয়ে এসেছেন, সেটা কম কী! একুশ শতকেও, জলবায়ু দূষণের এই আপদকালেও, মিথের প্রয়োজনীয়তা একেবারে ফুরোয়নি বলা যায়।       

 ..

পরিশিষ্ট-১

যে যুগে মঙ্গলকাব্যগুলি রচিত হয়েছিল, অর্থাৎ প্রধানত খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী – এই যুগে বাংলার সদাগরেরা ভারতের উপকূল অঞ্চল কিংবা বৃহত্তর ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে যে বাণিজ্যরত ছিলেন, তেমন নয়। সমসাময়িক রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বৌদ্ধ পাল এবং হিন্দু সেন রাজত্বের আমলে বাঙালির জীবন শিল্পে, বাণিজ্যে নানাদিক দিয়ে যেমন বিস্তৃতি লাভ করেছিল, এদেশে তুর্কি আক্রমণের পর থেকেই তা চারিদিক হতে সংকীর্ণ হয়ে আসে। অথচ সকল মঙ্গলকাব্যই রচিত হয়েছিল তুর্কি আক্রমণের পর। অতএব, মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে বাংলার সদাগরদের ভারতীয় উপকূল অঞ্চলে বাণিজ্য করে ধনৈশ্বর্য লাভ করার যে পরিচয় পাওয়া যায়, সেটা ঐতিহাসিক দিক দিয়ে মধ্যযুগের পূর্ববর্তী ঘটনা বলে স্বীকার করতে হয়। পাল রাজত্বের শেষভাগে বাংলার বহির্বাণিজ্য নানাদিক দিয়ে বিস্তার লাভ করেছিল বলে জানা যায়। সেই যুগে সমাজে স্বভাবতই বৈশ্য সদাগরদের প্রাধান্য ছিল। সেই জন্য মঙ্গলকাব্যের নায়কমাত্রই বৈশ্য সদাগর। ব্রাহ্মণের প্রতিষ্ঠা তখনও সমাজে স্থাপিত হয়নি। কিন্তু যে যুগে মঙ্গলকাব্যগুলি রচিত হয়েছে, সে যুগে ব্রাহ্মণের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। … পাল ও সেন রাজত্বে বাংলার সদাগরদের বহির্জগতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কিত যোগাযোগ স্থাপন করার সংস্কার এই সমাজে এত দৃঢ়মূল ছিল যে, সেই বিষয়বস্তু অবলম্বন করে প্রায় পাঁচ শতাধিক বছর পরও এ দেশে জাতীয় কাব্য রচিত হয়েছে।  

[পৃষ্ঠা ৪০-৪১, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, আশুতোষ ভট্টাচার্য, মুখার্জী অ্যান্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৬৪, ৪র্থ সংস্করণ, আধুনিক বানানে এবং বাংলা রীতিতে পুনর্লিখিত]

পরিশিষ্ট-২

p.191-194, Gun Island, Amitav Ghosh

I too left Bangladesh with a friend. His name was Kabir and he was from the same village, in Faridpur district. We had known each other since we were little. We played together, went through school together, and always stood by each other. 

A few years ago there was a dispute in my family, over land. One of my uncles is mixed up in politics and his sons are the local musclemen for the ruling party. For a long time they had been using their political clout to try to grab a part of of what was rightfully my father’s property. Every time there was a flood – which was happening more and more – they would try to move the boundaries. If we protested they would threaten us. 

One day there was a fight. My uncle and cousins attacked my father and me, so Kabir came to our defense and knocked my uncle down. After that it was like a riot. Kabir and I managed to get away, but from then on, we had to be constantly on the run. My uncle and his sons would hunt us down, wherever we went. They had henchmen everywhere, because of their party connections. They even got the Police to charge us with a made-up case. 

After a year of hiding we realized that we would be killed if we stayed on in Bangladesh. A relative put us in charge with a dalal who said he would get us to the Emirates in exchange for 350,000 taka. It was a lot of money but somehow we managed to raise it and the dalal gave us each a piece of paper, saying that this was an ‘airport visa’. He sent us to Chittagong where we boarded a plane that took us to Sharjah. Only when we got there did we realize that we would not be able to leave the airport. [we were just eighteen-year-olds]. Anyway, we had to remain in the airport, day after day, growing more and more desperate all the time. We had only fifty US dollars with us and we paid ten dollars for a prepaid card with thirty minutes of talktime. We called our dalal and he told us that we had only two choices. One was to go back to Bangladesh. The other was to go to Libya through Sudan. He said there was a war in Libya but it wasn’t all that bad – many Bengalis had chosen to go there. 

What could we do? To turn back now was impossible, so we decided to take the second option. … The next day we boarded a plane that took us to Khartoum. There were many other Bengalis at the airport, all waiting to go to Libya. After a day we flew to Tripoli. The airport was a shambles, with craters in the roof and shattered windows. Men with guns were walking in and out as they pleased. Some of these men surrounded  us and took us outside to a minivan with darkened windows. Only then did we realize that we had been kidnaped. 

For the next year and a half we were beaten, tortured, and sold by one one gang to another. They made us work from morning to night, paying us almost nothing and giving us only bread to eat. We were like slaves; what we went through was something that should not happen to any human being. 

But somehow through all of this Kabir and I managed to stay together and we even saved a little money. As the months went by we also became more worldly-wise. We learnt that there were Bengali dalals in Tripoli who could arrange for you to take boats to Europe. One day, with some careful planning, we were able to slip away from the gang that was then holding us. We made our way to Tripoli and paid a dalal who sent us to a town called Zuwara where they put us in ‘connection house’. This was just a concrete warehouse with a tin roof; some two hundred other people were already there – Nigerians, Sudanese, Eritrans, Iraqis, Afghans and also some other Bengalis.

A couple of months dragged by and then one night we were woken at 2 am and told that it was time for our “connection” and we need to get to the seafront quickly. We were herded to the beach and stripped of every belonging other than the garments on our backs. It was about 4 am when a boat appeared – it was just a smalle, battered fishing vessel. To get to ot we had to wade through chest-deep water. After hauling us in, the scafisti told us where we had to sit: those who had paid extra were on the upper deck and those who hadn’t were sent down into the hull below. Since Kabir and I had not been ble to make the extra payment we had to go below deck, and were seated near the engine, which was belching clouds of black smoke.

Once the boat began to move, water started to seep into the hull. We tried desperately to bail it out but it only got worse. By noon the next day the rear part of the boat was almost submerged, and we were hardly moving. We thought we would die, but then,  like a miracle, a helicopter appeared above us – we could hear it, even down below. On the deck above, people became very excited and began to jump up and down, yelling and screaming. It was then that our boat began to go down.

ইতালি উপকূলবর্তী অভিবাসী নৌকা

A frenzied scramble broke out, with all of us trying to claw our way out of the hull. Kabir and I managed to get out just before the boat sank. We had grown up swimming in rivers and ponds so neither of us was afraid of the water. We tore off our jeans and shirts and started to swim, trying to stay close to each other. We thought for sure a rescue ship would come soon and we would be safe. But a long time went by with no sign of either the ship or the helicopter. The sea was not rough that day but there was a steady swell. To fight the waves was tiring and after a time it became hard for us to stay close. We slowly drifted apart, losing sight of each other. 


By the time the rescue ship finally came I was exhausted and barely able to stay afloat. I managed to catch hold of one of the lifebelts they were throwing out; I clung to it while the speedboat was rescuing others. I looked around for Kabir and didn’t see him, but I wasn’t worried. I thought that he had probably been rescued already. When at last the lifeboat came for me I got in and looked around to see if Kabir was there. He wasn’t. 

I was one of the last to board the rescue ship. Looking at all the people on deck, I felt sure that Kabir was among them. They were handling out those shiny silver blankets and I wrapped one around my body and went up and down the ship like a madman, hoping to find Kabir. Every time I saw a Bengali, in the distance, my heart would lift, in hope – and then I would see that I wasn’t Kabir. In the end I collapsed, out of exhaustion, but when I woke up I started looking again. It went on like that until we got to port, and even afterwards, when we were taken to the camp. I could not bring myself to accept that Kabir hadn’t made it. To this day I keep thinking he will turn up somewhere. 

… For every euro I make from doing this work. I keep forty cents for my own needs. Of the rest I send thirty to my own family and thirty to Kabirs’s. He was an only child and his parents have no one to support them. For as long as they live I will send them money. I have to don’t I? It’s only because Kabir was my friend and that he’s not here today. And the strange thing, you know, is that never once, through all that we suffered, did he blame me.”

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৬ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২০ 
এইচজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।