ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বঙ্গীয় সম্মেলন: কবি নজরুলের ফরিদপুরের প্রথম সফর 

বাবু মল্লিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১১ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২১
বঙ্গীয় সম্মেলন: কবি নজরুলের ফরিদপুরের প্রথম সফর 

১৯২৫ সালে বাংলার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ফরিদপুরে। অল বেঙ্গল কংগ্রেস কনফারেন্স, অল বেঙ্গল স্টুডেন্ট কংগ্রেস কনফারেন্স এবং অল বেঙ্গল মুসলিম কংগ্রেস কনফারেন্স।

ওই সম্মেলন তিনটিতে উভয় বাংলার ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতা-কর্মী ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনে অংশ নিতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ফরিদপুরে প্রথমবারের মতো সফরে আসেন। পরবর্তীকালে বৃহত্তর ফরিদপুরে আরও অন্তত সাতটি ভ্রমণের বৃত্তান্ত পাওয়া যায়- ফরিদপুর শহর, মাদারীপুর ও গোয়ালন্দের পাংশায়।

বঙ্গীয় কংগ্রেসের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ফরিদপুর টেপাকোলা মাঠে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ওই সম্মেলনে যোগ দিয়ে তার বিখ্যাত গান ও কবিতা পরিবেশন করেন। পল্লীকবি জসীম উদ্দীন এতে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সম্মেলনে এসে কবি নজরুল একজন বামপন্থী নেতাসহ চারজনের একটি দল পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের বাড়িতে ওঠেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের (৫.১১.১৮৭০-১৬.৬.১৯২৫) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে মহাত্মাগান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮), নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু (২৩.১.১৮৯৭-১৯.৮১৯৪৫), সরোজিনী নাইডু (১৮৭৯-১৯৪৯), মওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-২২.২.১৯৫৮) যোগ দিয়ে বক্তৃতা করেন।

ফরিদপুর শহরের সাথে তখনও সরাসরি রেললাইন স্থাপন হয়নি, নদীর পশ্চিম পাড়ে এসে লাইন শেষ হয়েছিল। উনিশ শতকের শেষার্ধে রাজবাড়ি রেল স্টেশন থেকে পাঁচুরিয়া জংশন, খানখানাপুর-বসন্তপুর-শিবরামপুর হয়ে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের বাস্তুভিটা তাম্বুলখানার কাছে অম্বিকাপুর রেল স্টেশন স্থাপিত ছিল।

শহরের একেবারে প্রান্তে কুমার নদের ওপর ব্রিজ তৈরির পরে বর্তমান ফরিদপুর রেল স্টেশনের উদ্বোধন হয়েছিল আরও অনেক পরে, ১৯৩৫ সালের ২০ অক্টোবর। ফলে কবি নজরুলকে ফরিদপুর শহরের গেয়ালচামট সম্মেলন স্থলে যেতে, পল্লীকবির বাড়ির সন্নিকটে অম্বিকাপুর রেলস্টেশনেই ট্রেন থেকে নামতে হয়, এখানেই তাদের দেখা হয়। কবি নজরুলের সেবারের ফরিদপুর ভ্রমণের স্মৃতি লিখেছেন কবি জসীম উদ্দীন- “প্রতিদিন গাড়ি ভরিয়া বহু নেতা আমাদের বাড়ির পাশের স্টেশনে আসিয়া নামিতে লাগিলেন। স্বেচ্ছাসেবকের ব্যাজ পরিয়া আমরা তাহাদের অভ্যর্থনা করিতাম। একদিন আশ্চর্য হইয়া দেখিলাম, কবি নজরুল কয়েকজন শিষ্যসহ আমাদের বাড়িতে উঠিবার ইচ্ছা করিলেন। কবির সঙ্গে কমিউনিস্ট কর্মী আব্দুল হালিম, গায়ক মণীন্দ্র মুখোপাধ্যয় ও আরো একজন যুবক ছিলেন। আমি কবিকে আনন্দে আমাদের বাড়ি লইয়া আসিলাম। রান্নার দেরি ছিল। কবিকে আমাদের নদী তীরে বাঁশবনের ছায়াতলে মাদুর পাতিয়া বসিতে দিলাম। ... কবির হাতে একখণ্ড কাগজ দিয়া বলিলাম, “কবিভাই, আপনি একটা কিছু লিখে দিন। ”

আধঘণ্টার মধ্যে কবি একটি অপূর্ব কবিতা লিখিয়া ফেলিলেন। কবিতাটি হারাইয়া ফেলিয়াছি। সেজন্য মনে বড়ই অনুতাপ হয়। তার দুইটি লাইন মনে আছে-
“আকাশেতে একলা দোলে একাদশীর চাঁদ
নদীর তীরে ডিঙিতরী পথিক ধরা ফাঁদ’। ” [দ্রঃ যাঁদের দেখেছি, পৃঃ ৩... ]

এই কনফারেন্সে বাংলাদেশের বহু নেতা অংশ নেন, জেল ফেরত অনেকেও ছিলেন সেখানে। কবি তখন ততটা বাগ্মি হয়ে না উঠলেও আবেগমথিত কণ্ঠে গান গেয়ে সবাইকে উদ্বেলিত করেন। কবি সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে স্বকণ্ঠে তার বিখ্যাত কয়েকটি গণসঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গান গেয়ে সম্মেলনকে প্রাণবন্ত করেছিলেন।

কবি ‘চরকা’ নিয়ে গান গেয়ে মহাত্মাগান্ধীকে পুলকিত করেন। অনেকের মতে গান্ধিজীর সাথে এটাই কবি নজরুলের প্রথম পরিচয়ের ঘটনা। সম্মেলন শেষে কবি আবার জসীম উদ্দীনের বাড়িতে এসে সেখানে বসেই একটি বই লেখার মনস্কামনা ব্যক্ত করেছিলেন। কবি জসীম উদ্দীন লিখেছেন- “তখন কবি ভালো বক্তৃতা দিতে শেখেন নাই। সভায় কবি যাহা বলিলেন, তাহা নিতান্ত মামুলি ধরনের। কিন্তু কবি যখন গান ধরিলেন, সেই গানের কথায় সমস্ত সভা উদ্বেলিত হইয়া উঠিল। কবি গান ছাড়িলে সভার লোকে আরো গান শুনিবার জন্য চিৎকার করিয়া উঠিতেছিল। কবির কণ্ঠস্বর যে খুব সুন্দর ছিল তাহা নয়, কিন্তু গান গাহিবার সময় কথা বস্তুকে তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়া জীবন্ত করিয়া তুলিতেছিলেন। ‘কবি যখন জাতের নামে বজ্জাতি সব জাল-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া’ অথবা ‘শিকল পড়া ছল মোদের এই শিকল পড়া ছল’ প্রভৃতি গান গাহিতেছিলেন, তখন সভায় যে অপূর্ব ভাবরসের উদয় হইতেছিল, তাহা ভাষায় বলিবার নয়। জেল হইতে সদ্য খালাস পাইয়া বহু দেশকর্মী সভায় যোগদান করিয়াছিলেন। দেশকে ভালবাসিয়া শত-সহস্র কর্মী আপন অঙ্গে লাঞ্ছনার তিলক-চিহ্ন ধারণ করিয়াছিলেন। নজরুলের গান যে, তাঁহাদের দুঃখ-লাঞ্ছনার আশা-আকাংখার জীবন্ত প্রতীক।

একদিন মহাত্মা গান্ধির সামনে নজরুল তাঁর ‘ঘোর ঘোর ঘোর ঘোররে আমার সাধের চরকা ঘোর’ গানটি গাহিলেন। গান্ধিজি গান শুনিয়া হাসিয়া কুটিকুটি। কনফারেন্স শেষ হইলে কবি আবার আমার বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কবি স্থির করিলেন, তিনি এখানে বসিয়া ‘বালুচর’ নামে একখানা বই লিখিবেন। কিছুদিন কবির সঙ্গে কাটাইতে পারিব, এই আশায় মন পুলকিত হইয়া উঠিল। ” [যাঁদের দেখেছি, পৃঃ ২৯-৩০]।

ফরিদপুর সম্মেলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহনকারী বালিয়াকান্দি স্কুলের তৎকালীন ছাত্র কেতাবউদ্দিন আহমদ (১৪.৪.১৯০৮-১১.৪.১৯৮৫) ও (উত্তরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সহপাঠী। ইনি ফরিদপুর ইয়াছিন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ এবং প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর স্নেহধন্য করটিয়া কলেজে দীর্ঘকাল অধ্যক্ষ ছিলেন) অংশ নিয়েছিলেন। কেতাবউদ্দিন আহম্মদ সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ওই সম্মেলনেই কবি নজরুলের সাথে অধ্যক্ষ কেতাবউদ্দিনের সাথে প্রথমবারের মতো দেখা হয়। ফরিদপুর কনফারেন্সের স্মৃতিচরণ করেছেন অধ্যক্ষ কেতাব উদ্দিন- ‘আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। সব কনফারেন্সগুলিতে আমি অংশগ্রহণ করি। অল বেঙ্গল ছাত্র কনফারেন্সে বালিয়াাকান্দি স্কুল থেকে ডেলিগেট হিসাবে আমি অংশ নিই। অল বেঙ্গল ছাত্র কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ঐ ছাত্র কনফারেন্সে আমি বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম (মিডিয়াম) করার জন্য উত্থাপন করি। প্রস্তাবটি কনফারেন্সে পাস হয়ে যায়। ... 

কংগ্রেস কনফারেন্সের সভাপতি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও প্রধান অতিথি মহাত্মাগান্ধী। গান্ধিজীর ভাষণের প্রথম কয়েক লাইন এখনও আমার মনে আছে।

এই কনফারেন্সে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমি প্রথম দেখি। তাঁর নিজের তৈরি, নিজের কণ্ঠে গাওয়া কয়েকটি গান শুনে আমি বাস্তবিকই মুগ্ধ হই। এগুলির মধ্যে একটা ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীতে যাত্রীরা  হুঁশিয়ার। ’ [যাঁদের দেখেছি, পৃঃ .....]

এই নিবন্ধের পূর্বাংশে কবি জসীম উদ্দীনের ‘যাঁদের দেখেছি’ গ্রন্থের বিস্তারিত বিবরণ থেকে আমাদের জানার অবকাশ হয়েছে যে, ফরিদপুর কনফারেন্স চলাকালে তাঁর আগ্রহের কারণেই কবি নজরুল কমিউনিস্ট নেতা আব্দুল হালিম, হেমন্ত সরকার এবং আরো এক যুবককে পল্লীকবি জসীম উদ্দীন আনন্দের সাথে একদিন তার বাড়িতে তুললেন। নজরুল সঙ্গে আনা ‘বিষের বাঁশী’ আর ‘ভাঙার গান’ সেখানে রেখে শহরের কনফারেন্স ময়দানে অংশ নেন, সেখানে থাকার জন্য কবিকে একটি তাঁবু দেওয়া হয়েছিল। পল্লীকবি এখানে তাঁর ‘খাস ভলান্টিয়ারে’র দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কনফারেন্স শেষ হলে নজরুল আবার জসীম উদ্দীনের বাড়িতে এসে ওঠেন এবং সেখানে থেকেই একটি বই লেখার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। কিন্তু পাবনা জেলা থেকে জনৈক ভদ্রলোক এসে কবিকে নিয়ে যান। কবি ফরিদপুরে সেবারের সফরে এসে ‘সম্মেলন ময়দানের তাঁবুতে’ অবস্থান নেওয়ার এক অবসরে স্থানীয় জমিদার লালমিয়ার বাড়িতেও গিয়েছিলেন বলে শোনা যায়।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক, সম্পাদক সাপ্তাহিক অনুসন্ধান

বাংলাদেশ সময়: ১৭১০ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।