ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া (৭)

শামীম খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০২১
সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া (৭)

শামীম খান। বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।

সম্প্রতি তিনি রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন। পাঠকের জন্য তিনি তুলে ধরেছেন সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আর রাশিয়ার এগিয়ে চলার খণ্ড খণ্ড চিত্র। আমরা তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছি। আজ থাকছে এর সপ্তম পর্ব।

রাশিয়ায় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাই সংখ্যাগুরু। ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের মানুষও সেখানে আছে। সেখানকার সর্বস্তরের মানুষ বড় দিনের উৎসবে অংশ নেয়। অত্যন্ত জাঁকজাকপূর্ণভাবে সামাজিক উৎসবের মতো বড় দিন উদযাপন করা হয়। সপ্তাহব্যাপী এই উৎসব চলে। ২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাস ডে হলেও রাশিয়ায় মূল উৎসব হয় নতুন বছর ১ জানুয়ারি থেকে সাত দিন। এ সময় ছুটি থাকে বড় দিন উদযাপনের জন্য। নতুন বছর ভালো কিছু নিয়ে আসবে এই প্রত্যাশায় মানুষ বড় দিনের অনুষ্ঠান উদযান করে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বড় দিন উদযাপনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে এই দৃশ্যটি চোখে পড়ার মতো। অফিস, মার্কেট, শপিংমল, হোটেল সবখানেই ক্রিসমাস ট্রি সাজানো শুরু হয় ডিসেম্বরের শুরু থেকেই।  

রাশিয়া ভ্রমণে আকর্ষণীয় বিষয় ছিলো মস্কোর ঐতিহাসিক রেড স্কয়ার ঘুরে দেখা। ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শিল্পে সমৃদ্ধ এক পর্যটনকেন্দ্র মস্কোর রেড স্কয়ার বা লাল চত্বর। এর ইতিহাস-ঐতিহ্য আর শিল্প সৌন্দর্য্যরে টানে প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের হাজারো ভ্রমণপিপাসু মানুষ এই রেড স্কয়ারে ছুটে আসে। রাশিয়ার প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ক্রেমলিন সংলগ্ন এই রেড স্কয়ারের প্রতিটি ভবনের যে নির্মাণশৈলী, কারুকার্য ও স্থাপত্যকীর্তি তা মানুষকে বার বার আকর্ষণ করে। রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর প্রাণকেন্দ্রে এই রেড স্কয়ার অবস্থিত। রেড স্কায়ারের চার পাশেই রয়েছে বিভিন্ন ধরণের ভবন। প্রতিটি ভবনই সুউচ্চ, স্থাপত্যশৈলী, শৈল্পিক কারুকার্যসজ্জিত ও নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নানা শৈল্পিক নিদর্শনে পরিপূর্ণ রেড স্কয়ারের চার দিকের প্রতিটি ভবনই যেনো এক একটি ভাস্কর্যের মতো ফুটে উঠেছে। এখানকার অধিকাংশ ভবনের রংই লাল। কোনো কোনো ভবনের রং পুরোপুরি লাল না হলেও নানা রঙের মাঝে লালেরও ছোঁয়া তো রয়েছেই। সাধারণভাবে বলা হয় ভবনের লাল রঙের কারণেই এই চত্বরের নাম হয়েছে ‘রেড স্কয়ার’ বা লাল চত্বর। তবে শুধু রঙই নয়, নামকরণের পেছনে অন্য কারণও আছে বলে ধারণা করা হয়। রাশিয়াতে লালকে সুন্দরের প্রতীক হিসেবেও তৎকালে গণ্য করা হতো। রেড স্কয়ারজুড়ে রয়েছে প্রাচীন ও জার শাসনামলের এবং রুশ বিপ্লবের অনেক নির্দশন। যার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ফুটে উঠেছে। আধুনিককালে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর এই রেড স্কয়ার কমিউনিস্ট বিপ্লবের স্মৃতিবিজড়িত স্থান হিসেবেও পরিচিত। জার শাসন আমলে এই রেড স্কয়ার ছিলো মস্কোর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। তবে জার শাসনামল-পরবর্তী সোভিয়েত আমল এবং বর্তমানে রাশিয়ার জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানও এখানে উদ্যাপন হয়ে আসছে। বর্তমানে এটি রাশিয়া তথা বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্যটনকেন্দ্র। প্রতিদিন এখানে হাজারও মানুষ ভিড় করেন এর ঐতিহাসিক ও দৃষ্টিনন্দন নিদর্শনগুলো দেখার জন্য।  

রেড স্কয়ারে শায়িত আছেন রুশ বিপ্লবের মহানায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ (ভি আই) লেনিন। কমিউনিস্ট বিপ্লব যেটি অক্টোবর বিপ্লব হিসেবে বিশ্বে পরিচিত সেই বিপ্লবের মাধ্যমে রশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে আজ থেকে ৯৮ বছর আগে ১৯২৪ সালে কমরেড লেনিন মৃত্যুবরণ করেন। ভি আই লেনিনের মরদেহ মমি আকারে এই রেড স্কয়ারে সংরক্ষণ করা আছে। লেনিনের প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্র থেকে রাশিয়া সরে গেছে। কিন্তু রেড স্কয়ারে রক্ষিত লেনিনের সমাধি আজও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঐতিহাসিক স্মৃতি বহন করে চলেছে। একইভাবে এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছিলো ইতিহাসের আরেক নায়ক, লেনিনের উত্তরসুরি যোসেফ স্তালিনের মরদেহ। পরবর্তী সময়ে তাকে এই রেড স্কয়ারেই সমাহিত করা হয়েছে। অক্টোবর বিপ্লবের সেই দিনগুলোতে বিপ্লবী লাল ফৌজের যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের এই রেড স্কয়ারেই সমাহিত করা হয়েছিলো। এ কারণে কমিউনিস্ট মতাদর্শের সমর্থকদের কাছেও এই স্থানটির প্রতি এক আলাদা আকর্ষণ ও দুর্বলতা রয়েছে। এই রেড স্কয়ার রাশিয়ার ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন বহন করে চলেছে যার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসও স্থান করে আছে।  

রুশ বিপ্লবের ওপর লেখা ’দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ বইয়ের লেখক বিখ্যাত আমেরিকান সাংবাদিক জন রিডের সমাধিও রয়েছে এই রেড স্কয়ারে। জন রিড রুশ বিপ্লবের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে পেশাগত দায়িত্ব পালনে রাশিয়ায় অবস্থান করেন এবং ওই উত্তাল দিনগুলোর প্রতি মুহূর্তের ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেন। এই কাজটি করতে গিয়ে রেড আর্মিদের (বিপ্লবী বাহিনী) সন্দেহের চোখেও পড়তে হয়েছিলো তাকে। তবে পেশার বাইরেও ব্যক্তি জীবনে তিনি একজন কমিউনিস্ট ছিলেন এবং রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির ছাড়পত্র থাকায় সেদিন তিনি প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন। বিপ্লবের সেই দিনগুলোর ঘটনাবলী তিনি তুলে ধরেছেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ”দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন” এ। বিপ্লবের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেলেও কিছু দিন পরই দেশ ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে আসেন। মস্কোতে তার অকাল মৃত্যু হলে এই রেড স্কয়ারে অক্টোবর বিপ্লবের শহীদ বিপ্লবীদের সমাধির পাশেই তাকে বিশেষ সম্মানে সমাধিস্থ করা হয়।  

রুশ বিপ্লবের শত বছর পেরিয়ে গেছে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্মৃতি বিজড়িত স্থান হিসেবেও এই রেড স্কয়ার পরিদর্শনে আজও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি দুর্বলতা না থাকলেও রেড স্কয়ারে আসা যে কোনো মতাদর্শের পর্যটকরাও এখানে রক্ষিত লেনিনের সমাধিসৌধে যান। এখানকার একটি ভবনের অভ্যন্তরে সংরক্ষিত লেনিনের মমি দেখার জন্য প্রতিদিনই লম্বা লাইন পড়ে যায়। লেনিনের মমির কাছে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে দর্শার্থীদেরকে অপেক্ষা করতে হয়। আর এ কারলেই লেনিনের সমাধিসৌধের এতো কাছে এসেও তাঁকে দেখা সম্ভব হয়নি। যাদের তত্ত্বাবধানে আমরা রেড স্কয়ারে যাই প্রতিদিনের মতো ওই দিনও তারা আমাদের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। লেনিনের মমি দেখার আগ্রহের কথা আমাদের সঙ্গে থাকা রোসাটমের কর্মকর্তা মাক্সিমকে জানিয়েছিলাম। সে প্রথমেই দুঃখ প্রকাশ করে বিনয়ের সঙ্গে জানালো এর জন্য যে সময় প্রয়োজন আমাদের হাতে সে সময় নেই। এ সময় আমার মনে পড়ে ভিয়েতনামের কথা। হো চি মিন- এর সমাধির সামনে থেকে ঘুরে এসেছি, তাকেও দেখতে পারিনি। বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কর্মী সমর্থক ও মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার আরেকটি নাম ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা হো টি মিন। তার মৃত্যুর পর তাকেও মমি করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে ২০১২ সালের ভিয়েতনাম গিয়েছিলাম। রাজধানী হ্যানয়ের প্রাণ কেন্দ্রে হো চি মিনের সমাধিসৌধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হো চি মিনের সমাধি ভবনের সামনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন। আমরাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সেখানে যাই। তখন ছিলো নভেম্বর মাস, হো চি মিনের মমি যে ভবনে রাখা হয়েছে, বছরের এই সময়ে সেখানে প্রবেশ বন্ধ থাকে। তাই হো চি মিনকে দেখা আমাদের সম্ভব হয়নি। চলবে...

সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া (১)
সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া (২)
সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া (৩)
 সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া (৪)
সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া (৫)
সোভিয়েত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগিয়ে চলেছে রাশিয়া (৬)

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০২১
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।