ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ওয়াসীম পলাশের গল্প | অট্টহাসি

শিল্প-সাহিত্য ~ গল্প | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২২
ওয়াসীম পলাশের গল্প | অট্টহাসি সংগৃহীত ছবি

ইদানীং কদমগাছটি এক রহস্যময় আচরণ করছে। মধ্যরাতে প্রায়ই এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।

সে এক অসহনীয় হাসি। এটা অবশ্য সবাই টের পায় না। শুধু প্রফেসর মুহাম্মদ সালেহরই এটা এক মনোবেদনার কারণ। মাস তিনেক আগে একদিন প্রথম টের পেয়েছিলেন এ হাসি। প্রথম কয়েক দিন নিজেই হজম করার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু মাত্রাটা বেড়ে যাওয়ায় স্ত্রী শায়লা আফরিনকে বলেছিলেন। স্ত্রী বিষয়টাকে পাত্তাই দেননি। দ্বিতীয়বার তার সঙ্গে শেয়ার করায় বন্ধু মনোচিকিৎসক মুর্তজা সালেহীনের সঙ্গে একটু পরামর্শ করতে বলেন। স্ত্রীর পরামর্শ শোনার পর প্রফেসর মুহাম্মদ সালেহ এক মানসিক দোটানায় পড়ে যান; নিজের আত্মবিশ্বাসে একটা সূক্ষ্ম চিড় ধরে। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠেন।

উপাচার্যের বাংলোতে গত তিন বছরের বেশি সময় আছেন তিনি। স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে এখানে থাকেন। একমাত্র ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। গত বছর সামার ভ্যাকেশনে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে দেশে এসেছিল। এ বাংলোতেই ছিল। প্রফেসর সালেহর সে দিনগুলো বেশ ভালোই কেটেছে। বিগত তিন দশক প্রফেসর সালেহর জ্যামিতিক উন্নতিতে তার বন্ধুরা ঈর্ষান্বিত; কিন্তু কেউই তার সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। এ জন্য তাকে বহু জলে নামতে হয়েছে। আরও গভীর জলে নামতে তিনি প্রস্তুত; কিন্তু কদমগাছটির এই অসহনীয় অট্টহাসি কীভাবে মোকাবিলা করবেন, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।

অট্টহাসি একটি নয়; দুটি। একটির পিছু নিয়েছে অন্যটি। কদমগাছটির হাসি চলমান; কিন্তু ওই হাসিটি বিদ্ধ করেছিল প্রফেসর সালেহর মগজ, অস্তিত্ব-দীর্ঘদিনের সমস্ত অর্জন। সে পরাজয়টা মাথা থেকে মুছতে পারছেন না তিনি কোনোভাবেই। রাত আড়াইটার দিকে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। বেশ কয়েক বছর নানান জটিলতায় বিছানায় যেতে তার একটু দেরিই হয়। আজও রাত সোয়া একটার দিকে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। তিন মাস যাবৎ প্রায়ই এ ঘটনাটা ঘটে। বাইরে এসে পশ্চিম পাশে দোতলার বারান্দায় দাঁড়ান প্রফেসর সালেহ। একটা চেয়ার টেনে বসেন। তাকান কদমগাছটির দিকে। প্রফেসর সালেহকে দেখে কদমগাছটি যেন নড়েচড়ে বসে। এখনই ছুড়ে দেবে সেই বিকৃত অট্টহাসি। যা আর কেউ টের পাবে না—এমনকি শতায়ু বটগাছটিও। এই কটু অট্টহাসি ইচ্ছে করলেই তিনি এড়িয়ে যেতে পারেন; কিন্তু এ হাসিটার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করতে চান তিনি।
জীবনে পরাজিত হতে ভালো লাগে না তার; কিন্তু মানুষ টের পায় না যে তারা শুধু এক পরাজয় থেকে আরেক পরাজয়ের মধ্যে একটু জিরিয়ে নেয়। এটাকেই তারা জয় বা সাফল্য বলে ধরে নেয়।

কদমগাছটির হাসিটা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। একবার তিনি বেডরুমে ফিরে যান, দেখেন স্ত্রী এক গভীর ঘুমে ডুবে আছেন। একটু দাঁড়ান সেখানে। এভাবে ঘুমাতে পারেন না তিনি কত দিন! পাশের ঘরে গিয়ে একটা ছোট গ্লাসে একটু পানীয় নেন। এক টুকরা আইসও ঢালেন তাতে। কাউকে ডাকলেন না। আবার ফিরে যান প্রশস্ত বারান্দায়—চেয়ারটিতে বসেন। এই গভীর রাতে সবাই গভীর ঘুমে অচেতন। শুধু প্রফেসর সালেহ আর কদমগাছটি মুখোমুখি।

একবার এক প্রবীণ অধ্যাপকের কাছে শুনেছিলেন, এই কদমগাছটি লাগিয়েছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক দার্শনিক প্রফেসর—১৯৭১ সালে। তিনি ছিলেন অনেকটা সন্ত প্রকৃতির। সংসার করেননি। সবার কাছে তিনি ছিলেন কিংবদন্তির মতো। তৎকালীন উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তিনি, মাঝে মাঝেই এসে এ বাংলোতে দাবা খেলতেন। এ কদমগাছটি রোপণের কিছুদিন পরই তিনি হানাদার বাহিনীর হাতে নিজেরই বাসায় নৃশংসভাবে শহীদ হন। সে হিসাবে এ কদমগাছটির বয়স পঞ্চাশ। প্রফেসর সালেহ এই ভেবে একটা আত্মবিশ্বাস ফেরানোর চেষ্টা করেন যে তিনি ওই কদমগাছটির চেয়ে এক যুগের বড়; কিন্তু তার এই বড়ত্ব কিছুদিন যাবৎ যেন কোনো কাজে আসছে না।

গত দশ বছর তিনি সব ধরনের যোগাযোগ বাড়িয়েছেন বহুগুণে। তার এই সফলতার মূল রহস্য—দিনরাত তিনি সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পরিষদের সভাপতির নাতির খতনা থেকে এলাকার এমপির বিবাহবার্ষিকী—কোনোটাই তিনি মিস করেননি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোতেও পা ফেলেছেন খুব সচেতনভাবে; কিন্তু এই সচেতনতায় তার শরীরের চামড়া ও এক বিজ্ঞানমনস্ক মগজ যে কত ভোঁতা করতে হয়েছে, তা শুধু তিনিই জানেন। একসময় মনে করতেন, স্ত্রীও বোধ হয় কিছুটা বুঝতে পারেন; কিন্তু পরে টের পেলেন, তার স্ত্রী তার সাফল্যের ঝলকানি গায়ে মেখে এক অদ্ভুত আবেশে ডুবে থাকেন। জীবনের আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করা যায়; কিন্তু পাশাপাশি যে গ্লানি, অট্টহাসি বয়ে বেড়াতে হয়, তা ভাগ করা দায়।

রাজনীতির ময়দানটা কেমন যেন দিন দিন আরও জটিল হয়ে উঠছে। আগের কৌশলগুলো এখন আর তেমন কাজ করে না। নেতা ইদানীং একটা পলিসি ফলো করেন—বিভিন্ন লোভনীয় পদগুলো একসঙ্গে একাধিক বা একজনকে একাধিকবার দেন না। তিনিও জীবনের অভিজ্ঞতায় অনেক কঠোর ও বাস্তববাদী হয়ে উঠেছেন। তাকে কোনো কিছু বোঝানো এত সহজ না। প্রফেসর সালেহর সামনে কয়েকটা অপশন আছে; দ্বিতীয় মেয়াদে আবার উপাচার্য হওয়া, উন্নত কোনো দেশের রাষ্ট্রদূত হওয়া অথবা শিক্ষাবিদদের জন্য বরাদ্দ কয়েকটি লোভনীয় পদ। যদিও প্রফেসর সালেহর শিক্ষাবিদ হওয়া তো দূরের কথা, শিক্ষার সাথেই যোগাযোগ নেই দীর্ঘদিন। তিনি এত দিন যাবৎ এগুলোর মধ্যেই তার ভাবনা সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন; কিন্তু সেদিনের সেই ঘটনা তাকে নতুনভাবে ভাবতে তাড়া দিচ্ছে।

তিন মাস আগের ঘটনা। এলাকার নানান রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার একটা সক্রিয় ভূমিকা ও অংশগ্রহণ আছে। এটা তিনি বিগত বছরগুলোতে আরও বাড়িয়েছেন। তার স্ত্রীর উৎসাহটা তার চেয়ে বেশি। সেদিন এলাকার একটা অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এসব অনুষ্ঠানের প্রকাশ্য কারণ বলে মানুষ যা মনে করে, অপ্রকাশ্য বিষয় থাকে তার চেয়ে ঢের বেশি। এসব বিষয়ের সদর-অন্দর গত দুই দশকে ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন প্রফেসর সালেহ। সেদিনের সে অনুষ্ঠানে এলাকার এমপি আসগর আহম্মেদও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী; যদিও এলাকার মানুষ তার কী ব্যবসা, কী পরিমাণ টাকা আছে, তার কিছুই পরিষ্কারভাবে জানে না। শুধু জানে—বিশাল ধনী। এলাকায় খুব বেশি যান না।

এই আসগর আহম্মেদদের রাজনীতিতে উত্থান খুব বেশি দিন নয়। দীর্ঘদিন যারা এলাকায় সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করে, তারা কেন্দ্রের কাছে এখন আর আগের মতো পৌঁছাতে পারে না। পাত্তাও পায় না। এখন তারা অনেকটাই অপ্রয়োজনীয়। আসগর আহম্মেদরা রাজনীতিতে অর্থকে মুখ্য করে দিয়েছেন, না অর্থ মুখ্য হয়ে যাওয়ায় আসগর আহম্মেদরা জরুরি হয়ে উঠেছেন রাজনীতিতে? এটা একটা চলমান ধাঁধা। সব প্রশ্ন নিয়ে প্রফেসর সালেহ এখন আর মাথা ঘামান না।

হঠাৎ একটা হট্টগোল বাধে। প্রফেসর সালেহরও ইতিমধ্যে একটা ক্রেজ তৈরি হয়েছে এলাকায়। অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। প্রফেসর সালেহ সামনে এগিয়ে যান। হঠাৎ এমপি আসগর পূর্ব শঙ্কা থেকে উত্তেজিত হন। তার মাথায় ভনভন করছে আসগর আহম্মেদের ওই কথাগুলো আর অট্টহাসিটি।
‘এটা কি আপনার বিশ্ববিদ্যালয় ভাবছেন? এখানে খেলতে টাকা লাগে, মানুষের সঙ্গে নানান খেলা খেলতে হয়।
খায়েশ হইলে নামেন দেখি খেলতে, কী হিম্মত আছে? কয় দিন টেকেন?’

স্ত্রী ও নিজস্ব কিছু লোকজনের সামনে এভাবে বলায় প্রফেসর সালেহ প্রচণ্ড অপমানিত হয়েছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার পথে শুধু ওই অট্টহাসিটাই ভেসে উঠছিল তার মাথায়—এমপি আসগরের সেই অট্টহাসি। স্ত্রীর সঙ্গেও খুব বেশি কথা হয়নি সেদিন। সেদিনই মনে মনে প্রফেসর সালেহ একটা সিদ্ধান্ত নেন। এমপি আসগরের সাথে একটা খেলা খেলতেই হবে। এখন তার শুধু চিন্তা কীভাবে আসগর আহম্মেদকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া যায়। প্রফেসর সালেহ এ-ও জানেন, সব খেলার কূটচালগুলো একই রকমের বিশ্রী; কিন্তু শিক্ষাঙ্গন নিয়ে খেলা আর আসগরদের নিয়ে খেলা, এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান, রাজনীতিবিদদের নিয়ে খেলা এক নয়; কিন্তু এ খেলা থেকে পিছু হটবার পাত্র তো প্রফেসর সালেহ নন।

এলাকা থেকে বেশ কিছু লোক ফোন করে গভীর রাতে, ‘এর একটা বিহিত করতে হবে, স্যার। আপনি পারবেন। আমরা আপনার সাথে আছি। রাজাকারের পুতরে এবার একটা খেলা দেখাতে হবে। ’ প্রফেসর সালেহ জানেন, আসগর আহম্মেদের বাবা ছিলেন ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, পিস কমিটির সভাপতি; কিন্তু সেসবের আজ আর কোনো মানে নেই। এটা অনেকটা অচল ইস্যু। নেতাও তো এসব জানেন। গত দুবারও এসব জানা সত্ত্বেও হঠাৎ করে নমিনেশন নিয়ে গেল। এলাকার বর্ষীয়ান নেতাদের তো কোনো মূল্যায়ন দল করেনি। এসব নিয়ে ভাবার মতো সময় হাতে নেই। আগামী সংসদ নির্বাচনের খুব বেশি দিন বাকি নাই। এর আগেই কিছু একটা করতে হবে। এখন নির্বাচনে তেমন কিছুই লাগে না। জনগণ লাগে না, প্রচার লাগে না, ভোট লাগে না। খালি নমিনেশনটাই লাগে। এটাই যত সব ঝামেলা।

এসব ভাবতে ভাবতেই প্রফেসর সালেহ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন—নির্বাচন তাকে করতেই হবে; এমপি তাকে হতেই হবে। আসগর আহম্মেদের কথাগুলো কানে বাজতে থাকে। শরীরটা একটু ক্লান্ত হয়ে একটা ঝিমুনি আসে। চেয়ারটায় এলিয়ে বারান্দায় বসে আছেন প্রফেসর সালেহ। রাত গভীর, কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ এক অট্টহাসি শুনতে পান প্রফেসর সালেহ। দেখেন কদমগাছটি হাসছে। প্রথমে একটু ভড়কে গিয়েছিলেন। ঝিমুনিটা ঝেড়ে ফেলে আবার তাকান গাছটির দিকে ভালোভাবে। স্পষ্টভাবে দেখতে পান কদমগাছটির সেই বিকৃত হাসি। সেদিনই শুরু। একটু আতঙ্কিত হয়ে বেডরুমে এসে ঘুমানোর চেষ্টা করেন প্রফেসর সালেহ; কিন্তু ঘুমটা শেষ পর্যন্ত আর আসে না।

এবার এক নতুন প্রজেক্ট নিয়ে নামেন প্রফেসর সালেহ—এমপি হওয়ার প্রজেক্ট। কাজটা মোটেই সহজ হবে না, সেটা ভালো করেই জানেন তিনি। এর আগেও বেশ কিছু প্রজেক্টের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। একটা প্রজেক্টের কথা তার মনে আছে, যেটার লিড কনসালট্যান্ট ছিলেন তিনি। বিশ্বব্যাংকের ঋণের অর্থায়নে প্রজেক্টটা সম্পন্ন হয়েছিল। তিন বছরের সে প্রজেক্টের প্রয়োজনীয়তা তিনি এখনো নির্ণয় করতে পারেননি; কিন্তু সে প্রজেক্টই তার জীবনে একটা জৌলুশ এনে দিয়েছিল। মাঝে মাঝে প্রফেসর সালেহর কাছে জীবনটাই একটা প্রজেক্ট মনে হয়। এর মধ্যে আবার নানান সাব-প্রজেক্ট, সেগুলো কখনো কখনো অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিতে হয়।

পার্টির অফিস ও ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোতে ধরনা দেওয়া শুরু হয় প্রফেসর সালেহর। গত দুই দশক প্রফেসর সালেহ যে পথে দৌড়ঝাঁপ দিয়েছেন, তা-ও কর্দমাক্ত ছিল; কিন্তু এই অঙ্গনের কদর্যগুলোর কোনো পোশাক পরানো নেই। তিনি নিজেও তার পোশাকের একটু পরিবর্তন আনেন। মাঝে মাঝেই এলাকায় যান। এলাকার কিছু স্থানীয় রাজনীতিবিদেরাও আসা শুরু করে তার উপাচার্যের বাংলোতে। স্থানীয় রাজনীতিকে যারা কেন্দ্র থেকে নেপথ্যে নিয়ন্ত্রণ করেন, এ রকম কিছু রাজনীতিবিদদের সাথে আগে থেকেই তার যোগাযোগ ছিল। তাদের বাসায়ও ইদানীং যাওয়াটা বাড়িয়ে দিয়েছেন।

স্বাধীনতার পর থেকে এক আঞ্চলিক রাজনীতিতে একক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন জামিল হোসেন। তিনি সব এমপি-মন্ত্রী বানান; কিন্তু নিজে কোনো দিন এমপি হতে পারেননি। দু-তিনবার চেষ্টা করেছিলেন। তার সম্পর্কে একটা কথা প্রচলিত আছে, তার এলাকায়—জনগণের ভোটে জামিল হোসেন কোনো দিন মেম্বারও হতে পারবেন না। তার বাড়িতে একবার দেখা করতে যান প্রফেসর সালেহ। এর আগেও তার সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছে; কিন্তু এবার জানি কেমন একটু ভয় ভয় করছে। সাহসটা ভালো করে সঞ্চয় করতে পারছেন না। বাড়িতে সাক্ষাৎপ্রার্থী অনেক। মনে হয় পীরের দোয়া নিতে আসছে মুরিদরা—নানান ধরনের মুরিদ। পীরের দিল খুশি হলে মুরিদদের ভাগ্য খোলে। আবার কেউ কেউ অন্যের ভাগ্য নষ্ট করার জন্যও তদবির করে। এ এক আজব আস্তানা!

নিজের ভিজিটিং কার্ডটা দেওয়ার পর তাড়াতাড়িই সাক্ষাৎ পান এক জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক গুরুর। বড় ড্রয়িংরুমে একটা গদিতে বসে পা দুটো টেবিলের ওপরে উঠিয়ে বসে আছেন জামিল হোসেন। আট-দশজন মানুষ তখনো বসা। ‘আসো ড. সালেহ। শুনলাম তোমার নাকি এমপি হওয়ার খায়েশ জাগছে?’
প্রফেসর সালেহ কোনো কথা না বলে একটু লাজুকভাবে জামিল হোসেনের পা ছুঁয়ে সালাম করেই কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসেন আর বলেন, ‘আপনার দোয়া নিতে আসছি। ’
মনে মনে বিড়বিড়িয়ে জামিল হোসেন বলতে থাকেন, গত পঞ্চাশ বছর যাবৎ তো খালি দোয়াই করলাম।
এক অজানা অহংকারের সুর বেজে ওঠে জামিল হোসেনের ভেতরে।
‘তা ড. সালেহ, তুমি শিক্ষিত ভদ্রলোক মানুষ, ইউনিভার্সিটির ভিসিগিরি ছাইড়া আসগরের লগে ভ্যাজালে নামবা ক্যান? এলাকার লোকজনের সাথে যোগাযোগ করো? হ্যারা কী কয়?’
প্রফেসর সালেহ আমতা আমতা করে বলেন, ‘আপনি দোয়া করলে এলাকার মানুষজন কোনো সমস্যা হবে না। ’
প্রফেসর সালেহ, জামিল হোসেনসহ সকল আমজনতাই জানে, নির্বাচনে জনগণ এখন আর কোনো ফ্যাক্টর না। কৃষক ছাড়া কৃষি হয়, ডাক্তার ছাড়া চিকিৎসা হয়, ভোটার ছাড়া ভোটও হয়। খালি জামিল হোসেনদের ছাড়া কেন জানি কোনো কিছুই হয় না। প্রফেসর সালেহ বুঝতে পারেন, এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। ওঠার অনুমতি চান জামিল হোসেনের কাছে।
বলেন, ‘যাও, যোগাযোগ কইরো, দেখি কী করন যায়। ’
বেরিয়ে আসে প্রফেসর সালেহ। আরও একবার সালাম করবেন কি করবেন না, এই দোটানা মাথায় নিয়েই বেরিয়ে আসেন।

হাতে খুব বেশি সময় নেই। সবার সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেন প্রফেসর সালেহ। এই বাষট্টি বছরের জীবনে তার ব্যর্থতা যে নেই, তা নয়; কিন্তু ব্যর্থতার চেয়ে সফলতাই বেশি। সবার মধ্যে ঘটনাটা জানাজানি হওয়ার পর একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল; কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন তাকে নিরুৎসাহিত করল। আবার অনেকে তার এ প্রজেক্টে একটু তা দিয়ে তার স্বপ্নকে রাঙিয়ে দিল।
তারা বলল, ‘নেতার আপনার প্রতি যে নেক নজর, তা এমপি একবার হইতে পারলে শিক্ষামন্ত্রী অথবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় তো আপনার নিশ্চিত। ’
আশপাশের কিছু মানুষ, যারা সারাজীবনে একটা টয়লেটও বানাতে পারেনি, তারাই কথায় কথায় উজির-নাজির মারে। দেশ চেঞ্জ করে ফেলে। এই খেলা যে কত ভয়ংকর, তা গত বিশ বছরে তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন এই ভদ্র কাপড়ে আবৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বস্ত্রটাও এখন খসে পড়ার উপক্রম; তা তিনি ভালোই জানেন।

নানাজনের নানান পরামর্শের মধ্যে তার বিশ্বস্ত জুনিয়র কলিগ ড. সাঈদ তাকে মনে করিয়ে দেন, ‘স্যার, আজকাল রাজনীতিতে কেন্দ্রের চেয়ে কিছু উপকেন্দ্র বেশি পাওয়ারফুল। লাইন ওই দিকে লাগানো লাগবে। এলাকার মানুষজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে লাভ নেই। ’ ড. সাঈদের কথাটি প্রফেসর সালেহর মনে ধরেছে। তিনি যে এ বিষয়টা বোঝেন না, তা নয়; কিন্তু ওই দুই অট্টহাসিতে কেমন জানি সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। সামনের কয়েকটা দিন মনোযোগ দিতে হবে ক্ষমতার উপকেন্দ্রগুলোর দিকে। মুহূর্তেই কিছু যোগাযোগের ফন্দিফিকির ভাবতে থাকেন প্রফেসর সালেহ।

দুই সপ্তাহ পরেই দলের প্রতিষ্ঠাতার শাহাদাতবার্ষিকী। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এলাকায় এটা ঘটা করে পালন করতে হবে। প্রতিবছর সংগঠনের পক্ষ থেকেই এটা আয়োজন করা হয়। এমপি আসগরই টাকাটা দেন। এবার এমপি আসগর আহম্মেদের বাজেট আরও বেশি, আয়োজন আরও বড়। তার লোকজন এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। প্রফেসর সালেহর সাথেও একদল লোক কেন্দ্রে ও আর একদল এলাকায় যোগাযোগ করে এবং মনে করিয়ে দেয় এমপি আসগরকে টেক্কা দেওয়ার এটাই একটা মোক্ষম সময়। প্রফেসর সালেহ সবার কথাই শোনেন এবং একটা বড় অনুষ্ঠান করার সব আয়োজন করতে বলেন। মোটামুটি লাখ পাঁচেক টাকার একটা বাজেটও করেন। নিজেরও একটা ভাবনা আছে, অনুষ্ঠানটার মধ্যে একটা সুস্থ সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটাবেন।

এগুলো মাথায় রেখে যথাযথ একটা আয়োজনের ঘোষণা দিয়ে নিজের নাম ব্যবহার করে এলাকায় পোস্টার ছাপিয়ে দেন। ছোটখাটো কিছু সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে এগোয় সময়। অনুষ্ঠানের আগের দিন সন্ধ্যায় গিয়ে হাজির হন জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয়। সেখানে স্থানীয় সুধী ও রাজনীতির কিছু মানুষের সঙ্গে তার একটা ছোট মিটিং হয়। অনুষ্ঠানের দিন সকালবেলা গিয়ে যথাসময়ে হাজির হন অনুষ্ঠানে। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আসগর আহম্মেদের লোকেরাও আয়োজন করে অনুষ্ঠান করছে। থানার রাজনীতিবিদেরা বিভক্ত হয়ে গেছে। পদবঞ্চিত কিছু নেতা প্রফেসর সালেহর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন।

দীর্ঘদিন পর স্থানীয় রাজনীতি অনেকটা সরগরম। তিন শ গজ দূরত্বে একই দলের দুটি গ্রুপের, তাদের নেতার শাহাদাতবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের দুটি ভিন্ন মঞ্চ। নতুন খেলোয়াড় হিসেবে প্রফেসর সালেহর সূচনাটা একটু পানসে লাগছে। দর্শকেরা খুব একটা আনন্দ পাচ্ছে না; কিন্তু একজন শিক্ষিত সজ্জন রাজনীতিতে আসছে, এটা ভেবে কিছু মানুষ খুশি। বাসস্ট্যান্ড, চায়ের দোকানে সবাই অনেক দিন পর আলোচনার একটা ইস্যু পেয়েছে।
নানাজনের নানান কথার মধ্যে চায়ের দোকানদার হাসমত বলে, ‘হোনেন, ওই আসগর এমপি ঘাগু মাল। হের বাপ-দাদার আমল হইতে রাজনীতি করে। বুকে অনেক সাহস। টাহার কুমির। হের লগে টক্কর দেওয়া অত সোজা না। হের লগে সালেহ প্রফেসর টেকব না। ’

হাসমতের কথাই ঠিক। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই আসগর এমপির লোকজন হামলা চালায় প্রফেসর সালেহর শোক র‌্যালিতে। উদ্দেশ্য ছিল প্রফেসর সালেহকে একটা ভয় পাইয়ে দেওয়া; কিন্তু এর মধ্যে একটা বেওয়ারিশ আধলা ইট এসে পড়ে প্রফেসর সালেহর মাথায়। মাথা ফেটে রক্তাক্ত হয় তার শরীর। স্থানীয় একটি হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে নিয়ে আসা হয় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। এখন এই হাসপাতালের একটি কেবিনে শুয়ে আছেন প্রফেসর সালেহ। তিনটি সেলাই লেগেছে মাথায়। তেমন গুরুতর নয়। দু-একদিন পরেই বাসায় ফিরতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ও এলাকার লোকজন খবর পেয়ে হাসপাতালে ভিড় করেছে আজ সারা দিন। রাত দশটার পর সব লোকজন চলে গেছে। এই মুহূর্তে পাশের বিছানায় শুধু স্ত্রী আছেন। তিনি ঘুমাচ্ছেন। প্রফেসর সালেহ একটা বিষয় বুঝে উঠতে পারছেন না দীর্ঘদিন থেকেই—তার স্ত্রী শায়লা কীভাবে ঘুমান নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও।

রাত দেড়টা বাজে। প্রফেসর সালেহ ঘুমানোর চেষ্টা করছেন; কিন্তু ঘুম আসছে না। কেবিনটা ১২ তলায়। জানালা দিয়ে রাজধানীর আলোগুলোকে অনেকটা ক্লান্ত মনে হচ্ছে। জানালার কাছটা কিছুটা আলো-আঁধারির খেলায় মেতেছে। বালিশে ঠেস দিয়ে শুয়ে আছেন প্রফেসর সালেহ। হঠাৎ দেখতে পান কদমগাছটি এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছে। এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে কদমগাছটি। উঠে বসেন প্রফেসর সালেহ—ভালো করে খেয়াল করেন তিনি কোথায় আছেন। বাংলোর পশ্চিম বারান্দায়, নাকি হাসপাতালের কেবিনে? নিশ্চিত হন, হাসপাতালের কেবিনেই আছেন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, কদমগাছটি আর অট্টহাসিটি হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। একটা অজানা আতঙ্ক পেয়ে বসে প্রফেসর সালেহকে। তিনি তাকান স্ত্রীর দিকে।

প্রফেসর শায়লা আফরিন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন নাজলী আহমেদ। নাজলী ছিলেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত প্রফেসর নাজির আহমেদের ছোট মেয়ে। ইংরেজি সাহিত্যের তুখোড় ছাত্রী। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার সরব অংশগ্রহণ ছিল। রাজনীতি সম্পর্কেও তার মতামত ছিল খুবই স্পষ্ট। প্রফেসর সালেহ জীবনে বহু নারী দেখেছেন; কিন্তু এমন আত্মপ্রত্যয়ী নারী তিনি খুব কমই পেয়েছেন।

কেবিনের আলোটা বন্ধ করে দেন প্রফেসর সালেহ। শুধু হালকা একটা আলো ছড়াচ্ছে টেবিল লাইটটি। তার চোখে ভেসে উঠল নাজলীর মুখখানি। উচ্চবিত্তের উচ্চশিক্ষিত, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা এক প্রগতিশীল নারী। জীবনের অনেকগুলো অলিগলি তার কাছে ছিল পরিষ্কার। কোনো কিছু কেন করেন এবং কেন করেন না, তার এক স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকে তার। অজপাড়াগাঁয়ের নিম্নবিত্ত একটা পরিবারে বেড়ে ওঠা সালেহর সঙ্গে সংসার শুরু করতে তার কোনো কুণ্ঠা ছিল না। প্রফেসর সালেহ গ্রামের স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষায় অসাধারণ ফলাফল করেছিলেন। তারপর আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অসাধারণ ফল করেছিলেন। তার রেজাল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বছরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ; গোল্ড মেডেলও পেয়েছিলেন। মেট্রিকেই তিনি শুধু মেধাতালিকায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন। এরপর আর কখনো তিনি দ্বিতীয় হননি।

রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে খুব সক্রিয় না হলেও প্রফেসর সালেহর এগুলোর প্রতি এক গভীর আস্থা ও শ্রদ্ধা ছিল। নিজের শিকড়, বাঙালি সংস্কৃতি ও সাম্যবাদী সমাজের বিষয়টা তার ভেতরে প্রথিত ছিল। এ জন্য নাজলী তাকে সম্মান করতেন। মাস্টার্সের ফলাফলের ছয় মাসের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি। এক বছর পরে একটা প্রেস্টিজিয়াস বৃত্তি পেয়ে পিএইচডি করতে চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চার মাস আগে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন নাজলী আহমেদের সঙ্গে। নাজলী তখন এমএ পরীক্ষা মাত্র শেষ করেছেন। নাজলীও পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে প্রফেসর সালেহর সাথে। নাজলী একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রিয়েটিভ আর্টের ওপরে তার দ্বিতীয় মাস্টার্স করেন।

প্রফেসর সালেহর গবেষণাটা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমিয়ায় এটা একটা মর্যাদা পায়। তার দুটি লেখা খুবই মর্যাদাপূর্ণ জার্নালে স্থান পেয়েছিল। তাকে নিয়ে তার সুপারভাইজার ও অন্যান্য প্রফেসর খুবই আশাবাদী হয়ে ওঠেন। ওখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়া ও কাজের সুযোগ পেয়ে যান; কিন্তু সেসব পেছনে ফেলে দেশে ফিরে আসেন এবং আবার পুরোনো কর্মস্থলে যোগদান করেন। এখন তার ধ্যানজ্ঞান শুধুই গবেষণা এবং এই গবেষণার একটা কালচার বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করা। সিনিয়র প্রফেসররা, বিশেষভাবে তার শ্বশুর প্রফেসর নাজির আহমেদ সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন। নাজলী আহমেদও তার সঙ্গে দেশে ফিরেছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে যোগদান করেছিলেন।

কিছুদিন বেশ ভালোই চলছিল। দেশে ফিরেও শিক্ষকতা ও কিছু গবেষণার ব্যাপারে খুবই মনোযোগী ছিলেন প্রফেসর সালেহ। তরুণ শিক্ষার্থীরা খুবই উৎসাহিত হয়েছিল। অনেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন যে দেশে এবার বিজ্ঞান গবেষণার একটা দেশীয় সংস্কৃতি শুরু হবে। যদিও প্রফেসর সালেহ সেই তরুণ বয়সেই বুঝতে পেরেছিলেন, বিজ্ঞান গবেষণা একক কোনো বিষয় নয় এবং এর জন্য একটা সুন্দর অবকাঠামো দরকার। ওই প্রতিকূলতার মধ্যেও তার আরেকটি গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক মহলের বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

কিন্তু হঠাৎ করেই যেন এই সব ইতিবাচক ইচ্ছা ও শক্তি এক ভুল পথে প্রবাহিত হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রংবেরঙের হলি খেলায় মেতে ওঠেন তরুণ প্রতিভাবান শিক্ষক-গবেষক ড. মুহাম্মদ সালেহ। স্ত্রী নাজলীর সঙ্গে আস্তে আস্তে একটা দূরত্ব তৈরি হয়। নাজলী টের পান—মানুষটা ভুল পথে পা বাড়াচ্ছেন, যা তার তৃষ্ণা ও চরিত্রবিরুদ্ধ। তা দু-একবার নাজলী স্পষ্টভাবে বলেছেন প্রফেসর সালেহকে। একটা কথা খুব মনে পড়ে—নাজলী ওই সময়ে প্রায়ই বলতেন, ‘এসব করার জন্য তোমার জন্ম হয়নি। ওই সব ন্যাস্টি পলিটিকস করার লোকের এখানে অভাব নেই। ’
প্রফেসর সালেহ নাজলীকে বলেছিলেন, ‘এই কালচারের একটা পরিবর্তন দরকার। আমার মনে হয়, আমরা এগিয়ে গেলে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। ’
অবশ্য কিছু সিনিয়র শিক্ষকেরাও তাকে এ পথে পা বাড়াতে উৎসাহিত করেছিলেন।

এরপর এক তরুণ প্রতিভাবান শিক্ষক ও গবেষকের এক বিপরীতমুখী উত্থান পর্ব। এক অপেক্ষাকৃত শক্ত রঙের ছায়ায় তার শুধু ওপরে ছোটা। কিছুদিন পর নাজলী আহমেদ পিএইচডি করতে ইংল্যান্ডে চলে যান। মাস কয়েক পরে তিনি সম্পর্কটা আর কন্টিনিউ করতে চান না বলে একটা চিঠি লেখেন। সে চিঠি ও তার অবস্থান ছিল যুক্তিপূর্ণ। প্রফেসর সালেহ কোনো ব্যাখ্যা না চেয়ে তার কাছ থেকে অফিশিয়াল লেটার চান এবং তিনি তা পজিটিভলিই গ্রহণ করবেন বলে তাকে আশ্বস্ত করেন। কয়েক মাসের মধ্যে অফিশিয়ালি ডিভোর্স হয়ে যায় তাদের। পরে শুনেছেন নাজলী এক স্কটিশ লেখককে বিয়ে করেছেন। তিনি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান ও নভেল লেখেন। গোটা দুই আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছেন। পরে তার সঙ্গে আরও দুবার দেখা হয়েছে, স্বামীসহ একবার। তার সর্বশেষ উপন্যাসটি আন্তর্জাতিকভাবে খুবই সমাদৃত হয়েছে। এটা এখনো পড়া হয়নি প্রফেসর সালেহর। প্রফেসর সালেহর দীর্ঘদিন থেকেই কোনো কিছু পড়ার আর সময় হয় না। পড়ার অভ্যাসটাও নষ্ট হয়ে গেছে।

কেবিনের জানালা দিয়ে দূরে তাকানোর চেষ্টা করেন। এ শহর যেন শ্রান্ত, ক্লান্ত—অঘোরে ঘুমাচ্ছে। চোখ যায় শায়লার দিকে। শায়লাও কি ক্লান্ত? মানুষের ভেতরের ক্লান্তি অনেক সময়ই টের পাওয়া যায় না। নাজলী আহমেদের সঙ্গে অফিশিয়ালি বিচ্ছিন্ন হওয়ার ছয় মাস পর বিয়ে করেন সমাজবিজ্ঞানের প্রভাষক শায়লা আফরিনকে। শায়লার সঙ্গে গত উনত্রিশ বছর সংসার করছেন। শায়লা মধ্যবিত্ত পরিবারের এক সংগ্রামী ও আত্মসচেতন নারী। তার নাজলীর মতো বিস্তৃত কোনো জগৎ নেই। প্রফেসর সালেহর এই যে সফলতার গল্প, তার এক সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছেন শায়লা। প্রফেসর সালেহ খুব অসহায়ভাবে তাকান শায়লার দিকে।

এখন তার নিজেরই নিজের দিকে তাকাতে ইচ্ছে হচ্ছে একবার। বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে যান, আয়নায় ব্যান্ডেজ করা মাথাসহ শরীরের ওপরের অংশটা দেখেন ভালোভাবে। হঠাৎ সেই কদমগাছটি জীবন্ত হয়ে ওঠে আয়নায়। আবার সেই অট্টহাসি। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারেন না প্রফেসর সালেহ। চিৎকার করে বের হয়ে আসেন ওয়াশরুম থেকে। চিৎকারের শব্দে তার স্ত্রীর ঘুমও ভেঙে যায়। হতভম্ব হয়ে উঠে বসেন—দেখেন আতঙ্কে আচ্ছন্ন হয়ে বেডে বসে আছেন প্রফেসর সালেহ। স্ত্রী আলোটা জ্বালান।
প্রফেসর সালেহকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হয়েছে? পানি খাবে?’
এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেন। তখনো তার ঘন নিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে হাসপাতালের কেবিনটিতে। এক চুমুক পানি নেন মুখে। চোখটা বন্ধ করে স্ত্রীকে বলেন, ‘লাইটটা বন্ধ করে দাও আর তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। ’

ঘুমানোর চেষ্টা করেন প্রফেসর সালেহ। ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে যাচ্ছে; কিন্তু ভেতরে একটা উথালপাতাল চলছে। প্রফেসর সালেহ মনে করার চেষ্টা করেন তার সর্বশেষ একক গবেষণাপত্র বেরিয়েছে বিশ বছর আগে। সেবারই তিনি প্রফেসর পদে নিয়োগ পান। এরপরে যৌথ কিছু কাজ করেছেন, সেগুলো ছাপানোর চেয়ে না ছাপানোই ভালো ছিল। তার এই বিশ বছরের যে উন্নতি ও সফলতা চারপাশের মানুষ দেখে, আনন্দিত হয়, প্রশংসা করে, তা আসলে একজন মানুষের সুশৃঙ্খল পতন। তার এই হেরে যাওয়া বা অধোগতি বোধ হয় সূচনাপর্বেই টের পেয়েছিলেন নাজলী আহমেদ। প্রফেসর সালেহকে গত বিশ বছর সফলতার একেকটি সিঁড়ি স্পর্শ করতে গিয়ে এমন সব কাজ করতে হয়েছে, যা পরিবর্তনের উদ্দেশ্যেই তিনি তার যাত্রা শুরু করেছিলেন।
যে প্রক্রিয়ার পরিবর্তনের জন্য তিনি এ পথে পা বাড়িয়েছিলেন, তারই এক স্থূল ক্রীড়নক হয়ে উঠেছেন নিজের অলক্ষ্যেই। নিজের এ ক্ষয় নিজে বোধ হয় টের পাওয়া যায় না। টের পাওয়ার মতো স্থিরতা তার আসেনি বহুদিন।

দুই দিন পর নিজের বাংলোয় ফেরেন প্রফেসর সালেহ। একান্ত কিছু অফিশিয়াল অ্যাপয়েনমেন্ট ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা করেন না। ঘর থেকে কোথাও বের হন না; এমনকি বারান্দায়ও যান না। প্রশাসনের এক কর্মকর্তাকে ডেকে কদমগাছটিকে কাটার ব্যবস্থা করতে বলেন। দুপুরে শুনতে পান ইলেকট্রিক করাতের শব্দ। অনেক দিন পর মেয়ের সঙ্গে বিকেলটা ও সন্ধ্যাটা কাটান প্রফেসর সালেহ। সন্ধ্যায় এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে বাংলোয়। এভাবে আরও একটি দিন কেটে যায় প্রফেসর সালেহর। গত ৩৬ ঘণ্টায় তিনি আর কোনো অট্টহাসি শুনতে পাননি। তিনি নিজেকে কিছুটা মুক্ত বোধ করেন। একটু বেরোনোর ইচ্ছে জাগে তার।

সন্ধ্যায় মেয়ে এসে নাজলী আহমেদের লেখা সর্বশেষ উপন্যাসটি হাতে দেয়। একেবারে নতুন বই। সাফল্য ও ব্যর্থতার আখ্যান। পৃষ্ঠা ওলটান—প্রথম লাইনটায় চোখটা আটকে যায়, ‘তারা সফলতার ব্যাখ্যা তাদের মতো করে; কিন্তু ব্যর্থতা, পরাজয় শুধু নিজেকেই বহন করতে হয়—একান্তেই। ’ নিমগ্ন হয়ে পড়তে থাকেন উপন্যাসটি। অনেক দিন পর মনোযোগ দিয়ে নিবিষ্ট মনে একটা বই পড়ছেন। অনেক রাত হয়ে গেছে। বইটির মাঝামাঝি পৌঁছে গেছেন প্রফেসর সালেহ। একটু বিরতি নেন।

দরজা খুলে পশ্চিমের বারান্দায় পা বাড়ান—পাতানো চেয়ারটায় বসেন। নিশ্চিন্ত মনে তাকান ওই দিকটায়, আজ আর কোনো অট্টহাসি নেই। ওপাশটায় আজ আলো একটু কম; কিন্তু কী যেন একটা জলজ্যান্ত তার চোখে ভেসে ওঠে। একটু আঁতকে ওঠেন। ভালো করে বোঝার চেষ্টা করেন। রেলিংটার দিকে একটু এগিয়ে যান, চেয়ার ছেড়ে ঝুঁকে ভালো করে তাকান। একজন জীবন্ত ও পূর্ণাঙ্গ মানুষ দেখতে পান। বহুদিন এ রকম একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের দেখা পাননি তিনি।

কে যেন একটা ছোট গাছের চারা রোপণ করছেন আর তাতে একটু একটু করে পানি ঢালছেন নিবিষ্ট মনে। স্থিরভাবে দেখার চেষ্টা করেন। সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন নিচতলায়। এই মধ্যরাতে কোনো তাড়া নেই। দীর্ঘ অনেক দিন পর আজ যেন কোনো তাড়া নেই। অনেকটা নির্ভার। ধীরে ধীরে এগিয়ে যান। কাছে গিয়ে দাঁড়ান। একজন মানুষ সাদা পাঞ্জাবি পরা আর পরনে সাদা চেক লুঙ্গি। তিনি ধীরে ধীরে মমতাভরে পানি ঢালছেন চারাগাছটিতে। প্রফেসর সালেহ একটু পরে বুঝতে পারলেন—মানুষটি সেই দার্শনিক প্রফেসর যিনি একাত্তরে শহীদ হয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২২
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।