ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২২
হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা

 

বিফল বৈকল্য
মন ভাঙলে জোড়া লাগবে এমন মলম
আছে কি না জানা নাই
মনের ব্যারাম হলে
দেহে মনে ভিতরে উপরিতলে
দরকারি ন্যূনতম উপশম
ত্রিভুবনে খুঁজিয়া বেড়াই
মন ওরে পোড়াধুড়া মন
কোথায় যে এলোমেলো করো বিচরণ
নিষ্কৃতি অনেক দূর কতটুকু পাই
মনোচাষ করতে থাকি হয়তো বৃথাই...

 

বিচ্ছেদিয়া তুষ্টি সুখ
পুবালী বাও পুবালী বাও
একটুখানিক পরশ দিয়া যাও
দুঃখ যাতন আমার থাকুক
সেসব আমার জ্বলন্ত সুখ
আনন্দটুক নিংড়ে চেঁছে নাও!
যে দেয় ব্যথা তার দখলে দাও
তাও সে নারী সুখে থাকুক তাও
সহ্য করি, নাই প্রতিবাদ রাও!
ভুল করে ভালোবাসলে

কে বলে বিস্মৃতিধুলো সেই ছবি আড়াল করেছে
দেখি আরো জ্বলজ্বলে, আরো সত্য, আরো দৃঢ়মূল
যে বলে ভুলেছি সব, এই কথা ডাহা মিছে ভুল
ভুলে যাওয়া অতটা সহজ নয়, যতটুকু ভাবি
কী করে যাবে তা ভোলা, নৃত্যময়ী সেই দুল
ঘামের বিন্দুর সঙ্গে মিতালি করেছে ওই প্রিয় নাকছাবি
স্মৃতি নয় কুয়াশা ঝাপসা নদী, বহে নিত্য নিরবধি
আমি তাকে ভুল করে সর্বাত্মক ভালোবাসি যদি
তাহলে কীভাবে সম্ভবপর বিস্মৃতির খাবিখাওয়া ভয়
ভুলিনি ভোলার মতো এই স্রোত পরম্পরা কোনোদিনই
 যে আমাকে পোড়ায় জখম করে, আনন্দ সে কুড়ায় নিশ্চয়।

 

জোড়া পঙ্ক্তি

১.
ডানা থাকলে ওড়ার আনন্দশক্তি মিলতো কিছুটা
সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে আশাহত দুরাশায় বাঁচি...
২.
ছলনায় পটীয়সী ওই লুব্ধ সাপিনীকে কতটুকু চিনি?
ঝাঁপ দিই উদ্যত ফণার নিচে বেকুব যেহেতু...
৩.
পাইনি বলেই ভালোবাসতে মরতে এত সুখ
এমন সুখের আনন্দ কী সবাই পেতে জানে?
৪.
দাহ্যশক্তি একমাত্র তোমাকেই দিয়েছেন বিধি
আমার কপাল শুধু ঝুরে ঝুরে দহনের জন্যেই নির্মিত
৫.
বিচ্ছেদিয়া বন্দিশের পরতে পরতে আমি লুকিয়ে রয়েছি
 কেউ নাই সেই মর্ম উদ্ধারের মতো যোগ্যা মেধাবিনী
৬.
পাথরে ফোটাবো ফুল এইমতো প্রতিজ্ঞা করেছি
কিন্তু সেই পাথরের কাছে গেলে ছুঁতেই পারি না...
৭.
লিখতে যাই শিশিরের শব্দগন্ধ, অগ্নিফুলকি হয়
মিলন আরাধ্য কিন্তু বিচ্ছেদের বীজ বুনতে মরিয়া হৃদয় 
৮.
ভিতর উপরিতল সবখানে তুমি আছো, তারপরও নাই
আড়ালবর্তিনী এক আলোছায়া অশরীরী ধূপের ধোঁয়ায়
৯.
কবেকার হারানো রুমাল যদি হঠাৎ পেয়েছি খুঁজে
শুকনো চুম্বনের স্মৃতি হাতড়ে ফিরি, কোনো চিহ্ন নাই
১০.
জানতাম ভাঙা নায়ে চড়বার পরিণতি, জেনেও কী এড়ানো গিয়েছে?
নিমজ্জন ছিল ঠিকই অনিবার্য, তার জন্যে অনুতাপ করি না ভুলেও
১১.
পাবো না পাবো না জানি, তাও ভুলে দু’হাত বাড়াই
রক্তাক্ত জখমসহ ভাঙা হাত ফিরে আসে তরী ডোবে তীরে
১২.
দিনগুলো চলে গেছে স্মৃতি কিন্তু সতেজ এখনো
 ঠোকরায় অহর্নিশ, দংশনের লালা বিষে জর্জরিত আমি
১৩.
আধেকটুকু উন্মোচিত, তার দহনেই ভস্মীভূত ছাই
তুরীয় সেই আনন্দসুখ সবটুকুনই লুটেছো একলাই
১৪.
পাঁজর পুড়িয়ে আমি যথাসাধ্য তোমাকে রচনা করি
একজন্ম কেটে গেল, অর্ধেক প্রতিমা গড়া এখনো হলো না
১৫.
বুকের গোপনে ব্যথা প্রশমন কিছুমাত্র নাই
অন্তিমে ব্যথারও কিন্তু একপ্রকার সম্মোহন আছে...

 

নম্রতানিঃসঙ্গ ঋতু
ব্যথাভারাতুর এক নম্র ঋতু।


                 মিইয়ে আসা রোদ।
               হালকাপলকা শৈত্যছোঁয়া।
আবছা এক সময়ের ছায়ারেখা
                     হেমন্ত সে নিস্তেজ নদীর ছবি।
ধানসিঁড়ি নদী আর নাই
পড়ে আছে ঝরাপালকের ধু ধু স্মৃতি 
                 ধূসর জীবনানন্দ দাশ
                    হেমন্তের আলতো আঁচড়ে
ফুটে ওঠা নিঃসঙ্গ কবির কষ্ট মনোরঙ
হেমন্ত কী একাকিত্ব পান করে করে
আরো একা দূরগামী ঝাপসা হয়ে যাবে?


মুক্তিস্বপ্ন দূরবর্তী নয়
মুক্তিকামী মানুষের বুভুক্ষা ও মুমূর্ষু মিছিল
                             বড়ো হচ্ছে দিন দিন
রক্তমাখা পথ বেয়ে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে
            দেশান্তরে, অনিশ্চিত অন্ধকারে
                       ধুঁকে ধুঁকে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে
পথ চলছে মানবতা, পুঁজে বিষে গ্লানি পাপে
                          জর্জরিত বিশ্বের বিবেক
আরাকান নয় শুধু,
মানবিক সভ্যতাই বর্তমানে ধর্ষিতা লাঞ্ছিতা
রোহিঙ্গাই নয় শুধু শরণার্থী, উদ্বাস্তু উন্মূল
সুস্থ স্বাভাবিক সব মানুষেরই জীবনযাপন
কাঁটাতারে সহিংসতা জিঘাংসা ও বুটের তলায়
পিষ্ট ও দলিত চূর্ণ বিধ্বস্ত অঙ্গার
কিন্তু আমরা জানি এই ধ্রুব সত্য
এই দিনই শেষ নয়, নতুন ভোরের স্বপ্ন আশা ও প্রত্যয়
স্পষ্ট আর সুনিশ্চিত হবে একদিন
সেই দিন সন্নিকটে খুব একটা দূরবর্তী নয়॥  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।