প্রায় ২০ ঘণ্টা পথে পথে কেটে গেছে তখন। দেশ বদলেছি, শহরও।
লম্বা বাস যাত্রায় বাংলাদেশে একটা সমস্যা সবসময় অনুভব করি- যখনই চোখ লেগে আসে, এরা তখনই স্টপেজ দেয়। ঘুম ভেঙে যেতে আর কিছুর দরকার হয় না। এই যন্ত্রণা ভারতে এসেও কাটেনি। এখানকার মানুষও ঢাকার মতোই; ফুটপাতে বাইক তুলে দেয়, মানুষ ঠকানোর ধান্দায় ঘুরে বেড়ানো লোকও অনেক।
দিল্লি থেকে ধর্মশালার পথ প্রায় ১২ ঘণ্টার। এর মধ্যে প্রথম স্টপেজ ছিল হরিয়ানায়। বাস চলতে দেখতে সবসময় ভালো লাগে। ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তায় বহুবার চড়েছি, তবুও প্রতিবারই যাওয়ার সময় বাইরে তাকিয়ে থাকি।
রাস্তার পাশের পথের একটা অদ্ভূত রকমের মায়া আছে। সম্ভবত ভরপুর জোছনা দেখা অথবা ঘোর অন্ধকারে ঘাঁপটি মেরে বসে থাকার আনন্দও একই রকম। রাতের আঁধারে সেসব দেখার অবশ্য উপায় নেই। তবুও পথটা মন্দ না। রাস্তার পাশে নানা রকমের শাটার বন্ধ করা দোকান, সেসব পড়তে পড়তে সময় কাটানো খারাপ কিছু না।
ঘণ্টাখানেক চলার পর হরিয়ানার এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে বাস থামলো। গিয়ে দেখি শত-শত স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে। একটু পর বুঝতে পারলাম- তারা সব একই জায়গার, পিকনিক-টিকনিক টাইপের কিছু করতে যাচ্ছে। আনন্দ পেলাম অবশ্য রেস্টুরেন্টে ঢোকার পথে। বিশালদেহী এক ভদ্রলোক, মাথায় তার পাগড়ি, মুখে লম্বা গোঁফ। দাঁড়িয়ে আছেন বুড়ো মানুষের লাঠি হাতে।
মশা কামড়ে গেলে তার অবশ্যই টের পাওয়ার কোনো কারণ নেই; নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়। একটু ধাক্কা দিতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ভিনদেশি পাসপোর্ট নিয়ে কাজটা বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে; ওই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে তাই খেতে গেলাম। হিন্দি বলা নিয়ে ঝামেলা ইন্ধিরা গান্ধী এয়ারপোর্টে নামার পর থেকেই হচ্ছে।
এমনিতে ভাষাটার প্রায় সবই বুঝি। কিন্তু তেমন বলতে পারি না, কখনো অবশ্য চেষ্টাও করিনি। বাংলার সঙ্গে ‘হা’, ‘হু’ লাগিয়েই কাজ চালাতে হচ্ছিল। কিন্তু রেস্টুরেন্টের যে ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হলো, তিনি বোধ হয় নিজেও হিন্দিতে দুর্বল। ভারতের বিশালতার মাঝে এমন কিছু খুব স্বাভাবিকও।
ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ‘হে’ ‘হু’ তে হিন্দি বলার পর তিনি মেন্যুটা কোথায় আছেন দেখিয়ে দিলেন আঙুল দিয়ে। খাবারের ফর্দের প্রথম নাম- গোল গাপ্পে। হিন্দি সিনেমা- ওয়েব সিরিজ প্রায় নিয়মিতই দেখি। ক’দিন আগে অ্যামজনের একটা ওয়েব সিরিজে গোল গাপ্পের নামটা শুনেছি বলে স্পষ্ট মনে আছে।
ওই স্মৃতি থেকেই গোল গাপ্পে খাওয়ার খুব ইচ্ছে জাগলো। কী জিনিস হবে- এটা ভেবে একটু পুলকিতই হলাম। ভারতে আসার আগে এখানকার খাবার-দাবার নিয়ে তো আর কম শুনিনি, গুগল ঘেটেও অনেক কিছু দেখে এসেছি; ওসব খাবারের ভালোর দিককার কিছু হবে বলেই ধারণা করে অপেক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
রেস্টুরেন্টের এক লোক ‘গোল গাপ্পে...’ বলে ডাকতেই আগ্রহ নিয়ে গেলাম। ওমা! এ তো দেখি বাংলাদেশের ফুচকা। তাও আবার দু-তিনটা দানার মতো কিছু একটা দেওয়া। স্বাদ অবশ্য একটু আলাদা, তবে নিশ্চিতভাবেই ফুচকার চেয়ে খারাপ। রাতের খাবার হিসেবে তো কোনোভাবেই এই ‘গোল গাপ্পে’ থাকলে হয় না। এ জিনিস হজম করার আগেও পেট রীতিমতো চো চো করছিল।
অভিজ্ঞ বড় ভাই ইয়াসিন হাসানের কারণে পরে রক্ষা। গত দুদিনে যিনি অসংখ্যবার আমাকে ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে এনেছেন। তার কল্যাণে রাতের খাবারটা ঠিকঠাক হওয়ায় স্বস্তি মিললো। তবুও শেষ রাতে যে ক্ষুদা চেপে বসেছিল, বাসে টিকে থাকা মুশকিল হতো গোল গাপ্পে খেয়েই পাড় করতে চেয়ে।
কীভাবে পরের ক্ষুদাটা মিটলো? সম্ভবত ভোরের সূর্যোদয় দেখে। পাহাড় দেখার অভিজ্ঞতা তেমন নেই। কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ ধরে বড় ভাই বাইক চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন; এটুকুই। ভোর হওয়ার আগে ভেঙে যাওয়া ঘুম তাই আর জোড়া লাগাতে চাইনি। চোখের ক্লান্তিতে জমে যাওয়া বরফ অবশ্য উবে গেলো নিমিষেই।
না ঘুমিয়ে কী ভীষণ ভালো কাজটাই না করেছি; নিজের পিঠ চাপড়ে বাহবা দিতে ইচ্ছি করছিল। আঁকাবাঁকা পথে বাস বেঁকে যায় ভয়ঙ্করভাবে, তবুও পথ চলে অবলীলায়। এর মাঝে কিছুই চোখ এড়াতে ইচ্ছে করে না। সবুজে ঢেকে যাওয়া উঁচু উঁচু পাহাড়, তার উপরের সাদা হিমালয়, বাস একদম সোজা উপরে উঠে যাওয়ার দৃশ্য; এসব দেখে চোখ লুকানোর কোনো মানে হয় না।
ভোরের সূর্য যখন উঠে, পাহাড় যেন হয়ে উঠে সে মায়া বিভ্রম; মানুষকে বশ করার ক্ষমতা আছে যার। আটকে রেখে দিতে পারবে চাইলে অবলীলায়। ফোনটা বের করে দুয়েকটা ছবিও তখন তুলে রেখেছিলাম। কিন্তু ক্যামেরার কী আর এমন সৌন্দর্য ধরে রেখে উপলব্ধি করানোর ক্ষমতা আছে!
যেমন নেই হিমালয় ছুয়ে দেখার সাহস। হোটেলের বারান্দায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে প্রকৃতির মায়ায় ডুবে থাকার ফুসরৎ। যেমন নেই ঠিকানাহীন হয়ে পাহাড়ের কোথাও লুকিয়ে থাকার মতো হেয়ালীপানা। ধর্মশালায় আসার পর স্রেফ একটি কথাই মনে হচ্ছে বারবার, ‘ছবির মতো সুন্দর’ এই মায়ার দুনিয়া ছেড়েও আত্মহুতি দেয় কেউ কেউ। আহারে, কী বোকা তারা!
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৩ ঘণ্টা, ৫ অক্টোবর, ২০২৩
এমএইচবি