কলকাতা: ভারতের জম্বু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার বিজবেহারার ওয়াঘামা অঞ্চলে বেড়ে ওঠা আমির হোসেন লোন। ছোটবেলায় দুর্ঘটনায় নিজের হাত দুটি হারিয়েছিলেন।
আর সেই ভালোবাসাকে হাতিয়ার করে নিজের অক্ষমতাকে অস্ত্র করে, ভিন্নভাবে সক্ষম হয়েছেন কাশ্মীরের আমির। কাঁধ আর ঘাড়ের মাঝে ব্যাট রেখে তার ব্যাটিং স্টাইল গোটা ক্রিকেট দুনিয়াকে চমকে দিয়েছে। চমক দিয়েছে পা দিয়ে পেস বোলিং এর ক্ষেত্রেও।
হার না মানা আমিরের মানসিকতাকে সম্মান জানিয়ে সম্প্রতি কাশ্মীরে গিয়ে 'সালাম ঠুকে' গেছেন ভারতের ক্রিকেট 'মাস্টার ব্লাস্টার' শচীন টেন্ডুলকার। একা শচীন নন, আমিরের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছেন ভারতের শীর্ষ শিল্পপতি গৌতম আদানিও।
ক্রিকেটের প্রতি তার অসীম ভালোবাসা ও দৃঢতা দিয়েই নিজের জীবনের ট্রাজেডিগুলো জয় করে চলেছেন আমির। হাত না থাকায় ব্যাটের হাতল নিজের কাঁধে ও ঘাড়ের মাঝখানে চেপে ব্যাটিং করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন সর্বত্র। বর্তমানে শুধু জম্বু ও কাশ্মীরের প্যারা (প্রতিবন্ধী) ক্রিকেট দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন না, সেই দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।
নিজের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পেছনের গল্প নিজেই শুনিয়েছেন আমির। তিনি বলেছেন, 'ক্রিকেটের প্রতি আমি শুরু থেকেই খুব আগ্রহী ছিলাম। সাত বছর বয়স থেকেই ক্রিকেট খেলতে শুরু করি। দুর্ভাগ্যক্রমে যখন আমার ৮ বছর বয়স, তখন আমি একটি দুর্ঘটনায় কাঠের মিলের করাতে নিজের হাত দুটি হারিয়েছি। তখন থেকেই আমার জীবনে নানান ঘাত-প্রতিঘাত ও হতাশার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করে। এরপর টানা তিন বছর হাসপাতালে কাটানোর পরে বাড়ি ফিরে শুধু মানুষের সহানুভূতি পেয়েছি। অনেকেই আমার পরিবারকে বলেছে, আমার নাকি দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা উচিত হয়নি। কারণ শারীরিকভাবে অক্ষমদের জীবন-যাপন করা খুবই কঠিন। '
'এসব বিষয় যখন আমাকে কষ্ট দিচ্ছিলো। তখন সব কিছুর ঊর্ধ্বে আমার দাদী ও পরিবার রক্ষাকবচ হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা আমাকে বেঁচে থাকা এবং লড়াইয়ের পাঠ দিতে থাকেন। দুর্ঘটনার পর থেকেই আমার জীবন চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ। স্কুলে আমি অনেক অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। যারমধ্যে সামাজিক কুসংস্কারও ছিল। পরে বুঝলাম, এই বৈষম্য শুধু স্কুলের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়, স্কুলের চার দেওয়ালের বাইরেও বিরাজমান। '
শত বাধা সত্ত্বেও আমির হাল ছাড়েননি। তার মধ্যে ক্রিকেট খেলার প্রতি আগ্রহ বরং আগের চেয়ে বেড়েছে। খেলার অদম্য ইচ্ছা থেকে কাঁধ ও ঘাড়ের মাঝখানে ব্যাট রেখে ব্যাটিং অনুশীলন শুরু করে। একইভাবে পা দিয়ে শুরু করেন বোলিং। শুরুর দিকে কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। কাঁধ ও ঘাড়ে চরম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। শরীরের ভারসাম্য সমান না রাখতে পেরে মাটিতে পড়ে যাওয়া, রক্তক্ষরণ, চোট আঘাতেও হার মানেননি আমির। সঙ্গে পরিবারের সহযোগিতায় দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে যেতে থাকেন তিনি। মাঝরাতে তেল পুড়িয়ে কাঁধ ও ঘাড়ের মালিশ করে দিতেন দাদি। ভোরে পাখির ডাকের আগেই উঠে পড়তেন আমির। এরপর শুরু হতো তার ব্যাটিং অনুশীলন এবং পা দিয়ে বোলিং। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই যন্ত্রণা তাকে কিছু করে দেখানোর লড়াইয়ে বাড়তি শক্তি যোগায়।
আমিরের কঠোর পরিশ্রম শেষ পর্যন্ত তাকে জম্মু ও কাশ্মীরের প্যারা ক্রিকেট দলে জায়গা করে দেয়। ক্রিকেট দলের প্রতিনিধিত্ব করা প্রসঙ্গে আমির বলেছেন, '২০১৩ সালে দিল্লিতে আমি প্রথম জাতীয় স্তরে ম্যাচ খেলেছিলাম। এরপর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় খেলেছি। ম্যাচ খেলতে বাংলাদেশ, নেপাল দুবাইও গিয়েছিলাম। আমি সব জায়গা থেকে অনেক ভালোবাসা, প্রশংসা এবং সমর্থন পেয়েছি। '
সহনশীলতার মাধ্যমে আমির শুধু দৈনন্দিন জীবনে চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠেননি, একইভাবে চায়ের কাপ তোলা, বই ধরা, লেখালেখি করা, দাড়ি কাটা, কাপড় ধোয়া, স্মার্টফোন ব্যবহার- সব কাজেই পা দিয়ে পারদর্শী হয়ে উঠেছেন আমির।
আমির ছোটবেলা থেকেই শচীন টেন্ডুলকারের ভক্ত। 'ভারতের ক্রিকেট ঈশ্বর' তাকে সই করা ব্যাট উপহার হিসেবে দিয়েছেন। পাশাপাশি কাশ্মীরে আমিরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন শচীন। সেই সুখস্মৃতির কথা স্মরণ করে আমির বলেন, 'এর জন্য তাঁর কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ। কাশ্মীরে এসে ওনার মতন ব্যক্তিত্ব আমার সঙ্গে দেখা করা- এটা আমার স্বপ্ন ছিল। যা সত্যি হয়ে যাওয়ার মতো একটা ঘটনা। '
আর্থিক সমস্যার কারণে আমিরের ক্রিকেট খেলায় যেন কখনো বাধা না আসে, সে কারণে এগিয়ে এসেছেন শিল্পপতি গৌতম আদানি। যে কোনো ব্যাপারে আমিরকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আদানি গ্রুপের কর্ণধার। তবে আমিরের একটি অনুশোচনা রয়েছে। দেশসহ সর্বত্র সহযোগিতা পেলেও নিজের রাজ্য থেকে যে সমর্থন পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন, সেটা তিনি আজও পাননি। খানিকটা হতাশ হয়ে এই প্রতিবন্ধী ক্রিকেটার বলেছেন, 'আমি মনে করি দেশের নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের সাহায্য করা। যাতে তারা তাদের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করতে পারে। তবে খারাপ লাগে নিজের রাজ্য থেকে কোনোরকম সাহায্য পেলাম না। '
তবে নিজের অর্জনে খুশি আমির। বললেন, 'আমি যেখানেই যেতাম সহানুভূতিশীল দৃষ্টি দিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানানো হতো। বেচারা ছেলেটা, দুটো হাত নেই ইত্যাদি। আমি তাদের ভুল প্রমাণ করতে পেরেছি। আমি যে আর পাঁচজনের মতো একজন, তা প্রমাণ করতে পেরেছি। শুধু দেশ নয়, বিশ্বের নানা মানুষ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, সাক্ষাৎকার নিতে আসেন। আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি, যে বিশ্বের প্রতিবন্ধী মানুষের আমি অনুপ্রেরণা হতে পেরেছি। আমার মতো সেই সব মানুষদের বলতে চাই, হতাশ হয়ে নিজের জীবন নষ্ট করবেন না। কখনো পরাজয় মেনে নেবেন না। লক্ষ্য ঠিক রাখুন আর কঠোর পরিশ্রম করুন। কেউ আপনার সফলতা আটকাতে পারবে না।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৪
ভিএস/এমএইচএম