কলকাতা থেকে ফিরে: ছেলেবেলা থেকেই বিখ্যাত শিল্পী মান্না দে’র ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানটি শুনতে শুনতে পার করে দিয়েছি জীবনের একটি দীর্ঘ সময়। সঙ্গত কারণেই কফি হাউজ নিয়ে কৌতূহলের শেষ ছিলো না।
নিখিলেশ, মঈদুল, রমা রায়, সুজাতা ও অমলদের সেই কফি হাউজের গানটা যখনই শুনতাম- কতসব ভাবনা মনের অবচেতনে খেলা করতো! তাই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম যদি কখনও কলকাতায় যাই কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজটি অবশ্যই দেখে আসবো।
সেই ইচ্ছে পূরণ হলো এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কভার করতে গিয়ে। টি-টোয়েন্টির এবারের আসরের আয়োজক ছিলো ভারত। তাই বিশ্বকাপের সংবাদ সংগ্রহ করতে ভারতের মাটিতে পা রাখা মাত্রই মনে হল, যাই কফি হাউজ দেখে আসি।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেটা হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের বাছাই পর্বের তিনটি ম্যাচের সংবাদ সংগ্রহ করতে কলকাতায় পৌঁছে প্রথমেই যেতে হয়েছিলো হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায়। তাই ভাবলাম বাছাই পর্বের খেলা শেষ করে কলকাতায় ফিরে কফি হাউজে কফি খেয়ে আসব।
ধর্মশালায় বাংলাদেশের বাছাই পর্বের খেলা শেষ করে পাকিস্তানের বিপক্ষে মূল পর্বে প্রথম ম্যাচকে সামনে রেখে ১৫ মার্চ চলে আসি কলকাতায়। কলকাতায় ফিরে যে হোটেলটিতে উঠেছিলাম তা ছিল গ্র্যান্ট স্ট্রিটে। হোটেলের অদূরেই ধর্মতলা ও নিউমার্কেট। সেখান থেকে কলেজ স্ট্রিট খুব বেশি দূরে নয়। তাই মনের অজান্তেই একটি ভালোলাগা কাজ করছিলো। বিষয়টি এমন যেন প্রিয় মানুষ বা প্রিয় কিছুর পাশে থাকার মতো।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়টি, খুব কাছে থেকেও সেদিন কফি হাউজে যেতে পারিনি। ১৬ মার্চ সুপার টেন বা শেষ দশে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ থাকায় সারা দিনই ইডেনে গার্ডেনে কেটেছে। তার পরদিন সকালে মাশরাফিরা বেঙ্গালুরুর উদ্দেশে রওনা হওয়ায় সেই সংবাদ সংগ্রহ করতে দিনের বেশির ভাগ সময় পার হয়ে যায়।
অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো সেদিন সন্ধ্যায়। হোটেল থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে প্রথমে মনে করলাম হেঁটে যাব। কিন্তু যখন জানতে পারলাম যে হেঁটে যেতে ঘণ্টা খানেকেরও বেশি সময় লাগবে তখন ট্যাক্সি খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু ট্যাক্সি যে ভাড়া চাইলো তা অনেক বাড়তি মনে হলো। নিউমার্কেট থেকে কলেজ স্ট্রিটের ভাড়া হাঁকালো ২০০ রুপি! নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসু বিমানবন্দর থেকে আমার হোটেলের ভাড়া যেখানে ২৮০ বা ৩০০ রুপি সেখানে এত কাছে থেকে ২০০ রুপি বেশি মনে হলো তাই ধর্মতলা থেকে ট্রামে চেপে রওনা হয়ে গেলাম।
মিনিট বিশেক পর আমার ট্রামটি এসে দাঁড়ালো লাল সোডিয়াম আলোয় ঘেরা একটি রাস্তায়। নেমেই এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করলাম কফি হাউজটি কোথায়? উত্তরে তিনি বললেন, ওই তো দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ আমি যেখানে নেমেছি সেখান থেকে মিনিট দু’এক হেঁটে গেলেই কফি হাউজ!
যাই হোক সেই মোতাবেক মিনিট দু’এক হাঁটার পর আমি এসে দাঁড়ালাম হিন্দু স্কুল ও প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে। এর ঠিক উল্টো দিকে তাকাতেই পুরনো একটি বহুতল ভবন চোখে পড়লো যার গায়ে আলোকোজ্জ্বল সাইন বোর্ডে লেখা ‘ইন্ডিয়ান কফি হাউজ, কলেজ স্ট্রিট অ্যালবার্ট হল। ’ দেখেই মনে মনে বেশ পুলকিত বোধ করেত লাগলাম।
এমন পুলকিত অনুভূতি নিয়ে কফি হাউজে প্রবেশ করতেই নিচ তলায় হাতের ডান দিকে চোখে পড়লো ‘ক্ল্যাসিক বুক হাউস’ নামে একটি ছোট লাইব্রেরি। লাইব্রেরিটি দেখতে দেখতে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে লাগলাম। দোতলায় উঠতেই চোখে পড়লো দেয়ালের গায়ে লাগানো বিভিন্ন রকমের পোস্টার। কোনটিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, কোনটিতে বই, কোনটিতে মঞ্চ নাটক বা মানবসেবামূলক অনুষ্ঠানের প্রচারণা।
এভাবে দেখতে দেখতে এক সময় সিঁড়ি শেষ করে প্রবেশ করলাম দোতলার কফি হাউজে। রাত তখন পৌনে ন’টা। কফি হাউজে প্রবেশ করেই কেমন ভালো লাগা কাজ করতে লাগলো। বিশাল একটি পুরনো হলরুমের মধ্যে ছোট ছোট চেয়ার টেবিল ঠাসাঠাসি করে বসানো। উপরে ফ্যান ঝুলছে, মানুষেরও অভাব নেই সেখানে।
কেউ কফি খাচ্ছেন, কেউ ধূমপান করছেন আর কেউ বা খোশগল্প। মান্না দে’র গান শুনে মনে করেছিলাম শুধু তার মতো পরিণত আর কবি-সাংবাদিকরাই বুছি সেখানে যান। কিন্তু গিয়ে দেখি তরুণ থেকে শুরু করে যুবক, বয়স্ক এমনকি প্রেমিক যুগলরাও সেখানে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছেন। এত মানুষের উপস্থিতিতে পুরো কফি হাউজ যেন গম গম করছিলো।
মানুষ দেখা শেষে কফি হাউজের দেয়ালের দিকে তাকাতেই অভিভূত হলাম। দেয়ালের গায়ে কবি নজরুল, মোনালিসাসহ আরও বিখ্যাত সব মানুষের দুর্লভ কিছু স্কেচ চোখে পড়লো।
কফি হাউজে মানুষের প্রচন্ড ভিড় থাকায় মনের মতো বসার জায়গা পাইনি। একটি যাও পেলাম সেখানে অচেনা অজানা দু’জন বসে ধূমপান করছিলেন। তাই উঠে দাঁড়িয়ে কফি হাউজ দেখছিলাম আর মান্নাদের সেই কালজয়ী গানের লাইনগুলো মনে করছিলাম।
এক সময় মনে হলো, আরে আমি কফি খাইনি তো! তাই কিছুটা দ্রুত পায়ে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গিয়ে কফির অর্ডার দিতেই একজন বললেন, ‘কফি নেই। ’ আমি বললাম নেই মানে? তিনি বললেন, ‘রাত ন’টা বাজে। ন’টার পর আমরা কফি বিক্রি করি না। ’ একথা বলেই তিনি দিনের হিসাব মেলাতে শুরু করে দিলেন। আমি আবার অনুরোধ করলাম এবং খুলে বললাম যে আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তিনি আমাকে এতটুকু পাত্তা না দিয়ে আবার টাকা গুণতে শুরু করে দিলেন। আর আমি কিছুটা মলিন মুখে কাউন্টার থেকে টেবিলের দিকে ফিরে এলাম।
একটু ভাবনায় পড়ে গেলাম। কী করবো? কফি হাউজে এলাম কিন্তু কফি খেতে পারলাম না! টেবিলের দিকে তাকাতেই দেখি বেয়াড়া দু’গ্লাস পানি রেখে চলে গেল। অগত্যা সেই দু’গ্লাসের ভেতর থেকে একটি হাতে নিয়ে পুরো পানিটা খেয়ে কফির খেদ ঘুচিয়ে বের হলাম। আর মনে মনে প্রয়াত মান্না দে’কে বলতে লাগলাম, কেমন তোমার কফি হাউজ? রাত ন’টার পর কফি মেলে না!
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৬
এমজেএফ/