ঢাকা: এতোদিন ধরে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেয়ে আসছিল কলকাতা নাইট রাইডার্স, এই টিমে টাইগার দলের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান খেলেন বলে। আইপিএলের অন্য ম্যাচের ব্যাপারে ততো বেশি আগ্রহ দেখা না গেলেও সাকিবের প্রতি ভালোবাসার কারণে কলকাতা টিমের খেলার পুরো সূচি মুখস্ত ছিল অনেকের।
কিন্তু এবারের আসরে বাংলাদেশ ক্রিকেটপ্রেমীদের সেই সমর্থনের অনেকখানিই খুইয়ে ফেলেছে নাইট রাইডার্স। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পাড় থেকে তারা যে সমর্থন পেতো, তা বাগিয়ে নিয়েছে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। সাকিব থাকতেও নাইট রাইডার্সের প্রতি ‘বাংলাদেশি ভক্ত’দের সমর্থন সানরাইজার্স কেড়ে নিয়েছে পাল্লার এক পাশে দুই কেজি ওজনের বাটখারার পরিবর্তে অন্য পাশে আধা কেজি ওজনের বাটখারা রাখার অবস্থার মতো করে, এই সময়ের বিস্ময়কর-রহস্যময় বোলার মুস্তাফিজুর রহমানকে দলে ভিড়িয়ে। যে মুস্তাফিজুর রহমানের বল নিয়ে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যান-কোচদের পাশাপাশি নিয়মিত গবেষণা করে চলছেন ধারাভাষ্যকাররা পর্যন্ত।
এবারের আইপিএলের বিদেশি খেলোয়াড়দের দলে ভিড়ানোর প্রক্রিয়া থেকেই ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের সমর্থন পাওয়া নিয়ে লড়াই শুরু হয় নাইট রাইডার্স ও সানরাইজার্সের মধ্যে। মুস্তাফিজুর রহমানকে ভিড়াতেই বাংলাদেশের ক্রিকেটসমর্থকদের অনেকে এবারের আসরের বাজির ঘোড়া ধরে ফেলেন সানরাইজার্সকে, মুস্তাফিজুরের রহস্যময় বোলিয়ে আস্থা রেখে।
এই ‘সমর্থনযুদ্ধ’ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো শনিবার (১৬ এপ্রিল) নাইট রাইডার্স ও সানরাইজার্সের মধ্যকার লড়াইকে ঘিরে। শুরুতেই বাংলাদেশ ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রায় সবাই খোঁজ নিতে থাকেন সাকিব তার দলের হয়ে মাঠে নামছেন কিনা, দুই ‘স্বদেশি’র লড়াই নিশ্চিত হলে খেলা আরও দারুণ উপভোগ্য হবে বলে।
খেলা শুরু হতেই স্পষ্ট হয়ে পড়ে সাকিবের চেয়ে মুস্তাফিজুর রহমানের প্রতি টাইগারসমর্থকদের ভালোবাসা-দুর্বলতার বিষয়টি। টসে হেরে নাইট রাইডার্স যখন বোলিং শুরু করলো, তখন বাংলাদেশের ক্রিকেটসমর্থকরা অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন সাকিবের বোলিং দেখার। সাকিব বোলিংয়ে এসে দুরন্ত কয়েকটি ওভার করার পর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন তার সমর্থকরা। অবশ্য, ৩ ওভার বল করে মাত্র ১৮ রান দেওয়ার পরও সাকিবকে তার চতুর্থ ওভারটি করতে না দেওয়ার আক্ষেপ ঝরেছে কারও কারও মধ্যে।
ব্যাটিং শেষে সানরাইজার্স যখন বোলিংয়ে নামলো, তখনই বাংলাদেশি সমর্থকরা খোঁজ নিচ্ছিলেন মুস্তাফিজের, তিনি কি প্রথম ওভার করবেন, নাকি দ্বিতীয়। অপেক্ষা খানিকটা দীর্ঘ করে অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার মুস্তাফিজকে বোলিংয়ে আনলেন দলের পঞ্চম ওভার করতে।
তিনি বোলিংয়ে আসতেই ফেসবুক-টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেবল উইকেটের প্রার্থনা শুরু হলো। প্রথম ওভারে মাত্র ৩ রান দিলেও উইকেট পেলেন না মুস্তাফিজ। এরপর লম্বা বিরতি দিয়ে তাকে আবার বোলিংয়ে আনা হলো ১২তম ওভারে। ততক্ষণে তুমুল সমালোচনা হচ্ছিল ওয়ার্নারের, তিনি কেন মুস্তাফিজকে ব্যবহার করছেন না। মুস্তাফিজের বোলিংয়ে উইকেটের জন্য সবাই এমনভাবে প্রার্থনা করছিলেন, যেন নাইট রাইডার্স উড়েই যায়, সাকিবের দল হলেও।
দলের ১২তম ওভারে, অর্থাৎ নিজের দ্বিতীয় ওভারে মুস্তাফিজ ৫ রান দিলেন। এবারও কোনো উইকেট পেলেন না। এরপর তিনি এলেন ১৪তম ওভারে, নিজের তৃতীয় ওভার করতে। এই ওভারের চতুর্থ বলেই মুস্তাফিজুর দুর্বোধ্য এক ইয়র্কারে তুলে নিলেন নাইট রাইডার্সের ইনফর্ম ব্যাটসম্যান আন্দ্রে রাসেলের স্টাম্প। বেচারা আন্দ্রে রাসেল বল ঠেকাতে গিয়ে অর্ধেক ব্যাট পেতে দিয়েও পারলেন না, বরং নিজেই ধপাস করে পড়ে গেলেন। পড়ে গেল তার মিডল স্টাম্পও।
পুরো ম্যাচ শেষে বাংলাদেশ ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে এই বোল্ড আউটটাই আলোচ্য হয়ে রইলো। সাকিবের দল জিতে গেল ৮ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে, ১০ বল বাকি থাকতেই। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটভক্তদের কেউই যেন সাকিবের দলের সেই জয়ের খবর নিলেন না।
ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আলোচনায় ভেসে উঠতে থাকলো কেবল মুস্তাফিজের ইয়র্কারে আন্দ্রে রাসেলের চিৎপটাং হয়ে পড়ার দৃশ্যটি। মুস্তাফিজের বোলিং বৈচিত্র্যের বিষয়টি। মুস্তাফিজকে নিয়ে ধারাভাষ্যকার, তার দলের ক্রিকেটার-কর্মকর্তাদের উচ্ছ্বাস-প্রশংসার কথাগুলো।
সাতক্ষীরার এ লিকলিকে তরুণের বোলিংয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে লেখক ও সাংবাদিক ইশতিয়াক আহমেদ তার ফেসবুকে লেখেন, ‘মুস্তাফিজের বল কাউকে শুইয়ে দিলে তার দায় ইন্ডিয়ান সরকার নেবে না। - মোদি’
মুস্তাফিজুরের বলে আন্দ্রে রাসেলের স্টাম্প ভেঙে যাওয়া ও তার চিৎপটাং হওয়ার একটি ছবি পোস্ট করে একটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আরাফাত লেখেন, ‘অ্যান্ড দিস পিকচার মেড মাই ডে, মুস্তাফিজুর ইউ বিউটি’।
মুস্তাফিজুরের ওই বলের মোহ অবশ্য ভাঙতে পারছিলেন না ইএসপিএন ক্রিকইনফোর’র ধারাভাষ্যকাররাও। তখনই তারা বলছিলেন, ‘বলটার তোড়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন রাসেল। পড়ে গেল তার মিডল স্টাম্পও। কী দারুণ বল মুস্তাফিজের!’ যদিও আগে থেকেই অনেক ধারাভাষ্যকার কেবল খোঁজ নিচ্ছিলেন, কখন ব্যবহার করা হচ্ছে মুস্তাফিজকে।
এ কথা বলা বাহুল্য যে, ভালোবাসা-সমর্থনের এই জায়গা মুস্তাফিজের বৈচিত্র্যপূর্ণ বোলিংয়ের পাশাপাশি এনে দিয়েছে তার ‘গ্রামীণ সরলতা’, ‘সরল অথবা বালকসুলভ’ উচ্ছ্বাস। আর বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হয়েও মুস্তাফিজের কাছে সাকিব আল হাসানের ‘আলো’ হারানোর দায় পড়ে তার বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত ও ঊদ্ধ্যত আচরণও।
দেশের হয়ে খেলেন বলে সরাসরি বিরোধিতা করা না গেলেও বিদেশের মাটিতে যখন কোনো টুর্নামেন্টে স্বদেশির মুখোমুখি হন, তখন সাকিব আল হাসানের এই ‘সমর্থন খোয়ানো’ তার ঔদ্ধত্য, ক্রিকেট ছেড়ে ব্যবসায়ে বেশি নজর দেওয়াসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের নীরব জবাব বলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তবে, এইসব ছাড়িয়ে সমর্থকদের এখন দেখার বিষয়, এই ‘সমর্থনযুদ্ধ’ ছাপিয়ে আসল ক্রিকেটযুদ্ধে জয়ী হতে পারেন কোন জন? কলকাতার সাকিব, নাকি হায়দরাবাদের মুস্তাফিজুর।
বাংলাদেশ সময়: ২২২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৬
এইচএ/