শেবাগদের পা যেন আসলে মাটিতে পড়ছিল না। গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আচ্ছা ধোলাই খাওয়ার পরও কোনো দলকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে ছাড়ছিলেন না শেবাগ-শাস্ত্রীরা।
রোববার (১৮ জনু) ওভালে এই সব ঔদ্ধত্য সব অহমিকা ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান। লজ্জাকর ও শোচনীয়ভাবে কথিত সেরা ব্যাটিং লাইনআপের দলকে ধসিয়ে দিয়েছে মাত্র ৩০.৩ ওভারে ১৫৮ রানে। পরাজিত করেছে ভারতের মোট সংগ্রহেরও ২২ বেশি ১৮০ রানের ব্যবধানে।
ভারতীয় সাবেক-বর্তমান ক্রিকেটার-ক্রীড়াবিশ্লেষকদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতি বাড়াবাড়িও হাওয়ার বেগে উধাও হয়ে গেছে এই পরাজয়ে। ম্যাচ শুরুর আগে যে সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনাম ছিল এমন, ‘আইসিসি-ও বলছে, বিরাটরা আজ ফেভারিট’, ‘রোববার পাকিস্তানকে দু’বার হারানোর ‘মওকা’ ভারতের’, সেই সংবাদমাধ্যমগুলোই ম্যাচ শেষে শিরোনাম করতে বাধ্য হয়েছে, ‘চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে লজ্জার হার ভারতের’! ফেসবুকের যে ভারতীয় ট্রল পেজগুলো প্রতি মিনিটে মিনিটে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যে পোস্ট করেছে, তারাও চুপসে গেছে ম্যাচের অর্ধভাগ শেষ হওয়ার পর। অহমিকার কী নিদারুণ পরিণতি।
ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই রাজনৈতিক-ভৌগোলিক-সাম্প্রদায়িক ঝাঁঝ মিলিয়ে ক্রিকেটীয় লড়াইয়ের বাইরের ‘মনস্তত্ত্বে এগিয়ে থাকার লড়াই’। তেমনই এক লড়াই এই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল গড়ানোর আগে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে কেবল পরিসংখ্যান দেওয়া হতে থাকলো, বিশ্বকাপে ছ’বারের মুখোমুখি লড়াইয়ে একবারও ভারতকে হারাতে পারেনি পাকিস্তান। সুতরাং এবারও সুযোগ হচ্ছে না। যদিও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে চার বারের লড়াইয়ে দু’বার পাকিস্তান জিতেছে, তবে সবশেষে গ্রুপ পর্বে অমন দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়ায় দলটিকে উড়িয়েই দেওয়া হচ্ছিল ভারতীয় গণমাধ্যমে। তাদের সাবেকরা অতি-আত্মবিশ্বাসে বলে বেড়াচ্ছিলেন, ভারত এবার তৃতীয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিই ঘরে তুলতে চলেছে।
শেষ তক পাকিস্তানের কাছেই পাত্তা পেলো না কথিত বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপের ভারত। বিরাট কোহলি, ধোনি, যুবরাজ, ধাওয়ান, রোহিত, কেদার যাদবদের মতো ব্যাটসম্যানদের কেবল হাতে গ্লাভস লাগানো আর খোলার সময় দিয়েছে ফখর জামান, আমির, হাসান আলীদের বোলিং তোপ। খোদ আইসিসিই পেয়ে গেল জবাব, ভারতকে ফেভারিট তকমা দেওয়ার।
এটা ছিল প্রথমবারের মতো আইসিসির কোনো ওয়ানডে ইভেন্টের ফাইনালে ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি লড়াই। টস জিতে পাকিস্তানকে অল্প রানে বেঁধে ফেলার আশায় আগে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন ভারতের দলপতি বিরাট কোহলি। কিন্তু ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভার খেলে পাকিস্তান ৪ উইকেট হারিয়ে তুলে ফেলে ৩৩৮ রান। জবাবে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৩০.৩ ওভার খেলে ১৫৮ রানেই অলআউট হয়ে যায় ভারত।
আগে ব্যাটিংয়ে নেমে পাকিস্তানের ওপেনার ফখর জামান ভারতীয় বোলারদের বেধড়ক পিটিয়ে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম শতক (১১৪) হাঁকান। হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পান আরেক ওপেনার আজহার আলি (৫৯) ও মাঝারি পাল্লার ঝড় তোলা মোহাম্মদ হাফিজ (৫৭*)। ভারতের হয়ে একটি করে উইকেট তুলে নেন কেদার যাদব, হার্দিক পান্ডিয়া ও ভুবনেশ্বর কুমার।
পাকিস্তানের ছুঁড়ে দেওয়া ৩৩৯ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে ভারতের ব্যাটিংঅর্ডার। ০ রানেই রোহিত ফিরে যাওয়ার পর ৬ রানের মাথায় সাজঘরের পথ ধরেন বিরাট কোহলিও। ৩৩ রানের মাথায় ফিরে যান ইনফর্ম শেখর ধাওয়ান। ৭২ রানের মাথায় ভারতীয়রা ৬ উইকেট হারিয়ে ফেললে শতরানের আগেই গুঁড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কায় পড়ে যায়। তবে এই সময়ে খানিকটা বিনোদনের খোরাক যোগান হার্দিক পান্ডিয়া। তার ৪৩ বলে ৭৬ রানের মারদাঙ্গা ইনিংসটি রানআউটে শেষ হয়ে যাওয়ার পর ভারতের আশাও কার্যত শেষ হয়ে যায়। পরাজয়টা এরপর ছিল আনুষ্ঠানিকতা।
প্রথম থেকেই ভারতের ব্যাটিং লাইনআপকে কাঁপিয়ে দেন পাকিস্তানি বোলিং সেনসেশন মোহাম্মদ আমির। তার শিকারের তালিকায় ‘বড় তিন বোয়াল’, কোহলি, রোহিত ও ধাওয়ান। এছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির এবারের আবিষ্কার হাসান আলীও নেন তিন উইকেট। দু’টি উইকেট নেন শাদাব, একটি উইকেট যায় জুনায়েদ খানের ঝুলিতে।
বড় সংগ্রহের ভিত গড়ে দিয়ে শতকের জন্য ম্যাচ সেরা হন ফখর জামান। আর পুরো টুর্নামেন্টে বোলিং জাদু দেখানো হাসান আলীকে দেওয়া হয় ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের পুরস্কার।
ম্যাচ শেষে পুরো ক্রিকেটবিশ্ব থেকেই পাকিস্তানকে অভিনন্দন জানিয়ে শুভেচ্ছাবার্তা আসতে থাকে। শুভেচ্ছাবার্তা দেন ভারতীয় ক্রিকেটার হরভজন সিংও। তিনি টুইট করেন, ‘অভিনন্দন পাকিস্তান ক্রিকেট দল...বন্ধুরা কে বাবা, কে ছেলে এসব বলা বন্ধ করো। সবার মালিক তো একজন উপরওয়ালাই...’। প্রশ্ন হলো- হরভজন এই টুইট করার আগে কি শেবাগের ‘বাবা’ দাবির সেই টুইট দেখেছিলেন?
বাংলাদেশ সময়: ২১৫৭ ঘণ্টা, ১৮ জুন ২০১৭
এমআরপি/এমএমএস/এইচএ/