প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যতই উত্তপ্ত হোক না কেন, এখনও এই দুই দেশ হাত মিলিয়ে কাজ করতে পারে বলে আফ্রিদির বিশ্বাস।
পাকিস্তানের মরুভূমির ধুধু প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্যন্ত কিছু গ্রাম রয়েছে, যেখানে হাসপাতাল তো দূরের কথা খাবার পানিও নেই।
শহীদ আফ্রিদি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সমাজসেবার পাশাপাশি এখনও টুকটাক ক্রিকেট চালিয়ে যাচ্ছেন আফ্রিদি। সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সরে আসার পরে এখন আমার দ্বিতীয় ইনিংস চলছে। জীবনের এই ইনিংসটায় আমার লক্ষ্য মানুযের জন্য কিছু করা। আল্লাহ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন, আমি এবার মানুষকে কিছু ফিরিয়ে দিতে চাই। আমার লক্ষ্যই হচ্ছে পাকিস্তানে যত প্রত্যন্ত এলাকা আছে, সেখানে স্বাস্থ্য সমস্যা আর জলসঙ্কট দূর করা। আমরা সে রকম অনেক জায়গায় হাসপাতাল তৈরির চেষ্টা করছি। যেমন তিরাহ উপত্যকা (খাইবার অঞ্চলে)। যেখানে সামান্য খাবার জল জোগাড় করতে ১২-১৩ কিলোমিটার হাঁটতে হয়। আমরা সে জায়গায় পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করছি। হিন্দু-মুসলমান সবার জন্য আমার ফাউন্ডেশন এই কাজটা করে চলেছে। ’
আফ্রিদির ফাউন্ডেশনের প্রধান কাজটা হচ্ছে থর মরুভূমি অঞ্চলে। যে কথা বলার সময় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম চারশোটা ওভার বাউন্ডারি মারা ব্যাটসম্যান, ‘জানেন, ওই সব অঞ্চলে এমন এমন জায়গা আছে যেখানে বাচ্চারা জন্মের তিন মাসের মধ্যেই মারা যেতে শুরু করে। আমরা ওই সব জায়গায় ফোকাস করছি। ওখানে মা এবং শিশুদের জন্য হাসপাতাল তৈরি করছি। আমি স্বপ্ন দেখি, এক দিন এই মৃত্যুলীলা ঠিক শেষ হবে। ’
ভারতীয় ক্রিকেটভক্তদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় পাকিস্তানি ক্রিকেটারের নাম জানতে চাইলে, নিঃসন্দেহে আফ্রিদির নামটা সবার আগে থাকবে। শুধু ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে কেন, ভারতীয় ক্রিকেটারদের কাছেও আফ্রিদির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। কখনও ভারতীয় টিমের সই করা জার্সি, কখনও বিরাট কোহলির সই করা ব্যাট তার জন্য উপহার হিসেবে গিয়েছে। যে কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো আপ্লুত হয়ে পড়েন আফ্রিদি, ‘বিরাট কোহলি যে চ্যাম্পিয়ন ব্যাটসম্যান, তা তো গোটা দুনিয়া জানে। কিন্তু সে যে কত বড় মাপের মানুষ, সেটা আমি জানি। যখনই আমি কোনো সাহায্য চেয়েছি তার কাছে, বিরাট এগিয়ে এসেছে। তার ওই ব্যাটটা পাঠিয়ে দিয়েছে আমার ফাউন্ডেশনের জন্য। অসাধারণ ছেলে। ’
আরও একজন ক্রিকেটারের কথা বলছেন আফ্রিদি। যিনি আফ্রিদির মতোই নিজস্ব ফাউন্ডেশন গড়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যুবরাজ সিং। আফ্রিদি জানান, ‘আমি তো যুবরাজকে বলে রেখেছি, তুই এতো ভালো কাজ করছিস, আমি সব সময় তোদের পাশে আছি। যদি কিছুর দরকার হয়, আমাকে বলবি। আমি সব রকম ভাবে তোদের সাহায্য করতে তৈরি। ’
ভারত-পাকিস্তান জুড়ে থর মরুভূমি। সীমান্তের দু’পাশেই একই হাহাকারের ছবি। আফ্রিদি মনে করেন, হিন্দুস্থান-পাকিস্তান এক সঙ্গে কাজ করলে সাধারণ মানুষ আরও অনেক বেশি উপকৃত হবেন। তাই ভারতে এসে সাধারণ মানুষের জন্যও কাজ করতে তৈরি তিনি। জানিয়েছেন, ‘আমার ফাউন্ডেশন আন্তর্জাতিক মঞ্চেও কাজ করছে। আমেরিকা, বাহরাইন এসব জায়গায় আমরা খাদ্য সরবরাহ করছি। যদি ভারতে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পাই, তা হলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না। যদি ওখান থেকে কোনো এনজিও আমাকে ডাকে কাজ করার জন্য, তবে আমি, আমার ফাউন্ডেশন তৈরি। ’
১৪ আর ১৫ অগস্ট দুই দেশের স্বাধীনতা দিবস। তার আগে আফ্রিদির গলায় সম্প্রীতির ডাক, শান্তির আহ্বান। তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে কেন হিংসা থাকবে। কেন মারামারি হবে। আমি তো জানি, ভারতের মানুষ পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের কতটা ভালবাসে। আবার ভারতীয় ক্রিকেটারদেরও আমাদের দেশের মানুষ শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে। যেখানে এত ভালবাসা দুই দেশের ক্রিকেটারদের নিয়ে, সেখানে হিংসাত্মক ঘটনা কেন ঘটবে?’
আফ্রিদি মনে করেন, দুই দেশের মানুষকেই ভুল বোঝানো হয় নানাভাবে। এর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে, ‘আমার মনে হয় এই দায়িত্বটা সেলিব্রিটিদের নিতে হবে। বোঝাতে হবে, আমরা কেন বাইরের লোকের কথা শুনে মারামারি করব। ’
নিজের প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে বার বার ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে দেখা যেত আফ্রিদিকে। দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি শান্তির প্রতীক। জীবনের কোন ইনিংসটা তার কাছে বেশি চ্যালেঞ্জিং? এমন প্রশ্নে তিনি জানান, ‘জীবনের এই দু’টো পর্বেই আমাকে নানাভাবে দায়িত্বশীল হতে হয়েছে। প্রথমটায় আমি খেলেছিলাম দেশকে জেতানোর জন্য। দ্বিতীয়টায় খেলছি মানুষের জন্য। প্রথম ইনিংস আমার শেষ। আর এই দ্বিতীয় ইনিংসে আমাকে জিততেই হবে। ’
দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি জিতলে শুধু আফ্রিদিই জিতবেন না, জিতে যাবে মানব জাতিও।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, ১৩ আগস্ট ২০১৭
এমআরপি