ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

জেসমিন: রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে প্রভাবশালী নারী

স্পোর্টস ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৯
জেসমিন: রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে প্রভাবশালী নারী জেসমিন আক্তার/ছবি: সংগৃহীত

জন্মের পরেই বাবাকে হারানোর পর বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে। ভাগ্যের সহায়তায় একসময় যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানো। আর মাত্র ১৮ বছর বয়সেই জায়গা করে নিয়েছেন বিবিসি’র সেরা ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায়। বিশ্বকে চমকে দেওয়া এই নারীর নাম জেসমিন আক্তার। নারী ক্রিকেটার হিসেবে তার পরিচিতি এখন বিশ্বজোড়া। বিবিসি’র তালিকায় তার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের নাম লেখা রয়েছে।

মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কতটা অবর্ণনীয় দুর্দশা সইতে হয়েছে তা এখন সবাই জানে। নিজ জনগোষ্ঠীর অনেকের মতো জেসমিনের পরিবারও মিয়ানমার সরকারের দমন পীড়ন শিকার হয়েছিল।

মুখোমুখি হতে হয়েছিল জীবনের সবচেয়ে নিষ্ঠুর পরিস্থিতির তথা জাতিগত নিধনের। ফলে বাধ্য হয়ে নিজ ভূমি বিতাড়িত জেসমিনের পরিবার সীমান্ত পাড়ি দিয় আশ্রয় নিয়েছিল বাংলাদেশে।  

সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা নিপীড়ন ও গণহত্যার হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তবে জেসমিনের পরিবার এখানে এসেছে আরও আগে। ১০ বছর আগে, মাত্র ৮ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান জেসমিন। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ‘ইউএনএইচআর’র সহায়তায় পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সেবার ৭৫০ জন শরণার্থীর সঙ্গে জেসমিনদেরও ঠাই হয় ইউরোপের সমৃদ্ধশালী দেশটিতে।

.তবে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দিয়েও শান্তির দেখা পাননি জেসমিন। নতুন করে জীবন গোছানোর আগেই তার মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন। মাত্র ১৩ বছরের জেসমিনের কাঁধে তখন পাহাড় সমান বোঝা। এটা এমন এক সময়ের কথা যখন ক্রিকেটের প্রতি তার ভালোবাসা তৈরি হওয়ার পথে। ওই সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জেসমিন বলেন, ‘মা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর আমি পুরোপুরি হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে লুকিয়ে রাখতাম আর স্কুল কিংবা বাসায় কারও সঙ্গে সেভাবে কথা বলতাম না। ’

হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকলে আজকের জেসমিনকে হয়তো কোনো শরণার্থী শিবিরেই আটকে থাকতে হতো। কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন লড়াকু জেসমিন, ‘একদিন আমার এক বন্ধু আমাকে স্কুল শেষে একটি ক্লাবে নিয়ে গেল, যেখানে এক কোচ আমাকে ক্রিকেট দলে যোগ দিতে বললেন। মাত্র কয়েক মাসেই ব্যবধানে আমি দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হলাম আর ইয়র্কশায়ার দলের ট্রায়ালে অংশ নিলাম। ’

সতীর্থদের সঙ্গে জেসমিন (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)বাংলাদেশের কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের মাঝে ক্রিকেট বেশ জনপ্রিয়। মূলত ক্যাম্পের বন্দি জীবন থেকে সাময়িক মুক্তির স্বাদ পেতেই তাদের মধ্যে এই খেলাটির প্রতি বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হয়। যুক্তরাজ্যে এসে জেসমিনের জীবনেও মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছে ক্রিকেট। শুধু তাই না, ব্যাট এবং বলে সমান পারদর্শী তিনি।  

তবে ক্রিকেট খেলতে গিয়েও জেসমিনকে নানান সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল। জেসমিনের ভাষায়, ‘আমি যখন স্কুলে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট খেলতে শুরু করি, কিছু সমস্যা তৈরি হয় এবং নারী হয়েও ক্রিকেট খেলার কারণে অনেকে কটাক্ষও করে। কিন্তু আমার রোহিঙ্গা কমিউনিটির কাছে আমি কৃতজ্ঞ এজন্য যে, তারা আমাকে সমর্থক এবং উৎসাহ দিয়েছেন। ’

লর্ডসের ব্যালকনিতে সতীর্থদের সঙ্গে জেসমিন/ছবি: সংগৃহীতজেসমিনের সত্যিকারের উত্থান শুরু হয় যখন তিনি ‘স্ট্রিট চাইল্ড ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ’-এ অংশ নেন তখন থেকে। ‘সেন্টারপয়েন্ট’ নামের এক এনজিও যুক্তরাজ্যের গৃহহীন শিশুদের নিয়ে কাজ করে। এই এনজিও’র একজন কর্মী ব্র্যাডফোর্ডের কমিউনিটি সেন্টারে জেসমিনকে খুঁজে পান। জেসমিন তখন শিশুদের কোচিং করাচ্ছিলেন। এরপর তিনি জেসমিনকে দলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। সেখান থেকে তিনি ‘স্ট্রিট চাইল্ড ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ’-এ ইংল্যান্ডের নেতৃত্ব দেন।

২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ মাঠে গড়ানোর ঠিক আগে বিশ্বের ১০টি দল নিয়ে পথশিশুদের বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয়। এর ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়ে লন্ডনে অবস্থিত ‘হোম অব ক্রিকেট’ খ্যাত লর্ডসে। এই আয়োজনের আসল উদ্দেশ্য সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করার দুর্লভ সুযোগ করে দেওয়া, যাতে তাদের যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জীবন পার করতে হয়, সেই মানসিক ধাক্কা কিছুটা সামাল দেওয়া যায়। এছাড়া তাদের প্রতি সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষদের যে নাম ছিটকানো ভাব দেখা যায় তা থেকে কিছুটা মুক্তির স্বাদ আর আইন প্রণেতাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যেন তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফেরার ব্যবস্থা করা হয়।

ব্যাটে-বলে সমান পারদর্শী জেসমিন/ছবি: সংগৃহীত‘স্ট্রিট চাইল্ড ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ শেষে এখন ব্র্যাডফোর্ড কলেজে অধ্যয়ন করছেন জেসমিন। তার স্বপ্ন কলেজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন করা। তবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। জেসমিনের ভাষায়, ‘এটা (ক্রীড়া) এমন কিছু, মনে হয় যেন এজন্যই আমার জন্ম। ’ তার কাছে এটা মুক্তির স্বাদ পাওয়ার উপলক্ষ। মুক্ত জীবনের প্রতি তার আকর্ষণ কতটা তা বোঝা যায় তার এই কথায় ‘মুক্ত মানুষ হিসেবে প্রতিটি নিশ্বাস আরও বেশি আনন্দ দেয়। আমি জানি, সেই অনুভূতি কেমন। '

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৯
এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।