সিলেট থেকে: ‘নাইস টু মিট ইউ’ সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ধারাভাষ্য কক্ষে যাওয়া কঠিন, অনুরোধ রেখে নিচে এসেই প্রথমে কথাটা বললেন অ্যান্ড্রু লেনার্ড। মনে হলো, প্রাণ খুলে কথা বলবেন।
‘নো লঙ্গার আয়ারল্যান্ড বেস্ট স্পিনার...’ নিজেকে এমন উপাধি কেন দিয়েছেন, শুরু হলো এটা দিয়ে। সঙ্গীহীন জীবন, ধারাভাষ্যে আসা, বন্ধু ইয়ন মরগান-কেভিন ও ব্রায়ানদের সঙ্গে স্মৃতির কথাও শোনালেন তিনি। জীবনের একমাত্র হ্যাটট্রিকের দ্বিতীয় উইকেট ছিলেন মরগান, গর্ব নিয়ে বললেন অ্যান্ড্রু।
ক্রিকেট কয়েক মাইল ব্যবধানে সেরা খেলা তার কাছে। এর টানেই ১৫ মাস ধরে যাযাবর হয়ে ঘুরছেন। আইসিসির সহযোগি দেশগুলোতে কাজ করার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় শুনিয়েছেন তাদের উন্নতির পথ। নারী এশিয়া কাপে ধারাভাষ্য দিতে আসা আয়ারল্যান্ডের অ্যান্ড্রুর জীবন গল্পের অনেকটা আধঘণ্টায় শুনেছেন মাহমুদুল হাসান বাপ্পি।
বাংলানিউজ : বাংলাদেশে প্রথমবার এলেন?
অ্যান্ড্রু : না, এ নিয়ে দ্বিতীয়বার। খুব খুব আনন্দ লাগছে এখানে আসতে পেরে। ২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সময় এসেছিলাম। তখন আমি আইসিসি ডিজিটালে কাজ করতাম। শেষ চার-পাঁচ বছর ধরে ধারাভাষ্য দিচ্ছি। ওই কাজেই নারী এশিয়া কাপের মতো রোমাঞ্চকর টুর্নামেন্টে আসতে পেরে দারুণ লাগছে।
বাংলানিউজ : সাবেক ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার, উপস্থাপক এমন অনেক কিছুর সঙ্গে আপনার ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে লেখা, ‘নো লঙ্গার আয়ারল্যান্ডের বেস্ট লেগ স্পিনার’। এটা লেখার কারণ কী?
অ্যান্ড্রু : হাহাহা...অনেকেই এটা নিয়ে প্রশ্ন করে। হয়তো আমাকে এটা বদলাতে হবে! আসলে মজা করেই লেখা শুরুতে। আয়ারল্যান্ডে আমাদের লেগ স্পিনার নেই। পার্ট টাইমার ছাড়া আয়ারল্যান্ডের শেষ লেগ স্পিনার খুঁজতে হলে আপনাকে সেই ‘৯০ এর দশকে চলে যেতে হবে।
আমি কখনো আয়ারল্যান্ডের হয়ে খেলতে পারিনি। হয়তো ক্রিকেটার হিসেবে নিজের সামর্থ্যের জানান দিতে পারিনি। তবে আয়ারল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলেছি, অনেক লিগ ক্রিকেটও। বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেছি, হ্যাম্পশায়ারের হয়েও কিছুদিন খেলেছি বয়সভিত্তিক পর্যায়ে।
তুমি যেটার কথা বললে, ওটা আসলেই মজা করেই লেখা। যেহেতু আমি এখন আর আয়ারল্যান্ডের হয়ে খেলার চেষ্টা করছি না, ধারাভাষ্য দিচ্ছি। তাই এমন লেখা।
বাংলানিউজ : আপনি তো লেগ স্পিনারই ছিলেন?
অ্যান্ড্রু : হ্যাঁ, অবশ্যই! আমার বলে খুব টার্ন ছিল, খুব শার্প গুগলিও করতে পারতাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রতি ওভারেই দুইটা বাজে বল করতাম। তবে আইরিশ ক্লাব ক্রিকেটে আমার অনেক উইকেট আছে, যদিও রান দিয়েছি প্রচুর। আমি কাদের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি জানেন? উইলিয়াম পোটারফিল্ড, কেভিন ও ব্রায়ানদের সঙ্গে। এখন দেখেন, ক্রিকেটার হিসেবে না পারলেও ধারাভাষ্যকার হিসেবে ভাগ্য আমাকে পুরো বিশ্ব ঘুরে ঘুরে ক্রিকেটের আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে।
বাংলানিউজ : আপনি তো নিজেকে বেশ ভালো লেগ স্পিনার হিসেবেই দাবি করলেন। বাংলাদেশও হন্যে হয়ে খুঁজছে এমন বোলার। লেগ স্পিনার হতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী?
অ্যান্ড্রু : আমার মনে হয় তরুণ লেগ স্পিনারদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে বল টার্ন করানো। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের যুগে অনেক কোচ হয়তো বলে থাকেন দ্রুত ও খুব ফ্ল্যাট বল করো। আপনি রশিদ খানের মতো ৫৫-৫৬ মাইল গতিতে বল করে দুই দিকে টার্ন করাতে পারবেন না। রশিদ এটা পারে জন্যই সে বিশ্বের সেরা।
তাবরিজ শামসিকে দেখেন, বল একটু ধীরগতিতে আকাশে ভাসিয়ে দিয়ে দারুণ টার্ন করায়। আপনার লেগ স্পিনারকে ভালোবাসুন, তাকে সুযোগ দিন। যদি কয়েকটা বাউন্ডারি খায়ও, তার ওপর আস্থা রাখুন, কারণ উইকেট এনে দেবে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তারা সফল উইকেট এনে দেয় বলে।
বাংলানিউজ : তাহলে কি রশিদ খান তরুণদের জন্য আদর্শ না?
অ্যান্ড্রু : ডান হাতি লেগ স্পিনার হয়ে রশিদকে উপেক্ষা করা কঠিন। বাঁ-হাতি হিসেবে তাবরিজ শামসি, আদিল রশিদরা আছে। অ্যাডাম জাম্পা দুর্দান্ত দেড় বছর কাটিয়েছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আপনার চোখ তার ওপর রাখতে পারেন। কিন্তু আবারও বলছি, এই সব লেগ স্পিনাররা কী করে? টার্ন করায়।
যদি তারা কন্ডিশনের জন্য বড় টার্ন নাও করায়, তাদের বলে রেভস (অনেক বেশি ঘূর্ণি) থাকে। আপনার বলে যদি রেভস থাকে, তাহলে পিচ থেকে প্রতিক্রিয়া পাবেনই; সেটা টার্ন হোক বা বাউন্স। আমি যেটার কথা বলছি লেগ স্পিনারদের ক্ষেত্রে ড্রিফট, ডিপ ও টার্ন। এটাকে সংক্ষেপে ‘ডিডিটি’ বলা যেতে পারে।
বাংলানিউজ : আপনার ক্রিকেট শুরুর গল্পটা...
অ্যান্ড্রু : ১৯৮০ এর দিকের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দেখে ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। তাদের ক্রিকেটের ঝকঝকে ভাব, স্পন্দন, প্যাশন আমার ভালো লাগতো। আইরিশ হিসেবে, যে দল ইংল্যান্ডকে হারাতে পারে, আমরা তাদেরই সমর্থন দেই। ওই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইংল্যান্ডকে নিয়মিত হারাতো।
তখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলে এমন কোনো দল আমাদের ছিল না। আয়ারল্যান্ডের শুরু হলো ১৯৯৩ সালের আইসিসি ট্রফিতে, বাংলাদেশও যেটার অংশ ছিল। ১৯৯৭ সালে এই টুর্নামেন্টটা আমাদের জন্য ছিল হৃদয় ভাঙার আর বাংলাদেশের আনন্দের।
তারা চ্যাম্পিয়ন হলো, আমরা হলাম চতুর্থ। স্কটল্যান্ডের কাছে হেরে আমাদের বিশ্বকাপ খেলা হলো না। এরপর আরও দশ বছর লেগে গেছে বিশ্ব আসরে খেলতে। শেষ ১৫ বছরে আয়ারল্যান্ডের গল্পটা অবশ্য দারুণ।
বাংলানিউজ : বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ড প্রায় প্রতিবারই বড় একটা ম্যাচ জেতে। কিন্তু ক্রিকেটে তো নিজেদের সেভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না...
অ্যান্ড্রু : সমস্যা হচ্ছে ২০১৮ সালে আমরা টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছি, কিন্তু ম্যাচ খেলেছি মাত্র তিনটা। ভালো ব্যাপার আগামী মৌসুমেই আমরা ইংল্যান্ডে টেস্ট খেলবো। তাদের বিপক্ষে আমাদের একটা দারুণ টেস্ট হয়েছে। তাদের ৮৫ রানে অলআউট করে দিয়েছিলাম।
আমার মনে হয় কঠিন ব্যাপার হচ্ছে, আলাদা ফরম্যাটে একসঙ্গে ভালো করা। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডেও আপনি দেখবেন ভাগ হয়ে যাচ্ছে। বেন স্টোকস ওয়ানডে থেকে অবসর নিয়ে নিলো টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে মনোযোগী হতে। আয়ারল্যান্ডে যেটা হয়, আমরা একই ক্রিকেটারদের ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে নেই; এখন টেস্টেও একই নাম দেখা যাচ্ছে।
এটা আমাদের জন্য কঠিন। আমাদের পুলটা ছোট। আমাদের সাদা বলে মনোযোগ দিয়ে লাল বলের সঙ্গে ভারসম্য করা নিয়ে অনেকেই তর্ক করতে পারে। আমরা কীভাবে উন্নতি করতে পারি? ইতোমধ্যেই আয়ারল্যান্ড নিজেদের সামর্থ্য জানিয়েছে, বড় দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছে। শেষ বছর দেড়েকে কাছে গিয়েও কয়েকটা ম্যাচ জিততে পারিনি।
নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ওয়ানডেতে খুব কাছাকাছি গিয়েছি। কিন্তু পরে ৩-০তে সিরিজ হেরেছি, যেটা ২-১ এ জেতা উচিত ছিল। আমরা কখনও তাদের হারাতে পারেনি। ভারতের সঙ্গেও টি-টোয়েন্টিতে খুব ভালো প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছি। কিন্তু একজন সন্তুষ্ট আইরিশ সমর্থক হয়েও বলছি, এই ম্যাচগুলো আমাদের জিততে হবে।
বাংলানিউজ : আয়ারল্যান্ডে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আসলে কেমন?
অ্যান্ড্রু : এক কথায় বললে- আয়ারল্যান্ড স্পোর্টিং নেশন। আমরা খেলার প্রতি অবসেসড। ক্রিকেট হয়তো সেরা ছয় বা সাতটা খেলার মধ্যেও থাকবে না। আমাদের গেলিক ফুটবল, গেলিক ক্রেলিং জাতীয় খেলা। রাগবি, সকার, বক্সিং; পৃথিবীর সেরা কয়েকজন বক্সার আইরিশ। অ্যাথলেটিক্স, হকিও জনপ্রিয়।
ক্রিকেট দিন দিন আরও বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে। খেলাটার ভিত্তি আমাদের ওখানে ছোট। বাংলাদেশের মতো একই রকম জনপ্রিয়তা বা আবেগ নেই। খেলোয়াড়দের পুলটাও ছোট। আমরা হয়তো ১৫ জনের স্কোয়াড গড়তে ৩৫-৪০ জন ক্রিকেটার দিতে পারবো নির্বাচকদের হাতে।
কিন্তু এই ক্রিকেটাররা যা করবে, লড়াই। ভাবনার বাইরে পারফরম করবে। একই সঙ্গে আমরা সৌভাগ্যবান পৃথিবীর সেরা কিছু ক্রিকেটার আমাদের এখানে জন্মেছে। এড জয়েসের কথা বলতে পারি, কেভিন ও ব্রায়ান কয়েকদিন আগে অবসর নিলো; আমরা তাকে এই বিশ্বকাপে মিস করবো। পল স্টার্লিং খুব প্রতিভাবান।
জশ লিটলকে উইকেট নিতে দেখছি নিয়মিত। হ্যারি টেক্টর সিপিএলে বার্বাডোজের হয়ে খেলছে এখন। আমার মনে হয় বিশ্ব ক্রিকেট এখন দেখছে আয়ারল্যান্ডে কত সম্ভাবনা ও প্রতিভাবান ক্রিকেটার আছে। সুপার লিগ আমাদের খুব ভালো ওয়ানডে দল বানিয়েছে।
টি-টোয়েন্টিতে কিছুটা ভুগছি। গ্রুপ স্টেজ পাড় করা খুব কঠিন হবে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ে আছে। যদি আমরা সুপার টুয়েলভে যেতে পারি, অনেক বড় অর্জন হবে।
বাংলানিউজ : আপনার জীবনে ফিরে আসি আবার। ডিজিটালে কাজ করতেন। ধারাভাষ্যকার কেন হয়ে গেলেন?
অ্যান্ড্রু : আমার জন্য ধারাভাষ্যকার হওয়া সবসময় স্বপ্ন ছিল। আমার মনে হয় ক্রিকেট না খেলেও খেলাটার সঙ্গে যুক্ত থাকা সবচেয়ে সেরা কাজ এটা। খেলোয়াড় হিসেবে যেতে না পারলেও এখন পৃথিবী ঘুরছি যাযাবরের মতো, এটা আমার জন্য সৌভাগ্যের।
বাংলানিউজ : পরিবার ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয় না?
অ্যান্ড্রু : ব্যক্তিজীবনেও আমি কিছুটা ভাগ্যবান। আমার তেমন পিছুটান নেই, নতুন পরিবার বা স্থায়ী জীবনসঙ্গী। যাদের জন্য আমাকে আয়ারল্যান্ডে পড়ে থাকতে হবে। আমি ২০২১ সালের জুলাইতে দেশ ছেড়েছি। গত ১৫ মাস ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি...৩৮০ দিনের বেশি সময় ধরে।
এটা কারো জন্য হয়তো দুঃস্বপ্নের মতো মনে হবে, কিন্তু আমার জন্য স্বপ্নপূরণ। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, কিছুদিন পাপুয়া নিউগিনিতে ছিলাম; নেপাল আছে, আমার অনেক সময় কাটে এখানে। দেখেন, এটা আমার জন্য সত্যিই স্বপ্নের মতো ব্যাপার।
শুধু সহযোগী দেশগুলো না। এখন নারী এশিয়া কাপেও ধারাভাষ্য দিচ্ছি। বড় টেস্ট দেশগুলো খেলছে। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে ধারাভাষ্য দেবো কখনও ভাবিনি, আগামী সপ্তাহেই কিন্তু দিচ্ছি!
বাংলানিউজ : ধারাভাষ্যে আপনার আদর্শ কে?
অ্যান্ড্রু : টনি কোজিয়ার। ‘৮০ এর দশকের সেই ক্যারিবীয়ান কণ্ঠ। অস্ট্রেলিয়ানদের উপেক্ষা করা যায় না। রিচি বেনো, তাকে কে না ভালোবাসে! গ্রেট টনি গ্রেগ...। ধারাভাষ্যকার হিসেবে আমার জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে দেখানো ছবিটাকে মূল্য দেওয়া। এমন কিছু বলতে হবে, যেটা ব্রডকাস্টকে আরও মজার করে তুলবে।
মজা করতে হবে ক্রিকেটের মতো। এটা স্পোর্টস, এন্টারটেইনমেন্ট প্রোডাক্ট। ক্রিকেটারদের মজা করতে হবে, আমাদেরও। আধুনিক ধারাভাষ্যে আমার কাছে অনেক বড় ব্যবধানে মাইকেল আথারটন এগিয়ে। তার চেয়ে ভালো কেউ নেই। শান্ত থাকা, মজা করতে পারা, খেলাটা উপভোগ করা; সে অসাধারণ।
বাংলানিউজ : ধারাভাষ্যের কাজ কঠিনও তো?
অ্যান্ড্রু : ইয়ান বিশপের সঙ্গে আমি কাজ করেছি আইসিসি ডিজিটালে থাকতে। সে অনেক পরিশ্রম করে। নাসির হুসেইনের কথা যদি বলেন...। বিশ্বের সেরা ধারাভাষ্যকাররা অনেক কষ্ট করে পর্দার আড়ালে। আপনি হয়তো দুই বা তিনটা আইকনিক বাক্য শুনেন; কিন্তু তারা পেছনে অনেক পরিশ্রম করে।
আর কঠিনের কথা যেটা বললেন। এই নারী এশিয়া কাপেই ধরুন, সকাল সাতটায় বের হতে হয়। এরপর যখন হোটেলে ফিরি, অন্তত সন্ধ্যায় ছয়টা। ওখানে গিয়ে আমি আবার দেড় ঘণ্টা প্রস্তুতি নেই পরের দিনের জন্য, এটা না করলে আমার ভালো লাগে না। সব খেলোয়াড়ের নাম, উচ্চারণ, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড; সবকিছু বিস্তারিত জেনে নেই।
অনেক প্রস্তুতি হয়তো ব্যবহার করতে পারি না। কিন্তু যখন ধারাভাষ্যকক্ষের সিটে বসি। তখন আমি এটা নিশ্চিত হতে চাই যে পুরোপুরি তৈরি আছি। আপনি যদি কোনো কাজ করেন, সেটা কখনোই আকাশে ভেসে যাবে না।
বাংলানিউজ : ধারাভাষ্যকার হিসেবে সবচেয়ে বড় স্বপ্ন কী আপনার?
অ্যান্ড্রু : দাঁড়ান, একটু ভেবে নেই...। সম্ভবত লর্ডসে কোনো টেস্টে ধারাভাষ্য দেওয়া। ওখানে আমি সমর্থক হিসেবে দুই-তিন দিন খেলা দেখেছি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে এখন অনেক খেলা টেলিকাস্ট করা হচ্ছে, তরুণদের জন্য দারুণ সুযোগ। এসেই আপনি স্টার স্পোর্টসে ধারাভাষ্য দিতে পারবেন না। এটা তো উচিতও না! আপনাকে শিখতে হবে আগে।
আয়ারল্যান্ডে যখন সব ম্যাচ স্ট্রিমিং করা হলো, তখন আমি ধারাভাষ্য শুরু করি। এরপর রশিদ খানের ওভারের ধারাভাষ্য দিয়েছি। এই বছর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ধারাভাষ্য দিলাম। অনেক কিছু শিখেছি। কিন্তু আমার মনে হয় টেস্ট হচ্ছে ক্রিকেটে সবকিছুর উপরে। লর্ডসে একটা টেস্ট অথবা বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে আয়ারল্যান্ডের একটা ম্যাচে ধারাভাষ্য দেওয়া আমার জন্য স্বপ্নপূরণ হবে।
বাংলানিউজ : খেলা হিসেবে ক্রিকেটের অবস্থান কোথায়?
অ্যান্ড্রু : ক্রিকেটকে আসলে আমি জীবন হিসেবে দেখি। কয়েক মাইলের ব্যবধানে এটাকে সেরা খেলা মনে করি।
বাংলানিউজ : ফুটবল না?
হায় ঈশ্বর, অবশ্যই না! পৃথিবীর আর কোনো খেলাতেই এত টুইস্ট থাকে না ক্রিকেটের মতো। ডান হাতি-বাঁহাতি ম্যাচ আপ, স্পিন-পেস, ভ্যারিয়েশন, আলাদা কন্ডিশন, সুযোগ-সুবিধা, আবহাওয়া প্রতিটা ম্যাচেই আসে। খুব ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার। আমি চাই, তিন ফরম্যাট একসঙ্গে টিকে থাকুক।
বাংলানিউজ : তিন ফরম্যাটের একসঙ্গে টিকে থাকা কি সম্ভব?
অ্যান্ড্রু : আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সম্ভব। সব সমর্থকরাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে আরও বেশি লক্ষ্য করছে। তাদের নিয়ে আসার জন্য ও আনন্দ দিতে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট দারুণ মঞ্চ। কিন্তু সবকিছুর উপরে বড় ব্যবধানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। আমি যখন আইসিসিতে কাজ করতাম, তখন খেলোয়াড়রা আমাকে বলেছে যে তিন ফরম্যাট একসঙ্গে টিকে থাকতে পারবে।
কোনো বিশ্লেষক বা ধারাভাষ্যকার না কিন্তু। ক্রিকেটাররা বলেছে, তারা বছরে ৩০০ দিন ক্রিকেট খেলে তবুও যখন বিশ্বকাপে আসে; এই অনুভূতি আলাদা, বিশেষ। বিশ্বকাপ আলাদা ব্যাপার তাদের কাছে। এজন্য আমি আইসিসি ইভেন্টে কাজ করতে পছন্দ করি। আগে প্রশাসক হিসেবে করেছি, আশা করি ভবিষ্যতে ধারাভাষ্যকার হিসেবেও করবো।
বাংলানিউজ : সহযোগি দেশগুলো কাজের অভিজ্ঞতা অনেক আপনার। তাদের ভবিষ্যৎ কেমন দেখেন?
অ্যান্ড্রু : এটা হয়তো পুরো পৃথিবীতে খেলাটার বিস্তারের জন্য উত্তম সময় না। আমাদের হয়তো ৩০-৩৫টা দেশ আছে ছেলেদের ক্রিকেটে, যারা প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারে। মেয়েদের ক্রিকেটে এটা ১৫-২০। ছেলেদের ক্রিকেটে ২০ ও মেয়েদের ক্রিকেটে দশটার মতো সহযোগি দেশ।
বড় পাঁচটা দলের হয়তো অনেক ক্রিকেটার ও রিসোর্স আছে। তাদের সবসময়ই এটা ছিল। সহযোগি দেশগুলোতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে যেটা বলতে পারি, পুরুষদের ক্রিকেটে র্যাংকিংয়ে ১৫-৩০ এর মধ্যে থাকা দলগুলো টেস্ট র্যাংকিংয়ের নিচের দিকে থাকা দলগুলোকে হারাতে পারবে।
আমরা দেখেছি কয়েক দিন আগেই বাংলাদেশ খাবি খেয়েছে ইউএইর কাছে। নামিবিয়া, স্কটল্যান্ড অসাধারণ, এখন সহযোগি দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ দল। নেদারল্যান্ড খুব শক্তিশালী। নেপালের অনেক বেশি সম্ভাবনা রয়েছে। তারা এখন যা করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করার সামর্থ্য তাদের আছে।
বাংলানিউজ : আপনার সম্পর্কে খুঁজতে গিয়ে পেয়েছি, নেপালে অনেক কাজ করেছেন। তাদের সঙ্গে জড়ালেন কীভাবে?
অ্যান্ড্রু : নেপাল আমার জন্য দ্বিতীয় ঘর। ২০১৮ সালে ইভারেস্ট প্রিমিয়ার লিগের প্রথম মৌসুমেই তাদের সঙ্গে জড়াই। আমার দুজন বন্ধু ওখানে যুক্ত হলো, কেভিন ও ব্রায়ান এবং পল স্টার্লিং। কেভিন লিগের মালিককে বললো, তোমাদের ধারাভাষ্যে কে আছে?
মালিক তাকে জানাল স্থানীয় কয়েকজন ও শ্রীলঙ্কান আছে। কেভিন বলল তোমাদের কোনো ওয়েস্টার্ন ধারাভাষ্যকার নেই? তখন জবাব পেল, তারা এত টাকা দিতে পারবে না। কেভিন বললো, আমার এক বন্ধু আছে। সে মাত্র শুরু করেছে, কিন্তু অসাধারণ।
কেভিন আমাকে প্রথম সুযোগ এনে দিলো, এরপর ২০১৮ এর ডিসেম্বরে এটা ছিল আলাদা পৃথিবী। হাজার হাজার সমর্থক এলো মাঠে। খুব দ্রুত আমি নিজেকে তাদের মধ্যে হারিয়ে ফেললাম। কারণ ক্রিকেটের প্রতি আবেগ আমাদের একই রকম।
দক্ষিণ আফ্রিকার কোন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ম্যাচ হোক কিংবা রাজকীয়; আমার জন্য একই রকম। আমি খেলাটাকে ভালোবাসি। এজন্য নেপাল আমার পছন্দ হয়েছে। তাদের হয়তো পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মতো এত ক্রিকেট হয় না। কিন্তু যখন হয়, তারা তাদের আবেগ দেখায়।
বাংলানিউজ : নেপাল, নামিবিয়া বা নেদারল্যান্ডের মতো দলগুলোর জন্য আইসিসির কিছু করার আছে?
অ্যান্ড্রু : তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা করতে হবে। অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। অনেকগুলো দেশের তেমন আছে, নামিবিয়া এক্ষেত্রে আদর্শ উদাহরণ হতে পারে। নেদারল্যান্ড দারুণ কিছু করছে, যুক্তরাষ্ট্রও ভালো। যদি আপনি সঠিক অবকাঠামো দিতে পারেন, তাহলেই ক্রিকেট দাঁড়াবে।
২০ বছর আগে বাংলাদেশ যেমন করেছিল। আইসিসি এখন কিন্তু সুযোগ দিচ্ছে। র্যাংকিংয়ের সেরা ৩২-এ থাকা প্রতিটি দলেরই সুযোগ আছে বিশ্বকাপ খেলার। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আরও বড়।
২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হবে ২০ দলের। এটাই একমাত্র পরিবর্তন না কিন্তু। সুপার টুয়েলভে যেতে প্রিলিমানারি স্টেজ নেই। ২০ দলকে ৪ গ্রুপে ভাগ করা হবে। এর মানে হচ্ছে আপনি বাছাই পাড় করতে পারলে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর বিপক্ষে খেলবেন। এটা নামিবিয়া ও উগান্ডার মতো দেশগুলোর মতো দারুণ ব্যাপার।
বাংলানিউজ : এই দলগুলো আসলে কতটা জরুরি ক্রিকেটের জন্য?
অ্যান্ড্রু : আমরা যদি শীর্ষ পাঁচ দলই একে-অন্যের সঙ্গে খেলি। তাহলে খেলাটা কোথায় থাকবে? মরে যাবে, ধ্বংস হবে। আমাদের ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিতে হবে। গত আট বছরে খেলার পরিসরকে আমরা ছোট করে এনেছি। ১০ দলের বিশ্বকাপ করেছি, আনন্দ, মজা, রঙ কিছুই ছিল না।
নতুন দল আসেনি। ফিফাতে যেমন হয়, আন্ডার ডগের গল্প সামনে আসেনি। এগুলোই তো বিশ্বকাপের মজা। টুর্নামেন্টের বাইরে বাকি তিন বছর তো বড় দলগুলো একে-অন্যের বিপক্ষে খেলছেই। ছোট দলগুলোকে সুযোগ দিতে হবে, অন্য খেলাগুলো যেমন দেয়।
পরের সার্কেলে আইসিসি সেটা করছে। বিশ্বকাপে টি-টোয়েন্টিতে ২০ দল, ওয়ানডেতে আবারও ১৪তে ফিরছে। এটা দলগুলোর জন্য আরও বেশি সুযোগ। ২০১৯ সালে আইসিসি সবাইকে টি-টোয়েন্টি স্ট্যাটাস দিয়েছে, এটা তাদের অন্যতম সেরা সিদ্ধান্ত।
বাংলানিউজ : সহযোগি যে দেশগুলো দেখা যায়, অনেক আছে যারা নিজেদের অরজিনের বাইরের ক্রিকেটারদের খেলায়। তাদের উন্নতিতে ক্রিকেটের লাভ আসলে কতটুকু?
অ্যান্ড্রু : এটা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ইংল্যান্ড এখান থেকে লাভবান হচ্ছে; জিম্বাবুয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডও। ইয়ন মরগানকে দেখেন, ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কিন্তু আইরিশ।
আমি তার সঙ্গে বেড়ে উঠেছি, খেলেছি। জীবনে একটাই হ্যাটট্রিক করেছিলাম, দ্বিতীয় উইকেট ছিল মরগান...(হাসি)। আমার ১৩ বছর বয়স ছিল, ওর ১২। আমি ওকে বোল্ড করেছিলাম। আইরিশ হয়েও সে ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিয়েছে।
তবে ইউএইর মতো দেশগুলোকে আপনার কৃতিত্ব দিতে হবে। তারা যা করছে, ক্রিকেটারদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে সঙ্গে বয়সভিত্তিক সিস্টেমও দাঁড় করাচ্ছে। খেলোয়াড়রা তাদের সিস্টেমে উঠে আসছে। আমি প্রশ্নটা বুঝতে পারছি। কিন্তু পাপুয়া নিউগিনি, উগান্ডা, নেপালের মতো দেশও আছে ক্রিকেটে।
বাংলানিউজ : মরগান বা অন্যদের ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে দেখে আপনাদের কষ্ট লাগে না?
অ্যান্ড্রু : সম্প্রতি এমন কাজ করেছে তিনজন। ইয়ন মরগান, এড জয়েস ও বয়েড রাংকিন। পরের দুজনকে আমরা ফিরিয়ে আনছি। আমার মনে হয় না কোনো আইরিশ সমর্থক তাদের দায় দেবে। আয়ারল্যান্ড খুব অপেশাদার দল ছিল তখন।
মরগানের অনেক স্বপ্ন ছিল। সে টেস্ট খেলতে চেয়েছিল। আমার মনে হয় আইরিশরা ইতিবাচকভাবেই দেখেছে। হয়তো আয়ারল্যান্ডের জার্সিতে পারেনি, কিন্তু দ্বিতীয় সেরা ব্যাপারটা করেছে। ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক সে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০২২
এমএইচবি/আরইউ