চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) বিভিন্ন পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেছে শিক্ষকদের একটি বড় অংশ। এ ঘটনার পর নিয়োগসহ বেশকিছু ইস্যুতে চবি উপাচার্য ও প্রক্টরের দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আসে।
দু’দিন আগে (১৩ মার্চ) অনুষ্ঠিত চবির পালি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় নিয়ম ভঙ্গ করে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়ার স্ত্রী অভি বড়ুয়াকে।
একইসঙ্গে দুই পদের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও নিয়োগের জন্য ৪ জনকে সুপারিশ করা হয় নিয়োগ বোর্ড থেকে। এর মধ্যে সুপারিশের তালিকায় এক নম্বরেই রাখা হয়েছে সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়ার স্ত্রী অভি বড়ুয়ার নাম। যদিও বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অতিরিক্ত দুই শিক্ষকের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই এখন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, যেকোনও সময় উপাচার্যের পদ পরিবর্তন হতে পারে। তাই তোড়জোড় করে বিভিন্ন বিভাগের নিয়োগের এজেন্ডা দ্রুত বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রশাসনপন্থিরা। তারই অংশ হিসেবে সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়ার স্ত্রী অভি বড়ুয়াকে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাছাড়া প্রক্টরিয়াল বডি থেকে সম্প্রতি বড় একটি অংশ পদত্যাগ করলেও অরূপ বড়ুয়ার পদত্যাগ না করার পেছনেও স্ত্রী অভি বড়ুয়ার নিয়োগের স্বার্থই মুখ্য বলে মনে করছেন তারা।
এর আগে ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি পালি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক এর বিপরীতে ১টি স্থায়ী প্রভাষক পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সেই পদের বিপরীতে আবেদন করেন ৩৮ জন প্রার্থী। গত বছরের ৩ মার্চ পালি বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির সভায় আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়। তবে আবেদনকারী অভি বড়ুয়া তার আবেদনপত্রে এমএ পরীক্ষায় ১ম হয়েছে বলে মিথ্যা তথ্য দিলেও তা দৃষ্টিগোচর না হওয়ায় মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। তখন পালি বিভাগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন ড. জ্ঞানরত্ন শ্রমণ।
২০২২ সালের ২৪ আগস্ট প্রভাষক পদে অস্থায়ী নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আরেকটি বিজ্ঞাপন দেয়। সেই পদের বিপরীতে আবেদন করেন ২৭ জন প্রার্থী। এর মধ্যে পরিবর্তন হয় পালি বিভাগের সভাপতি। নিয়মানুযায়ী পালি বিভাগের নতুন সভাপতি শাসনানন্দ বড়ুয়া রুপন গত ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত পরিকল্পনা কমিটির সভায় ২৭টি আবেদন যাচাই-বাছাই করে ২১টি আবেদনপত্র গ্রহণ করেন। তবে বিজ্ঞপ্তির আলোকে শর্ত পূরণ না হওয়ায় ৬টি আবেদনপত্র বাতিল করা হয়। এর মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্তাবলী পূরণ না হওয়ায় ৪ জন প্রার্থীর আবেদন বাতিল করা হয়। তবে দুইজন আবেদনকারী- অভি বড়ুয়া ও সুরভী বড়ুয়া তাদের আবেদনপত্রে ফলাফল সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় বিষয়টিকে জালিয়াতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
পরিকল্পনা কমিটি সদস্যরা জানান, তথ্য গোপন করা আবেদনকারীদের একজন হলেন সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়ার স্ত্রী অভি বড়ুয়া। তিনি আবেদনপত্রে উল্লেখ করেন, ২০০৩ সালের এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন। কিন্তু তার ফলাফল যাচাই করে দেখা যায় তথ্যটি ভুল। তাই পরিকল্পনা কমিটি আবেদনপত্রটি বাতিল করে। শুধু তা-ই নয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শতকরা হিসাবে প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখ করার শর্ত থাকলেও আবেদনপত্রে অভি বড়ুয়া তা উল্লেখ করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় বিধি অনুসারে অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ দরখাস্ত সরাসরি বাতিলযোগ্য। পরিকল্পনা কমিটি তাদের এ সিদ্ধান্তের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানায়।
এদিকে পরিকল্পনা কমিটির সিদ্ধান্তগুলো গোপনীয় হলেও আবেদনকারী অভি বড়ুয়ার স্বামী অরূপ বড়ুয়া পরিকল্পনা কমিটির সদস্য হওয়ায় প্রার্থী বিষয়টি জানতে পারেন। পরবর্তীতে তিনি ভুল স্বীকার করে বিধি বহির্ভূতভাবে গত ৬ নভেম্বর রেজিস্ট্রার বরাবর পুনরায় আবেদন করেন। অভি বড়ুয়ার আবেদনপত্রটি গ্রহণ করে গত ১৮ ডিসেম্বর পরিকল্পনা কমিটির কাছে পাঠানো হয় পুনর্বিবেচনার জন্য।
যদিও নতুন করে জমা দেওয়া আবেদনপত্রটিও ছিল অসম্পূর্ণ। সেখানে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শতকরা হিসাবে প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখ করার শর্ত থাকলেও প্রার্থী তা করেননি। তাই পরিকল্পনা কমিটি সুপারিশ না করার সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন।
এছাড়া ৩৮ জন আবেদনকারীর মধ্যে স্নাতকের ফলাফলের দিক থেকে অভি বড়ুয়ার অবস্থান ছিলো ২৬তম এবং স্নাতকোত্তরের ফলাফলে তিনি ছিলেন ১৩তম অবস্থানে। এমনকি ২০০৩ সালে পড়াশোনা শেষ করলেও গত ২০ বছরে তিনি কোনো একাডেমিক বা চাকরির অভিজ্ঞতা দেখাতে পারেননি। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ৫০.২% মার্কস পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন তিনি। স্নাতক পরীক্ষার ফলাফল ছিলো ৩.৪৩। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগে এমন ফলাফল নিয়ে শিক্ষকতার জন্য আবেদনের যোগ্যতাও রাখেন না কেউ।
এত অসঙ্গতির পরও অভি বড়ুয়াকে পরিকল্পনা কমিটির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। বিভাগের একাধিক শিক্ষকের মতে, কোনো ধরনের উচ্চতর ডিগ্রি ও প্রকাশনা না থাকা সত্ত্বেও সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়া প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে স্ত্রী অভি বড়ুয়াকে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক বাংলানিউজকে বলেন, এ ধরনের অযোগ্য প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে একাডেমিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। সচরাচর পরিকল্পনা কমিটি কোনো প্রার্থীকে সুপারিশ না করলে তাকে ইন্টারভিউর সুযোগ দেওয়া হয় না। কিন্তু গত ১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত পালি বিভাগের নিয়োগ পরীক্ষায় সব ধরনের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে অংশ নিয়েছেন অভি বড়ুয়া।
জানা গেছে, নানান অসঙ্গতি থাকায় পালি বিভাগের সভাপতি শাসনানন্দ বড়ুয়া ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) পোষণ করা সত্ত্বেও অভি বড়ুয়াকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে ভাইভা বোর্ড। এমনকি সুপারিশকৃত চার প্রার্থীর মধ্যে সবার প্রথমেই রাখা হয়েছে অভি বড়ুয়ার নাম।
এ নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার বড়ুয়া, চবির পালি বিভাগের অধ্যাপক ড. জ্ঞানরত্ন শ্রমণ। এছাড়া পদাধিকার বলে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ছিলেন চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার ও পালি বিভাগের সভাপতি শাসনানন্দ বড়ুয়া রুপন।
মৌখিক পরীক্ষার সময় (১৩ মার্চ) নিয়োগপ্রার্থী অভি বড়ুয়ার নিয়োগের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন পালি বিভাগের সভাপতি। তা সত্ত্বেও উপাচার্যের উপস্থিতিতে সেই অভি বড়ুয়াকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে ভাইভা বোর্ড।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পালি বিভাগের সভাপতি শাসনানন্দ বড়ুয়া রুপন বাংলানিউজকে বলেন, নিয়োগ পরীক্ষার পরপরই আমি সবগুলো বিষয় স্পষ্ট করে উপাচার্য বরাবর চিঠি (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়েছি। বিভাগ ও শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে আমি যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের পক্ষে থাকার চেষ্টা করেছি। যেহেতু একটি নিয়োগ বোর্ডে চারজন সদস্য থাকেন এবং অধিকাংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতেই নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়, তাই এখন বিষয়টি বিবেচনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের।
এ বিষয়ে জানতে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৩
এমএ/টিসি