চট্টগ্রাম: দেশ যখন প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিতে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বিভিন্ন অঞ্চলে একের পর এক বিস্ফোরণ, দুর্ঘটনা আমাদের জাতীয় অগ্রগতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে মনে করে বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি।
বুধবার (১৫ মার্চ) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিপজ্জনক রাসায়নিকের বিস্ফোরণে জনজীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।
আবদ্ধ স্থানে জমাটবদ্ধ বিপজ্জনক কেমিক্যালস গুদামজাতকরণ, স্থানান্তর ও পরিবহন, সেপটিক ট্যাংকের গ্যাসে প্রাণহানি, এলএনজি, সিএনজি প্রভৃতির অনিরাপদ ব্যবহার, বসতবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে প্রাকৃতিক গ্যাস ও রাসায়নিকের ব্যবহারে জনসচেতনতার প্রয়োজনীয়তা থেকেই এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি মনে করে জানমালের ক্ষতি রোধ করে দুর্ঘটনা থেকে জননিরাপত্তা বিধানে এসব দুর্ঘটনা রোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. জয়নাল আবেদীন সিদ্দিকীর সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সমিতির সভাপতি বাংলাদেশ সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব মো. জাফর আলম। বক্তব্য দেন বাংলাদেশ রসায়ন সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী।
আলোচনা করেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সভাপতি সালাউদ্দিন মো. রেজা, চট্টগ্রাম কলেজের রসায়নের অধ্যক্ষ ড. সামসুদ্দীন আজাদ, সমিতির চট্টগ্রাম অঞ্চলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. রেয়াজুল হক এবং সমিতর সদস্য বিসিএসআইআরের প্রিন্সিপাল সাইন্টিফিক অফিসার ড. শ্রীবাস চন্দ্র ভট্টাচার্য।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ঝুঁকিপূর্ণ কারখানায় সরকারি বা স্থানীয় সরকারের মনিটরিং কাজে নিয়োজিত জনবলের যেমন অভাব আছে, প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবলের ও ঘাটতি আছে। রসায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশ রসায়ন সমিতির চট্টগ্রাম অঞ্চল এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং বিভিন্ন পর্যায়ের করণীয় সম্বন্ধে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে।
সমিতি মনে করে আবদ্ধ বিপজ্জনক দাহ্য গ্যাস সংরক্ষণ ও সুরক্ষার পদ্ধতি, আবাসস্থলে দাহ্য গ্যাসের বিষয়ে সতর্কতা, আবদ্ধ গ্যাসের রাসায়নিক ও বিপজ্জনক চরিত্র জ্ঞান, এসবের পরিচিতি, কোথাও বিপজ্জনক দাহ্য গ্যাসের শনাক্তকরণের বিভিন্ন পদ্ধতি, গন্ধ-বর্ণহীন গ্যাস, যেমন কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড প্রভৃতির উপস্থিতি শনাক্তকরণ বিষয়ে ভোক্তা ও ব্যবহারকারীদের এবং মিল-ফ্যাক্টরি কিংবা রাসায়নিক কারখানায় সম্পৃক্ত শ্রমজীবী মানুষের দক্ষ ও সচেতন থাকা অত্যাবশ্যক।
আবদ্ধ স্থানে বিপজ্জনক দাহ্য গ্যাস শনাক্তকরণ, এদের ধরন নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণে করণীয় এবং এসবের বিপদ থেকে সুরক্ষার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এসব বিপজ্জনক গ্যাসের উৎস, ধরন শনাক্ত করে ঝুঁকি মূল্যায়ন, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োগ, রক্ষণাবেক্ষণের প্রশিক্ষণ গ্রহণ, স্বাভাবিকভাবে পরিদর্শন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য।
বসতবাড়িতে সেপটিক ট্যাংকের নিরাপদ ব্যবস্থাপনা, তদারকি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জনগণ ও শ্রমজীবী মানুষের অজ্ঞতায় জীবনহানি ঘটে। আবদ্ধ এসব গ্যাস ট্যাঙ্কারকে নিরাপদ করতে প্রশিক্ষিত ও সচেতন জনবল গড়ে তোলা অপরিহার্য। এসব দুর্ঘটনায় নিম্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষের প্রাণসংহার হয় বেশি, তাই তা সমাজে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক করে, জনমনে হতাশার সৃষ্টি করে, সরকারকে বিব্রত করে।
বাংলাদেশ রসায়ন সমিতির আঞ্চলিক এই কমিটি বিপদজনক কেমিক্যালস ও বিষাক্ত পদার্থের হ্যান্ডেলিং, পরিবহন, বিতরণ, স্থানান্তর, ব্যবহার ও গুদামজাতকরণে এ যাবৎ কালে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে সুপারিশমালা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-
বিপজ্জনক কেমিক্যালস ও অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ হ্যান্ডলিংয়ে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম অনুসরণ করা। কঠিন, তরল, বায়বীয় সব ধরনের পদার্থের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী দরকার।
এ বিষয়ে সরকারি বা স্থানীয় সরকারের রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের অবগতি থাকা আবশ্যক। হ্যান্ডলিং কার্যক্রমের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা দক্ষ ও শিক্ষিত ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম প্রস্তুত থাকতে হবে।
হ্যান্ডলিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অগ্নিনির্বাপণের সুবিধাদি থাকতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কিংবা গুচ্ছ প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অ্যাম্বুলেন্সের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
বিপজ্জনক রাসায়নিক গ্যাস, তরল যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, আন্তর্জাতিক বিধি মোতাবেক পরিবাহিত হতে হবে। এলএনজি, এলপিজি, বিভিন্ন ধরনের এসিড, গ্যাসীয় পদার্থ ট্রাক ও লরিতে পরিবাহিত হয় ঝুঁকি ও বিপদকে সঙ্গে নিয়ে। পরিবহনের সময় এসব পণ্যের নাম, ইউএন নম্বর, পণ্যের বিপদ সংক্রান্ত বর্ণনা প্রতীক চিহ্ন প্রদর্শন করতে হবে। কঠোরভাবে তা মনিটর করতে হবে।
বিপজ্জনক পদার্থ পরিবহন করতে আন্তর্জাতিক, জাতীয় এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিধি অনুসরণ করতে হবে । জাতিসংঘ, আইএমও, আইএটিএ এবং জাতীয় সড়ক পরিবহন সংস্থা যাদের অন্যতম।
বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ পরিবহন সংক্রান্ত আইনের অনুপুঙ্খ অনুসরণ অত্যাবশ্যক। সঠিক প্যাকেজিং এবং লেভেলিং অত্যাবশ্য। প্রশিক্ষিত পরিবহন চালক, যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণ, জরুরি অবস্থার পরিকল্পনা, রুট পরিকল্পনা, যোগাযোগ, নিরাপত্তা ও বিমা কভারেজ, বিপজ্জনক পদার্থের পূর্ণাঙ্গ তথ্য, নিরাপদ পণ্য চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষণকৃত সব রাসায়নিকের লেভেল লাগানো, যথাযথ কনটেইনার ব্যবহার, মনোনীত এলাকায় সংরক্ষণ, জনবসতি থেকে দূরত্ব অবলম্বন, নিয়ন্ত্রণ এক্সসেস, নিয়মিত মনিটর এবং পরিদর্শন, জরুরি পরিকল্পনা গ্রহণের প্রক্রিয়া অনুসরণ এবং এসবের দায়িত্বশীল তদারকি প্রয়োগ করেই রাসায়নিককে ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বসবাসের বাড়িতে গ্যাসের সংযোগস্থানে গ্যাস ডিটেক্টর বসানো, আবাসিক অধিবাসীদের ভবনের যথোপযুক্ত স্থানে গ্যাস ডিটেক্টর স্থাপন করে ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্ল্যান অনুযায়ী ড্রিল পরিচালনা করে এ সংক্রান্ত তথ্যাদি সংরক্ষণ করা, প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ লাইন ব্যবহারকারী ও সংযোগ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্দিষ্ট সময় শেষে পরীক্ষা করে নবায়ন সনদ দেওয়া, প্রতিটি এলাকার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত টেকনিশিয়ান ও কর্মকর্তার নাম ঠিকানা সর্বসাধারণকে জানানোর ব্যবস্থা, বহুতল ভবনগুলোর জন্য নকশা অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্ল্যান প্রস্তুত করা, ম্যানুয়াল এবং অদক্ষ শ্রমিক দ্বারা কোনো অবস্থাতেই সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার না করা এবং প্রতি তিন বছর পর সেপটিক ট্যাংক আদর্শ উপায়ে পরিষ্কার করা, আবাসিক বাসিন্দাদের বিপর্যয় সম্পর্কে অবহিত করা ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্ল্যান বিষয়ে অরিয়েন্টেশন দেওয়া, সরকারি ও স্থানীয় সরকার সংস্থার অধীনে এনফোর্সমেন্ট ও মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করা, বিপজ্জনক কেমিক্যালসের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কার্যক্রমের দ্বৈততা পরিহার করে ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন ২০১৮ এর অধীন কেমিক্যাল রেজিস্ট্রেশন ও ডাটাবেজ প্রস্তুত করে ওয়ান স্টপ সার্ভিস ব্যবহার করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০২৩
এআর/পিডি/টিসি