চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: ‘আব্দুল করিমের (ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক সভাপতি) পদোন্নতির সময় রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি কে পাঠাইছে? তুমি পাঠাইছো? তোমরা একটা ভয়ঙ্কর চক্র। আমি বসে থাকার মহিলা না।
আমার প্রমোশন কিভাবে হইছে সেটা এখন বলবো না। তুমি হাসেম, আলতাফ ও করিমের লোক (ফারসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাসেম, সহযোগী অধ্যাপক ড. আব্দুল করিম ও সহকারী অধ্যাপক আলতাফ হোসেনের কথা বলা হয়েছে)। হাসেমরে আমি হাইকোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যাবো। এটাই জীবনের লক্ষ্য। ’
গত ২২ মার্চ বাংলানিউজে ‘নিজের গবেষণা নিজেই মূল্যায়ন করে পেলেন পদোন্নতি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ সংবাদের জেরে বিভিন্ন সময় এসব কথা বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সভাপতি আছমা আক্তার।
গত ২২, ২৩, ২৬ ও ৩০ মার্চ বাংলানিউজের প্রতিনিধির হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ক্ষুদে বার্তায় ওই সংবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন তিনি। সর্বশেষ গতকাল রোববার (২ এপ্রিল) মুঠোফোনে একই ধরনের মন্তব্য করেন তিনি।
এছাড়া সংবাদ প্রকাশের পর থেকে শিরোনাম পরিবর্তনের জন্য প্রতিনিধিকে মুঠোফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপ পাঠানো ক্ষুদে বার্তায় বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করেন তিনি। জবাবে ‘শিরোনাম সঠিক এবং পরিবর্তনের সুযোগ নেই’ বলে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘আমার হাসবেন্ড ল’য়ার (আইনজীবী)। আমার স্ট্যাটাস সম্পর্কে তুমি জানো না। আমার মায়ের আপন খালাতো ভাই হলো আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, লতিফ সিদ্দিকী। আমার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে রিপোর্ট করা দরকার ছিলো। আমিও আমার রাস্তায় আগাবো এখন। আমি তোমার বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমি ছাড়বো না। ’
তার এসব মন্তব্যের কল রেকর্ড ও ভয়েস রেকর্ডসহ ৯০টি ক্ষুদে বার্তা বাংলানিউজের কাছে সংরক্ষিত আছে।
এছাড়া আছমা আক্তার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিকল্পনা কমিটির সভা ছাড়া পদোন্নতি হয়েছে। ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহীদুল আলম শাহিনকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন তাদের ৫ জনের পদোন্নতির সময় প্ল্যানিং (পরিকল্পনা কমিটির সভা) ছিলো না। প্ল্যানিং ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় যদি পদোন্নতি দেয়, তাহলে আপনার রিপোর্ট ভুল প্রমাণিত হবে। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সি’।
এ বিষয়ে ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহিদুল আলম শাহিন বিস্ময় প্রকাশ করে বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের বিভাগে সর্বমোট শিক্ষক আছেন ৩ জন। সেখানে তিনি ৫ জন শিক্ষকের কথা কোন জায়গা থেকে বলছেন জানিনা। এছাড়া আমার পদোন্নতির সময় পরিকল্পনা কমিটির সভা হয়েছে এবং সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে সুপারিশ করা হয়েছে। উনার এ বক্তব্য ভুল। এখানে আমাকে কেন টেনে আনা হলো সেটাই বুঝতে পারছি না।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটিউট ৯ এর ধারা ১ এর ‘বি’তে দেখা যায়- বিভাগের কোনো শিক্ষকের পদোন্নতি ও ইনক্রিমেন্টের বিষয়ে সুপারিশ করবে পরিকল্পনা কমিটি।
তবে স্ট্যাটিউট ৭ এর ‘ঘ’ ধারা অনুযায়ী- পরিকল্পনা কমিটি (প্রার্থীর) আবেদন বিবেচনার জন্য সুপারিশ না করলে সেক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ প্রার্থী বিভাগের সভাপতির মাধ্যমে উপাচার্য বরাবর আপিল করতে পারবেন। এক্ষেত্রে উপাচার্য পরিকল্পনা কমিটির সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হলে তিনি নিজের মতামতসহ বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য পরিকল্পনা কমিটিতে রেফার ব্যাক করবেন। এরপরও বিভাগের পরিকল্পনা কমিটি যদি উপাচার্যের মতামতের সঙ্গে একমত না হন সেক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনার জন্য উপাচার্য সিন্ডিকেটে পেশ করবেন। সর্বশেষ সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। ’
যদিও ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সভাপতির পদোন্নতির ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিটির দ্বিমত থাকার পর এ প্রক্রিয়াও অনুসরণ করা হয়নি।
এর আগে গত ৪ মার্চ চবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান বিভাগের সভাপতি আছমা আক্তার। সেই পদোন্নতির বিষয়ে বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির সদস্যদের দ্বিমত ও বিভিন্ন অসঙ্গতি উঠে আসে প্রকাশিত সংবাদে। বিষয়টি সামনে আসার ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
নিয়মানুযায়ী পিএইচডি, এমফিল এবং গবেষণা প্রবন্ধ- পদোন্নতির জন্য যাচাই করা হয় ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির সভায়। অথচ ফারসি বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির যে সভা থেকে আছমা আক্তারের পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করা হয়েছে, সেই সভায় পদোন্নতি প্রার্থী এবং তার পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক ড. মো. নূরে আলম ছাড়া পরিকল্পনা কমিটির কোনও সদস্য ছিলেন না। যদিও পরিকল্পনা কমিটির সদস্যদের যাচাই ও মতামতের ভিত্তিতেই প্রার্থীকে পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করা হয়।
জানা গেছে, আছমা আক্তারের পদোন্নতির জন্য জমা দেওয়া ৪টি প্রবন্ধের মধ্যে দুটি নিজের এবং দুটি তার পিএইচডির তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে যৌথ। আবার ওই পিএইচডির তত্ত্বাবধায়কই পরিকল্পনা কমিটির একজন সদস্য। পরিকল্পনা কমিটির সভায় আর কেউ অংশ না নেওয়ায় নিজেরাই নিজেদের গবেষণা প্রবন্ধ মূল্যায়ন বা যাচাই করেছেন। আর সেই সুপারিশের ভিত্তিতেই আছমা আক্তারের পদোন্নতি হয় বলে অভিযোগ করেছেন বিভাগের শিক্ষকরা।
গত ৪ মার্চ সকাল ১০টায় চবি উপাচার্যের দফতরে আছমা আক্তারের সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি বোর্ডের সভা হয়। সেই বোর্ড থেকে পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করলে একইদিন দুপুরে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় আছমা আক্তারের পদোন্নতি অনুমোদন করা হয়। যদিও ওই সিন্ডিকেট সভা নিয়েও আছে নানান বিতর্ক।
দীর্ঘদিন পর গত ৬ মার্চ চবির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিন্ডিকেটের ৪টি প্রতিনিধি পদে নির্বাচন হয়। নির্বাচনের দুইদিন আগে তড়িঘড়ি সিন্ডিকেট সভা করে কর্তৃপক্ষ। চবি শিক্ষক সমিতি থেকে দুই দফায় এ সিন্ডিকেট সভা পিছিয়ে নির্বাচনের পরদিন (৭ মার্চ) করার অনুরোধ জানানো হলেও সেটা উপেক্ষা করা হয়।
জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের দাবি- সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধিরা আসার আগেই নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এজেন্ডাগুলো কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই অনুমোদন করে নেওয়া ছিলো ওই সিন্ডিকেট সভার উদ্দেশ্য।
জানা গেছে, বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের পদোন্নতি, বিভিন্ন প্রকল্পের বাজেট, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে জমা হওয়া এমফিল, পিএইচডিসহ অনেকগুলো বিষয় অনুমোদন করা হয় ৫৪৩তম সিন্ডিকেট সভায়। সেই সিন্ডিকেটেই অনুমোদন হয়েছিল ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সভাপতি আছমা আক্তারের পদোন্নতি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৩, ২০২৩
এমএ/টিসি